চালচিত্র
ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
মদনের বৌ মাঠের দিকে গিয়েছিল। সতীশ খুড়ো উপুর মাঠে বেগুন চাষ করেছে। চারিদিকে বেড়া দিয়েছে যাতে কেউ চুরি না করে।গরমের কাল। বাবুরা ফ্যান চাইলে ঘুমুচ্ছে।।কোঁচলে ঝপাঝপ নিয়ে নিল কয়েকটা।আজ সরষে দিয়ে ঝাল রাঁদবে। ধানের শিষ কুড়োতে এসে তরকারি টাও জোগাড় হয়ে যায়। মন্দ কী। ওদের মরদরা অত সংসারের মায়া ভাবে না।
ধানের শিষ কুড়ানোর নামে নির্জন প্রান্তরে লোকের জমি থেকে ধান কেটে নেয় মাঝে মাঝে। দু বস্তা ধান হয়েছে।আরো একবস্তা করতে পারলেই তিন হাজার টাকা।শাউরির তো বলা মুখ চলা পথ ।বলবে “অ বৌ। তোর কত টাকা। আমাকে মশারি কিনে দিবি”।
সকালে ঘুম থেকে উঠে বড়ো বাড়িতে কাজে যায়। বাবুদের ছেলেরা জজ ব্যারিস্টার। সব শ ওরে থাকে। দু মাস অন্তর ছেলেরা পালা করে আসে। বলে যায়
“মদনের বৌ। মা কে দেখিস।তোকে দুহাজার টাকা দেবো। ঘর দোর সামলাস”। মদনের বৌ সব শোনে।
মাঠ থেকে ফিরে দেখলো শাউরি নটে শাক এনেছে। এই বয়সে ঠিক পুকুরের পাড় থেকে শাক তুলে আনে। ফোকলা মুখে হাসির বান ডেকে যায়।
“গয়লা নটে লো বৌ।রসুন লঙ্কা ফোড়ন দিবি।কী ভালো খেতে হয়।পাঁচটা টাকা থাকে তো দে না ।একটু বেসন আনি হরি ঘোষের দোকান থেকে।ছোট্ট ছোট্ট বেসনের বড়ার টক তুই খুব ভালো রাঁদিস”।
বৌ রাগ করে। “তোমার এই বয়সে ওসব খাবার মোট্টে খাওয়া যাবে না। তোমাকে কৈ মাছের ঝোল রেঁদে দেবো।বলেই জিয়োতে দেওয়া কৈ মাছ দেখালো”। শাউরি বৌ আজ অসীম আনন্দে ভাসছে যেন।
একগোছা এঁটো বাসন নিয়ে পুকুরে মাজতে গেল মদনের বৌ। বলে গেল “বাসনকটা মেজে পুকুরে গা ধুয়ে আসছি। তুমি শাক কটা বেছে রাখো। আমি এসে তোমাকে জলখাবার দেবো”। মা বললে “তা যা না বৌ। কতক্ষণ আর লাগবে বল।তবে ভিজে কাপড়ে তাড়াতাড়ি আসবি। ন ইলে যদি জ্বর আসে”।
বাড়িতে হাঁস মুরগী পুষেছে বৌ। একটা ডিমের দাম পাঁচ টাকা। ওপাড়ার নাপিত গিন্নি বললে “ও সুমি। তোর ডিম আছে”? মদনের বৌ সুমিতা।মদন ও সুমি বলেই ডাকে। সুমি বললে “আছে গো কাকীমা। কটা চাই”?
“দে না দশবারোটা”। সুমি পাঁচটা ডিম রেখে সব বিক্রি করে দিল। ইশারায় টাকাটা শাশুড়ি কে দিতে বলে উনুনশালে আগুন দিল। মাজা ঝকঝকে সসপ্যানে চা বসিয়ে হাঁড়িতে জল দিল। আদা দিয়ে চা আর মুড়ি বেড়ে শাশুড়ি র সাথে খেতে বসলো।হাঁড়ির জলটা ফুটুক।তারপর চাল দেবে এখন।
বেশ বেলা হয়ে গেছে। সুয্যি দেবতা মাথার উপরে। ছেলেটা নেই তাই রক্ষে। ইস্কুলে গরমের ছুটি।তাই পিসে এসে নিয়ে গেছে। একেবারে দু বেলার চাল নিয়ে নিল ।কাঠ কমে আসছে ।দুবেলা রান্না করা খরচার ব্যাপার।
মুড়ি খেতে খেতে বৌ বললে” ডিম যা বিক্রি হবে ওই পয়সা তুমি জমিয়ে রাখবে। মশারি কিনে দেবো। আমাদের এই পাড়ায় বাঁশঝাড়ের জন্য ই তো এত মশা হয়। ভাতটা ফুটুক মা। আমি বরং দৌড়ে গিয়ে কটা ডুমুর আর কটা কুলেখাড়া পাতা চট করে তুলে আনি। ঝোলটা টেস হবে”।
শাউরি বললে খুব সাবধানে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ডুমুর তুলবি। নৈলে মাথা ঘুরবে খেয়ে। সুমি খিলখিল করে হেসে বললে “এই বয়সে তাও শেখাবে”।
সুমি ডুমুর তুলছে দেখে গঙ্গা বলল “বড়ো পুকুরে সব জল ছেঁচে দিয়েছে। যাবি বৌ মাছ ধরতে?
সুমি বড়ো বড়ো চোখে বলে “তাই নাকি? তবে কখন যাবো।না রাঁদলে তোর দাদা কাজ থেকে এসে খাবে কি?যাবার আগে প ইপ ই করে বলে গেছে “মন দিয়ে রাঁদবি সুমি”। গঙ্গা হাসতে হাসতে মাছ ধরতে চলে যায়।
বাড়ি ফিরে সুমি দেখলো মদন এসেছে। এত তাড়াতাড়ি কাজ থেকে ফিরে গেল! এখনও ভাত ই নামে নি। বললে “সুমি। কেরাচিনির বোতল দে”।
সুমি আদরের ঢঙে বললে “ক্যান গা।কী হবে”।
“তুই তো উকিল মশাই। সব কতা তোরে বলতেই হবে?”
মদনের সামান্য কথাতেই সুমির অভিমান । বলে “বেশ যাও! বলতে হবে না”।
মদন পিছন থেকে সুমিকে জড়িয়ে ধরে। বলে “পাগলী বৌ একটা”।বড়োপুকুর ছেঁচেছে।পাঁকে নেমে মাছ ধরবো। তাই কেরাচিনি চাইছি। নাহলে গা কুটিয়ে মরব।
শাউরি উনুনশালে। ডুমুর কেটে ধুচ্ছে। “কুলেখাড়া গুলোর কাঁটা হয়ে গেছে বৌ”।সুমি বললো “আমি করছি।তুমি চুপ করে বোসো”। মদন কেরাচিনি মাখতে এসে দুটো ল্যাটামাছ দিয়ে গেছে।
পাকা তেঁতুল শিষ কুড়োতে গিয়ে কুড়িয়ে এনেছে সুমি। “আজ জবর রান্না করবি বৌ”?
“হ্যাঁ গো মা। বেগুনের তেলঝাল,কৈ মাছের ঝোল আর ল্যাটা মাছের টক”। শাউরির চোখ চকচক করে। সুমি বলে “টক খাবার মাস্টারণী তুমি”। শাউরি বলে “বড়ো করে সিঁদুর পরলে তোকে সোন্দর দেখায়”। সুমির মনে খুশি র জোয়ার আসে।
সেই কবে মা কে হারিয়েছে সুমি। গান করতে করতে কাজ করতো মা। মুখে হাসি লেগেই থাকতো। সেই সুর ভালোবাসা হয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখতে শেখায়। শাউরি টাও তো মা। কত ভালোবাসা কথায় ঝরে পরে। সেই যে বারে টাইফয়েড হল। শাউরি কত সেবা করেছে। এসব ভাবতে ভাবতে রান্না করে সুমি।
মদন ফিরে এল একগাদা মাছ নিয়ে। শোল,বোল,ল্যাটা,কৈ। সুমি বললে “দারুণ। কর্তামা কে কটা কৈ মাছ দিয়ে আসবো। মাংস তো খায় না।তবে মাছটা খায়”। মদন চুপ করে থাকে। সংসারে সুমি হল গিয়ে নেত্রী। শাউরি বলল ,”চানটা করে নে মদন।গোটা গায়ে পাঁক লেগে আছে”। সাবান আর তেল নিয়ে পুকুরে স্নান করতে গেল। বললে “তুই জল জায়গা কর।আমি আসছি।”
খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে ঘরের কাজ গুছিয়ে নিয়ে সুমি গেল কর্তামার কাছে। শাউরি বলল “কখন আসবি বৌ”।
“তা একটু দেরী হবে বৈকি মা। কর্তামা বড়ো দুখি। ছেলে সংসার কেউ কাছে নেই”। শাউরি বলে “বেশি রাত করিস নি। আমার একা থাকতে ভালো লাগে না”।
মদন জেলের মতো মানুষ দের জীবন কঠোর সংগ্ৰামের। “একটা জাল আর একটা নৌকা যদি থাকতো তবে নদীতে মাছ ধরে সংসারের সব অভাব মিটিয়ে দিতে পারতো।বৌ কে অত কাজ করতেই দিত না”। সুমি চলে গেলে এসব চিন্তা করছিল মদন। হঠাৎ সোমেশ্বর এসে হাজির। বললে “কী করছো গো মদন দা!
মদন বলল “আয়। বিড়ি খাবি?
তা দাও একটা। খাই।
“আচ্ছা মদন দা। তোমরা কী কর্তাবাবুদের জমি ঠিকে নিয়েছ? নিতাই খুড়ো বললে ওদের জমি মদন ছাড়া আর কাকে দেবে। মদনের বৌ কর্তামাকে দেখশোন করে।” সোমেশ্বর এক নিশ্বেসে বলে যায়।
মদন বলে “গাঁ এর লোকের আর কাজ কী? ওই তো আছে। বলি জমি চাইলে কর্তারা রাজি হবে ঠিকই, তবে কথায় বলে না “ঘরে নেই ইন্দি/ভজরে গোবিন্দি”।
“চাষ করতে টাকা চাই। কে দেবে এত টাকা।তারপর যদি মড়ক লাগে তো কপাল চাপড়ে মরো।
আচ্ছা সমে। জমি কী কারো দরকার?বর্গাদারী আইনের জন্য এখন কেউ জমি কাউকে দিতে চায় না।”
সোমেশ্বর চলে গেল।মদন বিড়বিড় করে বলল “সব চালবাজি”।
বড়ো বাড়ির কাছে এসে অবাক হল সুমি। সাঁঝের বেলা আলো জ্বালা নেই। চারদিক আলো আঁধারী।ডাক দিল “কর্তা মা।ও কর্তা মা। কোতায় আছো গো।”সুমি আওয়াজ না পেয়ে এগিয়ে গেল। “কর্তামা। দরজা হাট করে খোলা,চারদিক অন্ধকার ক্যান গা”।
ভেতর থেকে একটা অস্ফুট গোঙানি কানে আসতেই ছুট্টে কর্তামার ঘরের দিকে গেল সুমি। শুনতে পেল কান্নার আওয়াজ।
সুমি ঘরে গিয়ে দেখলো সব অগোছালো। বললে “কী হয়েছে গো মা।”
কর্তামা বলল “মদনের বৌ। তুই এসেছিস মা। আমি হা পিত্যেশ করে বসে আছি। আমার পা এর যন্ত্রণা টা খুব বেড়েছে। গঙ্গা এয়েছিল খানিক আগে। ওকে জিজ্ঞেস করলুম “ও গঙ্গা। বলি বৌ কে দেখিচিস। গঙ্গা বলে কিনা বৌ শাউরির জন্য ডুমুর তুলছিল। ঝোল রাঁদবে”।
সুমি বলল “তাই বলো। আমি বলি বড়ো দোর কে খুলল।হ্যাঁ গো কর্তামা। রোজের এক জ্বলন হয়েছে এই রাঁদাবারা।কী রাঁদি তাই ভেবে সারা হ ই। সকালে ধান কুড়োতে গেসলুম গো মা। ইদিকে কাঠ ফুইরেছে। জ্বালোনের অভাব”।
কর্তা মা বলে “এককাজ করবি বৌ। ঘুঁটে কিনে নিবি। আর মদন কে বলবি গঞ্জের ওখানে করাতকল থেকে কাঠগুঁড়ো এনে দিতে। নেপালের মা বলছিল ।খুব সুবিধে। কুড়ি টাকা বস্তা”।
“আর মা গো। কুনদিকে যাই। ঘুঁটের পোন কুড়ি টেকা। তোমার ছেলের সারাদিন কাজ করে যা হয় তাতে পেয়োজন মেটে না গো”।সুমির কথায় কর্তামা বলে”ক্যানে। ও তো মাছ ধরে।তোদের জাত ব্যাওসা।ওই এক ই কাজ করে সঞ্জয় পাকাঘর তুলছে। তোরা ক্যান পারিস না”।
“হায় রে কপাল। ওরা আর আমরা। সঞ্জয় জেলে এই এলাকার ধনী জেলে। ওর নিজের জাল আছে অনেকগুলো।নিজে মাছ ধরে আবার জাল ভাড়া দেয়। খ্যাপলা জাল আছে পাঁচটা। তিনটে নৌকো ছিল ।বর্ষার মরশুমে আরো দুটো নৌকো নামবে।”
সুমি বলে যায় “এখন তো তবু ভালো করে খেতে পাই। কতগুনো প্যাট ভাবো দিকিনি। গরীবের যত নেই তত খিদে গো কর্তামা।বুড়ি শাউরি টাকে একটু ভালো করে যত্ন করতে পারি না”।
এই বলে সুমি বলল “কর্তামা। তুমি একটু ওঠো। ওই চেয়ারটাতে বসো। তোমার বিছানাটা ঝেড়ে দিই। চাদরটা বদলে কাচা চাদর বিচ্ছে দিই।এভাবে থাকলে অসুখ বিসুখ করবে। ওঠ মা”।
আসতে আসতে কর্তামাকে তুলে চেয়ারে বসালো মদন জেলের বৌ।তারপর বিছানাটা সুন্দর করে পরিস্কার চাদর পেতে দিল।কর্তামা কে বলল “তোমার কাচা কাপড় বেলাউজ দিলাম। ওগুলো তো বাসি।ছেড়ে দাও মা। কেচে দে যাই।”
নতুন কাচা কাপড় পরিয়ে বাসি কাপড় সাবান জলে ডুবিয়ে ঘর দোর ঝাঁট দিল।কর্তামা বলে”তোর কাজের বাগ আছে রে বৌ। কেমন সুন্দর করে দিলি সবকিছু নিমিষেকে।
চিরুনি টা এনে বলল “তোমার চুলটা আঁচড়ে দি কর্তামা। বাবুই পাখির বাসা করে রেখেছ”।
চুলটা আঁচড়ে তুই চলে যাবি না কিরে বৌ?
আজকাল বড় একা লাগে।এতবড় বাড়ি যেন গিলতে আসে।তুই আর একটু থাক না বৌ”।
“এক কাজ করি কর্তামা। এট্টু তেল গরম করে আনি। তোমার পাটা টিপে দিই”।কর্তামা উৎফুল্ল হয়।”তোর মতো মেয়ে লাখে একটা মেলে”।
“মদনের বৌ কর্তামার সেবা করে বাড়ির দিকে যায়।মনে মনে বলে “রাতে র ভাত আছে। গরম ডিম ভেজে নেবো এখন”।
বর্ষার মরসুমে গাঁ এর গরীব গুর্বোদের কষ্ট। মদনের দুটো ঘরেই জল পড়ে। শ্রাবণ মাসে জল থৈথৈ। নদীও তখন যেন সাগর। রাত দুপুরে বুড়ি শাউরি আর দুধে বালক ছেলে নিয়ে সুমি অস্থির হয়ে যায়। মাকে বলে “ও মা। ঘুম আসে না। তোমার ছেলে কত কষ্ট করে।আমার ভয় হয়।”
এবারে পুবুলে করেছে।মাছ ধরাও বন্ধ তিনদিন।নদীতে জল ছেড়েছে। উপুরমাঠে হাঁটু অবধি জল। মদন বলে “তুই রাঁদবি কী করে সুমি? উনুন ভর্তি জল”। সুমি কাঁদতে থাকে দেখে মদনের মেজাজ চড়ে যায় “আঃ।কী হচ্ছে কী”?মদনের বকুনিতে কান্না দ্বিগুণ হয়ে যায়। মদন বলে “এই বৃষ্টিতে কর্তামার বাড়ি তুই যাবি না।ক্যানে। ওদের ছেলেদের কর্তব্য নেই।বুড়ি মাকে ফেলে নিজেরা স্বর্গ সুখ ভোগ করছে। তুর সংসার নাই?
মদন কেরাচিনি আনতে গেল।বাইরে প্রচন্ড হাওয়ার দাপট। দেখলো রান্নাচালাটার একটা অংশ ভেঙে পড়েছে।মনটা হু হু করে উঠল সুমির জন্য। কখনও ওমনি করে বকে নি। আসলে সুমির চোখে জল দেখলে ওর মাথার ঠিক থাকে না।মনে মনে বলল “সুমি তুই কাঁদিস না। তোকে বড্ড ভালোবাসি”।
মদন কেরাচিনি নিয়ে ফিরলে রান্না বসলো। ঠাকমা নাতিকে গল্প বলে বর্ষার রাতে। রূপকথা,আকাল সব গল্প। আর সুমি রান্না করতে করতে চিন্তা করে কর্তামার কথা। সব থেকেও কেউ নেই। কতবার বলেছে “কর্তামা। তুমি যাও ছেলের সংসারে” বলেছে “ছেলের সংসারে আমার ঠাঁই নেই”।কেন যে নেই তা সুমি বুঝতে পারে না। এই যে তিল তিল করে রক্তের ডেলাটাকে মানুষ করা, কতদিন না খেয়ে সন্তান কে খাওয়ানো,অসুস্থ হলে রাতজাগা, কত স্বপ্ন সব কী তবে মিথ্যে? টাকা, সম্পদ,বোভব সব হল। মা এর ভাঙাচোরা বুড়ি গলার ডাক “খোকাআআআ। আমি তোর মাআআ। তুই শুনতে পাচ্ছিস না”। এইসব ভাবতে ভাবতে সুমির গাল,চিবুক জলে ভেসে যেতে লাগল। মদন বলতে থাকে “ও সুমি। অমন করে কাঁদতে নেই।আর বকবো না তোকে। ও বুঝেছি। আচ্ছা।রান্না করে নে। আমি তোকে কর্তামার বাড়ি নিয়ে যাবো। স্বামীর বুকে মাথা রেখে অঝোরে কাঁদতে থাকে মদনের বৌ”।
আলুভাতে লঙ্কাভেজে মাখলো মদন ।আর গরম গরম ডিমভাজা দিয়ে শাউরি আর ছেলে খেয়ে নিল। মদন আর সুমি পরে খাবে। এখন ওরা কর্তামার কাছে যাবে। এই বর্ষা এখন ছাড়বে না।কর্তামার কী প্রয়োজন তা জানাও দরকার।
বড় দরজা বন্ধ ছিল। কী ভাগ্যি মদন আছে। পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকে দরজা খুলে দিল। সুমি বাড়ির ভিতরের দরজায় টোকা দেয়। “কর্তামা। দরজা খোলো। আমি এয়েছি”।
দু তিনবার ডাকার পর দরজা খুললো কর্তামা। অঝোর নয়নে বললে “বৌ। আমাকে একা ফেলে যাসনি। আমাকে তোরা নিয়ে চ। এখানে থাকলে আমি মরে যাবো”।
কর্তামা যত কাঁদে সুমি আরো বেশি কাঁদে। মদন ভাবে আচ্ছা খপ্পরে পরা গেছে। বলে “সুমি। তুই কাঁদবি না কি কর্তামার খাবারের জোগাড় করবি”।
মদনের কথায় সম্বিত ফিরে পায় সুমি।বলে “এই তো। ভাতেভাত চাপ্পে দিচ্ছি। কাল ধরণ করলে আসবো। সব ঠিক হয়ে যাবে। দুবলার খাবার একবারে রেঁদে দেবো। কর্তামা। তুমি কেঁদো না। আমি হ্যাঁচোড় প্যাচোড় করে মরি”।
“কর্তামা। এই বরষায় তুমি দাদা দের কাছে শ ওরে যেতে পারো। এখানে রাত বিরিতে একা। দিনেমানে না হয় সুমি আসবে। রাত্তিরে একা থাও।আমার ভাবনা হয়” কথাটা বলে কর্তামার দিকে চাইলো মদন।
কর্তামা বললে “ওখানে আমি গেলেই বড় অশান্তি। বড় বৌ তো বলে ঘর থেহে বেরোবে না। সবার সাথে কথা বলবে না। বৌ এর ভয়ে ছেলেরা জুজু। এই তো একটু আগে ফোন করে খবর নিল।বলে ঝড় জল হলেও মদনের বৌ কে আসতে হবে। ওর দায়িত্ব জ্ঞান নেই?আমি বললাম চুপ কর তোরা। লোককে দায়িত্ব শেখাতে যাস না। গু গোবরের কুলকুচি দেবে তোদের গা এ”।
মদন বলে “এ কী গো। তবে তো বুজাই যাচ্ছে উরা তুমাকে দেখবে না।”
কর্তা মা বলে, “সে কি আর আমি জানি না। তোরা আসার আগে বলছিল। বললে বৃদ্ধাশ্রমে তোমাকে পাঠাবো। ওখানে দারুন ব্যবস্থা। তাছাড়া গাঁ এর বসতবাড়ি, জমি,জায়গা,বাঁশবন, পুকুর বেচলে অনেক টাকা।ওদের ওটাই মতলব”।
সুমি রান্নাঘর থেকে চেঁচায়,আশ্রমে কেন যাবে?মদন বলে “বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে চায় ছেলে বৌ”।
আঁতকে ওঠে সুমি।বলে”ঘরের মানুষ ঘরে ঠাঁই পাবে না। তায় আবার গব্বধারিনী”।
কর্তামা উত্তর দেয় “গর্ভের কলঙ্ক”।
আকাশ টা বেলার দিকে ধরণ করতেই সুমি উপুর মাঠের দিকে গেল। মদন মাছ ধরবার ছুতোয় বেড়িয়েছে। এই তাল। নৈলে বলবে “জলকাদায় বেড়িয়ে দ্যাখ। তুর একদিন কী আমার একদিন”। সুমি বরের কথায় হাসে।
একহাঁটু জলে গিয়ে মাঠকলমী শাক তুলে নিয়ে এল। আলের গর্তে হাত ঢুকিয়ে ঝপাঝপ দুধে কাঁকড়া। উফফ।দারুণ লাগবে খেতে। আদা আর রসুন দিয়ে রাঁদবে। কবরেজ খুড়োর বৌ সাথে ছিল। কাপড়টা ভিজে গেছে একেবারে।
সবকিছু নিয়ে বাড়ি ফিরলে মদন গম্ভীর হয়ে থাকে। সুমি চুপচাপ নিজের কাজে মন দেয়। জানে একটু পরেই বলবে “সুমি রাণী।চাঁদবদনী”।
কিন্তু না। আজ কী একটা হয়েছে যেন। জিজ্ঞাসা করতে ভয় পায়।খেতে বসে ভালো করে খায় না।সুমি বলে “কী হয়েছে?
মদন উত্তর দেয় শান্ত ভাবে “কাজ টা নেই”।
এতক্ষণ চুপ করেই ছিল। পুকুর ঘাটে বাসন মাজতে গিয়ে গঙ্গার কাছে ভেঙে পড়ল সুমি। বলল”এবার আমরা কী খাবো”?
গঙ্গা বলল “আমি আন্দাজ করেছিনু। এমন একটা হবে। গ্ৰামে কানাঘুষো শুনেছি। ওদের ধারণা কর্তামা তুদের জমি লিখে দেবে।কী রিরিংসে বাবা”।
কথাটা কর্তামার কাছে গেছে। ঘর মুছতে গিয়ে গঙ্গা বলেছে বৌ ঘাটে কাঁদছিল। হু হু করে ওঠে অতৃপ্ত মাতৃহৃদয়। বলে “গঙ্গা। শুনে রাখ। গাঁ এর লোক ঠিক বলেছে। তুই আমাকে নিয়ে চল বৌ এর কাছে”।
মদন দূর থেকে দেখলো কর্তামা আসছে। বলল “ও সুমি। কর্তামা আসে আমাদের ঘরে”।
সুমি ছুটে বেড়িয়ে আসে। মা আসছে। চিৎকার করে কর্তামাআআ। কাল থেকে ওদের কত চিন্তা।কর্তামা এসে জড়িয়ে ধরে।
বলে, “ভয় কী রে!যার মা আছে তার আবার কিসের ভয়”।
পরের দিন গোটা গাঁ জেনে গেল কর্তামা তার চাষের জমি মদন জেলের বৌ কে দিয়ে দিয়েছে।
(সমাপ্ত)