তিস্তা পারের রহস্য (প্রথম অংশ)
সলিল চক্রবর্ত্তী
০৯-১১-২০২২
মেয়ের বাড়ি যাবে বলে শিয়ালদহ থেকে দুপুর দুটো পয়তাল্লিশের মেল ট্রেন তিস্তাতোর্সাতে চেপে বসলেন অরুণ রায়, সঙ্গে সহধর্মিনী। ব্যাবসায়ী মধ্যবয়স্ক মানুষ। ব্যাবসার চাপে সহধর্মিণীকে নিয়ে বেড়ানো আর হয়ে ওঠেনি। সিকিমের রংপোতে মেয়ের অস্থায়ী বাসস্থান হওয়ার জন্যে রথ দেখা কলা বেচা হচ্ছে আর কি। অরুন রায় মজা করে গিন্নীকে বললেন “সেই কবে বিয়ের পর দুজনে গিয়েছিলাম হানিমুনে, আজ ছাব্বিশ বছর পর একইভাবে যাচ্ছি হানিসানে।” কথাটা যে মজা করে বলা সেটা বুঝেও গিন্নী বললেন- “তার মানে?” অরুন রায় হাসতে হাসতে বললেন- ” যখন হানিমুনে গিয়েছি, তখন আমরা সদ্য যুবক যুবতী, চন্দ্রের স্নিগ্ধ সুষমায় অবগাহন করেছি। আজ সব স্মৃতি, এখন প্রৌঢ়বয়সে পদার্পণ করে সংসারের জ্বালা যন্ত্রনায় সূর্যের প্রখর তাপের মতো জর্জরিত হচ্ছি, তাই আর কি—-“
পাশে বসা আপার বার্থের ভদ্রলোক বিষন্নমুখে হালকা হেসে মৃদুস্বরে বললেন “আপনি তো বেশ মজার মানুষ! ইচ্ছা থাকলেও আনফরচুনেটলী আমি আপনাদের আনন্দে মিলিত হতে পারছিনা।” অরুন রায় জিঞ্জাসু দৃষ্টিতে ভদ্রলোককে বললেন-“কিছু যদি না মনে করেন, আ-প-না-র–!!”
—–” হ্যাঁ,আমি আজ সকালে আমার এক পরম আত্মীয়াকে পিস হ্যাভেনে শায়িত রেখে ছুটছি ধুপগুড়ি।” অরুন রায় আরও একটু অবক হয়ে বললেন- “ব্যাপারটা ঠিক ক্লিয়ার হলো না।” ভদ্রলোক একটু বিষন্নতার হাসি হেসে বলেন-“স্বাভাবিক,তবে শুনুন সংক্ষেপে বলি,আমার স্ত্রী বাবামায়ের একমাত্র সন্তান।আমার শাশুড়ীমাতা ভীষণ ভালো এবং নিরীহ গোছের মানুষ। শশুর মশাই ভালো, তবে একরোখা মানুষ।নিজে যেটা ঠিক মনে করবেন, সেটাই শিরোধার্য। বুঝলাম বিয়ের বছর দুই পর।শশুর মশাই মেয়েকে ডেকে জানালেন, স্ত্রীকে তিনি ডিভোর্স দিতে চান। শুনে আমরা-তো আকাশ থেকে পড়লাম, নিরীহ মানুষটার অপরাধ! তার কোনো উত্তর নেই। শাশুড়ী’মা শুধু কাঁদছেন,কারন তিনিও ধোঁয়াশায়। আমরা অনেক বোঝালাম,এই বয়স, সমাজ বলে তো একটা কথা আছে, লোকে কি বলবে!কিন্তু শশুরমশাই তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়। অগত্যা সকলে মিলে তাঁকে বোঝানো হলো, তিনি যদি এক ছাদের তলায় না থাকতে চান-তো ধুপগুড়ির পৈতৃক ভিটে বাড়িতে গিয়ে থাকুন। ডিভোর্স দিয়ে অহেতুক লোক হাঁসানোর কোনো মানে হয়? তিনি সকলের এই সাজেশনটা আর ফেলতে পারলেন না। তল্পিতল্পা গুছিয়ে তিনি চলে গেলেন ধূপগুড়ি, বাড়িটা ভাড়া দিয়ে আমি শাশুড়ীমাকে আমার কাছেই রাখলাম। এই ঘটনার পর শাশুড়ী মাতা মানসিক এবং শারীরিক ভাবে ভেঙে পড়লেন,ফল স্বরূপ নানা রকম রোগ তাঁর শরীরে বাসা বাঁধল। মধ্যে এই পাঁচ সাতটি বছরে শশুরমশাই একবারের জন্যেও স্ত্রীকে দেখতে আসেননি। গতকাল শাশুড়ী মা পরলোক গমন করেছেন। মৃত্যুর আগে বারবার শশুরমশাইকে দেখতে চাইছিলেন। কিন্তু তাঁর সাথে তখন যোগাযোগ করতে পারিনি। এখন চলেছি ধূপগুড়ি, শাশুড়ি মাতার শেষ ইচ্ছা পুরোন করতে শশুর মশাইকে নিয়ে যদি তাঁর নশ্বর দেহটার সামনে দাঁড় করাতে পারি।
অরুন রায় একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন-” আহা-রে কি করুন পরিনতি! এ পৃৃথিবীতে যে কত ধরনের মানুষ আছে সে-ও এক বিশ্বয়।” সহযাত্রী ভদ্রলোক অরুন রায়কে বললেন-” দাদা আমি খেয়ে শুয়ে পড়ি,সারাদিন যা ধকল গেল। রাত তিনটে নাগাদ ট্রেন এন জে পি-তে পৌঁছাবে, আমি আপনাদেরও ঘুম ভাঙিয়ে দেব।”
রাত ন’টা নাগাদ ডিনার সেরে স্ত্রীকে লোয়ার বার্থে দিয়ে অরুন রায় মিডিল বার্থে শুয়ে পড়লেন। ট্রেনের দুলুনি আর পাশের ট্রাকে পাস হওয়া ট্রেনের আওয়াজে ঘুম কি আসে, শুয়ে শুয়ে আপার বার্থের ভদ্রলোকের কথা গুলো অরুন বাবুর মনের স্মৃতি গুলোকে উসকিয়ে দিল। স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠল মেজ জেঠিমার কাতর আকুতিভরা মুখখানি। পিস হ্যাভেনে শায়িত ভদ্রমহিলা জানতেন তাঁর স্বামী জীবিত, সেইজন্য তাঁকে দেখতে চেয়েছিলেন। আর জেঠিমা-তো মৃত্যুর সময় এক কপাল সিঁদুর নিয়ে ইহলোক ত্যাগ করেছেন, জ্যাঠামশায়ের কথা অনেক বার বলেছিলেন, কিন্তু তাঁকে কেউই কোনো ভরসা দিতে পারেনি। জেঠিমাও মৃত্যুকালে জানতে পারেননি স্বামী জীবিত না মৃত! আজও আমরা জানিনা মেজ জ্যাঠামশায়ের অন্তর্ধান রহস্য। বয়স অনুসারে তাঁর আর জীবিত থাকার কথা নয়। ষাটোর্ধ মানুষটি হঠাৎ সন্ন্যাস গ্রহন করে সেই যে গৃহত্যাগী হলেন, আর ফেরেননি। ভোরবেলা জেঠিমা ঘুম থেকে উঠে দেখেন বিছানায় জ্যাঠামশাই নেই। ভেবে ছিলেন ঘুম থেকে উঠে এদিক ওদিক কোথাও গেছেন। যখন ফিরলেন না তখন খোঁজ খবর করা হল, মিসিং ডাইরি করা হল, কোনো লাভ হয়নি। মেজ জেঠিমা জ্যাঠামশায়ের মাথার বালিশের নিচে একটা চিরকুট পেয়েছিলেন, যাতে লেখা ছিল-” আমাকে খোঁজাখুঁজি কোরোনা, আমি তোমাকে না জানিয়ে গৃহত্যাগ করার জন্যে দুঃখিত। জানালে আমি বাধার সম্মুখীন হতাম। যাইহোক, গুরুর আদেশে এক অসাদ্ধ সাধন করতে চললাম। সিদ্ধিলাভ করলে ফিরতেও পারি—।” ব্যাস এই টুকুই, শ্রেফ একটা কাপড়ের ঝোলা, তার ভিতর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র ভরে বেরিয়ে পড়েছিলেন। নিঃসন্তান জ্যাঠামশায়ের পিছুটানও বিশেষ কিছু ছিলনা।
স্মৃতিচারণের মধ্যে অরুন রায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়েন বুঝতেও পারেননি।ঘুম ভাঙল হই হট্টগোলের মধ্যে,ঘড়ি দেখলেন রাত পৌনে তিনটে। বেশিরভাগ প্যাসেঞ্জার এন জে পি নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আপার বার্থের ভদ্রলোক গুগল সার্চ করে বললেন আর মিনিট দশেকের মধ্যেই এন জে পিতে ট্রেন ঢুকে যাবে।
ট্রেন থেকে নেমে দ্বিতীয় শ্রেণির ওয়েটিংরুমে ঢুকে সাময়িক ভাবে তিন জন ফ্রেশ হয়ে নিলেন। ভোর পাঁচটার আগে স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে লাভ নেই বুঝে, তিনজন ধূমায়িত লেমনটি সহযোগে গল্প গুজব করতে করতে ভোর পাঁচটার অপেক্ষায় থাকলেন।
১০-১১-২০২২
সহযাত্রী ভদ্রলোককে বিদায় জানিয়ে অরুন রায় ও তার স্ত্রী একটা শেয়ার স্করপিয়োতে চড়ে বসলেন। রংপো পর্যন্ত পার হেড চারশো টাকা ভাড়া। সাড়ে পাঁচটার মধ্যে দশজন যাত্রি নিয়ে গাড়ি ছাড়ল। এখানে এখনো দিনের আলো ফোটেনি। গাড়ির হেড লাইটের আলোতে তারা এন জে পি স্টেশন থেকে বেরিয়ে খানিকটা এলেন। এত সকালে রাস্তাঘাট সুনশান থাকায় দ্রুত গতিতে তাদের গাড়ি খানিকটা এসে থামল। সেখানে ড্রাইভার বদল হল। ইউনিয়নের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি গাড়িতেই এইভাবে ড্রাইভার বদল হয়। যাইহোক, মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে গাড়ি ছাড়ল। আরো আধ ঘন্টা আসার পর গিরিরাজের চরণ স্পর্শ করল।
সিকিম, ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম অঙ্গরাজ্য। রাজ্যটি ভারতের উত্তর- পূর্ব দিকে অবস্থিত। অপার্থিব সৌন্দর্যে বিরাজমান এই রাজ্যটি উত্তরে চিনের তিব্বত,দক্ষিণে পশ্চিমবঙ্গে দার্জিলিং, পূর্বে ভুটান ও তিব্বত এবং পশ্চিমে নেপাল সীমান্ত দিয়ে পরিবেষ্টিত। ১৯৭৫ খ্রীস্টাব্দে ২৬শে এপ্রিল ৮০০০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই অঞ্চলটি চোগিয়াল রাজবংশ থেকে ভারতের অন্তর ভুক্ত হয়। এখানকার প্রধান ভাষা সিকিমিজ, অন্যান্য ভাষার মধ্যে নেপালী, গোর্খলী,লেপচা, হিন্দি ও ইংরেজি প্রচলিত। প্রধান ধর্ম হিন্দু এবং বৌদ্ধ। দশ নম্বর জাতীয় সড়ক (NH 10) শিলিগুড়ি থেকে শুরু হয়ে গ্যাংটক পর্যন্ত (174 km) গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাথে সিকিমের যোগসূত্র স্থাপন করেছে।
ধিরেধিরে ভোরের আলো ফুটছে, সম্মুখের অস্পষ্ট পাহাড়গুলো স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে লাগলো। ভোরের এই নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে রায় দম্পতির ঘুম না হওয়া রাতের ক্লান্তি দূর হয়ে মনটা নুতন প্রান শক্তিতে ভোরে উঠল। এন এইচ টেন ধরে সর্পিল পথে স্করপিয়টি রংপোর দিকে এগিয়ে চলেছে। রাস্তার প্যারালালে ধেয়ে এসেছে সিকিমের প্রধান পাহাড়ী নদী তিস্তা। সম্মুখে দুটি পাহাড় শৃঙ্গ যেটা সবুজ বনানীতে আবৃত। প্রথম শৃঙ্গটিকে আবৃত করে মেঘের আনাগোনা দু’চোখ ভোরে দেখতে দেখতে নজরে পড়ল দ্বিতীয় শৃঙ্গে দিনের প্রথম সূর্য কিরণ। ওঃ এমন নৈ’ স্বর্গিক দৃশ্য অরুন রায়ের কল্পনাতিত। এ যেন পৌরাণিক কাহিনির দেবতার তিল তিল করে তিলোত্তমা গড়া। সৃষ্টি কর্তা মনে হয় তার সৃষ্টিতে নিজ কল্পনা শক্তি’র কাছেই পরাজিত।
নিউ জলপাইগুড়ি থেকে রংপো পর্যন্ত নব্বই কিলোমিটার পথ ভারতীয় রেল, রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। তবে দার্জিলিং এর মতো সড়ক পথের সমান্তরালে নয়, ব্রিজ ও টার্নেলের উপর নির্ভর করে।
আটটা বেজে গেছে, অরুন রায়ের মেয়ে তৃষা ফোন করল, জানতে চাইল কতটা পথ তাঁরা এসেছেন। অরুন রায় ড্রাইভারের সাহায্য নিয়ে জানালেন, গেটওয়ে অফ কালিম্পং পার হলেন। অর্থাৎ রংপো পৌছুতে আর আধ ঘন্টার মত সময় লাগবে। গাড়িটা একটা বড় হোটেল কাম রেস্টুরেন্টের সামনে দশ মিনিটের মত ব্রেক দিল। অরুন রায় এবং তাঁর স্ত্রী ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে দুইকাপ লিকার চা নিয়ে গাড়ির পাশে দাড়িয়ে চা সহযোগে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করছেন। জাতীয় সড়কের একদিক খাড়াই পাহাড়, অন্যদিকে গিরিখাত। মনে হচ্ছে যেন কল্পনার স্বর্গদ্বারে তাঁরা পৌঁছে গেছেন। হটাৎ অরুন রায়ের চোখে পড়ল কিছুটা দূরে খাড়াই পাহাড়ের গা’বেয়ে একটা পায়ে চলা খাড়াই পথ হাইওয়ে থেকে উপরে উঠে গেছে। যে পথে শেরপা ছাড়া সাচ্ছন্দ্যে গোর্খাদেরও উঠতে অসুবিধা হবে। ঠিক সেই পথে এক বৃদ্ধ সাধুবাবা কোনকিছু অবলম্বন ছাড়াই সাবলীল ভাবে উপর দিকে উঠছেন। অরুন রায় অবাক হয়ে স্ত্রী কে দেখিয়ে বললেন-” দেখ, কি অনুশীলন, না হলে এই বৃদ্ধ বয়সে ওই রাস্তা দিয়ে কোনো মানুষের দ্বারা ওঠা সম্ভব!!”
এরি মধ্যে গাড়ির হর্ণ বেজে উঠল, সবাই গাড়িতে উঠতেই গাড়ি আবার ছুটল রংপোর দিকে। বাকি আধ ঘন্টা প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে পার হয়ে গেল অরুন রায় টেরও পেলেন না।
পৌঁছে গেলেন রংপো,পশ্চিমবঙ্গ এবং সিকিমের বর্ডার। দশ নম্বর জাতীয় সড়কের উপর ড্রাগন শোভিত ‘ওয়েলকাম টু সিকিম’ লেখা তোরনটি বুঝয়ে দিল এটি গেটওয়ে অফ সিকিম। খাকি ইউনিফর্মের কয়েকজন গোর্খা পুলিশ আইনানুগ গাড়িটির সামনে এসে উঁকিঝুঁকি দিয়ে সরে গেল। গাড়িটা মিনিট খানিক চলার পর ৯১ কিঃ মিঃ অতিক্রম করে আই বি এম মোড়ে একটা পেট্রলপাম্পের সমনে দাঁড়াল, যেখানে অরুন রায়ের মেয়ে তৃষা এবং জামাই সুশোভন তাঁদের আসার অপেক্ষায় আছে।
রংপো জায়গাটা বিরাট অংশ নিয়ে একটা পাহাড়ি সমতল ভূমি, যেখানে রঙ্গিত নদী এসে মিলিত হয়েছে তিস্তা নদীতে। অর্থাৎ এটি একটি মোহোনাস্থলও বটে। এখানে বাড়ি ঘর, রাস্তা ঘাট সমতল ভূমির মতো। রংপো শহরটি অর্ধেক পড়ে পশ্চিম বঙ্গের মধ্যে, বাকিটা সিকিমে। তৃষারা একটা পাঁচ তলা বিল্ডিংয়ের চারতলায় থাকে। সুশোভনের সাথে ছাদে উঠে অরুন রায়ের জ্ঞান পিপাসু মনটা ভোরে গেল। যতটুকু চোখে পড়ল, এই সমতলে প্রচুর অট্টালিকা আছে।এখানকার পাঁচতলা বিল্ডিং গুলো কোলকাতার মতো নয়, হালকা এবং ছোটো। কারন আর্থকোয়েক এবং ল্যাণ্ডস্লিপ টেনডেন্সি আছে তো। সুশোভনের কাছে এখানকার স্থান বৈশিষ্ট্য শুনলেন। ব্লাড কানেকশনে সিকিমিজ হতে হবে,তবেই জমি কিনে বাড়ি করা যাবে। ফলে এখানকার অধিবাসীরা বেশিরভাগই বহিরাগত,ভাড়াটিয়া।
দুপুরে খাওয়ার পর সময় নষ্ট না করে একটা হালকা গরম পোশাক গায়ে চাপিয়ে অরুন রায় একাই বেরিয়ে পড়লেন তিস্তার মোহনায়।
তিস্তাকে সামনে থেকে দেখলে কোলকাতার বাগজোলা খালের’ও করুনা হবে। সমস্ত মোহনা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অজস্র বড়ো, মাঝারি,ছোট নুড়ি পাথর। আর রঙ্গিত নদীর মধ্যস্থল দিয়ে নুড়ি পাথরে বাধা অতিক্রম করে ঠাণ্ডা বরফ গলা জল সর্পিল আকারে ধেয়ে এসে তিস্তার বুকে মিশছে। তিস্তার অবস্তা রঙ্গিতের তুলনায় বেশ কিছুটা ভাল। কোনো শিশুকে যদি বলা হয় এটি দুই নদীর মোহনা, সে হয়ত নদীর সঙ্গাটাই ভুলে যাবে। জলজ প্রাণী হীন, জোয়ার-ভাটা না খেলা দুটি নিষ্প্রাণ নদী। এই-ত জলের বহর, এই জল নিয়ে আবার ভারত বাংলাদেশের ঝগড়া। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, পাহাড়ি নদীর আসল রূপ ধরা পড়ে জুন,জুলাই,আগাস্ট মাসে। যাইহোক নিষ্প্রাণ মোহনার বর্তমান অবস্থায় ফেরা যাক। মোহনার পার বরাবর একটা গোর্খা বস্তি আছে। পাশেই বিস্তৃত কাশ গাছের জঙ্গল, যাতে সদ্য শুকানো কাশ ফুলের শিষ গুলো হালকা বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে। কাশ বনের পাশেই একটা শ্মশান, যেটাকে আপাত দৃষ্টিতে শ্মশান বলে মনে হবে না। টিনের শেড, চারদিক খোলা, দোচালা একটি ঘর। মেঝেতে একটা লোহার বেদি,যার উপর জ্বালানি কাঠ সাজানো হয়। শ্মশান বেদির পর থেকে তিস্তার ঢাল নেমে গেছে। সেই ঢালে পঞ্চাশ ষাট স্কয়ার ফুট ছোটো ছোটো জায়গা পাথর দিয়ে ঘিরে গোর্খা মহিলারা ছোটো ছোটো নুড়িপাথর ভাঙছে। তারও নিচে তিস্তা ও রঙ্গিত নদীর মাঝ বরাবর চার চাকার ছোটো ছোটো ট্রাক গুলো দাঁড় করিয়ে থান ইঁটের মতো পাথর গুলো তুলছে।
অরুন রায়ের মনে প্রশ্ন জাগল,মিনি ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া পাথর নিশ্চই কোনো কাজে লাগবে, কিন্তু গোর্খা মহিলারা যে নুড়ি গুলো ভাঙছে ওগুলো কি কাজে লাগবে!এগিয়ে গেলেন এক মাঝ বয়সি গোর্খা মহিলার কাছে। এখানে আবার ভাষাগত সমস্যা দেখা দিল। হয় সিকিমিজ নয়ত গোর্খালি নিদেনপক্ষে হিন্দিতে কথা বলতে হবে। অরুন রায় কোনো ভাষাই জানেন না, হিন্দি অল্পস্বল্প বোঝেন তবে বলতে পারেন না। তবে হাল না ছেড়ে ঈশারা এবং বাংলা ভাষা মিশিয়ে প্রশ্ন করলেন, এই নুড়িপাথর তারা ভাঙছে কেন। ভদ্রমহিলা উত্তর না দিয়ে মুখটা শুধু হাসিহাসি ভাব করল। ভি ডি ও রেকডিং করতে করতে একই কর্মরত পার্শ্ববর্তী বৃদ্ধাকে একই প্রশ্ন করলেন। তিনিও না বুঝে অরুন রায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। হঠাৎ, পিছন থেকে নুড়িপাথর ভাঙতে ভাঙতে বছর বারো চোদ্দর একটি মেয়ে বাংলা হিন্দি মিশিয়ে বলে উঠল-” পাকা বাড়ি তৈরির জন্য পাথর ভাঙছি, ঠিকাদার এসে কিনে নিয়ে যাবে। ” অরুন রায় একটু আশার আলো দেখলেন, আবার অবাকও হলেন। এ যেন ওয়েসিসের দেখা পেলেন। মেয়েটির কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-” তুমি বাংলা জানো! তোমার নাম কি?” মেয়েটি পাথর ভাঙতে ভাঙতে উত্তর দিল “চম্পা ছেত্রি।” ছেত্রি টাইটেল শুনে অরুন রায় জিজ্ঞেস করলেন-” তুমি কি ওয়েস্টবেঙ্গলে ছিলে?”মেয়েটি না সূচক ঘাড় নাড়ায়। তবে কি তোমার মা বাঙালি?মেয়েটি এবারও না সূচক ঘাড় নাড়ায়। তাহলে তুমি বাংলা জানলে কি করে? চম্পা বলল-” দাদির কাছ থেকে।” তোমার দাদি কি বাঙালি?প্রশ্নের উত্তরটা চম্পা সবে দিতে যাচ্ছিল হঠাৎ অরুন রায়ের চোখে পড়ল এক সাধুবাবা, শ্মশানের দিক থেকে কাশ জঙ্গলের দিকে যাচ্ছেন। কালিম্পং গেটের কাছে খাড়াই পাহাড়ি পথ ধরে ওঠা সে-ই সাধুবাবা!! না-ও হতে পারে, দূর থেকে দেখে একই রকম লাগল। দেখা মাত্রই অরুন রায় এক অমোঘ টানে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল শ্মশানের দিকে। কিন্তু যাওয়াই সার হল, চারদিকে তন্নতন্ন করে খুজলেন কিন্তু সাধুবাবার দেখা পেলেন না। শ্মশানের কাছেই দাঁড়িয়ে দুটি যুবক গল্প করছিল,তাদের কাছে আকার ঈঙ্গিতে জিজ্ঞেস করতে তারা কিছুই দেখেনি জানাল। অরুন রায় আশাহত হলেন। এদিকে সূর্য অস্ত গেছে, অচেনা অজানা জায়গা ফলে তিনি বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন।
লিফটহীন চারতলায় সিঁড়ি ভেঙে কষ্ট করে উঠে ঘরে ঢুকতে যাবেন, দেখেন মেন দরজার সামনে পাতা পাপসটার উপর একটি হলুদ রঙের,লোমশ, বাঘের মতো কুকুর শুয়ে আছে। অত বড়ো কুকুর দেখে অরুন রায় প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেন। কিন্তু কুকুরটির ভিতরে তিনি কোনো হিংস্রতা লক্ষ্য করলেন না, বরং এক করুন আকুতি নিয়ে যেন ফ্যালফ্যাল করে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। আর এগুনো উচিত হবে কিনা ভেবে তৃষাকে ফোন করতে যাবেন, এমন সময় জামাই সুশোভন অফিস থেকে ফিরে এলো। পরিস্থিতি বুঝে হাসতে হাসতে বলল-” ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ও হলো তৃষার বডিগার্ড।” সুশোভনের গলার আওয়াজ পেতেই কুকুরটি পাপস ছেড়ে উঠে চলে গেল। সুশোভন কলিং বেলের সুইচ দিতে দিতে বলল-” আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আমি বাড়ি থাকলে কুকুরটা কক্ষনও আসে না। আবার আমি ফিরলে ওকে তাড়াতে হয় না।”
ঘরে ঢুকে সুশোভন তৃষাকে বলল-” গাড়ি বুক করে এলাম, কাল ভোর পাঁচটায় গাড়ি আসবে, পেলিং বেড়াতে যাব। এদিকে বাবা মশাইকে তোমার বডিগার্ড এর হাত থেকে রেসকিউ করে আনলাম, সেই অনারে একটু কফি খাওয়াও দেখি।”
কফি খেতে খেতে অরুন রায় তিস্তাপারে বেড়ানোর বর্ণনা করতে থাকেন, বর্ণানুক্রমে সাধুবাবার কথা উঠতেই তৃষা বাবার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সুশোভনকে বলল-” দেখেছ, তোমরা বল আমার চোখের ভুল, তোমরা কেউ সাধুবাবাকে দেখতে পাওনা শুধু আমিই দেখি। আজ বাবাও সাধুবাবাকে দেখেছেন, প্রমান হল তো??”
১১-১১-২২
মোবাইলের অ্যালার্ম সকলকে ভোর চারটেয় তুলে দিল। চারজন ফ্রেশ হয়ে গোছগাছ করে নিচ্ছেন, এদিকে পাঁচটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকিতেই গেটের কাছে গাড়ির হর্ণ বেজে উঠল। সময়ানুবর্তিতায় এখানকার মানুষ বাংলার থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে। অরুন রায় রেডি হয়ে ছিলেন বলে নিচে গাড়ির কাছে চলে এলেন। কুয়াশায় ঢাকা, পাহাড় দিয়ে ঘেরা, রঙ্গিত নদীর পারে দাঁড়িয়ে, হালকা আলোয় বেশ মায়াবী মায়াবী পরিবেশ। তিনি এমন একটা প্রাকৃতিক দৃশ্যের সাক্ষী থাকতে পেরে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল সেই সাধু বাবা। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় একটা পাতলা লাল শালু গায়ে জড়িয়ে তিস্তা পারের শ্মশানের দিকে যাচ্ছেন। ড্রাইভার ওদের সামাজিকতায় অরুন রায়ের দিকে তাকিয়ে বলে-” গুড মর্নিং দাজু।” অরুন রায় প্রত্যুত্তর দিয়েই সাধু বাবার পিছু নিলেন। মিটার পঞ্চাশেক পথ তাড়াতাড়ি হেঁটে গেলেন, কিন্তু কুয়াশার মধ্যে কোথায় যে সাধুবাব অদৃশ্য হয়ে গেলেন, অরুন রায় খুজেই পেলেন না। এদিকে তৃষারা গাড়ির কাছে এসে তাঁকে ডাকতে সাধু বাবার আশা ছেড়ে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন।
গাড়ি ছাড়ল, গন্তব্য স্থল পেলিং। পশ্চিম সিকিমের দ্রষ্টব্য স্থান গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য এই পার্বত্য শহরটি। বেড়াতে বেরিয়েও অরুন রায়ের মনটা অস্থিরতায় ভুগছে। কে ওই সাধুবাবা!! কেন একটা অমোঘ টান তাঁকে সাধু বাবার কাছে নিয়ে যাচ্ছে!! তৃষাই বা কেন সাধু বাবাকে একা দেখছে, সুশোভন নয়!! কুকুরটাই বা কেন চারতলায় উঠে দরজার সামনে শুয়ে থাকে, যখন সুশোভন বাসায় থাকেনা!! প্রশ্ন গুলো তোলপাড় করছে মনের মধ্যে, মেলাতে পারছেন না। তৃষার ডাকে সম্বিত ফিরল। ” বাবা চুপচাপ কেন গ্যাস হয়ে গেছে? কিছু খাবে?” পাহাড়ি বনানীর বুক চিরে অশ্বখুরাকৃতি কালো পিচের রাস্তা যেন স্বর্গে উঠছে। নেই কোনো লোকজন, নেই কোনো দোকানপাট। বেশ কিছুটা তফাৎ অন্তর একটা করে বাসস্টপ দেখা যাচ্ছে। অরুন রায় মেয়েকে আস্বস্ত করে বলেন -” খিদে তো পেয়েছে, কিন্তু এই পাণ্ডব বর্জিত স্থানে খাবার পাবো কি? জলের বোতলটা বার করতো একটু জল খাই।” বোতল বার করতে সকলেই জল খেল। বোতলের জল শেষ হতেই ড্রাইভার খালি বোতলটা অরুন রাযের হাত থেকে নিয়ে নিল, যাতে তিনি খালি বোতল বলে গাড়ির বাইরে না ফেলেন। যত্রতত্র প্লাসটিক দ্রব্য ফেলে দেওয়া সিকিমে দণ্ডনীয় অপরাধ। যাইহোক কিছুটা যাওয়ার পর একটা ডাস্টবিন দেখে ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয়ে নিজে গিয়ে বোতলটি ফেলে দিল।
সুশোভন ড্রাইভারকে বলে দিল সে যেন খাওয়ার মতো দোকান পেলে দাঁড়ায়। গাড়ি চলছে তো চলছেই, পথ যেন আর শেষ হয় না। দীর্ঘ পথে মাঝে মাঝেই একটা করে জে সি পি দাঁড় করানো দেখে অরুন রায় কারনটা শুশোভনের কাছে জানতে চাইলেন। সুশোভন বলল-” পাহাড়ের যে জায়জাটা ধস নামার প্রবল সম্ভাবনা থাকে (Landslip Tendency Zone) সেখানে জে সি পি স্ট্যান্ড করে রাখে, যাতে বিপর্যয় ঘটলে এজ সুন এজ পসিবল মোকাবিলা করাযায়। না হলে পাহাড়ি শহর গুলোর মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
অবশেষে ছয়, সাত ঘন্টার জার্নি শেষে তৃষারা পেলিং শৈত্য শহরে এসে পৌঁছুল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা সাত হাজার দুশো পঞ্চাশ ফুট। পরিষ্কার আকাশ থাকায় কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখে মন ভরে গেল। সিকিমের উত্তর-পশ্চিমে নেপাল সিমান্তে অবস্থিত, পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম পর্বত শৃঙ্গ, যার উচ্চতা ৮৫৮৬ মি। এখানকার গুম্ফা ও মনাস্টেরি গুলো দেখার মতো। মন ভরিয়ে দিল একশ সিড়ি ভেঙে উঠে ত্রিশ ফুটের বুদ্ধ মুর্তি দর্শন। অবাক বিস্ময়ে সকলে চাক্ষুষ করলেন ভারতে প্রথম চিনের সহযোগিতায় তৈরী গ্লাস স্কাই ওয়াক। কাঁচের এই ফুট ব্রিজে চেপে নিজেদের বেশ ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। ঘন্টা দুই কাটিয়ে তৃষারা বাড়ির পথে পা বাড়ালো। বাসায় ফিরে রান্নার পাট রাখবেন না বলে সকলে মিলে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ঢুকে তুলনামূলক ভাবে সস্তায় পেট পুরে গরম গরম মোমো খেয়ে নিলেন।
১২-১১-২০২২
আজও সকালে সময়মতো গাড়ি এসে গেল। তৃষারা আজ প্রায় রেডি ছিল। গাড়ির হর্ণ বাজতেই সবাই প্রায় এক সাথে নিচে নেমে আসল। অরুন রায়ের মন বেড়ানোর থেকে সাধু বাবার উপস্তিতি নিয়েই বেশি ভাবিত। তিনি গাড়িতে ওঠার আগের মুহুর্ত পর্যন্ত এদিক ওদিক নজর রাখছিলেন, যদি সাধু বাবার দেখা পান।
গাড়ি ছাড়ল, প্রধান গন্তব্যস্থল গ্যাংটক, সঙ্গে কয়েকটি অন্যান্য সাইডসিন। গ্যাংটক শৈত্য শহরটি সিকিমের রাজধানী। আট হাজার বর্গ কিঃমিঃ আয়তনের এই শৈত্য শহরটি সমুদ্র পিষ্ঠ থেকে ছয় হাজার ফুট উচ্চে পূর্ব সিকিমে অবস্থিত।
প্রথমে হনুমান টক যাওয়ার জন্য গাড়ি এন এইচ টেন ছেড়ে সিকিম শহর রুট ধরল। যতই হাই হিলে গাড়ি উঠছে ততই ঠাণ্ডা বাড়ছে। এক সময় গাড়ি হঠাৎ গতি কমিয়ে দিল, তৃষাদের ড্রাইভার অন্য গাড়ির ড্রাইভারের কাছ থেকে জেনে বলল, ল্যান্ড স্লিপের পর পাহাড়ের সাইড বাঁধানোর কাজ চলছে। গাড়ির গতি একদম কম থাকায় সেই মেরামতটাও অরুন রায় ভাল ভাবে দেখতে পেলন। গ্যালবানাইজ্ড মোটা তারের নেট বানিয়ে ধস নামা স্থানে বসানো হচ্ছে, তারমধ্যে থান ইঁট সাইজের পাথর সাজিয়ে স্ট্রং সিমেন্ট গোলা ঢেলে পাথরের বাঁধনকে মজবুত করে নিয় তার ভিতরের অংশে গাছ লাগানো হচ্ছে। দেখতে দেখতে আবার গাড়ির স্পিড বাড়ল। প্রথমে পৌছুলেন অর্কিড স্যাংচুয়ারিতে, মন ভোলানো নানা রকম পাহাড়ি ফুল, অর্কিড ছাড়াও এখানে একটা নয়নাভিরাম ঝর্নাও চাক্ষুষ করলেন। তারপর সেখান থেকে গেলেন গনেশ টক। কলকাতার টেম্পল গুলোর মতো অত ভিরভাট্টা এবং অপরিষ্কার নয়। পরিচালন কমিটি এবং দর্শনার্থী উভয় দিক থেকেই বেশ সিস্টেমেটিক। এখানে কিছু সময় কাটিয়ে আবার গাড়ি ছাড়ল। গন্তব্য হনুমান টক। সুশোভন বলল- ” হনুমান টক সম্পূর্ণ ইন্ডিয়ান আর্মির আণ্ডারে। ওখানে জেনারেল পাবলিককে কোনো ব্যাবসা করতে দেওয়া হয় না। শুধুমাত্র দর্শনার্থী রূপেই প্রবেশাধিকার।”
চলন্ত গাড়িতে দুই দিকের অভুতপূর্ব দৃশ্য দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলেন হনুমান টক। এখানে ঠাণ্ডা একটু বেশিই লাগছে। প্রটেকশন নিয়েই সকলে মিলে মন্দির চত্তর ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলেন। খিদে’ও পেয়েছে। সুশোভন মিলিটারি ক্যান্টিনে খাবারের অর্ডার দিয়ে এসে বলল-” মশলা ধোসা আর কফির অর্ডার দিলাম। আশি টাকা পার হেড।” ক্যানটিনটা একটা ম্যালের উপর অবস্থিত। অনেক বেঞ্চ পাতা, সেই অনুযায়ী পর্যটক নেই। অরুন রায় মন্দিরের কাছাকাছি একটা বেঞ্চে পাহাড়ের খাদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসলেন।চোখ বন্ধ অবস্থায় কখন যেন সেই সাধুবাবার অস্পষ্ট অবয়বটা তাঁর স্মৃতিপটে চলে এল–এক প্রশ্ন তাঁকে কুরেকুরে খাচ্ছে, কে এই সাধু বাবা? কেনই বা তাঁকে কয়েক সেকেন্ড দেখা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে?? তিনি কি কিছু বলতে বা বোঝাতে চাইছেন?? তিনি তো আমার সামনাসামনি হয়ে তাঁর বক্তব্যটি বলতে পারতেন। ” কি ভাবছিস বেটা, এতো –” বাংলা হিন্দিতে মেশানো কথাটা কানে আসতেই অরুন রায় মুদিত চোখ চেয়ে চমকে উঠলেন। চক্ষু সম্মুখে দণ্ডায়মান এক পুরহিত গোছের মানুষ। কৃষ্ণ বর্ণ,ফুট ছয়েক লম্বা, এই শীতে গায়ে একটা ছোট সাদা থান জড়ানো, অর্ধ আদুল কলেবর থেকে যেন একটা জ্যোতি বিরাজমান। অরুন রায় চরম বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে তাঁর দিকে চেয়ে থাকলেন। মৃদু হাস্যমুখে সাধুবাবা বললেন-
–“এতো কি ভাবছিস? লক্ষে অবিচল থাক,বিচলিত হবি না,অন্তর আত্মার ডাকে সাড়া দে, অভিষ্ঠ লাভ হবেই হবে। বেড়াতে এসেছিস আনন্দ উপভোগ কর। এই নে হনুমানজির প্রসাদ,( সাধুবাবা অরুন রায়ের হাতে একটা লাড্ডু দিয়ে) খা বেটা।”
অরুন রায় লাড্ডু সহ করজোড়ে সাধুবাবাকে নত মস্তকে প্রণাম জানালেন। ” কি ব্যাপার আপনি মন্দিরের পিছনে দাঁড়িয়ে হনুমানজীকে প্রনাম করছেন?” অরুন রায় চোখ খুলে দেখলেন কোথায় সেই সিদ্ধ পুরুষ! এতো সুশোভন!! জোড় হাত উন্মুক্ত করে লাড্ডুও দেখতে পেলেন না। জামাতা একটু অবাক হয়ে বলল-” খারার দিয়েছে চলুন।”
অরুন রায় একটা ঘোরের মধ্যে আছেন। কাউকে কিছু বলতেও পারছেন না। একটা চাপা অস্বস্তি মনের ভিতর বয়ে চলেছেন। যাইহোক টিফিন পর্ব সেরে প্রধান গন্তব্যস্থল গ্যাংটকে যাওয়ার জন্য গাড়ি ছাড়ল। মধ্যে দুই একটা ছোটো টুরিস্ট স্পট ঘুরে তাঁরা গ্যাংটকের দিকে চললেন। ঘন্টা খানিকের মধ্যে গ্যাংটক ম্যালে পৌঁছে গেল। গাড়ি পার্কিং করে প্রথমে সকলে রোপওয়ে চাপতে গেল। অরুন রায়ের মন সায় দিলনা। তিনি গাড়িতেই অপেক্ষা করলেন। রোপওয়ে চাপা হলে তৃষারা মার্কেটিং এখান থেকেই সেরে নেয়। তারপর একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে লাঞ্চ করে। তারপর সূর্য ডোবার আগে পর্যন্ত ম্যালে বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
ঘন্টা দেড়েক গাড়ি চলার পর গাড়িটা অকস্মাৎ জোরে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। সেই সাথে মেঘ ডাকার মতো আওয়াজ। অরুন রায়ের স্ত্রী ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন। কোনো লোকালিটি নেই, শুধু পাহাড় আর বাঁশ গাছের জঙ্গল এবং ততধিক অন্ধকার। ড্রাইভার বলল সামনে দু’টো গাড়ির পর থেকে ল্যাণ্ডস্লিপ চলছে। আওয়াজটা তারই হচ্ছে। পুলিশের হাই পাওয়ার টর্চের আলোতে দেখা গেল অন্তত একশ ফুট উপর থেকে পাথর মিশ্রিত পাহাড়ি মাটি স্বশব্দে ভেঙে রাস্তায় এসে পড়ছে। উক্ত স্থানে কোনো বড় গাছ না থাকায় সমস্যা একটু কম হল।
ফরচুনেটলি টন টন ওজনের পাথর গুলো একটিও গাড়ির উপর এসে পড়ছেনা। কোনো এক অজানা শক্তি এ যাত্রায় তাদের বাঁচিয়ে দিল। প্রায় এক ঘন্টা ধরে চললো ধস বিপর্যয়। ল্যাণ্ডস্লিপ বন্ধ হতেই ডিজাস্টার কর্মিরা অতি তৎপরতার সাথে পুলিশের সহযোগিতায় রাস্তা পরিস্কারের কাজ শুরু করল। রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা জে সি পির ভূমিকা অরুন রায় মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারলেন। জে সি পি একটি গাড়ি পাস হওয়ার মতো রাস্তা পরিস্কার করতেই, পুলিশ ক্রমান্বয়ে দুই দিকের গাড়ি পাস করাতে শুরু করল। কারন উক্ত স্থানের দুই দিকের রাস্তায় হাজার হাজার গাড়ি অপেক্ষমাণ।
অনেক বিপদজনক পরিস্থিতির সাক্ষী হয়ে রাত নটা নাগাদ তৃষারা বাসায় ফিরল।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়।)