শুভঙ্কর আর প্রভাস রাত ন’টা নাগাদ নিতাই টি স্টলে গিয়ে ঢুকলো। নিতাইয়ের থেকে দুটো চা নিয়ে শীতের রাতে চাদর জড়িয়ে আরাম করে বসে, আয়েশ করে চা খেতে খেতে গল্প শুরু করল—
শুভঙ্কর— আর বলিস না, আমাদের
বাড়ির ডানদিকে যে দোতলা বাড়িটা আছে, ওটাকে ঘিরে আবার নতুন করে সমস্যা দেখা দিয়েছে।
প্রভাস— যে বাড়িটা কারোর কপালে শুট করছে না বলে চার পাঁচ বার হাত বদল হলো, ওই বাড়িটা?
শুভঙ্কর— হ্যাঁ, তাছাড়া আর কোনটা হবে!
প্রভাস— আবারও কি সেই ভুতুড়ে কেস?
শুভঙ্কর— একদম, রাতে ছাদে কারা যেন হাঁটে। দরজার ,জানালার ছিটকানি দেওয়া থাকলেও কারা যেন তা খুলে দেয়।
প্রভাস— ধ্যাৎ, ভুত বলে কিছু আছে নাকি, কোনো অসাধু চক্র হয়তো তাদের সুবিধার জন্য ওই সব ভৌতিক কান্ড ঘটাচ্ছে।
পাশের টেবিলে বসে মুড়িশুড়ি দিয়ে কফি খাচ্ছিলেন প্রণব বোস। মাঝ বয়সী, অনেক বিষয়ে অভিজ্ঞ মানুষ। চাদর দিয়ে মুখ ঢাকা ছিল বলে শুভঙ্কর,প্রভাস বুঝতে পারেনি। ওদের কথোপকথন শুনে কফিতে শেষ চুমুকটা দিয়ে বললেন—” কি-রে প্রভাস, ভুত নেই তোকে কে বলল? এই যে এখানে আমরা এতগুলো মানুষ বর্তমান, এর মধ্যে কেউ তো প্রেত আত্মা থাকতে পারে, যে মানুষের ছদ্মবেশ ধরে আমাদের মধ্যে রয়েছে। আমরা বুঝতেও পারছিনা।”
প্রভাস— তাহলে তুমি বলছো ভুত আছে?
প্রণব— আলবাত আছে, যদি আত্মা অলীক চিন্তা ভাবনা হত তাহলে হাজার হাজার বছর ধরে তাকে নিয়ে এত চর্চা হত না। সেই প্রাচীন মিশরীয় যুগ থেকে আত্মা নিয়ে রিসার্চ চলছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলিম প্রতিটা ধর্মে তাদের ধর্মগ্রন্থে আত্মার উল্লেখ আছে। এগুলোর সবই কি তাহলে মিথ্যা? না, মিথ্যা নয়, তারা আছে, এবং ইহলোকের মানুষের মধ্যে তাদের অপূর্ণ ইচ্ছাকে পূরণ করতে আসে। কিছু বলতে বা বোঝাতে আসে, আমরা তার বক্তব্য না বুঝে ভয় পাই। কিন্তু তারা আমাদের কোনো ক্ষতি করতে আসে না, ক্ষতি করতেও পারে না। যদি পারতো তাহলে কত খুন খারাপির রহস্য উন্মোচন হয়ে যেত। এই প্রয়োজন মানুষেরও হয়, তখন প্ল্যানচেট করে আত্মাকে এনে অজানাকে জেনে নেওয়া হয়। যদিও এটা খুব সহজলভ্য সিস্টেম নয়। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে বার কয়েক প্ল্যানচেট করে আত্মাকে আনা হয়েছিল, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্ল্যানচেট বিষয়ক লেখা গুলো পড়লে দেখবি আত্মার উপস্থিতি সম্পর্কে অনেক ধারণা বেড়ে যাবে।
শুভঙ্কর— তাহলে তোমার কথা অনুযায়ী, আত্মা আসে তার প্রয়োজনে, প্রয়োজন ফুরোলে চলে যায়। আমাদের পাড়ার ওই ভুতুড়ে বাড়িরও ওই রকম কোনো ব্যাপার ঘটছে।
প্রণব— নিশ্চই,কোনো ভাল তান্ত্রিক ডেকে ওই বাড়িতে যারা যারা আজ পর্যন্ত মারা গেছে তাদের অতীত বলতে হবে। তান্ত্রিকই সমাধান করে দেবে।
প্রভাস— কেন,তান্ত্রিক ছাড়া আর কেউ পারবেনা??
প্রণব— সাধারণ মানুষ? (একটু হেসে) ভয় পাবে, কারোর লাভ হবে না। প্রেত আত্মার সাথে কথা বলার জন্য মনের সাহস এবং জোর থাকতে হবে। সেটা ক-জনের আছে!
শুভঙ্কর— তোমার জানা এমন ঘটনা কোথাও ঘটেছে?
প্রণব— ঘটেছে, এবং সেটা আমার জীবনে।
শুভঙ্কর— বলো কি, আমার গায়ে তো কাঁটা দিয়ে উঠছে। বলোনা শুনি,অন্তত একটা অভিজ্ঞতা তো হবে।
প্রণব বোস বলা শুরু করল তার জীবনে ঘটে যাওয়া সত্য কাহিনী——-
“প্রথমে আমি আমার একটা শোনা ঘটনা বলি। তারপর আমার অভিজ্ঞতার গল্পটা শোনাব–
আমার তখন বছর দশেক বয়স। থাকতাম গ্রামের বাড়িতে, মুসলিম পাড়া, গরিব মুসলিম সম্প্রদায়ের বসবাস। যতই গরিব হোক না কেন এক দেড় বিঘার একটা করে বাগানআলা ভিটে বাড়ি ছিল। আর একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, ওই পরিবারে কেউ মারা গেলে নিজেদের জমিতে কবর দিত। আলাদা কোনো গোরস্থান ছিল বলে জানতাম না। এমন এক গরিব পরিবারে গৃহকর্তা হঠাৎ মারা গেলেন। রেখে গেলেন পাঁচ পাঁচটা নাবালক সন্তান ও স্ত্রীকে। বিধবা স্ত্রী কোনোমতে কষ্টেশিষ্টে পাঁচ সন্তানকে নিয়ে দিন গুজরান করছে। একদিন রাতে ঘটল ঘটনাটা–
রাত তখন বড়জোর দশটা, গ্রামতো মনে হচ্ছিল মাঝরাত। সন্তানরা সব অকাতরে ঘুমোচ্ছে। বিধবা ভদ্র মহিলার পেটের যন্ত্রনায় ঘুম ভেঙে গেল। এমন বেগ এসে গেল যে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেই হবে। গ্রামে গরিব মানুষ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য নিজেদের বাগানকেই ব্যবহার করত। সুতরাং বিধবা মহিলা বদনা নিয়ে ছোটেন বাগানের দিকে। কিন্তু বেশিদূর এগুতে পারেননি, স্বামীর কবরের কাছাকাছি গিয়ে বসে পড়েন। এতক্ষন লুজমোশানের জন্য কিছু টের পাননি। চারদিক ঘন অন্ধকার, মিনিট খানিক পরে একটু স্বস্তি পেতেই তার মনে হল, কে যেন এই অন্ধকারে তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক সেকেন্ড পর মনে হলো কে যেন তার কাঁধে হাত রাখল, ঘাড় ঘোরাতেই মনে হলো হাতটা সরিয়ে নিল। তখন তিনি উঠে চলে আসার অবস্থায় নেই। চিৎকার করে ডাকলেও কারোর কান পর্যন্ত পৌঁছাবে না। স্বামীর কবরের দিকে অটোমেটিক চোখ চলে যায়। মহিলা দেখতে পান, একটা ছায়া মূর্তি কবর থেকে উঠে বাগানের ভিতর দিকে চলে যাচ্ছে। আল্লাকে ডাকা ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিলনা। এরপর তিনি দেখলেন অনতিদূরে মোটা আম গাছটার গোড়ায় ছায়া মূর্তিটি দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকছে। মহিলা তখন উপায়ন্তর না দেখে ভয়ে কাতরাতে কাতরাতে বলেন-” তুমি আমাকে যে ডাকছ, তুমি তো আমাদের কারোর কথা না ভেবে চলে গেলে , এখন আমি গেলে তোমার ওই ছোট ছোট ছেলেমেয়ে গুলোর কি হবে, কে দেখবে ওদের?” এই কথা বলার পর মন্ত্রের মতো ফল ফললো। ছায়া মূর্তি সরে গিয়ে বাগানের সাধারণ নিস্তব্ধতা ফিরে এলো।
গল্পটা বলে প্রণব বোস বললেন, ঘটনাটা যদি সত্যি হয় তবে ওই মুসলিম ভদ্র লোকের আত্মা তার স্ত্রী কে কিছু বোঝাতে চেয়েছিল, বিধবা না বুঝতে পেরে ভয়ে জড়সড় হয়ে যেটুকু বুঝেছে তার উত্তর দিয়েছে। আত্মাও তাকে নিষ্কৃতি দিয়ে সরে গেল। বিতর্কে যাবনা, কারণ এসব ঘটনা যুক্তি তর্ক দিয়ে ব্যাখ্যা হয় না, এটা উপলব্ধির ব্যাপার। এবার শোন আমার জীবনে ঘটা উপলব্ধির ঘটনাটা।
বছর পনেরো ধরে আমি একটা দুস্থ পরিবারকে মাসোহারা দিয়ে আসছি। এর আগে দিতাম কালেভদ্রে, এখন যেটা তারা পেয়ে থাকে অন্যান্য আত্মীয়দের কাছ থেকে। পরিবারটিতে সবাই অন্ধ। আগে এমন ছিলনা, সকলেরই চোখের সমস্যা থাকলেও দেখতে পেত। কপাল দোষে বর্তমানে সবার জীবনে অন্ধত্ব ঘনিয়ে এসেছে। যাইহোক, পেনশন ভোগী মানুষের মতো আমার ওই সামান্য মাসোহারার জন্য দিন গুনত। মা দুই ছেলের সংসার, ছোট ছেলেটি যখন অল্প বিস্তর চোখে দেখে, তখন সে বিয়ে করে বসে। আমি মনঃক্ষুন্ন হয়েছিলাম বটে, তবে পারিপার্শ্বিকতার ভাবনা থেকে বুঝেছিলাম ওদের পরিবারে একটা সুস্থ মানুষেরও প্রয়োজন আছে। বিয়ের বছর খানিকের মধ্যে বড় ছেলেটি মারা যায়। পারলৌকিক কাজ মেটাতে গিয়ে জেনে ছিলাম ছোট ছেলের বউ সন্তান সম্ভবা। একটু রাগারাগি করেছিলাম বটে, তবে ভাবনাটা এক তরফা ছিল। এই ভাবে কেটে গেল আরও পাঁচ সাত বছর। এরই মধ্যে আমি শুনলাম, বৃদ্ধার নাতনির পিঠে আবার এক নাতি হয়েছে, প্রায় বছর খানিক হয়ে গেল, ভয়ে আমাকে বলেনি, যদি আমি রাগারাগি করি। ওদের অনুমান ঠিকই ছিল, আমি জেনে হুলুস্থুল কান্ড করে ছিলাম। অনেক কটূক্তি এবং অত্যুক্তিও করে ছিলাম। সর্বোপরি আমার একটা উক্তিই বৃদ্ধার মনে দুশ্চিন্তার জন্ম দিয়ে ছিল। বৃদ্ধাকে বলেছিলাম–“নিজেরা কি খাবে তার ঠিক নেই সদস্য বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। আপনি গত হলে আমি একটি টাকাও দেবনা। বুঝবে তখন আপনার ছেলে।” আমার অহংকারী মানসিকতার অতিশাসনে ওই পরিবারের তিনজন প্রাপ্ত বয়স্ক সদস্য মাথা নিচু করে ছিল, একটি বাক্যও ব্যায় করেনি। কিছু কি বলতে পারত না? পারত, বলেনি কারণ ওদের মানসিকতা আমার অহংকারী মনের থেকে অনেক উঁচুতে বিরাজ করছিল। আমি পরে বুঝেছিলাম ওই অন্ধ পরিবারে মধ্যরাতে ঈশ্বর সূর্যের ন্যায় পুত্র সন্তানটি প্রেরণ করেছেন,যে কিনা বড় হয়ে মানুষ হয়ে মা বাবার জীবনে নুতন ভোরের সূচনা করবে। পরাশ্রয়ী হয়ে কোনো মানুষ বাঁচতে চায়!!
এই ঘটনার মাস ছয়েক পরে আমার পরিবারে একটা অঘটন ঘটে গেল। আমি এবং আমার স্ত্রী মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলাম। আমার থেকে বেশি হতাশায় ভুগছিলেন ওই অন্ধ বৃদ্ধা, যদি তাঁর মাসোহারা বন্ধ হয়ে যায়। চিন্তায় চিন্তায় তাঁর সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়ে গেল। সরকারি হাসপাতালে সপ্তা খানিক যমে মানুষে টানাটানি করে জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়ে বাড়ি ফিরলেন বটে তবে না ফিরলেই ভাল হত। ডান অঙ্গ সম্পূর্ণ প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিল। জড়িয়ে জড়িয়ে কোনো রকমে কথা বলতেন। শুনলাম কেউ কথা বললেই আমার নাম ধরে ডাকতেন। আমাকে অনেকে বলেছিল একটু দেখা করে আসতে, কিন্তু আমি নিজের কাজের ফাঁকে সময় করে উঠতে পারিনি। তবে আমার মনে হয়েছিল উনি তো বুঝতে পেরেছিলেন যে আর বাঁচবেননা, সেই জন্য আমাকে হয়তো অন্ধ ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলতেন “ওদের দেখো।” যাইহোক এই ভাবে সপ্তা দুয়েক উনি বেঁচেছিলেন। মৃত্যুর পর আমি গিয়েছিলাম, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দাহ কার্য সম্পন্ন করেছি। পরে শ্রাদ্ধে আমি যেতে পারিনি, তবে অনুষ্ঠানের দায়িত্ব থেকে সরে আসিনি। শুধু আমি নই, কিছু আত্মীয় স্বজন বৃদ্ধার ছোট ছেলেকে ভালোই অর্থ সাহায্য করেছে।
এই পর্যন্ত বলে প্রণব বোস নিতাইয়ের দেওয়া দ্বিতীয় রাউন্ড গরম গরম চায়ে ঠোঁট ঠেকিয়ে বললেন— তোরা ভাবছিস, প্রণবদা ধান ভানতে শিবের গীত গায় কেন, এ-ত নিজের ঢাক নিজেই পেটাচ্ছে। আসলে আত্মার ইতিহাস না জানলে অস্তিত্বও টের পাওয়া যায় না।
শুভঙ্কর —-এর পরে কি তুমি আত্মাকে দেখেছিলে?
প্রণব বোস—-না, অনুভূতি দিয়ে অনুভব করেছিলাম।
প্রভাস— কি রকম?
প্রণব বোস—ওই ঘটনার ঠিক দুই মাস পরে ঘটল একটা ঘটনা—
আমার বাড়িতে কেউ নেই, সবাই বেড়াতে গেছে। আমি একাই বাড়িতে আছি। রাতে শুয়েছি, আমার মধ্য রাতে একবার টয়লেটে যাওয়ার অভ্যাস আছে। অভ্যাসবশত আমি রাত দুটো নাগাদ টয়লেটে উঠেছি, টয়লেট থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে, লাইট অফ করে শুয়েছি। তখনো ঘুম আসেনি, হঠাৎ শুনতে পেলাম বাইরের ঘরের দরজাটা আস্তে আস্তে খুলছে। আমি একটু সতর্ক হলাম, মনে হল পাশের ঘরে কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে। আমি কান খাড়া করে শুনছিলাম, কিন্তু কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারিনি। ভোরের দিকে যখন ঘুম ভাঙল, তখন মনে পড়লেও ঘুমের ঘোরের ভুলভ্ৰান্তি মনে ভেবে ব্যাপারটা ভুলে গেলাম। আসলো দ্বিতীয় রাত, লাইট অফ করে যেই শুয়েছি গত রাতের মতো সেই একই ঘটনা, আমি না ঘুমিয়ে খেয়াল করতে থাকলাম ব্যাপারটা। মিনিট খানিক বাইরের ঘরে পায়ের শব্দ হওয়ার পর সব নিস্তব্ধ। হঠাৎ আমার শোয়ার ঘরের দরজা মৃদু আওয়াজে আস্তে আস্তে খুলে গেল। আমি বিছানাতে মড়ার মতো ঘাপটি মেরে পড়ে থাকলাম। দ্বিতীয় দিনেও আমি কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা। দিনের বেলা কাজকর্মে থাকি ফলে রাতের ঘটনা আর মাথায় থাকে না। পরদিন রাতে শোয়ার পর ঘুম না আসা পর্যন্ত গত দুদিনে মধ্য রাতের ঘটনাটা নিয়ে ভাবতে থাকলাম। কোনো অশরীরী আত্মা যে আসছে সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু কার আত্মা? আমার কাছে তার কি-বা প্রয়োজন!! ক্লান্ত শরীর ভাবনার মধ্যে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙে জানালার শব্দে। চোখ খুলতেই ঘুমঘুম চোখে দেখি মাথার সামনের জানালাটা একবার বন্ধ হচ্ছে, একবার খুলছে। ঝড় উঠেছে ভেবে বন্ধ করে দিয়ে টয়লেটে গেলাম। বেরিয়ে এসে ঘড়িতে দেখলাম, রাত দুটো দশ। শুয়ে পড়লাম মনে একটা খটকা নিয়ে। কোনো ঝড় ওঠেনি, তাহলে জানালাটা অমন খোলা বন্ধ হচ্ছিল কেন? তবে কি হঠাৎ দমকা বাতাস!! বুঝলাম এই বার, রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে গত দুইদিনের মতো বাইরের দরজা খোলার শব্দ। আমি চুপ করে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকলাম। কয়কে সেকেন্ড পর বাইরের ঘরে হাঁটার শব্দ পেলাম। বুঝতে পারলাম তার পদধ্বনি, কিন্তু কে?? হঠাৎ আমার দশ বছর বয়সে শোনা সেই মুসলিম বিধবার গল্পটা মনে পড়ে গেল। সেই সাথে মনে পড়ল, অন্ধ বৃদ্ধাকে রেগে বলেছিলাম তিনি মারা গেলে আমি আর মাসোহারা দিতে পারবনা। ওনার শ্রাদ্ধের সময় অনেকে অন্ধ ছেলের হাতে সাধ্যমতো অর্থ সাহায্য করেছিল, ফলে আমি মাস দুই আর মাসোহারা পাঠাইনি। চোখ বন্ধ করে আমি অঙ্কটা মেলানোর করছি। হঠাৎ ক্যাঁ- চ শব্দে আমার শোয়ার ঘরের দরজা খুলে গেল। তার পর ঘরের এল প্যাটার্ন ফাঁকা জায়গাতে হাঁটার শব্দ আমার কানে আসতে থাকল। আমার শীয়রে আত্মার বিচরণ, মনে হলো আমার মধ্যে আমি আর নেই। ভয়ার্ত মনেই আমার কাছে অঙ্কটা পরিষ্কার হয়ে গেল। ভয় না পেয়ে, মনকে দৃঢ় করে মৃদু স্বরে বললাম-” আপনি ফিরে যান, আমি কথা দিচ্ছি যতদিন না আপনার নাতি বড় হয়ে সংসারের হাল ধরছে আমি ততদিন আমার সাধ্য মতো মাসোহারা পাঠাব।” রীতিমতো অবাক করে মিনিট খানিকের মধ্যে সবকিছু শান্ত। মনে হচ্ছিলনা যে এতক্ষন এখানে দুই লোকের দুই আত্মার মধ্যে বোঝাপড়া চলছিল। আমার সাধ্য মতো মাসোহারা পাঠাব।” রীতিমতো অবাক করে মিনিট খানিকের মধ্যে সবকিছু শান্ত। মনে হচ্ছিলনা যে এতক্ষন এখানে দুই লোকের দুই আত্মার মধ্যে বোঝাপড়া চলছিল।
প্রভাস— তারপর??
প্রণব বোস— পরদিন গত দুই মাসের মাসোহারা পাঠিয়ে দিলাম। এবং সেই রাত থেকে আর তাঁর অস্তিত্ব টের পাইনি। আজও চালু আছে সেই মাসোহারা।
সকলে সত্য ঘটনাটা শুনে স্তম্ভিত। নিস্তব্ধতা ভেঙে নিতাইদা বলল “ওঠো সবাই, অনেক রাত হয়েছে দোকান বন্ধ করবো।”