জীবনপাঁচালী
ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
1
কতদিন ধরে ভেবে অস্থির হচ্ছিল শ্যামাপদ। বাড়ির পিছনে বিরাট বটগাছটার তলায় যখন দুপুরে চ্যাটাইটা পেতে শুতো তখন সেই চিন্তা উসকে দিত পাঁচি। বলতো “কালবোশেখির ঝড়ে ঘরের মটকা উড়ে রোদে হাপসে দিচ্ছে। এখন না হয় গাছতলায় আশ্রয় নিয়ে দিব্যি কাটাচ্ছো বলি এরপর যখন অঝোরধারে বারিষ নামবে তখন ছেলেপুলে নে কোতা যাবো বলো দিকি। এট্টা ব্যাবস্থা করতে হবে।”
এই চিন্তা শ্যামাপদ কেও গ্ৰাস করে আছে। তবু বৌয়ের দিকে কটকট করে তাকায়। রাগত স্বরে বলে “তোর বাপ ভাইকে বলগে না। বে তে তো আচ্ছা ঠকালে। একন হাজার কুড়ি দিতে বল।ঘরটা বাঁধি বর্ষার আগে”।
পাঁচি বলে “তারা কেনে দিতে যাবে। তুমার সংসার তোমাকেই করতে লাগবে। “
শ্যামাপদ কামটের মতো দাঁত বার করে বলে “তবে ম্যালা ফ্যাচর ফ্যাচর কিসের। শালা যবে থেকে ঘাড়ে চেপেছে তবে থেঙে শান্তি দিলে না। আমার ঘর ফুটো তো অন্য ঘর বেঁধে নে গা”।
কী কথায় কী উত্তর। পাঁচি উঠে আসে । বুকের মধ্যে একটা দলাপাকানো কান্না গলার কাছে আটকে যায়। ঘরে এসে হাঁক দেয় “ও কেষ্ট। কী করিস বাপ”?
কেষ্ট পাঁচির ছেলে। প্রাইমারি ইস্কুলে পড়ে। আট বছর বয়স। সাড়া দেয় “পড়ালেখা করি মা। সেলেটে সব লিখেছি। মাস্টারমশাই বলেছেন কেষ্ট আমাদের ফাস্টো বয়”।
ছেলের কথায় শান্তি পায় পাঁচি। উনুনশালে ন্যাতা দিয়ে এঁটো বাসন নিয়ে চলে যায় পুকুর পাড়ে। গোবরমাটি দিয়ে বাসন মাজতে মাজতে মনে পড়ে যায় বাপের কতা।বাপ বলতো “পাঁচির এমন ঘরবর হবে যে কুনো অভাব হবে না”।
বাসনগুলোর উপরে নোনাজল পড়তে থাকে। সোয়ামি শ্যামাপদ কত শিক্ষিত। পাড়ায় সবাই বলে “শ্যামা আমাদের উচ্চমাধ্যমিক ফেল। তাতে কি?অত দূর যাওয়া কি চাড্ডিখানি কতা।”
বাসনমাজা হয়ে গেলে মুখে চোখে জল দেয় পাঁচি। ঠিক সেইসময় ওখানে হাজির হরির বৌ। বললে “কী হল গো ঠাকুরঝি। কেঁদে কেঁদে চোখদুটো যে লাল।”
পাঁচি মৃদু হাসে। বলে “কপালের দোষ গো বৌদি। ভগমান কাঁদনের কপাল দেছে”।
হরির বৌ উত্তর দেয় “সয়ে থাকলে রয়ে পাবে গো”।
কথা আর এগোয় না। বাসনের গোছা নিয়ে বাড়ির দিকে এগোতে থাকে।
শাশুড়ির জন্যে মনটা কেঁদে উঠলো ওর। একটা হাত নুলো শাশুড়ির। পাশের পাড়ায় ইস্কুল ঘরের পাশে মোহন্তদের চন্ডীমন্ডপে থাকে। কতবার আসে। তাকিয়ে দেখে পাঁচিকে। মাথায় হাত দিয়ে বলে “অ বৌ। ঘর বাঁধলে আমায় থাকতে দিবি তো। দোয়ারেই থাকবো। তবু তাড়াস না বৌ।ছেলে আমার জন্ম গোঁয়ার। তুই আমাকে ফেলিস না”।
পাঁচি বাসন রেখে ওলকপি কাটতে বসলো। ডিম দিয়ে ওলকপি রাঁধবে। হঠাৎ নজরে এল শাশুড়ি আসছে। দরজার কাছে এসে ডাকে “বৌ।অ বৌ। কী করছিস। এট্টু ল চা খেতে এলুম। করবি তুই?”
বুড়িটার প্রতি বড়ো মায়া পাঁচির। ওর ইচ্ছা হয় বুড়িটাকে যত্ন করে। শীর্ণ শির বের করা হাত দিয়ে যখন পাঁচির গায়ে হাত দেয় তখন পাঁচির মনে হয় “এই তো মা। কত মমতা ঝরে পড়ে চোখ থেকে”।
মাজাবাটিতে চা বসায় পাঁচি। আঁচলের খুঁট থেকে পাঁচটা টাকা দেয় কেষ্টকে। বলে “যা বাবা। ঠাগমার জন্যি চানাচুর কিনে আন। দুটো মুড়িমেখে দি”।
বলিরেখায় ভরা মুখে খুশির বন্যা বয়ে যায়। আড়চোখে দেখে নেয় শাশুড়ির সাদাথানের অনেক টা ছেঁড়া। গায়ে ব্লাউজ নেই। পাঁচির কানে পাশা দেখতে পায় বুড়ি। বললে “কার থেকে কিনলি। সোন্দর মাইনেছে তোকে”।
একটা অপরাধবোধ গ্ৰাস করে পাঁচিকে। কতবার ভেবেছে ঘরখানা বেঁধে সবাই মিলে থাকবে। দুপয়সা ইনকামে চার পয়সার বাওলামি। আবার কেষ্টকে লেখা পড়া শেখাতে হবে। ম্লান মুখ গুলো ওর ভরসায়। কিন্তু ওই বা কী করবে? লেখাপড়া না জানা মেয়েমানুষ।
ঠাগমা তাকিয়ে আছে নাতির ঘরে ফেরার দিকে। এই পৃথিবীর সব স্বাদ আস্বাদন এর সময় ফুরিয়ে আসছে তার। তাই হয়তো এত আকুতি।
কেষ্ট মুখে এমন আওয়াজ করে পাঁচটাকার চানাচুর নিয়ে ঘরে ঢোকে যেন সদ্যকেনা বাইক নিয়ে ঢুকলো। ফোকলা দাঁতে ঠাগমা হাসে। পাঁচি বলে “সিলভারের বাটিটা দাও। লঙ্কা জিরে ভাজবো”।
বড় গামলায় মুড়ি মাখে পাঁচি। মিশিয়ে দেয় পেঁয়াজের কুচি। বুভুক্ষু প্রাণগুলো তৃপ্তি করে খায়। সাথে চা। দুধ নেই। তবে ভালোবাসা যেন উপচে পড়ছে।
বুড়ি শাশুড়ি তৃপ্তি করে মুড়ি খায়। চোখগুলোতে কোনো স্বপ্ন উঁকি দেয় না। শুধু বৌ এর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। পাঁচি বললে “আজ রেতে আর গিয়ে কাজ নেই। একেনেই দুটো খেয়ে কেষ্টর কাছে শুয়ে পড়বে।”
চারটে বড়ো বড়ো হাঁসের ডিম খোল থেকে বার করে আনলে বৌ। চোখদুটো বেরিয়ে আসে শাশুড়ির। বললে “অ বৌ। ডিম রাঁদবি? গুটা গুটা ডিম। কতদিন খাই নি”।
পাঁচি হাঁস পোষে। খোলে অনেক হাঁসের ডিম এখন। বললে “এবার তো খাবে মা। “
শাশুড়ি বলে “ডিমের ঝোলে আলু দিবি নে?”
পাঁচি কিছুক্ষণ নীরব থাকে। তারপর উত্তর দেয় “অনেক দাম। পুকুরের পাড়ে ওলকপি বস্যেছিলেম। তা বাড়ে না ভালো। আর তোমার ছেলের রক্তে চিনি। আলু খাওয়া মানা”।
শাশুড়ি অবাক হয়ে তাকায়। “হায় কপাল! লক্তে চিনি ঢোকে ক্যামনে”। শাশুড়ির কথায় হাসি পায় পাঁচির। বলে “ওসব বোঝা তোমার কম্মো নয় গো মা”।
মা এর মন। অজানা আশঙ্কা গ্ৰাস করে। বলে “ওইসব ছাইপাঁশ খেয়ে লোগে ধরেসে। তাই খাটবার খেমতা নেই”।
একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে পাঁচির। ওলকপি ছোট্ট ছোট্ট টুকরো করে নুন দিয়ে হালকা সেদ্ধ করে নেয়। তারপর ডিমসিদ্ধ করে। শাশুড়ি ঠায় তাকিয়ে দেখে। এমন সংসার ছেলের হবে সেটাতো কল্পনায় ছিল। এখন দেখে ঠিক সেরকম হয়েছে কিনা। পাশের ঘরে কেষ্ট পড়ছে
“Little deeds of kindness
Little word’s of love
Make our earth an eden
Like the heaven above”
এসবের মানে এরা বোঝে না। ডিম সিদ্ধ হয়ে গেলে ঠান্ডা জল মিশিয়ে ডিমের খোলা ছাড়ায় পাঁচি। শাশুড়ি ডুকরে কেঁদে ওঠে। বলে “বৌ। অ্যাই নুলো হাতে তোরে ডিম ছাইড়েও দিতে পারি না। কী কপাল মোর।”
পাঁচি সান্ত্বনা দেয়। শাশুড়ি বলে “তোর কটা হাঁস বৌ। যশি বলছিল শওরে হাঁসের ডিমের দাম বেশি। তুই ওরে দিবি বৌ?”
পাঁচি বলে “তাতে লাভ নেই গো মা। যশিরা লাভ রাখে। ওতে লাভের গুড় পিঁমড়েতে খায়”।
উনানে একহাতে গুল দেয় শাশুড়ি। বলে “আঁচ গনগনে হলে ভাত চাপ্পে দে বৌ। ভাত ফুটতে ফুটতে তুর মশলা তৈরি হবে খনে”।
ভাত ফুটলে চারদিকে গরম ভাতের গন্ধ খিদেকে উসকে দেয়। শাশুড়ি একটা সানকি বাড়িয়ে দেয়। বলে একটু গরম ফ্যান দে না বৌ। নুন গুলে খাই।”
পাঁচি শাশুড়িকে ফ্যানভাত দেয় দু হাতা। নুন মাখিয়ে পরম তৃপ্তিতে খায়। কিন্তু পাঁচি ভাবছে যশির কথা। ওর ভালো নাম যশোদা। মেয়ে তো নয়। যেন মদ্দো। সেদিন পাঁচিকে বলেছিল “অভাবের কাঁদুনি গাস না বৌ। ওইসব ভাতারের ভরসা করে থাকলি এমন অবস্থাই হবে। গেরাম থেকে বনগাঁ লোকাল ধরে চল ক্যানে আমার সাথে। ফুল,বেলপাতা, হিংচে,ডিমে,তুর ঘরে হাঁসের ডিম বেচবি। পইসারাখার জাইগা পাবি না লো। তা না ঘরের কুনে সতী সাবিত্রী। ছ্যা করো।
2
পাঁচি রাতে সবাই কে ভাত দিলে ডিম আর ওলকপির ডালনা দিয়ে। অভাব থাকলে খিদেটাও বেশি হয়। কেষ্ট বললে “আর একদিন এই রান্নাটা করবে মা।”
শাশুড়ি ভাত নেবার কথা বলতে পারে না। উঁকি দেয় হাঁড়িতে। পাঁচি বুঝতে পেরে ভাত দেয়। একমুখ হেসে শাশুড়ি বলে “তোর কম পড়বে না তো”।
খেয়েদেয়ে সবাই ঘুমুচ্ছে। শুধু একজন জেগে আছে। এই সংসার নৌকার হালটা তাকে ধরতে হবে। বিয়ের সময় ভাতকাপড়ের দায় নিয়েছিল লোকটা। গতকাল পাঁচির একটা নতুন কাপড় লুকিয়ে বেচে মদ খেয়েছে। আজ ও খেয়েছে। রোজ খায়।
গতবছর মোহন্তরা বলেছিল “কুমোর বৌ। নারী হল গিয়ে দশভূজা। কতায় আছে সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে”।চন্ডীমন্ডপের চাতালে ওদের মালসাভোগের জোগাড় করতে ডাকে পাঁচিকে। বড় কেত্তনের দল আসে। সারারাত পালাগান হয়। যখন পাঁচির শ্বশুর বেঁচে ছিল তখন ওই মালসা জোগান দিত শ্বশুর। কুমোরের চাক ঘুরিয়ে মাটির জিনিস তৈরি করতে শিখিয়েছিল শ্বশুর।
কতদিন আক্ষেপ করতে শুনেছে শ্বশুরকে। “কী কুঁড়েশুল ছেলে জন্মালে। শ্যামামায়ের দুয়ার ধরা একটা ছেলে। নাম রাখনু শ্যামাপদ। তা জাতব্যবসাটাও যদি মন দিয়ে করত। তা না কেবল তাসপাশা। কথায় আছে তাসা সর্বনাশা।”
রাতের নিঝুম অন্ধকারে শুয়ে বুঝতে পারে ঝড় উঠেছে। কেষ্টটা জানলার পাশটাতে শুয়ে আছে। হাওয়ায় জানলাটা খুলে যাবে। মায়ের নাড়ি ছেঁড়া ধন। জানলা খুললে ঘুম ভেঙে যাবে বাচ্ছার। উঠে পড়ল পাঁচি।
কুপিটি হাতড়ে হাতড়ে পেয়ে গেল। উনুনশালে আঁচে কাগজ দিয়ে কুপি জ্বাললো।কেষ্টর মুখ দেখে মনে হল যেন দেবশিশু। একটা কাঠের পাটাতন দিয়ে জানলায় ঠেস দিলে। মনে পড়ল কীর্তনঠাকুরের কথা। কেষ্ট তখন পেটে। বলেছিল “ও মা। নবজাতকের নাম রাখিস কেষ্ট। তোর সব দুঃখ দূর হবে’।
সকালে ঘুম থেকে উঠে শ্যামাপদ বাড়ি থেকে বেরোচ্ছিল। পাঁচি বললে “সকাল হতেই কোথায় চললে। চাল বাড়ন্ত। চাল না আনলে আজ হাঁড়ি চাপবে না”।
কোনোকথাতেই গুরুত্ব দেয় না আজকাল সে। সংসারের মানুষ গুলো কী খাবে তা নিয়ে ভাবতে হয় পাঁচিকে। তবু সাহসে ভর করে পাঁচি বললে “একটা কাজ করো। ঘুগনির মটর কিনে আনো বাজার থেকে। হাঁড়ি করে পাড়ায় বেচলে দুকানের পইসা হয়ে যাবে। “
শ্যামাপদ ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললে “তুকে বে করে অব্দি শান্তি স্বস্তি নেই। মেয়েদের বুদ্ধি তবে কয়েছে কেনে। বংশের একটা মর্যাদা আছে ।তুই কী বুঝবি আর। ওই তো তোর বাপ ভাই।ভিখারি র অধম শালা। পা চাটা ভিখারি”।
পাঁচির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ে।এমন রূপ শ্যামাপদ এর আগে কখনও দেখেনি। চিৎকার করে উঠল পাঁচি। বললে “গব্বোধারিনী মাকে যার ভিটের বাইরে রাত কাটাতে হয়, ছেঁড়া কাপড় পরি ঘুরতে হয় তার আবার মর্যাদা?”
সুড়সুড় করে বেরিয়ে যায় শ্যামাপদ। যেতে যেতেও কানে আসে “এঃ। মদের বোতল নিয়ে বাবু আমার বংশের মান রক্ষে করবেন। গিলতে আসলি দেবো খনে চার অক্ত ভাত। বড়ো ছোটো মান্যিজ্ঞান নেই” ইত্যাদি ইত্যাদি।
শাশুড়ি দেখলে বৌ কাঁদছে। কাছে গিয়ে বললে “অ বৌ। ওর ভরসা ছাড়ন দে মা। তুকেই এর ব্যবস্থা করতে লাগবে। আমি বোষ্টম বাড়িতে গিয়ে ভুখাদানা এনে দি। তুই ভাত চাপা। “
পাঁচি দুপুরের রান্না খাওয়া শেষ করে মোহন্তদের বাড়ি গেল। সামনের বৈশেখী পূর্ণিমা তে ওদের মালসা ভোগ। শ্বশুর দুবছর হয়ে গেল স্বর্গে গেছে। কালসাপে কাটলে যে। সবাই মিলে চেষ্টা করেছে বাঁচাবার। কপালে দুঃখ লিখে রেখেছে বিধাতা পুরুষ। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক থেকে।
পথে যশির সাথে দেখা। হাঁক দিয়ে বললে “কী গো বৌ। কোথা যাস। তোর সোয়ামির তো আবার নতুন নেশা হয়েছে। তাসের সাথে জুয়া। আমাকে শুধোয় যশি রে। পঞ্চাশ টেকা দিতে পারিস। তা আমি ও কৈলুম হ্যাঁ।পৈসা গাছে ফলে কিনা”।
পাঁচি ম্লান হাসে। যশি বলে “তুকে এত চুপচাপ কখনও দেখি নি বৌ। তুকে তো কয়েছি ওসব ভাতারের ভরসা নেই। যা করতে হবে তোরেই ভরসা”।
যশি কথা বলতে বলতে চলে যায়। পাঁচি পৌঁছায় মোহন্ত বাড়ির পাশে চন্ডীমন্ডপে। শাশুড়ি একটু আগেই এসেছে। নাটবাংলায় এসে বসে পড়ে পাঁচি। এখানেই গতবছর কেত্তন শুনতে এসেছিল পাঁচি। আহা অলোকবিহারীর দল। শুনিয়েছিল মালসাভোগের গল্প। পরেরদিন কেত্তনের দলকে রেঁধে খাইয়েছিল পাঁচি। অলোকবিহারী বলেছিল “কুমোর বৌ। তুমার অভাব। আর কৃষ্ণভক্ত সুদামাও ছিল খুব গরীব। কুচেলা ভিখ মেগে চারমুঠো চিঁড়ে এনে সুদামাকে দিয়েছিল। ওই তো মালসাভোগ।”
অবাক হয়ে পাঁচি বলেছিল “কুচেলা কে গা বোষ্টমঠাকুর”?
ঠাকুর হেসে বসেছিল “সুদামার বৌ কুচেলা”।
পাঁচি লেখাপড়া জানে না। তবে অনেক বুদ্ধি আছে ওর। শ্বশুর মশাই বলতেন “বুঝলে বৌমা। শুধু বইপড়া মুখস্থবিদ্যাতে কিছু হয় না। ব্যবহারিক শিক্ষার দাম আছে। এই যে থেটার বলো,কেত্তন বলো সবেতেই লোকশিক্ষে।রামকৃষ্ণ দেব সে কতাটাই বলেছেন”।
কী ভালোবাসতো মানুষ টা। কতদিন মাথায় হাত রেখে বলেছে “ও মা। তুই হলি মা লক্কী। ছেলের মতিগতি আমার ভালো ঠেকে না। আমি না থাকলে মাকে দেখিস”।
নাটবাংলায় বসে পাঁচির চোখের জল বাগ মানে না। অলোকবিহারীর অত কথা ওর মনে উদয় হয়। ও মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখেছে ও হয়েছে কুচেলা। সুদামাকে বলছে “কেষ্টঠাকুর তুমার বন্ধু। আমি ভিখ মেগে আনি দোরে দোরে। সেই নিয়ে বন্ধুর কাছে যেও”।
পাঁচি আপন মনে হেসে ওঠে। ও বলেছিল “বোষ্টমঠাকুর। কেষ্টকে সবাই চায়। সাধনা করে। রাধার সাধনা যেমন সত্যি, সুদামাও সত্যি”।
বোষ্টমঠাকুর হেসে বলেছিল “তোর চৈতন্য হয়েছে কুমোর বৌ। তোর কেষ্ট আছে। তুই ভালোবাসছিস। এ হল গিয়ে বাৎসল্যরসের সাধনা। তোকে একদিন বলমাসদাসের পদকীর্তন শোনাবো”।
পাঁচির আজকাল মনে হয় মানুষ এর লক্ষ্যটাই ভগবান। লক্ষ্যপূরণ করতে গেলে সাধনার পথ তো চাইই।এই যেমন কেষ্টটাকে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে। এরজন্য উপায় করতে হবে পাঁচিকে। হঠাৎ কোন এক আলো এসে পাঁচির ভিতরটা নাড়িয়ে দিয়ে বলল “মানুষ আবার পারে না কী?তুইও পারবি।”
হঠাৎ শাশুড়ি এসে ঠ্যালা দিয়ে বলল “অ বৌ!বিড়বিড় করে কী বলিস মা। আমার ভয় করে। তুই ছাড়া আমার যে কেউ নেই”।
অশক্ত শাশুড়ি কে জড়িয়ে ধরে পাঁচি। শাশুড়ি ফোকলা দাঁতে হাসে। বলে “দ্যাকো।মেয়েটার কান্ড দেখো”।
মোহন্ত বাড়ি যায় পাঁচি। অনেক দিন পর পাঁচি কে দেখে ছুটে আসে গিন্নিরা। বলে “কুমোর বৌ। কতদিন পরে এলি”।
সবাই কে পেন্নাম করলে পাঁচি। তারপর বললে “বোশেখি পুন্নিমেতে মালসা লাগবে একশ চৌষট্টিটা। আমি সব দিয়ে যাবো।”
মোহন্তরা খুব খুশি। বললে “টাকা নিয়ে যা বৌ। আগাম দিলাম। এরসাথে ঘট খুড়ি সব দিবি। আর তোর জন্য কাপড় কিনবো।ওটা মালসাভোগের দিন পরবি। অনেক জোগাড় যে। তোকে থাকতেই হবে এই বলে দিলুম। আমরা তবে পুষিয়ে দেবো”।
আজ পয়লা বৈশাখ। চাকপুজো করছে পাঁচি। কাল থেকে শুরু হবে মাটির জিনিস তৈরি। শাশুড়ি মাটি ছানছে একহাতে। কেষ্টটা কিন্তু পড়েই চলেছে,,,,,
“Little drops of water
Little grains of sand
Make the mighty ocean
And the pleasant land”.
–:: সমাপ্ত ::–