বোকার লাইন
✍️ শিব প্রসাদ হালদার
সবার মত সেই সাতসকালে আমিও ছুটলাম। গন্তব্যে পৌঁছে বুঝলাম হয়তো আমিই আসতে দেরি করে ফেলেছি। তখন সবে সকাল সাড়ে সাতটা। ততক্ষণে লাইনে অপেক্ষারত সবার নাম লেখানো হয়ে গেছে। শুনলাম একশত ষাট জন করে দুই জায়গায় দুটি লাইনে মোট তিনশত কুড়ি জনের জন্য ভ্যাকসিন আজ বরাদ্দ আছে। যদি পাই এই ভরসায় নাম নথিভুক্ত করবার জন্য অপেক্ষায় রইলাম। দেখতে দেখতে আমার পেছনে আরও কুড়ি পঁচিশ জনের মত এসে জড়ো হলেন। অগত্যা আমার নাম একশত আশিতে লিপিবদ্ধ হলে ভদ্রলোক চলে গেলেন। পেছনে অনেকেই বাকি রয়ে গেলেন। এবার অপেক্ষা শুধু টোকেন প্রাপ্তির। কিছুক্ষণ পরে টোকেনও পেয়ে অপেক্ষায় রইলাম। অবশেষে দুপুর সাড়ে বারোটায় এল সেই ভ্যাকসিন প্রাপ্তির সন্ধিক্ষণ। গত তিরিশে মার্চ দমদম মিউনিসিপ্যাল স্পেশালাইজড হসপিটালে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নিয়েছিলাম। বিয়াল্লিশ দিন অতিবাহিত হবার পর আজ নিলাম দ্বিতীয় ডোজ।
এই সাড়ে চার ঘন্টা হসপিটালে লাইনে অবস্থান কালে স্বচক্ষে দেখলাম কত মানুষের উৎকণ্ঠা। কত মানুষের মাঝে ভ্যাকসিন না পাওয়ায় আতঙ্ক —। শুনলাম কত মানুষের হৃদয় বিদারক বর্ণনা—! ইতিমধ্যে কত মানুষ চলে গেছে না ফেরার দেশে–! তবে এখানে সারিবদ্ধতায় সুশৃংখলভাবে সিরিয়ালি ভ্যাকসিন প্রদানে আমি ব্যক্তিগত ভাবে অত্যন্ত খুশি হলাম। যে যাই বলুক -যে যেভাবেই দেখুক, আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার দৃষ্টিতে পরিষেবা দেখে হসপিটাল কর্তৃপক্ষের প্রশংসা না করে পারলাম না।
সাড়ে চার ঘন্টা সময়ের মাঝে কিছুকিছু ছোট্ট ছোট্ট ঘটনা মনকে প্রশ্ন জাগালো মানুষের বিবেক নিয়ে। লাইনে দাঁড়িয়ে পেছনের লোককে-” দাদা আমি আপনার পেছনে আছি। একটু বসে নিই বলেই পাশে গিয়ে ফ্যানের তলে চেয়ারে বসে পড়লো—” কিন্তু লোকটাকে ততটা অক্ষম বলে মনে হল না। আমরা সমানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খুব মন্থর গতিতে এগোচ্ছি।আমি বয়সে সত্তরোর্ধ্ব হলেও যারা কয়েকজন পাশে গিয়ে চেয়ারে আরাম করে ফ্যানের তলায় বসে আছে তাদের দেখে মনে হল আমার থেকেও বয়সে কম এবং সুস্থ ও সক্ষম। এক ভদ্রলোক চেয়ার ছেড়ে একটু উঠতেই আমার সামনের আমার থেকেও বয়স্ক ও সামর্থে অক্ষম লোকটা ওখানে গিয়ে বসতেই একলাফে এসে তাকে উঠিয়ে দিয়ে বলল- “দাদা এটা আমার জায়গা—–।” অনেকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছে। কারোবা কোমর ধরে গেছে—। আর এদিকে অনেকেই ঘন্টার পর ঘন্টা এখানেই বসে তারা সময়ের অপেক্ষায় আছে কখন তাদের নির্ধারিত নম্বরের ডাক পড়বে। সব দেখতে দেখতে নানান উপলব্ধিতে সামনের বয়স্ক লোকটাকে বললাম- “সত্যিই আমরাই মনে হয় সবথেকে বোকা। আমরা তো সেই সকাল আটটা থেকে লাইনে এক ভাবেই দাঁড়িয়েই রয়েছি অথচ ওরা যারা বসে রয়েছে তাদের মধ্যে থেকে কই একটা লোককে তো বলতে শুনলাম না- “দাদা আপনি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একবার বসতে গেলেন–। আপনি বরং একবার একটু বসুন—-। কথাটা শুনে একজন বলে উঠল – “দাদা সেইদিন আর এখন নেই। সেই ধরনের লোক থাকলেও খুবই নগণ্য। এখন শুধু বেশির ভাগ সবাই একটাই বোঝে-” নিজে বাঁচলে বাপের নাম—–“
—০০০XX০০০—