জলের আরেক নাম – জীবন। জল ছাড়া কোন প্রাণী বাঁচতে পারে না। তাই গ্রহান্তরে প্রাণের সন্ধান করতে গেলে প্রথমেই বৈজ্ঞানিকদের জলের অনুসন্ধান করতে হয়। যে গ্রহে জল নেই, সেখানে প্রাণের অস্তিত্বও নেই। প্রোটোজোয়া, ব্যাকটেরিয়া কিংবা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী, যাই হোক না কেন, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জল তার চাই। জল জীবকোষকে নমনীয় রাখে। রক্তের 56% জল। তাই রক্ত শিরা উপশিরায় সহজেই প্রবাহিত হয়। জলজ প্রাণীরা জল থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করে বাঁচে। এমনকি উদ্ভিদদেরও বাঁচতে গেলে জলের প্রয়োজন।
পৃথিবীর তিন ভাগ, জল এক ভাগ স্থল। তবু জলের জন্য হাহাকার যেন পিছু ছাড়ে না মানুষের। উঁচু পাহাড়ে অভিযানে গেলে মানুষকে জল কিনে খেতে হয়। মরুভূমিতে জলের অভাবে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয় না। শুধু ক্যাকটাস, বাবলা, খেজুর ইত্যাদি উদ্ভিদ যারা জলের পরিবর্তে বায়ু থেকে জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করে বাঁচতে পারে তারাই জন্মায়। প্রাণীকুলের মধ্যে একমাত্র উটই আছে, যে মরুভূমিতে জল ছাড়া চলতে পারে। তবু তাদেরও এককালীন জল সংগ্রহ করে পাকস্থলীতে জমা রাখতে হয়। মরুভূমি পারাপার করতে গেলে মানুষের পথ ও সময় অনুসারে পর্যাপ্ত জল সঙ্গে না নিয়ে গেলে মৃত্যু অবধারিত।
প্রাকৃতিক জলের উৎস নদীগুলি আর বৃষ্টির জল। নদীর জল যেখানে পৌঁছায় না, সেখানে মানুষ বৃষ্টির জলের সাহায্যে প্রয়োজন মেটান। এই বৃষ্টির জল ভূত্বক শোষণ করে ভূগর্ভে পাঠিয়ে দেয়। যা মাটি খুঁড়ে আমরা পাই। নদী গতিপথ পরিবর্তন করলেও ভূগর্ভ সঞ্চিত জল বহুদিন পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে।
শিলা চুর্নের সঙ্গে জল মিশ্রিত হয়েই মাটি গঠিত হয়। আর সেই জল সংরক্ষণের মাধ্যমে জীবাণুরা অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয় বলেই মাটি নরম থাকে। মাটিতেই উদ্ভিদের জন্ম হয়। যা আমাদের জৈবিক ক্ষুধা নিবৃত্ত করে।
পার্বত্য অঞ্চলের মধ্যে শুধু ভঙ্গিল পর্বতমালাতেই উদ্ভিদ জন্মাতে পারে। কারণ ভঙ্গিল পর্বত সমুদ্র থেকে উত্থিত হয়। সমুদ্রের পলিমাটি তার মধ্যে সঞ্চিত থাকে। বলা বাহুল্য, আগ্নেয় পর্বত কিংবা ক্ষয়জাত পর্বতের কঠিন শিলায় উদ্ভিদ জন্মাতে পারে না। সেখানকার অধিবাসীদের বর্ষা কিংবা ঝর্ণার জলের উপর নির্ভর করতে হয়।
শহরাঞ্চলে পৌর কর্তৃপক্ষ যে পানীয় জল সরবরাহ করে থাকে, সে জল প্রসেস করতে লিটারে অন্তত পাঁচ টাকার মতো খরচ হয়। অথচ শহরবাসীদের অনেকেই সে খবর রাখেন না। তারা যথেষ্ট জল অপচয় করেন। এমনকি কাজ শেষ হয়ে যাবার পরও কল খোলাই রেখে দেন। পানীয় জল দ্বারা ময়লা বস্ত্র ধৌত করেন। সেই পানীয় জল দ্বারায় সারেন প্রক্ষালন।
বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে জল যেরকম বাষ্পীভূত হচ্ছে। বিপরীতে তেমনি মেরু প্রদেশের সঙ্গে পর্বতশৃঙ্গ -এ বরফ জমতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ফলে নদীগুলো যথেষ্ট জল পাচ্ছেনা। সেগুলো ক্রমশ নাব্যতা হারাচ্ছে। ক্রমশ স্রোতহীন হয়ে পড়ছে। পলি ধুয়ে নিয়ে সাগরে ফেলার জন্য অক্ষম হয়ে পড়ছে।
নদীর জল বিভিন্ন সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে ফসলের জমিতে সরবরাহ করা হয়। নদীতে জল কমে গেলে সেচ ব্যাবস্থা ব্যাহত হয়। শুধু তাই নয়, শহরাঞ্চলে জমি, বাড়ি, ঘরও বসে যায়। পুকুর বা কুয়োর জল শুকিয়ে যায়। সমতল মরুসদৃশ্য হয়ে পরে। জলের জন্য হাহাকার শুরু হয়ে যায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে।
জল পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর অভাব দূরীকরণের জন্য আমাদের উচিত –
১. বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করা। ২. জলের অপচয় রোধ করা। ৩. গ্রামাঞ্চলে আরও পুকুর কিংবা দীঘি খনন করা। ৪. সেচ খাল নির্মাণ করে নদীর জোয়ারের জল ধরে রাখতে হবে। সেই খালে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য লকগেট নির্মাণ করে পরিবহনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে ভূগর্ভের জলস্তর সহজে নেমে যাবে না। প্রয়োজনে মাছ চাষ ও চলবে বিদ্যুৎ উৎপাদন। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের রাঙামাটি জেলায় কাপ্তাই নদীতে বাঁধ দিয়ে এমনটাই করা হয়েছে।
পরিস্থিতি বুঝে সম্ভব মতো অন্যান্য ব্যবস্থা অবলম্বন করা উচিত।