” দিদা ___ ও দিদা__” ঘাড় ঘোরালেন না সুপ্রভা। আবার ডাকল মিনু, ” কি গো শুনতে পাচ্ছো না? সাড়া দিচ্ছো না যে?” এবার ও উত্তর না দিয়ে নিজের কাজ করে যান সুপ্রভা। গামলায় ময়দা ঢেলেছেন খানিকটা। সেটাই একমনে চটকাচ্ছেন। ” রাগ করেছ? দেরী হয়েছে বলে? কী করব? মার শরীর খারাপ তো! আজ আসতে পারবে না। খুব জ্বর জানো! ঘরের কাজ সেরে ভাই বোন কে মুড়ি দিয়ে তবে এলাম। “ হাত থেমে যায় সুপ্রভার। আরতি তবে কাজে আসবে না আজ! চোখ তুলে তাকান মেয়েটার দিকে। সেই চাউনিতে কি দেখে মিনু কে জানে! তড়িঘড়ি বলে ওঠে, ” ভেবো না। আমি বাসন মেজে ঘর মুছে দেব। “ আরতি ই করে ওগুলো। অনেক দিনের লোক। তপু, রিমা কেউ ই তখনো বাইরে যায় নি। এ বাড়িতে কাজ করতে করতেই বিয়ে হল ওর। তিনটে ছেলে মেয়ে। বর টা মদো মাতাল। একদিন এসে কেঁদে পড়লো আরতি। ” বড় মেয়েটাকে তোমার কাছে রাখো মা। ওর বাপকে বিশ্বাস নেই। কখন কী করে! “ প্রথমে রাজি হননি সুপ্রভা। দরকার ই বা কী আর একটা লোকের! মানুষ মোটে দুজন। ছেলে, মেয়ে দুজনেই কর্মসূত্রে বাইরে। বিয়ে , ঘর সংসার ও সেখানেই। এদেশে আসার সম্ভাবনা ও নেই। উল্টে বাপ মাকেই সেখানে ডাকাডাকি। __ কী হবে ওখানে পড়ে থেকে? এ দেশে চলে এসো। দেখবে লাইফ কী____! হেসেছেন চিন্ময় ___ সুপ্রভা। এই বয়সে দেশ ছেড়ে, অন্য কোথাও থাকার চিন্তা করাই বাতুলতা। তবে ছেলে মেয়ের আগ্রহে ঘুরে এসেছেন একবার। ব্যস। নিজের সংসার , ভাঁড়ার, ঠাকুর ঘর নিয়ে দিব্যি আছেন সুপ্রভা।(অন্তত নিজেকে বোঝান সেটাই।) আর চিন্ময় বন্ধু বান্ধব, আড্ডা, আর বাগান। মাঝে মধ্যে ছেলে মেয়ের ফোন! কুশল সংবাদ বিনিময়! ব্যস! চলছে তো! এর মধ্যে আবার একজনকে ঢোকাতে চান নি । কিন্তু আরতির কথা ফেলতে ও পারছিলেন না। শেষে চিন্ময় ই বললেন, ” বলছে যখন রেখেই দাও মেয়েটাকে। সময় অসময়ে দরকার হতে পারে। আর কিছু না হোক তোমার কাছে কাছে ঘুরলে তোমার ও একা লাগবে না।” কয়েক মুহূর্ত চিন্ময়ের মুখের দিকে চেয়েছিলেন সুপ্রভা। চিন্ময় কি বুঝতে পারেন তার এককিত্ব! সব থেকেও কিছু না থাকার বেদনা! কি জানি! তবু মত দিলেন। আর সত্যি সুবিধে ও হল। বেশ চটপটে মেয়েটা। বুদ্ধি ও আছে। শিখে নিতে পারে খুব তাড়াতাড়ি। শুধু কাজে কর্মেই না! দুপুর বেলা টা পড়াতে বসে দেখছেন তো! ক’ দিন হল! এরই মধ্যে দ্বিতীয় ভাগ শেষ করে ফেলেছে ! এখন তো আর ওকে ছাড়া চলেই না তার। এমনিতে সারা দিন থাকে। রাতে মা নিতে এলে চলে যায়। ওই সময় টুকু বড় ভারী লাগে সুপ্রভার। ভাবেন মনে মনে আর জড়াবেন না নিজেকে এই সব বন্ধনে! কিন্তু হয় কই! সেই আবার!! ” আমাকে দাও। আমি ময়দা মেখে দিচ্ছি।” হাত বাড়ায় মিনু। ওর হাত সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ান সুপ্রভা। নিজেই বেলন চাকি টেনে নিয়ে বেলা শুরু করেন। কড়াই তে তেল গরম হয়ে এসেছে প্রায়। একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে মিনু। চেয়ে চেয়ে দেখে__ এরই মধ্যে আলুর দম, সিমুইয়ের পায়েস করে নামিয়ে ফেলেছেন সুপ্রভা। ওদিকে ভেটকি মাছ টাও ধুয়ে নুন হলুদ মাখানো। ফুলকপি কুটবেন সম্ভবত। বার করা আছে। ও বাবা! দু রকম মাছ! অন্যদিন তো এক রকমই হয়। কেউ আসবে? নিশ্চয়ই। নইলে এত জোগাড় কিসের? সক্কাল সক্কাল এত কিছু! কে !! কাল অব্দি কিছু শোনে নি তো! বড্ড রাগ করেছে দিদা। কথাই বলছে না। কি করবে মিনু! মার যে বড্ড জ্বর! তাই তো দেরী হল! না হলে ওর কি ইচ্ছে করে ওখানে পড়ে থাকতে! মন তো কেবলই চায় ছুটে চলে আসে এ বাড়িতে। দিদার পাশে পাশে ঘুরতে। কী সুন্দর গন্ধ দিদার গায়! কী চমৎকার রান্না দিদার হাতের! আর কি ভালো ___ওই বই গুলো! যেগুলো থেকে দিদা ওকে গল্প শোনায়! ও তো এখন নিজেও পড়তে শিখে গেছে। কি যে আনন্দ হয় বই নিয়ে বসলে! ইচ্ছে করে পড়েই যায়! আরো পড়ে ! অনেক পড়ে! অনেক ! একদিন তো বলেই ফেলেছিল দিদাকে ” আমি অনেক বই পড়ব দিদা। ওই পাশের বাড়ির মিমি দিদি, রত্না দিদির মত! তোমার____” ইচ্ছে ছিল___ বলে তোমার ছেলে মেয়ের মত। বলে নি। দিদা যদি দুঃখ পায়। বোঝে তো মিনু। কষ্ট আছে দিদা আর দাদুর মনে। ওরা তো ভুলেই গেছে বাবা মাকে! আসেই তো না! কোনোদিন! দিদা কিন্তু ঠিক বুঝতে পেরেছিল। মুখে কিছু বলে নি। শুধু কী যেন দেখছিল ওর মুখের দিকে তাকিয়ে। কেমন যেন অন্য মনস্ক! কী ভাবছিল কে জানে! হয়ত লুসি দিদির কথা। বা পাবলোর কথা! জানে তো মিনু। কী অসম্ভব ভালোবাসে দিদা দুই নাতি নাতনিকে! তবে কি ওরাই কেউ !!! নিশ্চয়ই! হতেই হবে!! নইলে এত কিছু করবে কেন ? উত্তেজনায় ফেটে পড়ে মিনু, ” ও দিদা __ কে আসছে গো? পাবলো দাদা না লুসি দিদি? বলো না ___ও দিদা___” লুচি ভেজে একটা থালায় পরিপাটি করে সাজাচ্ছিলেন সুপ্রভা। এক ধারে পটল ভাজা, বাটিতে আলুর দম। পায়েস। চোখ তুলে তাকালেন। ” কী!!” ” কে আসছে? কার জন্য করছ এত সব ! ” ” কে আবার আসবে? ” ” তাহলে ?” উত্তর না দিয়ে থালা হাতে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন সুপ্রভা। পিছন পিছন মিনুও। ” কি গো ? তাহলে?” টেবিলের ধারে তার গা ঘেঁষে দাঁড়ায় মিনু। ” তাহলে এই।” এক মুখ হেসে থালা খানা টেবিলে রেখে ওকে দু হাতে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেন সুপ্রভা। ” নে। খা।” হাঁ করে মুখের দিকে চেয়ে থাকে মিনু। ” মানে?” ” মানে __ এ স___ব আজকের জন্য। তোর জন্য। বুঝলি হাঁদা!এবার চট পট খেয়ে নে। আর শোন। কাল দেরী করবি না একদম। দাদু কে বলে রেখেছি তোকে “মডেল “স্কুলে নিয়ে যাবে। ভর্তি হবি সামনের বছর____তবু দেখে আয় একবার স্কুল টা! খুব মন দিয়ে পড়তে হবে কিন্তু। কিরে? পড়বি তো?” অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে মিনু। তাকিয়েই থাকে! আনন্দ, বিস্ময়, যেন মাখামাখি হয়ে ঝরে পড়ে ওর দু চোখ বেয়ে! সেদিকে এক পলক চেয়েই ঝাপসা হয়ে আসা চোখ সরিয়ে নেন সুপ্রভা। ভীষণ ব্যস্ত হয়ে ঝুঁকে পড়েন সামনের আনাজের ট্রে টার ওপর।