ফুলমনির আখ্যান (দ্বিতীয় পর্ব)
সলিল চক্রবর্ত্তী
(পাঠক পাঠিকাদের অনুরোধে ‘ফুলমনির আখ্যান’ এর দ্বিতীয় পর্ব লিখতে বসলাম। যাঁরা প্রথম পর্ব পড়েননি তাঁদের ক্ষেত্রে এই গল্পটা পড়লেও কিছু অসম্পূর্ণতা থেকে যাবে।)
“স্যার, আপনাকে একজন খোঁজ করছেন, ভেতরে নিয়ে আসবো ?”
– কে আবার খোঁজ করছে, ভালো করে খোঁজ খবর নিয়ে ভেতরে নিয়ে এসো।
মৃনাল কান্তি বাকচি, দুর্গাপুর ব্লক ডেভলপমেন্ট অফিসার। সম্প্রতি বিপত্নীক মৃনাল বাবু মনেপ্রাণে সম্পূর্ণ বিধস্ত হয়ে আছেন। দুই কন্যার বড়জনের মাস ছয়েক আগে বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট মেয়ে আর তিঁনি থাকেন এক পরিচারিকার তত্ত্বাবধানে। সে আবার তার পারিবারিক সমস্যার কারণে গত কাল থেকে কাজ ছেড়ে দিয়েছে। মৃনাল বাবু পড়েছেন মহা বিপদে। মেয়ে কাজ জানলেও তার তো পড়াশুনা আছে। হঠাৎ করে বিশ্বাসী কাজের লোক মেলাও দুস্কর। এই সব সাত পাঁচ অফিসে বসে ভাবছেন। এরই মধ্যে দারোয়ান এসে জানালো ফুলমনি নামে এক সাঁওতাল মহিলা দেখা করতে এসেছে। মৃনাল বাবু ফুলমনি নামটা শুনে একটু অবাক হয়ে তক্ষুনি তাকে তাঁর চেম্বারে আনতে বললেন।
ফুলমনি মৃনাল বাবুর চেম্বারে ঢুকে জোড় হাতে প্রণাম করে বললো -” তুই ভালো আছিস বাবু?”
মৃনাল বাবুর সাথে ফুলমনির ভালো মন্দ কথাবাত্রা চলা কালীন একটা ক্যান্টিন বয় এসে মৃনাল বাবুকে ক্যান্টিনে খেতে ডাকল। মৃনাল বাবু ক্যান্টিন বয়কে সম্মতি জানিয়ে ভাবলেন এত বেলা হয়েছে ফুলমনিরও তো খাওয়া হয়নি, তিঁনি ফুলমনিকে সঙ্গে নিয়ে ক্যান্টিনে ঢুকলেন।
ফুলমনি কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে এক মনে খেয়ে চলেছে, মনে হচ্ছে এই প্রথম সে তৃপ্তি করে খাচ্ছে। মৃনাল বাবুই খেতে খেতে জানতে চাইলেন ,এখন সে কোথায় যাবে কি করবে—-। ফুলমনি জানায় সাঁওতাল পরগনাতে ফেরার তার আর ইচ্ছা নেই , তার সমাজ তাকে তাদের সামাজিকতায় পুনর্বাসন দেবে এ ব্যাপারে ফুলমনি যথেষ্টই সন্ধিহান। মৃনাল বাবু অবাক হয়ে বলেন–” তাহলে!!” ফুলমনি করুন বদনে মৃনাল বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে-” বাবু তুর এত বড় অফিসে আমাকে একটা কাম দে না বটে?” ফুলমনি তো দুম করে বলে দিল, সে তো জানে না যে মৃনাল বাবুর পক্ষ্যে সেটা কখনই সম্ভব নয়। মৃনাল বাবু কোনো উত্তর না দিয়ে বেসিনে গিয়ে মুখটা ধুতে থাকলেন। মৃনাল বাবু নীরব থাকায় ফুলমনি বুঝতে পারলো এটা হয়তো সম্ভব নয়,সেই জন্য খাওয়া শেষ করে বেসিনের কাছে গিয়ে বলল-” বাবু মুকে তুর বাড়ি নিয়ে চল, বাসন মাজব, ঘর মুছব, কাপড় কাজব, সব কিছু করবো বটে।” মৃনাল বাবু ভাবলেন, ফুলমনি কথাটা মন্দ বলেনি। তাঁর তো এখনই এই রকম একজন লোকের দরকার। সর্বোপরি এরা খুব সৎ এবং বিশ্বাসী হয়। মৃনাল বাবু মুখ মুছতে মুছতে বললেন-“তোমার গ্রামে ফিরে যাওয়ার একদম ইচ্ছে নেই?” ফুলমনি একদম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে বললো-” একদম লয় বাবু।”
বিকালে ফুলমনিকে নিয়ে মৃনাল বাবু বাসায় ফিরলেন। কলিংবেল চাপতেই ছোট মেয়ে মৌলি এসে দরজা খুলে দিল। বাবার সাথে এক অচেনা মহিলাকে দেখে কিছুটা অবাকও হলো। মেয়ের মুখের অভিব্যাক্তি দেখে মৃণাল বাবু বললেন-” ভিতরে চল কথা আছে।”
বড় ডাইনিং তার সাথে ওপেন রান্নাঘর,রান্না ঘরের সিঙ্কে সারাদিনের ব্যাবহার করা বাসন রাখা আছে। মৃনাল বাবু ফুলমনিকে ডাইনিং এ বসিয়ে মৌলিক ডেকে পাশের ঘরে ঢুকছিলেন । ফুলমনি তখন সিঙ্কের বাসনগুলো দেখিয়ে বললো-” বাবু আমি বাসন গুলো মেজে রাখি বটে?” মৃনাল বাবু একটু হেসে বললেন-” না দেখিয়ে দিলে পারবেতো?” ফুলমনি মৃনাল বাবুর সাথে কয়েক ঘণ্টা কাটানোয় জড়তা অনেক কাটিয়ে ফেলেছে। একটু হেঁসে বললো-” দেখ লা বটে।”
মৃনাল বাবু মৌলিকে আলাদা ঘরে নিয়ে গিয়ে ফুলমনির সম্পর্কে অতীত হইতে বর্তমান সবকিছুই সংক্ষেপে বর্ণনা করলেন। এবং এই পরিস্থিতিতে কিভাবে ফুলমনির পাশে দাঁড়ানো যায় তা আলোচনা করে ঘর থেকে বেরিয়ে ফুলমনির কান্ড দেখে বাপি বেটিতে ভিমরি খেয়ে পড়লেন। সিঙ্ক থেকে বাসন গুলো সব রান্না ঘরের মেঝেতে নামিয়ে পা ছড়িয়ে বসে মাজার চেষ্টা হচ্ছে। মৌলি একটুও রাগ না করে এক গাল হেঁসে ফুলমনিকে বেসিনে কিভাবে বাসন মাজতে হয় সেটা শিখিয়ে দিতে উদ্যত হলো।
দেখতে দেখতে কয়কে মাস কেটে গেল। মৌলির সহযোগিতায় এবং ফুলমনির শেখার আগ্রহে ফুলমনি এখন সভ্য সমাজের গৃহস্থালির অনেক কাজেই স্বয়ং সম্পূর্ণ। আর কিছু দিনের মধ্যে হেঁসেলটাও সে সামলে নিতে পারবে। মৌলির অবসর সময়ে দুজনে মিলে নানা রকম গল্পসল্প করে। ফুলমনির পূর্ব জীবন কাহিনী শুনে মৌলি বলে- ” জানতো শিক্ষাহীনতাই তোমাদের জীবনকে এত দুর্বিসহ করে তোলে।তুমি যদি শিক্ষিত হতে তবে তোমার জীবনটা এমন হতো না।” মৌলির কথা শুনে এক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফুলমনি মৌলিকে বলে- ” মৌলি দিদি তুই আমারে লিখা পড়া শিখাইবি বটে? তোর ওই মোটা মোটা বইগুলো আমার পড়তে ইচ্ছা হয় বটে।” মৌলি অট্ট হাঁসি হেঁসে বলে- ” দূর বোকা ,ওই বই পড়তে গেলে আগে অ,আ,ক,খ ,এ, বি,সি ,ডি শিখতে হবে।” ফুলমনি লজ্জা পেয়ে বলে – ” তুই হাসছিস বটে, আমাকে শিখানে বটে, দেখ আমি পারি কিনে!” মৃনাল বাবু অফিস থেকে ঠিক সেই সময় ফিরলেন, এবং ওদের কথপোকথন শুনে বলেন – ” বেশ তো মৌলি তুই প্রয়োজনীয় বই গুলো সংগ্রহ করে ওকে প্রাথমিক শিক্ষা দিতে থাক। আমি দেখছি বয়স্ক শিক্ষা ব্যবস্থায় কি কি সুযোগ সুবিধা করে দেয়া যায়।”
দেখতে দেখতে আরো কয়েক মাস কেটে গেল। ফুলমনি এখন বাংলা ইংরেজীতে নিজের নাম ঠিকানা লিখতে শিখে গেছে। মৌলির মোটা মোটা বই গুলো শুধু নাড়াচাড়া করে না, থেমে থেমে রিডিংও পড়ে। মৃনাল বাবু ফুলমনির নামে একটি ব্যাংক একাউন্ট খুলে দিয়েছেন। যাতে ফুলমনির কয়কে মাসের (মৃনাল বাবুর দেওয়া) মাহিনা জমা পড়েছে। রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের গরীব যোজনার সুযোগ সুবিধা সবই মৃনাল বাবুর বদান্যতায় পেয়ে চলেছে।
একদিন মৌলির বইয়ের পাঁজা নাড়াচাড়া করতে করতে ফুলমনি “সাঁওতাল সমাজের ইতিকথা” নামে একটি বই পায়। এবং কয়ক দিনের মধ্যে বাংলায় লেখা বইটি পড়ে ফেলে। বইটি পড়ে এবং নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে সে এটুকু উপলব্ধি করে যে পূর্ব জন্মে অনেক পাপ করলে তবে এই জন্মে এমন সমাজ ব্যাবস্থ্যায় মেয়ে হয়ে জন্মাতে হয়। তাদের সমাজ ব্যাবস্থ্যার কথা ভাবতে ভাবতে ফুলমনির মনটা বিষাদে ভোরে ওঠে। নাড়ির টান খণ্ডন করা মুশকিল, মনে মনে সে ভেবেই ফেলে – সময় সুযোগে একবার তার গ্রাম থেকে ঘুরে আসবে।
“শিবু তুর বেটি একটা পাস দিলো বটে। উকে আরো লিখা পড়া শিখাইবি বটে। দেখবি উ গিরামের মান রাইখবে বটে।” কাশতে কাশতে উপেন সোরেন কথা গুলো শিবু সোরেন কে বললো। এই প্রথম সাঁওতাল পরগনায় শিবু সোরেনের মেয়ে ঝুমুর প্রথম মাধ্যমিক পাশ করলো। কিছুটা সরকারি সুযোগ সুবিধা আর কিছুটা বাবা মায়ের ইচ্ছায় আদিবাসী শিশুরা বর্তমানে স্কুল মুখো হয়েছে। এর মধ্যে কিছু পড়ুয়ার নিজেদের আগ্রহ থাকায় পড়াশুনাতে কিছুটা উন্নতি ও করেছে। শিবু সোরেন মেয়েকে আর পড়াতে চায়না। সাঁওতাল সমাজে শোল বছর অতিক্রান্ত মানে বুড়ী হয়ে যাওয়া। শিবুর পাত্র ঠিক করা আছে, চার হাত এক করে দিতে পারলেই সে নিশ্চিন্ত। ঝুমুরের আরো পড়াশুনা করার ইচ্ছা, কিন্তু খরচ ও অনেক, শিবুর পক্ষ্যে সেই খরচ টানা সম্ভব নয়। ঝুমুরের স্কুলের হেড মাস্টার মশাই আশীর্বাদ করে বলেছেন – পড়াশুনা চালিয়ে গেলে তাঁর দিক থেকে যতটা সম্ভব সাহায্য করবেন।
ফুলমনি কে এখন আর চেনার উপায় নেই। মৌলির ডিরেকশনে আর নিজের ইচ্ছায় সে একজন সভ্য বাঙালি পরিচারিকা। কথার মাত্রা হিসাবে “বটে” বলা একদম বন্ধ করে দিয়েছে। কাজকর্মে কথাবাত্রায় আধুনিকতার ছাপ স্পষ্ট। মৃনাল বাবুকে তুই তামারি না বলে স্যার সম্মধন করে। মৌলি আর মৃনাল বাবু লাঞ্চ করছেন, ফুলমনি পরিবেশন করছে। মৌলি আর মৃনাল বাবুর কথোপকথনের মধ্যে ফুলমনি বললো-” স্যার, ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলাটা আমাকে একটু শিখিয়ে দেবেন?” ফুলমনির কাছ থেকে এমন একটা কথা শুনবে এটা দুজনের কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। কয়কে সেকেন্ড পরস্পর পরস্পরের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। তারপর মৃনাল বাবুর ইশারায় মৌলি কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। মৃনালবাবু বললেন-” নিশ্চই,নিজের কাজ নিজে করতে শেখা তো ভালোই, এতে পরোনির্ভরশীল হতে হয় না।”
বেশ কিছু দিন পর এক দিন মৌলি কলেজ থেকে বাড়ী ফেরার নির্দিষ্ট সময়ের ঘন্টা খানিক আগেই ফিরে আসলো। এসে দেখলো দরজাতে তালা ঝুলছে। তার কাছে ডুপ্লিকেট চাবিও নেই যে খুলবে। সে একটু অবাক হয়ে কিছু একটা ভাবছিল এরই মধ্যে ফুলমনি হন্তদন্ত হয়ে এসে মৌলিকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু ঘাবড়ে গেল।ফুলমনি আমতা আমতা করে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করতে মৌলি ওকে থামিয়ে দিলো। ভাবখান এমন ফুমনির বাড়ীর বাইরে যাওয়াটাকে সে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। আসলে মৌলি ফুলমনিকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিলো।
লাউদোহার সাঁওতাল পরগনাতে আজ উৎসব হবে। মুরগির মাংসের সাথে হাঁড়িয়া প্রস্তুত। সঙ্গে আছে মাদল নিয়ে নাচগান। লক্ষের থেকে উপলক্ষ বড়। অনুষ্ঠানের কাজে তৎপর বাবুরাম সোরেনকে কেউ একজন উৎসবের কারন জানতে চাইলে সে ব্যাস্ততার সাথে বলল–ঝুমুর বেটি এক সাথে দুটো পাশ দিয়েছে বটে। তার লিয়ে উৎসব হবে বটে।
ঝুমুর চারটে সাবজেক্টে লেটার নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে। পাশাপাশি জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষাতে নব্বই শতাংশর বেশি নাম্বার পাওয়ায় মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। ঝুমুরকে সন্তানের মতো গাইড করছেন ওদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক পরিমল হাঁসদা। সমস্যা হল অর্থ, তারপর ঝুমুরের ভাগ্য।
বছর পাঁচ পর—
মৃনাল বাবুর অবসর নেয়ার সময় হয়ে এসেছে। আর বছর দেড়েক হাতে আছে। তিনি মৌলির জন্য সুপাত্রের খোঁজখবর করছেন। এ দিকে সোনার দাম হুহু করে বাড়ছে। মৃণালবাবু অর্নামেন্টস গুলো আগে কিনে রাখার উদ্দেশ্যে ব্যাঙ্কে গেলেন টাকাকড়ির পজিশনটা জানতে। ব্রাঞ্চ ম্যানেজার তাঁর পূর্ব পরিচিত আবার বন্ধু স্থানীয়। বি এম এর চেম্বারে বসে চা খেতে খেতে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে ম্যানেজারবাবু বললেন—মৃণালবাবু আপনাদের পরিচারিকা ফুলমনি তো বেশ চৌকোষ হয়ে উঠেছে। ব্যাঙ্কে আসছে টাকা পয়সা তুলছে জমা দিচ্ছে, এক ভদ্রলোককে মাঝেমধ্যে সঙ্গে দেখি। একটা নিরক্ষর আদিবাসী মেয়েকে এত সুন্দর ভাবে তৈরী করেছেন যে আপনি তো মশাই এওয়ার্ড পাওয়ার যোগ্য। ফুলমনি ব্যাঙ্কে এসে টাকা জমা দেয় তোলে এটুকু শুনে মৃণালবাবু রীতি মতো অবাক হয়ে গেলেন। তিঁনি তো মাসের প্ৰথমে একবারই ক্যাশ ডিপোজিট করেন তাও অনলাইনে,ফুলমনির হাত দিয়ে নয়। তাহলে ফুলমনি কেন এত ব্যাঙ্কে আসে আবার অন্য পুরুষ থাকে। মৃণালবাবু অঙ্ক কিছুতেই মেলাতে পারছেন না। তাঁর যুক্তি বৃদ্ধি তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। মৃণালবাবুকে চিন্তান্বিত দেখে ম্যানেজার বাবু বললেন— কিছু মনে করবেন না, আমি কি অপ্রত্যাশিত কোনো মন্তব্য করে ফেললাম?
—-না না তেমন কিছু নয়, তবে আমাকে একটা হেল্প করলে খুব ভালো হয়।
—-নিশ্চই বলুন না!
—- ফুলমনির একাউন্টটা একটু ওপেন করবেন?
—- নিশ্চই আপনি যখন বলছেন!
ফুলমনির একাউন্ট ওপেন করতেই মৃণালবাবুর চক্ষু চড়ক গাছ। দীর্ঘদিন ধরে প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে জমা পড়ছে। কিন্তু সেই ব্যালান্স একাউন্টে নেই, তাছাড়া অন্য কেউ এই একাউন্টে টাকা জমা করেছে। তা হলে কে বা কারা ফুলমনির একাউন্টে টাকা জমা করে এবং কেন করে! তিঁনি তো ফুলমনির ভালো চান, ফুলমনি সেটাও বোঝে,তবে তাঁকে এই ব্যাপারে অন্ধকারে রেখেছে কেন! অনেক প্রশ্ন মাথায় নিয়ে মৃণালবাবু ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসেন।
বাড়িতে এসে মৌলির সাথে মৃণালবাবু ব্যাপারটা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেন। উদ্দেশ্য মৌলির চোখে সন্দেহজনক কিছু ধরা পড়েছে কিনা। পারিবারিক দিক থেকে ফুলমনির কাজ কর্মের দৃষ্টান্তমূলক কোনো ত্রুটি তারা পাইনি। তবে ফুলমনি যে মাঝে মধ্যে বাড়ীর বাইরে বার হয়, এটা প্রমাণিত। দুজনে মিলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো — এই ভাবে আর চুপ করে বসে থাকা যায় না। ফুলমনির গতিবিধির উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আরোপ করতে হবে।
কয়েক দিন পর মৃনাল বাবু একটু দেরিতে অফিসে ঢোকেন। চেয়ারে বসতে না বসতে বেয়ারা এসে এক গেলাস জল আর একটা খাম টেবিলের উপর রেখে গেল। মৃনালবাবু খামটি খুলে দেখলেন, আগামী রবিবার সরপির ইকোপার্কে একটা সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়েছে,সেখানে ওনাকে প্রধান অতিথির পদ অলংকৃত করতে হবে। সরকারি উচ্চপদ এবং প্রচুর মর্মস্পর্শী কবিতা লেখায় তাঁর একটা ভালো পরিচিতি আছে। সেই সুবাদে এমন অনেক জায়গাতেই তাঁর প্রধান অথিতির পদ অলংকৃত করতে যেতে হয়। তেমনি একটা সাধারণ নিমন্ত্র পত্র ভেবে নিজের কাজে ডুব দিলেন।
বেলা দুটোর পর ব্যাঙ্ক ম্যানেজার মৃনালবাবুকে ফোন করে জানালেন ফুলমনি এবং সেই ভদ্রলোক ঘন্টা খানিক আগে এসে টাকা তুলে নিয়ে গেলেন। মৃনালবাবু মৌলিকে ফোন করলেন জানতে সে আজ বাড়ীতে আছে না কোথাও বেরিয়েছে। মৌলি জানালো-” আমি বাড়িতে আছি, কিন্তু বাবা তুমি অফিসে বার হওয়ার সাথে সাথে ফুলমনি বেরিয়ে গেল। আমার অনুমতির অপেক্ষায় না থেকে একবার ‘মৌলি দিদি একটু বেরুচ্ছি তাড়াতাড়ি ফিরবো’ বলে চলে গেল।” মৃনালবাবু আর মৌলি ফোনের কথোপকথনেই ঠিক করলেন, ফুলমনিকে সরাসরি ওর চলাফেরা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হবে। এই ভাবে আর ধোঁয়াশার মধ্যে থাকা সম্ভব হচ্ছে না।
আজ রবিবার ফুলমনি খুব ভোরে উঠে অতি তৎপরতায় সংসারের কাজকর্ম গুছিয়ে নিচ্ছে। মৃনালবাবু সকালে হাটতে বার হন, ফেরার সময় বাজার করে ফেরেন। রবিবার দুপুর একটার মধ্যে খাওয়া হয়ে যায়। আজ ফুলমনির ভাব এমন যেন বারোটায় সবাই খেয়ে নিলে ভালো হয়। তার এই আচরণ মৌলির একদম ভালো লাগছে না। মনে মনে ভাবে, ‘আজ আবার বাবাকে না জানিয়ে গটগট করে বেরিয়ে যাবে না তো!’ মৌলি বাবার সাথে সব কথা বললো, এবং দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলো -খাওয়ার টেবিলে আজ ফুলমনির কাছে এই ব্যাপারে জানতে চাওয়া হবে। ধৈর্যের বাঁধ তাঁদের একদম ভেঙে গেছে।
দুপুরে মৃনালবাবু মৌলি খাচ্ছে, ফুলমনি পরিবেশন করছে। ফুলমনি রান্নাঘরে মাছেরঝোল আনতে গেলে মৌলি বাবাকে ইশারা করে জানায় ,ফুলমনি খাওয়ার টেবিলে এলেই যেন মৃনালবাবু কথাটা উথাপ্পন করেন। মৃনালবাবুও সম্মতি জানালেন। ফুলমনি ডাইনিং টেবিলের সামনে আসতেই মৌলি বাবার দিকে তাকালো, মৃনালবাবু কথাটি উথাপ্পন করবেন ঠিক সেই সময় ফুলমনি বিনা ভূমিকায় মৃনাল বাবুকে বললো – ” স্যার, আজকে সন্ধ্যায় আপনাকে আর মৌলি দিদিকে একটু সরপি ইকো পার্কে যেতে হবে।”
ফুলমনির মুখ থেকে এমন একটা কথা শুনে রীতিমতো অবাক হয়ে দুইজন দুইজনের দিকে কয়েক সেকেন্ড অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আজি তো মৃণালবাবুর সরপি ইকোপার্কে যাওয়ার কথা। কিন্তু একথা ফুলমনি জানলো কি করে! ফুলমনিকে নিয়ে তার চিন্তা ভাবনা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। একটু ধাতস্থ হয়ে মৌলি জানতে চায়–কেন, সেখানে গিয়ে কি হবে? ফুলমনি খাবার পরিবেশন করতে করতে নির্লিপ্ত ভাবে বলতে থাকে — ” মৌলিদিদি আমি পাঁচ ছয় বছর তোমাদের কাছে আমার বিষয়ে অনেক কিছু গোপন করে রেখেছি। তোমরা দুইজনেই বুঝতে পেরেও আমাকে কোনো প্রশ্ন করোনি। করলে কি হতো আমি জানিনা। কিন্তু আমার ভিতর অকৃতজ্ঞতার জ্বালা কুরে কুরে খাচ্ছে। আজ হয়তো সেই জ্বালা থেকে মুক্তি পেতে চলেছি।”
মৃনালবাবু মৌলির খাওয়া হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ফুলমনি তাড়াহুড়ো করে খেয়ে নিয়ে সংসারের পরবর্তী কাজ গুছিয়ে রাখলো। তারপর ড্রেস চেঞ্জ করে মৃণালবাবুর ঘরে গিয়ে অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে গেল। মৌলি এসে বললো– বাবা কিছু বুঝছ? মৃনালবাবু কবিতা লিখতে লিখতে বললেন–আর তো কয়কে ঘন্টা, আলোচনা পরিত্যাগ করে বরং অপেক্ষায় থাকি।
সরপি ইকো পার্কের অডিটোরিয়াম জন সমাগমে গমগম করছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে অনুষ্ঠান শুরু হবে। একে একে গণ্যমান্য ব্যাক্তিরা এসে তাঁদের নির্ধারিত সিটে বসছেন। ঘোষক অনুষ্ঠান সূচিটা বারবার ঘোষণা করেছেন। মৃনালবাবু আর মৌলি এসে তাদের নির্ধারিত সিটে বসলেন। মিনিট তিন চারের মধ্যে উদ্যোগতাদের মধ্যে একজন এসে মৃনালবাবুর হাতে একটা অনুষ্ঠান সূচীর লিফলেটে ধরিয়ে দিয়ে গেল। মৃনালবাবু লিফলেটটিতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন।
ঘোষকের ঘোষণা শুনে এবং লিফলেটটি পড়ে মৃনালবাবু একটি সম্মক ধারণা করে নিলেন এখানে কি হতে চলেছে , আর তাঁর ভূমিকাই বা কি। মৌলি এদিক ওদিক তাকিয়ে ফুলমনিকে খোঁজার চেষ্টা করছে। না দেখতে পেয়ে বাবাকে বললো- “আচ্ছা বাবা ব্যাপার কি বলতো?” মৃনালবাবু মুচকি হেঁসে বললেন-” ক্রমশ প্রকাশ্য!” এরই মধ্যে ফুলমনি এসে উপস্থিত। মুখে পরম তৃপ্তির হাঁসি, ” আপনারা এসেছেন স্যার, আমার যে কি ভালো লাগছে, কি বলবো!” মৌলি ফুলমনির কথা বাত্রার ম্যাচিউরিটি দেখে অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। এরই মধ্যে ঘোষক ফুলমনিকে মঞ্চে ডাকলেন। ফুলমনি মৌলিকে বললো-” মৌলিদিদি আজ আমার সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে , যাই ডাক পড়েছে।” মৌলি দ্রুত পায়ে মঞ্চের দিকে চলে গেল। মৌলির একটু অভিমান হল, এতদিন ধরে পিছিয়ে পড়া সমাজের একটি মহিলাকে লেখাপড়া আদপ কায়দা শিখিয়ে সভ্য সমাজের উপযুক্ত করে তুললাম সেই কিনা তার সাথে লুকোচুরি খেলছে!
ঘোষকের ঘোষণা শোনা গেল-” উপস্থিত শ্রদ্ধেয় অথিতিগণ , আপনাদের অনুমতি নিয়েই আমরা আমাদের অনুষ্ঠান শুরু করছি।আজ আমরা একত্রিত হয়েছি একটি সম্বর্ধনা সভাকে কেন্দ্র করে। লাউদোহার অনগ্রসর শ্রেণীর একটি মেয়ে নাম ঝুমুর সোরেন, যার বারো তেরো বছর বয়সে বিয়ে করে সংসারী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু না, তা হয়নি, সে এখন এম বি বি এস ডক্টর। আমরা তাকেই সম্বর্ধনা জানিয়ে নিজেদের ধন্য মনে করব। সমগ্র অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করছেন লাউদোহা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পরিমল হাঁসদা। তিঁনিই ঝুমুরের পথ প্রদর্শক। তাঁর আশীর্বাদের হাত ঝুমুরের মাথায় না থাকলে ঝুমুর হয়তো একটি শিক্ষিত মানুষ হতো,ডাক্তার হতে পারতো না। এখানে আর একজনের কথা না বললেই নয়——“
মঞ্চের লাইট অফ হয়ে গেল, ঘোষক ঘোষণা পরিবর্তন করে জানালেন-” আমাদের অনুষ্ঠান এখুনি শুরু হচ্ছে। প্রথমে উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করছে বৈশাখী হাঁসদা।”
উদ্বোধনী সংগীত সমাপ্ত হওয়ার পর মঞ্চে সভাপতিত্তের আসন অলংকৃত করার জন্য ডেকে নেয়া হলো মৃনাল কান্তি বাকচিকে। তাঁকে একটি ছোট্ট মেয়ের দ্বারা মাল্যদান করে বরণ করা হলো। মৃনালবাবু সংক্ষেপে তাঁর বক্তব্য রাখলেন। তিঁনি কথা দিলেন, তাঁর তরফ থেকে অনগ্রসর শ্রেণীর যত সুযোগ সুবিধা আছে সব কিছু পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন। তিঁনি পরিমল হাসদকে একটা কমিটি করতে বলেন, যার কাজ হবে মূলত পিছিয়ে পড়া শিশুদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেয়া। সাথে সাথে তিঁনি পরিকল্পিত কমিটির উদ্দেশ্যে দশ হাজার টাকার একটি চেক পরিমল হাঁসদার হাতে তুলে দিলেন।
এর পর সাঁওতালি গানের সাথে একটা নৃত্য পরিবেশন হলো। তারপর মঞ্চে ডেকে নেয়া হলো ঝুমুর সোরেনকে। ঝুমুরকে শংসাপত্র, উত্তরীয় প্রদান করে সন্মান জানানো হলো। এবার ঝুমুরকে সংবর্ধনা কমিটির তরফ থেকে কিছু বলতে বলা হলো। ঝুমুর পোডিয়ামের সামনে এসে তার বক্তব্য শুরু করল—
“উপস্থিত শ্রদ্ধেয় ভদ্র মন্ডলীগণ , প্রত্যেককে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই। এমন মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমি কখনো বক্তব্য রাখিনি, আর পারবো ও না। বরং আমি আমার জীবনের একটা গল্প বলি —
আমার বয়স তখন পাঁচ ছয় হবে, পাঁচটা শিশুর মতো খেলাধুলা করেই বেড়াতাম। মা কাজ করতেন আমাদের গ্রামের বাইরে একটা বাঙালি বর্ধিষ্ণু পরিবারে। সকালে যখন মা কাজে যেতেন, আমাকে নিয়ে যেতেন। সেই বাড়ীতে চার পাঁচ জন আমার মতো ছেলে মেয়ে ছিল। তারা সকালে যখন টিফিন করতো গিন্নিমা ওদের সাথে আমাকেও দিতেন। সত্যি কথা বলতে কি, ওই লোভেতেই যাওয়া। ব্রেকফাস্টের পর বাচ্চাগুলো পড়তে বসত। আমিও ওদের পাশে বসে পড়া শুনতাম। খুব ভালো লাগতো, ওদের দিদিমণি এসে যখন পড়া বুঝিয়ে দিতেন তখন আরো ভালো লাগতো। খাওয়ার লোভে যাওয়াটা আস্তে আস্তে আমার পড়ার লোভে পরিণত হলো। এই ভাবেই চলছিল, একদিন দিদিমণি এসে বাচ্চাদের একটা মুখস্ত করতে দেওয়া কবিতা বলতে বললেন। কিন্তু কেউই ঠিকঠাক বলতে পারছিল না। আমার মুখটা তখন উসখুস করছিল কবিতাটি বলার জন্য। বাচ্চাগুলো যখন বই দেখে জোরে উচ্চারণ করে কবিতাটি মুখস্থ করেছিল, আমার শুনেই সেটা মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল ‘দিদিমণি আমি বলবো’ কথাটা। তিনি একটু অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, আমি কবিতাটি কি করে জানলাম। আমার উত্তর শুনে উনি আরো অবাক হয়ে আমাকে কবিতাটি বলতে বললেন। আমি বললাম, শুনে উনি এতটাই খুশি হলেন যে সঙ্গে সঙ্গে গিন্নিমাকে এবং মাকে আলাদা ডেকে কিছু কথা বললেন। তারপর দিন দিদিমণি মাকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে এলেন। প্রথম দিকটায় আমাকে নিয়ে সবাই হাঁসাহাসি করত, কিন্তু বছর খানিক পর আমার পড়াশুনার ধরণ ও রেজাল্ট দেখে যাঁরা হাঁসাহাসি করতেন তাঁরা ভালো বাসতে শুরু করলেন। ক্লাস ফোরে মগ টেস্টে আমি খুব ভালো রেজাল্ট করলাম। স্কুলের এক্সজামেও আমি প্রথম হলাম। তারপর ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার হাত ধরে আবার ভর্তি হলাম লাউদোহা উচ্চ বিদ্যালয়ে। ক্লাস ফাইভ থেকে যখন প্রথম হয়ে ক্লাস সিক্সে উত্তীর্ণ হলাম তখন আমি আমাদের প্রধান শিক্ষক শ্রদ্ধেয় পরিমল হাঁসদার নজরে পড়লাম। তিঁনি আমাকে ডেকে আমার পারিবারিক পরিস্থিতির সমস্ত খবর নিয়ে আশ্বস্ত করলেন যে আমি যেন হঠাৎ করে পড়াশোনা ছেড়ে না দেই। আমার সুবিধা অসুবিধাগুলো আমি যেন ওনাকে জানাই। ওনার আন্তরিক সহযোগিতায় আমি খুব ভালোভাবে একের পর এক ক্লাসে উত্তীর্ণ হয়ে মাধ্যমিক পাশ করলাম। পাঁচটা সাবজেক্টে লেটের পেয়ে পাশ করলাম।আমিই হলাম আমাদের স্কুলের ম্যাক্সসিমাম নাম্বার প্রাপ্ত প্রথম স্টুডেন্ট।আমার নিজের খুশি হওয়ার ঢেউটা এবার এসে পড়ল আমার গ্রামের মানুষদের মধ্যে। তাঁরা আনন্দে উৎসব করলো,কেউ কেউ আর এগিয়ে যাওয়ার আশীর্বাদও করলেন। কিন্তু বাবা সমাজের কথা ভেবে আর না পড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দেবেন মনস্থ করলেন। কথাটা শুনে আমি খুব ভেঙে পড়েছিলাম। হেডস্যার এসে বাবাকে অনেক বোঝালেন, তাঁর দিক থেকে তিনি যতটা পারবেন সহযোগিতা করবেন। কিন্তু বাবা অনড়, মা চুপ। তাঁরা আমার শিক্ষার থেকে সমাজ নিয়েই বেশি ভাবিত। সাভাবিক ভাবেই মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। কলেজে পড়ার বিরাট একটা ইচ্ছা আমার মনে জাল বুনেছিলো, সেটা যেন এক লহমায় ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
ঠিক সেই সময়ে আমার জীবনে এক নক্ষত্রের উদয় হলো। পরদিন দুপুরে আমি বারান্দায় বসে আছি,তখন এক ভদ্র মহিলা এসে মাকে ডাকলেন। মা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, কিন্তু মা ভদ্র মহিলাকে চিনতে পারলেন না। ভদ্র মহিলা পরিচয়টা একটু পরিষ্কার করতেই মা চিনতে পেরে ওনাকে জড়িয়ে ধরলেন। মা আমাকে দেখিয়ে বললেন – “আরে ওই তো ঝুমুর, তুর বেটার সাথে খেলতো বটে। বেঁচে থাকলে ঝুমুরের মতো হতো বটে।” ভদ্র মহিলা আমার দিকে এগিয়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। অচেনা মানুষ, আমার অস্বস্তি লাগলেও সরে আসতে পারলামনা এই ভেবে, উনি হয়তো ওনার মৃত সন্তানের অপত্য স্নেহের স্বাদটা আমার কাছ থেকে পেতে চাইছেন। এর পর যখন উনি শুনলেন আমি মাধ্যমিক পাশ করেছি উনি আরো খুশি হলেন। আমারও ধীরে ধীরে আন্টির উপস্থিতি বেশ ভালো লাগছিলো। তিনি আমাকে বোঝালেন আমাকে আরো মোটা মোটা বই পড়তে হবে, বিদ্যান হতে হবে। বাবার না পড়াবার ইচ্ছার কথা শুনে বললেন -” তুই একদম বাবার কথা শুনবিনা, তোকে ডাক্তার হতে হবে। মনে রাখিস তোর জন্ম তোর জন্য হয়নি, হয়েছে নরকে ডুবে থাকা এই সমাজটার জন্য। তুই ডাক্তার হলে আর কোনো মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে না। ওঝা আর মোড়লের ডাইন অপবাদ দিয়ে নিরীহ মানুষ গুলোকে মেরে তাদের সম্পত্তি গ্রাস করতে পারবে না। শিশু মৃত্যু আর কোনো মায়ের কোল খালি করবে না। এর জন্য দরকার সমাজে তোর মত ছেলে মেয়ে। তোরাই পারবি এই ঘুন ধরা সমাজকে ঘুন মুক্ত করে এগিয়ে নিয়ে যেতে। এরই মধ্যে বাবা এসে আন্টির সব কথা শুনে বললেন –গরীব ঘরের মেয়েকে ওই সব স্বপ্ন দেখতে লাই বটে। উ যেমন আছে তেমন থাকতে দাও বটে। আরো পড়তে গেলে,ডাক্তার হতে গেলে কত বড়ো বড়ো কিতাব পড়তে হবে জানো? তার খরচ ও অনেক, কে দিবে সেই খরচ? আন্টি বাবার দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বললো – “আমি দেব।”
কয়দিন পর আন্টি আবার এলেন, আমি ততক্ষণে মায়ের কাছ থেকে আন্টির পরিচয়টা সম্পূর্ণ জেনে গেছি। উনি আমাকে আর বাবাকে নিয়ে লাউদোহা উচ্চ বিদ্যালয়ে গেলেন। ওখানে হেড স্যারের সাথে আন্টি আলাদা ভাবে অনেক্ষন ধরে কথা বলেন। কথা শেষে স্যর অতি উৎসাহে বললেন-” আমি তো তাই চাই, এমন সম্ভবনাময় মেধা অকালে ঝরে যাক কেউ কি তাই চায়! সব থেকে বড়ো কথা , আপনি আর্থিক ভাবে ঝুমুরের পাশে থাকছেন। আপনার ইচ্ছার লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে ওকে সাইন্স নিয়ে পড়তে হবে।'”
হেড স্যারের গাইড লাইন ও আন্টির অর্থ সাহায্যে শুরু হলো আমার নুতন করে পড়াশুনা। আমি বুঝলাম এবার আমার লেখাপড়া শুধু শিক্ষিত হওয়ার জন্য নয়, আন্টি আমার চোখের সামনে একটা মাইল স্টোন বসিয়ে দিয়েছে। আমাকে সেই লক্ষে পৌঁছতে হবেই হবে। আন্টির কঠোর নজরদারিতে চলতে থাকলো আমার পড়াশুনা। একটা সময়ে আমি চারটি সাবজেক্টে লেটের নিয়ে খুব ভালো মার্ক্স করে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলাম। পাশাপাশি জয়েন্টে খুব ভালো নাম্বার হওয়ায় মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেলাম।
শুরু হলো আমার নুতন করে অন্তিম লক্ষ্যে পৌঁছনোর পরীক্ষা, এ যুদ্ধের দুই সেনাপতি আন্টি আর হেড স্যার। কারণ আমি তো পড়ে দায় সেরেছি, তাঁরা দায় সামলিয়েছেন। আন্টি তাঁর সঞ্চিত সমস্ত অর্থ এনে স্যারের হাতে তুলে দিলেন। বাকিটা হেড স্যার নিজে এবং স্কুলের অন্য শিক্ষকদের থেকে কালেক্ট করলেন। কিন্তু ভর্তি হলেই তো হলো না। স্টাডি এক্সপেন্সেস তো কম নয়, সেটা নিয়ে ওনারা চিন্তায় পড়ে গেলেন। শেষে এক অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত নিলেন, এবং সেটাকে বাস্তবে রূপ দিলেন। তাঁরা পশ্চিম বর্ধমান অঞ্চলে কোনো অবস্থাপন্ন পরিবারে শুভ অনুষ্ঠান হলে সেখানে গিয়ে আমার কথা বলে অর্থ ভিক্ষা করতেন। অনেকে অর্থ সাহায্য করেছেন, আবার অনেকে ভণ্ডামি ভেবে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। আমার জন্য দুইজন অকৃতদার মানুষ, একজন তাঁর সর্বস্ব দিয়েও ভিক্ষা করছেন। আর একজন তাঁর পদমর্যাদা ক্ষুন্ন করে ভিক্ষা করছেন, কেন না আমার ডাক্তারি পড়ায় যেন বিঘ্ন না ঘটে। এটা ভাবলেই আমার দুই চোখ জলে ভোরে যেত। আন্টি আমাকে বুকে টেনে বলতেন, সেইদিন সব সুদে আসলে ফেরত পাবো, যে দিন তুই গ্রামের পিছিয়ে পড়া গরীব মানুষ গুলোর পাশে দাঁড়াবি।
আজ সেই দিনের দুয়ারে আমি দন্ডায়মান। একটা সহায় সম্বলহীন অনগ্রসর শ্রেণীর ছাত্রীর পাশে থেকে তাকে পাদপ্রদীপের আলোতে আনা সেই কান্ডারি যুগলকে পাশে নিয়ে আমি শপথ নেব। আমার দুই কান্ডারির একজনকে তো সবাই চেনেন, তিঁনি হলেন লাউদোহা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্রদ্ধেয় পরিমল হাঁসদা। আর এক জন হলেন আমাদেরই পিছিয়ে পড়া সমাজের এক লড়াকু মহিলা। যাকে এক সময় গ্রামের মোড়লেরা ডাইনি অপবাদ দিয়ে পাগল করে গ্রামের বাইরে বার করে দিয়েছিল। সেই লড়াকু মহিলা হলেন ফুলমনি ওরাং। আমি দুই জনকেই মঞ্চে ডেকে নেব।
ফুলমনি ওরাং এবং পরিমল হাঁসদা মঞ্চে উঠতেই ঝুমুর এগিয়ে গিয়ে দুজনকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো। তারপর পোডিয়ামের সামনে গিয়ে ঝুমুর বললো -” আমি ফুলমনি আন্টিকে পাশে দাঁড়করিয়ে সকলের সামনে কথা দিচ্ছি, আমি গ্রামের হসপিটালে চাকরি তো করবোই তাছাড়া যত দিন প্র্যাকটিস করব গ্রামের গরিব মানুষ গুলোকে বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎসা করবো। (অডিটোরিয়ামে হাততালির বন্যা বয়ে গেল) আবেগে ঝুমুরের চোখে জল চলে এলো। চোখ মুছতে মুছতে সে বলল- ” আমি আর কিছু বলতে পারছি না। আমার ইচ্ছা আন্টি আপনাদের কিছু বলুক, ধন্যবাদ।”
ফুলমনি পোডিয়ামের সামনে এসে দাড়ালো। সে যে অপ্রস্তুত, সেটা তার জড়তা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। তবুও সে বলার চেষ্টা করল—” সবাইকে নমস্কার, ঝুমুর আমার সম্পর্কে একটু বেশিই বলেছে। ঝুমুরকে ডাক্তার হতে সত্যিই যদি কেউ সাহায্য করে থাকেন তিঁনি হলেন মাস্টার মশাই। আমি শুধু আমার মনের কথা গুলো বলেছিলাম। কারণ আমি এক সময় নরকে বাস করতাম। সেখানে ছিল কিছু মানুষরূপী পশু। তারা আমাদের সমাজের কোনো উন্নতি চায় না। বরং নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য সমাজ ব্যবস্থাকে কুসংস্কসরে ভরিয়ে রেখেছে। আমিও তাদের শিকার হয়েছিলাম। কিন্তু কপাল জোরে সভ্য সমাজের কিছু মানুষের সহযোগিতায় আমি সেখান থেকে মুক্তি পাই। যাইহোক আমি স্বর্গ দেখেনি, দেখেনি দেবতাও,তবুও আমার উপলব্ধি দিয়ে বলছি–আমি এখন থাকি এক দেবলয়ে, যেখানে থাকেন মানুষরূপী স্বয়ং মহাদেব। তিঁনি আমাকে ওই নোংরা পরিবেশ থেকে উদ্ধার করে তাঁর নিজ গৃহে স্থান করে দিয়েছেন। সেখানের আরও একজন আছেন, তিঁনি মহাদেব কন্যা সরস্বতী, আমার মৌলিদিদি। একটা নিরক্ষর আদিবাসী মেয়ের চোখে জ্ঞানের আলো ফুটুয়ে এই জায়গাতে আনা, এটা মা সরস্বতী ছাড়া কি সম্ভব? পরিশেষে আমি আমার একটা ইচ্ছার কথা জানাই–স্যার এর আনুকূল্যে আমার নিজস্ব কোনো খরচ হয় না। সেইজন্য স্যারের দেওয়া যে অর্থ আমি পাই তা সমাজের পিছিয়ে পড়া দুস্থ মানুষের জন্য আমি মাস্টার মশাই পরিমলবাবুর হাতে তুলে দেব,নমস্কার।”
অডিটোরিয়ামের সমস্ত শ্রোতা উচ্ছসিত করতালিতে ফুলমনির ইচ্ছাকে বরণ করে নিলো। আস্তে আস্তে মঞ্চের পর্দা পড়তে থাকলো। ঘোষক অনুষ্ঠানের যবনিকা পড়ার ঘোষণা করছেন। হলের মধ্যে ফুলমনিকে নিয়ে আলোচনার গুঞ্জন চলছে। কিন্তু মৃনালবাবু আর মৌলি নির্বাক। তাঁরা বাক্য হারা হয়ে অশ্রুপূর্ণ নেত্রে এদিক ওদিক চাইছে। মনে হচ্ছে জন সমুদ্রে কাঙ্ক্ষিত মানুষ ফুলমনিকে তাঁরা খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
আস্ত আস্তে তাদের সামনে ফুলমনি এসে দাড়ালো। মৃনালবাবু ও মৌলির চোখে জল দেখে ফুলমনি মৌলির দিকে তাকিয়ে বলল–” তুমি কাঁদছো মৌলিদিদি!!” মৌলি ফুলমনিকে জড়িয়ে ধরে বলল-” আমাকে ক্ষমা করে দাও, না জেনে না বুঝে তোমাকে ভুল বুঝেছি।”
—