সত্যি কথন ~ সত্যি যাপন
……………………………….
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
ভূমিকা-
“স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না। কিন্তু যেই আঁকুক সে ছবিই আঁকে। অর্থাৎ যাহাকিছু ঘটিতেছে, তাহার অবিকল নকল রাখিবার জন্য সে তুলি হাতে বসিয়া নাই। সে আপনার অভিরুচি-অনুসারে কত কী বাদ দেয়, কত কী রাখে। কত বড়োকে ছোটো করে, ছোটোকে বড়ো করিয়া তোলে। সে আগের জিনিসকে পাছে ও পাছের জিনিসকে আগে সাজাইতে কিছুমাত্র দ্বিধা করে না। বস্তুত তাহার কাজই ছবি আঁকা, ইতিহাস লেখা নয়….”
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
……………………………………………………………….
উৎসর্গ- পিতৃদেব শ্রী অলক সরকার ও পিতৃব্যপ্রতীম সুধাংশুশেখর সরকার সেই অভিন্নহৃদয় দু’জন মহোদয়’দ্বয়ের হাতেই।
…………………………………………………………………
(৫ম পর্ব)
” আমরা বেঁধেছি কাশ’এর গুচ্ছ…”
….,……………………..,……………….
ছোটবেলায় পাঠভবন স্কুলে বাল্য ও কৈশোরকাল কাটার দরুণ বেশ কিছু সেরা মানুষ গড়ার কারিগরদের পায়ের কাছে বসে থেকে দিন কেটেছিল, সেটা এক অর্থে প্রাপ্তি তো বটেই। নুটু মিস্ (রত্না দাশ, ওরফে র.দা.) ক্লাস থ্রীর আমাকে গড়ে তুলেছিলেন বাংলা ভাষার ঐশ্বর্যদানে!
তখন কি আর জানতাম উনি সত্যজিৎ রায়ের মামাতো কিংবা মাসতুত কিছু একটা ধরণের আপন বোন হন। আসলে পাঠভবনের আঙিনাটাই তখন সত্যজিৎ আর রবীন্দ্র চর্চার আঁতুড়ঘর।
সেটাই বা তখন জানতাম থোড়াই।
পরে পুরনো সব টীচারদের কাছে গল্প শুনেছি
রায় সাহেব নিজে, চিন্মোহন সেহানবীশ আর জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ওরফে বটুক দা এঁরাই সব নিজেদের উদ্যোগ নিয়ে একটি খোলা খাপড়ার ঘরে এই মিনি শান্তিনিকেতনের রেপ্লিকাটিকে কলকাতার বুকে সেদিন জন্ম দেন বলেই আজও তার প্রিমিয়াম জীবনভর ধরে আদায় উসুল করছি।
উমা সেহানবীশ আমাদের কালে বড় অল্প দিনের মধ্যেই বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে ততোদিনে প্রধানশিক্ষিকার কাজ ছেড়ে দিয়েছেন বলে সেইভাবে উমাদিকে মনে নেই।
আর আমাদের প্রাইমারী ইস্কুলের পাশেই থাকতেন ‘ন হন্যতে’ খ্যাত সেই রবীন্দ্রধন্য শ্রদ্ধেয়া মৈত্রেয়ী দেবী।
এইসব-ই আসলে আমাদের একটা উত্তরাধিকারের গর্ব।
এছাড়া সন্দীপ রায়, কুশল চক্রবর্তী এঁরাও সব এখানেরই প্রাক্তনী। বালিগঞ্জ প্লেসের হাইস্কুল বিল্ডিং এর লাইব্রেরী ঘরে বাবুদা’র (সন্দীপ রায়) হাতে আঁকা নেতাজী ও রামমোহন রায়ের প্রতিকৃতি বাঁধানো আছে। উত্তম স্যার আর গৌতম দা বরাবর এইসব ছবি আঁকার ক্লাসের হোতা। এই ছবিগুলোই যেন রায় বাড়ির ছবি আঁকিয়ে জিনতত্ত্বের একটা বড় প্রমাণ !
মনে আছে ‘গুপি বাঘা ফিরে এল’ সিনেমার প্রেস রিলিজ ও গেস্ট শো দেখেছিলাম আমরাই স্কুল থেকে গিয়ে।’ বাক্স রহস্য’ যখন করলেন বাবু’দা তখনও।
বাবু’দাকে সেদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম –
” আর ফেলুদা হবে না?”
উনি তখন হেসে বলেছিলেন,
” হতেই পারে! তবে এটা উৎরোলে তবে তো!”
……….
সুকুমার শতবর্ষে আমি বেশ ছোট। পাঠভবন “সুকুমার মেলা” করেছিল রবীন্দ্রসদন -নন্দন প্রাঙ্গণে। এত্ত বড় একটা ‘ভয় পেয়োনা’ র কাটআউট ছাড়া ও মেলার আর বিশেষ মনে নেই।
নন্দনে গিয়ে ‘হীরক রাজার দেশে’ দেখতে গিয়ে কী বিপত্তি! একটা করে গান দেখাচ্ছে আর আমি সীটের ওপর উঠে নেচে গেয়ে অস্থির। আসলে এল পি রেকর্ডে ওটা ততোদিনে বাড়িতে শুনে অস্থির করে দিতাম।
এ্যান্টনী ফিরিঙ্গী আর গুপী বাঘার গান পালা করে না চললে ছোটবেলায় ঘুমাতাম না বা খেতে ঝঞ্ঝাট করতাম বলেই পরে শুনেছি।
সে ছেলে যে ‘পাঠভবনে’ পড়বে এ আর এমন কি কথা!
মনে পড়ছে ‘ফটিকচাঁদ’ ছবির স্পেশাল পাঠভবনের জন্য শো দেখতে গিয়ে জানলাম
” আগন্তুক” ও অন্য এক শোয়ে দেখাচ্ছে। তখন 1992 সাল এর ফেব্রুয়ারি /মার্চ হবে। তারপরে পরে এপ্রিল মাসে তো চলেই গেলেন ‘সত্যজিৎ রায়’। এর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার ‘উৎপল দত্ত’! ছেলেবেলাটা তখন আস্তে আস্তে কৈশোরবেলার হাতছানিতে দেখতে পাচ্ছি বদলে যাচ্ছে।
……..
জীবনানন্দের শতবর্ষে আমরা বেশ বড় তখন। স্কুলেই শতবর্ষের অনুষ্ঠানটা হয়েছিল। এসেছিলেন ‘জয় গোস্বামী’। ওঁর পাশে দাঁড়িয়ে জীবনানন্দের ওপর কবিতা বলতে হয়েছিল। বলে রাখি তখন থেকেই ইস্কুলের সব সাহিত্যসভা- টভা করি আর নিজেও ছাইপাঁশ একটু আধটু লিখিও। কাজেই এটা তো হতেই হবে! তাই না!
স্কুলের বাংলা ভাষা শিক্ষায় শম্পা মিস্ আর দেবী মিস্ এঁদের না পেলে অর্ধেক জীবনটা ভাষাহারা, বাণীহারা হয়ে হয়তো মরতেই বসতো। আবার প্রাইমারী বিভাগের শিক্ষিকা কৃত্তিকা মিসও এই স্কুলের ছাত্রী ছিলেন ছয়-সাতের দশকে। স্বয়ং সত্যজিত রায়ের হাত থেকে তিনি একবার প্রাইজ নিয়েছিলেন ! সে উদ্যমী অতীতকাহিনীটি বলে আমাদের বালকবেলায় স্নেহের সাথে স্পর্শ করিয়ে দিতেন অতীতের সেই সুউচ্চ দ্রাঘিমারেখাটি।
ভাগ্যিস ভাষামাতৃকা হয়ে ছিলেন ওঁরা!
আজ থেকে কুড়ি বছর আগে সত্যজিৎ রায়ের আশীতম জন্মবার্ষিকী তে পাঠভবন রবীন্দ্রসদনে প্রোগ্রাম করেছিল। সৌমিত্রবাবু, কুশল দা, বাবু’দারা সব গ্রীণরুমে জমায়েত। যদিও পাশ করে গেছি ততোদিনে তাও দীপঙ্কর স্যার বারণ করেননি এই প্রাক্তন ছাত্রটিকে বরং ওনাদের আপ্যায়ণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন নিছক ভালোবেসেই।
আরে ! সেজন্যই তো এত ভালবাসি ১০৩ এ/সি বালিগঞ্জ প্লেসের স্কুল বাড়িটা আর যখের ধনের মত আঁকড়ে রাখি ওইসব শিক্ষক শিক্ষিকাদের দামী পদরেণু।
এমন কত ঘটনা যে বলব !
আজ যেন শতবর্ষের আলোয় সত্যজিৎ নিজে ঠিক জানি এসে দাঁড়িয়ে আছেন দীর্ঘদেহে এক বটবৃক্ষের মত! তাঁর সেই দরাজ গলায় লাইট -সাউন্ড -ক্যামেরা -অ্যাকশন বললেই হাল্লার সৈন্যদের সামনে রাখা রাশি রাশি মিষ্টির হাঁড়ি আর ‘সন্দেশ’ এখুনি আমাদের জন্য এসে পড়বে যেন।
আর আমরা সেগুলো তখন কুড়িয়ে নেব তখন, আগে যেমন কুড়িয়ে নিয়েছি এরকম অজস্র দামী স্মৃতি ! আর গরিমা! ঠিক তেমনই!
“মধুর তোমার শেষ যে না পাই/প্রহর হল শেষ”!
…………
(এরপর ক্রমশ…)