বহে বেত্রবতী
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
প্রস্তরময় জঙ্গলগাত্রের ভিতর দিয়া একটি নির্ঝরিনী কলস্বরে বহিয়া বেত্রবতী নদীতে আসিয়া মিশিয়াছে। এই স্থানটি তপোবনের ন্যায় শান্ত। নদীতটে উড্ডীয়মান বহুবর্ণীল পক্ষী ও চিত্রিত মায়ামৃগ ব্যতিরেকে কেবল ময়ূর ও শশকজাতীয় প্রাণীই এই অরণ্যাংশে দৃষ্ট হয়। অপর কোনও হিংস্র প্রাণী সাধারণতঃ গোচরে আসে না।
একদা এই অরণ্যপথে ভগবন্ তথাগত তাঁহার প্রবজ্যাপথে আসিয়াছিলেন। তখনও তিনি বুদ্ধত্বের অনুধাবনে সিদ্ধ হন নাই। বরং সেইকালে তিনি এক সর্বসুখপরিত্যাগী সংশয়ী ঋষিকল্প যুবার ন্যায় তাঁহার আত্মদীপের অগ্নিশিখাটিকে সম্পূর্ণরূপে প্রজ্জ্বলনের অণ্বেষণেই ঘুরিতেছিলেন মাত্র।
****
এই অরণ্যের মধ্যে এক নিষাদ বাস করিত। তাহার নাম কীলক। অরণ্যের পশু বধ করিয়া সে নিকটস্থ চেদীরাজ্যের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলিতে পশু মাংস বিক্রয় করিয়া জীবিকা নির্বাহ করিত। গুঞ্জা ছিল তাহার একমাত্র কন্যা।মাতৃস্নেহবঞ্চিতা হইলেও অভাগিনী গুঞ্জা তাহার পিতার স্নেহ ও প্রশ্রয় তাহার বিড়ম্বিত জীবনে সম্পূর্ণরূপেই পাইয়াছিল।
পিতার নিকটে গুঞ্জা নৌচালনায় অতি অল্পবয়সেই পটুত্ব অর্জন করিয়াছিল। তাহার ক্ষুদ্রকায় ডিঙিটি বাহিয়া সে প্রপাতিনীর ধারা পার করিয়া বেত্রবতী নদীর মূল অবধি ভাসিয়া যাইত। ইহাই ছিল তার একমাত্র বিনোদন। বনেচর হইবার ফলে বহুবিধ ভেষজ লতা ও ফুল ও ফলের সন্ধানও সে জানিত। ক্রমে গুঞ্জার যৌবনপ্রাপ্তি হইল। সেইযুগে নিষাদ সমাজে অযথা আব্রু রক্ষার দায় হইতে নারীদের মুক্ত রাখাই হইত। বনেচর এই প্রকৃতিবালারা বনের শষ্পলতার সাথে একদিন বৃদ্ধি পাইয়া প্রকৃতির নিয়ম মান্য করিয়া ফলবতী হইয়া পড়িত। তাহাই স্বাভাবিক বলিয়া কন্যার বিবাহের জন্য কীলক একেবারে ব্যতিব্যস্ত হইবার প্রয়োজন বোধ করে নাই।
*****
বেত্রবতী যে স্থলে রঙ্গিলা নদীর ক্ষীণধারায় আসিয়া মিশিয়াছে তাহার অপরপ্রান্তেই শূরসেন রাজ্যের সীমানার প্রারম্ভ। ইহার পরই উত্তরবাহিনী বেত্রবতী ক্রমে অলস ছন্দে যমুনায় আসিয়া সমর্পিতা হইয়াছে। গুঞ্জা উজানে তাহার ডিঙিটি ভাসাইয়া ক্রমে চেদী রাজ্যের সীমানা পার করিয়া কি এক নেশায় ক্রমশ আরো দূরে যাইতেছিল। অপরাহ্নের আলো ক্রমে ক্ষীণ হইয়া আসিতেছে। এই অঞ্চলের বনাঞ্চল অপেক্ষা নদীপথ অধিক বিপদসঙ্কুল। প্রায়সই যমুনার ধারা বাহিয়া শিকারের লোভে কুম্ভীর আসিয়া লুকাইয়া থাকে। গুঞ্জা নিষাদের কন্যা। শৈশবকাল হইতেই এ অঞ্চলের প্রতিটি সংবাদ তাহার নখাগ্রে থাকে। ডিঙি চালাইতে চালাইতে সে দেখিল দূরের তীরভূমিতে এক মনুষ্যদেহ অচেতন হইয়া পড়িয়া আছে। তাহার দেহের অর্ধাংশ জলস্পর্শ করিয়া রহিয়াছে। অর্থাৎ তৃষ্ণার্ত হইয়া মনুষ্যসন্তানটি জলে নামিয়াছিল ঠিকই, কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে তাহার চেতনা লুপ্ত হইয়াছে। আরো কিছুদূর অগ্রসর হইয়া গুঞ্জা দেখিল মনুষ্যটি এক পিঙ্গলবর্ণের যুবাপুরুষ। সে দ্রুত তাহার ডিঙিটিকে একটি গুল্মের সহিত বাঁধিয়া যুবাটির নিকট আসিল। গুঞ্জা তাহার শ্বাসপরীক্ষা করিয়া বুঝিল নাড়ীর গতি ক্ষীণ হইলেও যুবাটি এখনো জীবিত। তাহার ডিঙিটিতে তৎপরতার সহিত অচেতন যুবাটিকে উদ্ধার করিয়া গুঞ্জা ফিরিবার পথ ধরিয়া তাহার নৌচালনা করিল।
********
পথিমধ্যে যুবাটির সংজ্ঞা আসিল। সে তাহার আয়তনয়ন মেলিয়া অতি বিস্ময়ে গুঞ্জাকে দেখিতে লাগিল। গুঞ্জা নৌযাত্রায় সর্বদা তাহার নিকটে কিছু ফল ও মধু সঞ্চিত রাখে। তাহা হইতেই সে যুবাটিকে তৎক্ষণাৎ কিছু ফল খাইতে ও মধু পান করিতে দিল।
যুবাটি বাস্তবিকই ক্ষুধায় সে বড়ই অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। সঙ্গে খাদ্য না থাকায় সে বাধ্য হইয়া জল পান করিতে নদীতে নামিয়াছিল। তাহারপর অবসন্নতা ও ক্লান্তিতে অকস্মাৎ চেতনালুপ্ত হইয়া পড়িয়াছিল। সে কিছুটা সুস্থ বোধ করিয়া উঠিয়া বসিলে গুঞ্জা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল-
” আপনাকে দেখিয়া সদ্বংশজাত বলিয়া মনে হইতেছে! তথাপি এ বনমধ্যে একাকী কি করিতেছিলেন? মৃগয়া করিতে আসিয়া পথভ্রষ্ট হইয়া পড়িয়াছিলেন বুঝি? কিন্তু তাহা হইলে আপনার অমাত্যগণ আর অস্ত্রশস্ত্র সব কোথায় হারাইলেন? “
যুবকটি স্মিত হাসিয়া কহিল-
” হে বরদে! আপনি সদয়া না হইলে এযাত্রায় আমি রক্ষা পাইতাম না। আমি মৃগয়াণ্বেষণে বনমধ্যে আসি নাই ঠিকই তবে আমিও একপ্রকার অণ্বেষী এ কথাও যারপরনাই সত্য!”
গুঞ্জা ইতিমধ্যে তাহার আত্মপরিচয় প্রদান করিয়াছে। সে পরম বিস্মিত কন্ঠে পুনরায় কহিল –
” তবে এই বনমধ্যে কিরূপ ধনের অণ্বেষণ করিতেছিলেন? আপনার ভাগ্য অতি সুপ্রসন্ন বলিয়া বিষধর শঙ্খচূড় সর্প অথবা ভয়াল কুম্ভীর হইতে রক্ষা পাইয়াছেন। আপনার শান্ত ও আয়ত চক্ষুদুটি দেখিয়া কোন দস্যুপতি বা ধনলোভী তস্কর বলিয়া ভাবিতে কষ্ট হইতেছে! তবে কি আপনি কোন বণিকপুত্র? “
******
বেত্রবতী যেস্থলে রঙ্গিলা নদীর ক্ষীণধারায় আসিয়া মিশিয়াছে তাহার একপার্শ্বে যুবাটি গুঞ্জাকে তাহার ডিঙিটি বাঁধিতে অনুরোধ করিল। তারপর ডিঙি হইতে মাটিতে অবতীর্ণ হইয়া তাহাকে করজোড়ে নমস্কার করিয়া যুবাটি বিদায়ের আজ্ঞা যাচনা করিল। গুঞ্জা হতবাক হইয়া যুবকটিকে দেখিতে লাগিল।
সন্ধ্যার প্রাকমুহূর্তে ক্রমশ গোধূলির গৈরিকআভায় যুবকটির মুখমন্ডল প্রশান্তিতে ভরিয়া উঠিতেছে। সে অপ্রকট হইবার কালে আত্মপরিচয় দিয়া কহিল – ” আমার পিতৃদত্ত নাম গৌতম! অনেকদূরের লিচ্ছবিরাজ্যের নিকটে শাক্যবংশে আমার জন্ম। মাসাধিককালপূর্বে আমি সংসারত্যাগ করিয়া যে মহাসত্যের সন্ধানে নিষ্ক্রান্ত হইয়াছি আজ তাহার অনেকগুলি প্রশ্নের মধ্য হইতে অন্তত একটি প্রশ্নের উত্তর পাইলাম তাহা হইল- সর্বং অনিত্যম্ সর্বং অনাত্মম্ সর্বং ক্ষণিকম্ – সকলেই অনাত্মীয়, সকলই অনিত্য, আর সব কিছুই ক্ষণিকের । হে ভদ্রে, আপনার জন্য আজ যে জীবন পুনরায় ফিরিয়া পাইলাম তাহা পুনরায় সেই মহাসত্যের অণ্বেষণেই নিয়োগ করিব! ” এই বলিয়া সে দ্রুতপদে বনমধ্যে মিলিয়া গেল।
গুঞ্জা এতক্ষণ নির্বাক দর্শকের ন্যায় এই অপরূপকান্তি যুবকটির কথা শুনিতেছিল। তাহার সপ্তদশবর্ষীয়া সুকুমারী হৃদয় এক অকল্পনীয় আবেগে ও অনুরাগে কম্পিত হইতে লাগিল। নিষাদপল্লীতে বেদাদি শাস্ত্রশিক্ষার উপায় তাহার নাই তবুও যুবকের কম্বুকন্ঠে ধ্বনিত সেই মহামন্ত্র –
” সর্বং অনিত্যম্ সর্বং অনাত্মম্ সর্বং ক্ষণিকম্” এই শব্দগুলি তাহার দেহতন্ত্রীতে বীণার ন্যায় বাজিতে লাগিল।
বিধাতার অভিপ্রায়ে গুঞ্জা ও তাহার ক্ষুদ্র ডিঙিটি সেই মহাজীবনের অনন্তযাত্রাপথের একটি অধ্যায় হইয়া বেত্রবতীর বুকে ভাসিয়া চলিতে লাগিল কাল হইতে কালান্তরের পটভূমিকায়।
*************