হাড়োল
কাকলি ঘোষ
এই দুপুরের সময়টা সাধারণত কেউ আসে না। থানা ফাঁকাই থাকে। বাইরে কনস্টেবল রাম সিং চেয়ারে বসে ঝিমোয়। ভেতরেও কেউ কেউ টেবিলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে যায়। খেয়ে দেয়ে এসে সবে নিজের জায়গাটিতে বসে একটা দাঁতে একটা কাঠি লাগিয়েছেন অমিয় পাত্র। তখনই দেখলেন লোকটাকে।
ভয়ে ভয়ে যেন খুব সংকোচের সঙ্গে ভেতরে ঢুকছে । পরনে আধ ময়লা ট্রাউজার ,গায়ে রংচটা একটা হাফ শার্ট। এক গাল দাড়ি। কোটরে ঢোকা চোখ। মুখে স্পষ্ট অস্বস্তির ছাপ। সঙ্গে আবার বছর কুড়ি বাইশের একটা মেয়ে ! চেয়ে রইলেন অমিয় পাত্র। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট বুঝে গেলেন জীবনে এই প্রথমবার থানার ভেতরে পা রেখেছে লোকটা। চোখে চোখ পড়তেই এক পা দু পা করে সামনে এগিয়ে এলো ।
“ কি চাই ? “ হালকা করে একটু ঘাড় হেলিয়ে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন অমিয় পাত্র।
“ আমার নাম নিতাই দাস স্যার। ওই বাজারের কাছে দীনবন্ধু স্টোরে কাজ করি। “
“ হুম। তো ? এখানে কি ?”
“ একটা ডায়রি করতে চাই স্যার “
“ ডায়রী ? অ। তা কি কেস ?”
কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে এবার ভালো করে তাকান এস.আই. অমিয় পাত্র। সেই চাউনির সামনে কেমন ঘাবড়ে যায় নিতাই। তারপর বিড়বিড় করে বলে,
“ স্যার কাল রাতে আমার মেয়েটাকে ওই মানকে গুন্ডা আর ওর দলবল তুলে নিয়ে গিয়ে _”
নিমেষে মাথা নিচু করে সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে চোখ ঘুরে যায ডিউটি অফিসারের। শ্যামলা রঙ। কিন্তু স্বাস্থ্যটি বেশ নজরধরা।দু গালে অশ্রুর ছাপ স্পষ্ট।
“ সেকি ! কখন ?”
“ দশটা নাগাদ স্যার। মেয়েটা ওই হারু ঘোষালের আমবাগান দিয়ে ফিরছিল।__”
আর বলতে পারে না নিতাই। এক ঝলক কান্না এসে গলায় আটকে যায় ওর।
“ রাত দশটা অব্দি তোমার মেয়ে বাইরে কি করে ? “
“ ও তো পড়াতে যায় স্যার। তিন চারটে টিউশনি করে। নিজেও কলেজে পড়ে। “
“ হুম। তো ডায়রি করতে চাও ?” আপনি থেকে সরাসরি তুমিতে নেমে আসেন অমিয় পাত্র। “মানকের এগেনস্টে ? ওর পরিচয়টা জানো তো?“ “জানি স্যার। এম. এল. এ. হরিসাধনবাবুর পোষা গুন্ডা ও। হেন খারাপ কাজ নেই যা করে না। “
“ ব্যস ব্যস । যতটুকু দরকার ততটুকু বল। ডায়রি করবে ? বলি মেয়েটার যে বদনাম হবে সে খেয়াল আছে ? বিয়ে দিতে পারবে ? ”
মাথা নিচু করে নিতাই। দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে ওর চোখ দিয়ে।
কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থাকেন অমিয় পাত্র। তারপর পচাৎ করে একদলা থুতু ঘরের কোনার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে মুখ মচকে হাসেন।
“ অ । তো কিসের ডায়েরি করবে ? রেপ না শ্লীলতাহানি? “
“ রেপ স্যার।” এবারে অকম্পিত গলা নিতাইয়ের।”
“ ও। তো এসব কেসের ডায়রী করার নিয়ম কানুন জানা আছে কিছু ? সব বলতে হবে কিন্তু । সব মানে স __ব। “ বলতে বলতে সামনে রাখা খাতাটা মেলে ধরেন সামনে।
“ এই যে মেয়ে — নাম কি ?
“ মালতী দাস। “
“ হুম। কবে ? কোথায় ? কখন ঘটনাটা ঘটেছিল ?
কতজন ছিল ?
একে একে ? না একসাথে সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ?
কাপড় পুরো খুলে দিয়েছিল ?
ব্লাউজ ?
শরীরের কোথায় কোথায় হাত দিয়েছিল ? বল। বল। চুপ করে থাকলে হবেনা। “
দু চোখ তুলে তাকায় মালতী। জোড়া জোড়া চকচকে চোখ। লোভে, বিকৃত কামনায় জ্বলজ্বল করছে । বাইরের মুখোশ খুলে বেরিয়ে এসেছে এক একটা হিংস্র শ্বাপদ। মাপছে ওর সর্বাঙ্গ। ক্লেদাক্ত , গলিত কামনা চুঁয়ে চুঁয়ে বেরিয়ে আসছে ওই জোড়া জোড়া চোখ দিয়ে। নারীর সব চাইতে অপমানের বিবৃতি শোনার জন্য কী ভীষণ উদগ্রীব ! কি বলবে ও ? কাদের বলবে? কিভাবে বলবে ?
রেপটা কি শুধু কালই হয়েছে ? আর আজ ? এখানে? এখন যেটা হচ্ছে ? সেটা _??
—ooXXoo—