দূষণের আদ্যপ্রান্ত
আমাদের বাসভূমি এই নীল গ্রহের সুন্দর পরিবেশ দিনে দিনে দূষিত হয়ে পড়ছে। সচেতনতার জন্য এই সংক্ষিপ্ত লেখাটি দয়া করে পুরোটা পড়বেন। “সবুজ স্বপ্ন”-এর সাথে যুক্ত হতে visit করুন – https://sabujswapna.org/environment/
এই লেখাটির শেষে “পরিবেশ দূষণ” সম্পর্কিত একটি প্রশ্ন দেওয়া আছে। আমাদের Email / WhatApp -এ তার সঠিক উত্তর পাঠিয়ে একাধিক ভাগ্যবান বিজেতারা পেতে পারেন একটি বিশেষ আকর্ষণীয় পুরস্কার। পুরস্কারের দিনটি Website-এ জানিয়ে দেওয়া হবে।
‘দূষণ’ শব্দটি বর্তমানে কিছু মানুষের কাছে অতি অবহেলিত এক বর্ণগুচ্ছে পরিণত হয়েছে। এই শব্দটি শুনলে তারা নিজ শ্রবণেন্দ্রিয়টিকে যথাসম্ভব বিমুখ করে রাখতে সচেষ্ট থাকেন। এদের কারণেই লেখচিত্রের মাপকাঠিতে দূষণের মাত্রা আজ ভয়ঙ্কর গতিতে ঊর্ধ্বগামী। অদূর ভবিষ্যতে এই দূষণের কারণে যদি মানবসভ্যতা অস্তিত্ব হারাতে বসেছে বলা হয়, তাহলে মনে হয় অত্যুক্তি হবে না।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে পূর্বে কি মানুষ দূষণ ছড়াতো না ?
উত্তর, নিশ্চয়ই ছড়াতো। আগেও তারা কাঠের আগুন জ্বেলে ভোজ্য তৈরি করতো। শীতে কাঠ জ্বেলে আগুন পোহাতো। আগুন জ্বেলে হিংস্র পশুদের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতো। আহারের জন্য আগেও তারা পশুপাখি হত্যা করতো। কিন্তু তা করতো বিক্ষিপ্তভাবে। আধুনিক যুগের মতো নিশ্চয়ই কলকারখানা গড়ে কোন বিশেষ স্থান-এর পরিবেশ দূষণ করতো না। কিংবা নদীপথে বাঁধ দিয়ে পলির স্বাভাবিক সম্প্রসারণ বন্ধ করতো না, যা জমিকে উর্বর করতে সাহায্য করতো। এখনকার মতো তারা পাহাড় কেটে, ভূগর্ভের কয়লা, খনিজ তেল, জল তুলে ভূ-ত্বকের এবং বায়ুমণ্ডলের ক্ষতিসাধন করতো না। আসলে প্রাণীকুল তখন ছিল ন্যূনসংখ্যক। তাদের সৃষ্ট ক্ষতিটুকু প্রকৃতি অতি সহজেই পূরণ করে নিতে পারতো।
বর্তমানকালে, যে হারে জনবিস্ফোরণ ঘটে চলেছে, পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের চাহিদা। তাতে এক ফসলী জমিতে রাসায়নিক সার প্রয়োগের মাধ্যমে বছরে দুবার, এমনকি তিন বারও খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে হচ্ছে খাদ্য সংস্থান-এর জন্য। এতে জমির স্বাভাবিক উর্বরতা যেভাবে লোপ পাচ্ছে তেমনি ফসলের খাদ্যগুণ এবং উৎকর্ষতাও হ্রাস পাচ্ছে। খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ব্যাহত হচ্ছে।
অপরদিকে, সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষকে বাসস্থানের চাহিদা মেটাতে হচ্ছে অরণ্য ধ্বংস করে। শহরাঞ্চলের কোথাওবা বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করে জলাভূমি বুজিয়ে তৈরি হচ্ছে বহুতল আবাসন। কোথাও নদীর দুই পাড়ে বোল্ডার ফেলে জমি তৈরি করতে হচ্ছে। এতে নদীর গতিপথের প্রশস্ততা হ্রাস পাচ্ছে। নদীর বয়ে আনা পলি যা উদ্ভিদ বৃদ্ধির সহায়ক, সে কথা না হয় বাদই দিলাম।
কথায় আছে “জঙ্গলই মঙ্গল”। কোন দেশের মোট জমির তিন-চতুর্থাংশ বনভূমির জন্য সংরক্ষিত রাখা বাঞ্ছনীয়। অথচ মানুষ নিজের স্বার্থে সেই জমি অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। গাছ এবং বন্যপ্রাণীরা আজ চোরা শিকারিদের দৌরাত্ম্যে বিপন্ন। অরণ্য তো লোপ পাচ্ছেই, তার সঙ্গে লোপ পাচ্ছে বন্যরাও।
যেমন, বাঘেদের কথাই ধরা যাক। পূর্বে বাঘ শিকার একটা আনন্দবর্ধক খেলা হিসাবেই গণ্য হতো। রাজা মহারাজারা বাঘ হত্যা করে তাদের বীরত্ব প্রদর্শন করতেন। 1975 সাল থেকে তা ভারত সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। কিন্তু যখন ঘোষিত হয় তাদের সংখ্যা প্রায় শূন্যতে নেমে এসেছিল। অভয়ারণ্য নির্মাণের ফলে বাঘের সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও চোরাশিকারীরা এখনো শিকার অব্যাহত রেখেছে বিভিন্ন কৌশলে।
বাঘের চামড়ার রস বিভিন্ন মহামূল্য এবং জীবনদায়ী ঔষধ তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাঘের নখ, দাঁত, দুধ কিছুই ফেলা যায় না। এই বাঘের আহার্য যে তৃণভোজীরা, তারা জীবনধারণ করে উদ্ভিদ এর সাহায্যে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে জীবজগত পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং সম্পূর্ণ জীবন রক্ষার জন্য উদ্ভিদ অপরিহার্য।
উদ্ভিদ শুধু আমাদের আহারেরই যোগান দেয় না, গৃহস্থালির প্রতিটি ক্ষেত্রে (দরজা, জানালা, খাট ও অন্যান্য আসবাবপত্র) তা ব্যবহৃত হয়। সবচেয়ে বড় কথা, নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমরা যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করি, উদ্ভিদেরা সেই বিষ খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে এবং প্রত্যুত্তরে অক্সিজেনের যোগান দিয়ে জীবজগতকে বাঁচিয়ে রাখে।
আবহমন্ডলের কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ খুবই কম (1.5% – 2% প্রায়)। এই গ্যাস দাহ্য নয় ঠিকই, তবে তাপ ধরে রাখতে সাহায্য করে। জীবাশ্ম জ্বালানী দহনের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্পাঞ্চলে সমজাতীয় গ্যাস কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন-মনোক্সাইড এর সঙ্গে কারখানা থেকে নির্গত সালফার-ডাই-অক্সাইড, CFC (ক্লোরো-ফ্লুরো-কার্বন), মিথেন এবং গাড়ির ধোঁয়ায় সীসাজনিত যৌগগুলো নির্গত হয়ে প্রতিনিয়ত ওজোন (O3) স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে। আর তার প্রভাবে সূর্যের মারাত্মক অতিবেগুনী রশ্মিগুলো (Ultra Violet Ray) সেই স্তরকে ভেদ করে পৃথিবীতে পৌঁছে বায়ুমন্ডলকে ক্রমশ উষ্ণতর করে চলেছে। তার প্রভাবে উত্তর ও দক্ষিণে হাজার হাজার বছরের সঞ্চিত বরফ আজ ধীরে ধীরে গলে জলে পরিণত হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের অভিমতে আন্টার্কটিকা কিংবা উত্তর মেরুর এই বরফগলা যদি আটকানো না যায়, অনেক দেশ শহর-গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার আশঙ্কা প্রবল। মালদ্বীপ, লাক্ষাদ্বীপ, আন্দামানের কিছু অংশ, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাঞ্চল এবং সমুদ্র স্তর থেকে সামান্য উচ্চতায় অবস্থিত দ্বীপগুলো বিলীন হয়ে যেতে পরে সমুদ্রগর্ভে।
বিশ্ব উষ্ণায়নের (Global Warming) প্রভাবে হিমালয়ের হিমবাহগুলো যে উচ্চতায় গলনাঙ্কে পৌছাতো, বর্তমানে সেই উচ্চতা আরও দুই কিলোমিটার উপরে অবস্থান করছে। ফলে পর্যাপ্ত জলের অভাবে গঙ্গা সহ ভারতের তথা বিশ্বের অন্যান্য দেশের দীর্ঘতম নদীগুলো একইভাবে আজ রুগ্নতায় ভুগছে। তাদের ক্ষীণ স্রোত পলি বয়ে নিয়ে আর সমুদ্রে ফেলতে পারছে না। ফলে বিভিন্ন জায়গায় চড়া জেগে উঠছে। নদীখাতগুলো ভরে যাচ্ছে পলিতে। বর্ষায় বন্যার জলে প্লাবিত হচ্ছে দুকুল। অথচ শুখা মরশুমে সেচের জন্য খাল কেটেও শস্য উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত জল পাওয়া যাচ্ছে না।
নদীর অববাহিকা নদীর জলেই পুষ্ট থাকে। সমভূমি যে মাটিতে গঠিত সে মাটির প্রধান উপাদান জল ও জৈবপদার্থ এবং জীবাণু। জলের অভাবে মাটি শিলা চূর্ণতে রূপান্তরিত হয়। নদীতে জল কমে যাওয়ায় অববাহিকায় জলস্তর ক্রমশঃ নিচে নেমে যাচ্ছে। এর কারণে শহরাঞ্চলে বাড়ি বসে যাচ্ছে, নদীর পাড় ভাঙছে, দেশ ক্রমশ মরুসদৃশ হয়ে পড়ছে।
বিশ্ব উষ্ণায়নের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো যুদ্ধ। আধুনিক যুগে প্রতিটি বোমা (আণবিক বোমা, হাইড্রোজেন বোমা ছাড়াও অন্যান্য বোমাগুলো) বিস্ফোরণ বায়ুমন্ডলকে দ্রুততর উষ্ণায়নের উচ্চ মাত্রায় পৌঁছে দিচ্ছে। শুধু তাই নয় বোমা তৈরীর উপকরণ সংগ্রহের সময়ও পারমানবিক চুল্লিতে (আকরিক থেকে রেডিয়াম, টিটেনিয়াম, প্লুটোনিয়াম নিষ্কাশনকালে) যে বিষাক্ত ভারীজল (Heavy Water) বাষ্পীভবন কিংবা সরাসরি জলে মেশে তাও সমুদ্রের জল ভান্ডারকে বিষাক্ত করে তোলে।
বর্তমানে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানবসৃষ্ট বর্ধিত এই বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে পরিবেশের ঋতুচক্র অসময়ে ঘুরতে শুরু করেছে। সমুদ্রে খুব ঘন ঘন ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় / টর্নেডো তৈরি হচ্ছে এবং তা স্থলভূমিতে আছড়ে পড়ছে। ফলে বাড়ি-ঘর সহ প্রচুর বৃক্ষ ধ্বংস হচ্ছে। এর ফলে দিন দিন বিশ্ব উষ্ণায়ন আরও বাড়ছে। তাতে ঘন ঘন নতুন ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা পরিবেশেরই এক দুষ্টচক্রে সম্পূর্ণ আবদ্ধ হয়ে পড়ছি, যেটা আরো ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে এগোচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সমগ্র জীবকুলের ভবিষ্যত প্রজন্ম আসন্ন সংকটের মুখে পড়ে যাবে। সুতরাং এখনই আমাদের সবাইকে সচেতন ও সাবধান হতে হবে এবং খুবই দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহন করতে হবে।
পৃথিবীর পরিবেশ কিভাবে দূষিত হচ্ছে ওপরের অনুচ্ছেদগুলিতে আমরা এই নিয়ে আলোচনা করলাম। এই বিষাক্ত পরিবেশে একমাত্র উদ্ভিদই আমাদের প্রকৃত বন্ধু। ফলে এইসব সমস্যার সমাধান করতে হলে আমাদের সর্বাগ্রে প্রয়োজন বৃক্ষনিধন বন্ধ করা। এর সঙ্গে বন্ধ করতে হবে পশু হত্যা। কারণ জঙ্গলে পশুপাখির মল মুত্র এবং উচ্ছিষ্ট মৃত পশু দেহই রূপান্তরে গাছ সার হিসেবে গ্রহণ করে। পাশাপাশি প্রয়োজন সমাজকে সচেতন করার মাধ্যমে শুরু করা সমাজ ভিত্তিক বৃক্ষরোপণ এবং বনসৃজন। কারণ বৃক্ষ কার্বণ-ডাই-অক্সাইড ধ্বংস করে বায়ুমন্ডলকে উষ্ণায়নমুক্ত করতে সাহায্য করে। এছাড়াও প্রস্বেদন (শিকড় দ্বারা মাটি থেকে জল গ্রহণ করে পাতার সূক্ষ্ম ছিদ্র দ্বারা নিক্ষেপ করা) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জলীয় বাষ্প নিষ্কাশনের মাধ্যমে বায়ুমন্ডলের আর্দ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। বৃক্ষের বজ্য পাতা ও শুষ্ক ডাল মৃত্তিকা তৈরি এবং বৃক্ষের শিকড় ভূমিক্ষয় রোধে সাহায্য করে।
পরিশেষে মানবসমাজে বৃক্ষের গুনাগুন বর্ণনাতীত। আবার বলছি বৃক্ষ আমাদের প্রকৃত সহকারি বন্ধু। তাই বৃক্ষছেদন নয়, বৃক্ষরোপণই আমাদের কর্তব্য। “একটি গাছ একটি প্রাণ, গাছ লাগান প্রাণ বাঁচান” এই মন্ত্রই আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত হোক। সবুজায়নই হোক আমাদের স্বপ্ন।
“সবুজ স্বপ্ন”-এর সাথে যুক্ত হতে visit করুন – https://sabujswapna.org
এই আশা রাখি যে, সবুজ স্বপ্নের পরিবেশ সংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মসূচিতে আপনাদের সবাইকে পাশে পাবো। আসুন আমরা সবাই মিলে এই জনসচেতনতার আন্দোলনে সামিল হই, নিজেদেরই ভবিষ্যত বাঁচাতে।
Ranjit Chakraborty (প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক – সবুজ স্বপ্ন)
Office – A/2, Subhasnagar Super Market, 2nd floor, Kolkata – 700065 (Beside Dum Dum Cantonment Rly Station)
প্রশ্ন : – পরিবেশ দূষণ মুক্ত করতে আমাদের কর্ত্তব্যগুলি কি কি ?