সেদিন নিশীথে
কাকলি ঘোষ
শেষ পর্ব
“ একটা কথা ছিল স্যার। যদি শোনেন “
“ আশ্চর্য তো ! এই রাত দুপুরে তুমি ঘরে ঢুকে বসে আছো কথা শোনাবে বলে ?”
“ ঢুকতে তো হয় না স্যার। আমি তো সব সময় এ ঘরেই থাকি। দু মাস ধরে আছি। যেতে পারি না যে। “
“ মানে ?”
“ মানে যেদিন ঘটনাটা ঘটলো সেদিন থেকে আমি এ ঘরেই থাকি।“
“ ঘটনা মানে ?”
“ ওহ ! আপনি জানেন না ? আপনাকে না বলেই ঘর ভাড়া দিয়েছে ? কিন্তু মালিকের নিষেধ ছিল যে। “
“ কি ব্যাপার ? কি নিষেধ ?”অমানুষিক প্রচেষ্টায় নিজেকে শক্ত করে তপন।
“ বলছি স্যার। আগে বলুন আপনি ভয় পাবেন না ?”
“ ভনিতা ছেড়ে ঘটনা টা বল। কে তুমি ? কিসের জন্যই বা এ ঘরে লুকিয়ে থাকো ? কি চাও ? বল। নইলে আমি এক্ষুনি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করব। “
হেসে ফেলল ছেলেটা। “ সে আপনি যত ইচ্ছে লোক ডাকুন । আমি বাধা দেব না। তবে শুনতে চাইছেন ।বলছি। মাস দুয়েক আগের কথা। শরীরটা ভালো ছিল না স্যার। জ্বর ছিল ক’দিন। গায়ে খুব ব্যাথা। মাথা ঘুরছিল। কিছু খেতে পারছিলাম না। তবু তাই নিয়েই কাজ করতে হচ্ছিল। এমনিতেই কাজের লোক কম ছিল। দুজন ছুটিতে। তো সেদিনও একজন বোর্ডার কে এ ঘরে পৌঁছাতে এসেছিলাম। বিশাল চেহারা। একগাদা মালপত্র। সব ঘাড়ে তুলে দিল স্যার। আমি কি করে জানব বলুন ওনার ব্যাগে অত দামী ক্যামেরা আছে ? কি করে জানি না অসাবধানে হাত ফসকে গেল স্যার। ক্যামেরা টা চুরমার হয়ে গেল। লোকটা যেন রাগে পাগল হয়ে গেল উঠল। হঠাৎ চিৎকার করে প্রচণ্ড জোরে আমার গলা টিপে ধরল স্যার __ আমি ছটফট করছিলাম, আমার দম আটকে আসছিল,বারবার বলছিলাম ছেড়ে দিতে কিন্তু উনি ছাড়লেন না স্যার। আর আমি ওর হাতের মধ্যেই __”
“ হাতের মধ্যেই __? কি হল ?”
নিজেই বুঝল তপন ওর গলা আর ওর বশে নেই।
বিষন্ন স্বরে হাসল ছেলেটা।
“ যা হয় স্যার। দুর্বল শরীর নিতে পারল না অতখানি চাপ। প্রথম দিকে কষ্ট হল। খুব কষ্ট। তারপর দেখলাম আর কিছু নেই। শরীর কেমন ফুরফুরে হালকা হয়ে গেছে। ঝরঝরে লাগছে। “
“ তু _ তুমি __ মানে __”
নিজের অগোচরেই তোতলাতে শুরু করেছে তপন। মানে পাচ্ছে ঠান্ডা ঘরের। এক তীব্র শীতলতা যেন হাড় হিম করে নেমে আসছে ওর শিরদাঁড়া বেয়ে।
“ ভয় পাবেন না স্যার। আমি মানুষ নই ঠিকই। কিন্তু তাই বলে আপনার কোন ক্ষতি করব না। “
গলা শুকিয়ে কাঠ। একটু একটু করে এবার পরিষ্কার হচ্ছে সব। রিসেপশনে ঘর দিতে না চাওয়া,ওর বারবার অনুরোধে অনিচ্ছা স্বত্বেও চাবি দেওয়া, ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে ছেলেটির পালিয়ে যাওয়া, এর হঠাৎ আবির্ভাব। সব। সব কিছুর মানে স্পষ্ট হচ্ছে এবার। কিন্তু কি চায় ও ? একজনের অন্যায়ের প্রতিশোধ কি অন্য জনের ওপর দিয়ে তুলবে ? কি করবে এখন তপন ? কাকে ডাকবে ? উফফ !
“ আপনি মিছি মিছি ভয় পাচ্ছেন স্যার। আমার কথা টা শুনুন একটু। “
“ আমি তো কিছু করি নি। তোমার সাথে খারাপ ব্যাবহার ও করি নি। আমি তোমায় চিনিও না। এই শহরে নতুন। কাল ই আমি ঘর ছেড়ে দেব। আমায় ছেড়ে দাও__”
“ একটু শুনুন স্যার। ভয় পাবেন না। বড্ড দরকার। শুধু আপনি নন এই দু মাসে যে কজন বোর্ডার এ ঘরে এসেছে সবাইকে বলার চেষ্টা করেছি । পারিনি। ভয়ে এক এক জন এমন এক একটা কান্ড করেছে যে মাঝখান থেকে এ ঘর ই বন্ধ করে দিয়েছে হোটেলের মালিক। আপনি এলেন আজ কতদিন পর। দেখুন না দেখুন। আমি সব কেমন ঝকঝকে পরিষ্কার করে রেখেছি। ঘর , মেঝে, বিছানা,বাথরুম। কোথাও এতটুকু ময়লা পেলেন ? “
বোবা চোখে চেয়ে থেকে ঈষৎ ঘাড় নাড়ে তপন। তারপর বিড়বিড় করে বলে,
“ আমার কাছে কি দরকার ? তুমি কি তোমার মৃত্যুর প্রতিকার চাও ? তোমার হত্যাকারীর শাস্তি চাও ? তাহলে আমি আমার কাগজে লিখব। দেখো ঠিক একটা বিহিত হবে। এর বেশি আমি কি করতে পারি বল ?”
আবারও হাসল ছেলেটা। “বিহিত কিছু করা যাবে না স্যার। আপনি বা আপনার কাগজ কেউ কিছু করতে পারবে না। ওনার হাত অনেক লম্বা। এখনকার যিনি এম.এল. এ. তার পেয়ারের লোক। মালিক কে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছে। কিছু গোলমাল করলে বা কাউকে বললে ব্যাবসা ই উঠিয়ে দেবে বলে হুমকি দিয়েছে। আমার লাশটাকেও গুম করে দিয়েছে। “
লাশ ! শব্দটা শুনেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তপনের। ভয়ে ভয়ে চোখ তুলে আবার তাকায় সামনের দিকে। একটা নিরীহ, গো বেচারা, সাধারণ চেহারার ছেলে। বিছানার একটু দূরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। মানুষ নয় ! অতি প্রাকৃত ! আত্মা ! কিন্তু ওর কাছে কি চায় ? কি দরকার ?
“ আমার একটা উপকার করে দেবেন স্যার ? আপনার কাছে কিছুই নয়। একটু যদি দয়া করেন __“
“ কিন্তু আমি তো এখানে কাউকে চিনি না”
“ এখানে না স্যার। আমি কলকাতার ছেলে। ওখানেই আমার বাড়ি। কালীঘাটে। আপনার অসুবিধে হবে না।
“ কি উপকার ?”
“ আমার কিছু টাকা আছে স্যার। মাইনের টাকা নয়। সে তো মালিক বাড়ির লোককে ডেকে দিয়ে দিয়েছে। এ টাকা আমার বখশিস এর টাকা। কেন জানি না স্যার এই হোটেলে বোর্ডার যারা আসত আমাকে সবাই চাইত। আর না চাইতেই বখশিস দিয়ে যেত। “
সেটা অসম্ভব নয়। রাতে তো দেখেছে তপন ভীষণ আন্তরিকতা ছেলেটির। হয়তো সেজন্যই সবাই পছন্দ করত।
“ মালিক বলত আমার জন্যই নাকি হোটেলে বোর্ডার বাড়ছে। আমি অত শত বুঝতাম না স্যার। শুধু নিজের কাজটাই মন দিয়ে করে গেছি। বখশিস এর টাকাটা আমি নিজের কাছেই রাখতাম। সেই টাকাটা আপনাকে আমার ভাইয়ের হাতে পৌঁছে দিতে হবে স্যার। দেবেন ? বলুন না ? দেবেন ?”
“ কত টাকা ?”
“ সব মিলিয়ে প্রায় দশ হাজার হবে। “
“ আর কাউকে পেলে না ?’
“ বলেছিলাম তো স্যার। সবাই এমন ভয় পেয়ে যায় ! আচ্ছা স্যর এই তো এতক্ষণ আপনি কথা বলছেন __এত কি ভয়ংকর আমি ? বলুন ?”
“ যারা তোমার সাথে কাজ করত এখানে তাদের কাউকে দিয়ে ___”
“ হল কোথায় স্যার ? সব ভয়েই মরে। আশ্চর্য লাগে জানেন ? যারা এত ভালোবাসতো তারা সবাই আজ ভয় করে আমাকে ! “
শেষের দিকের কথাগুলো বিষন্নতায় ডুবে যায়।
কি জানি কেন হঠাৎ ই একটা অন্য অনুভূতি কাজ করতে থাকে মনের মধ্যে। অবাক হয় তপন ! কই ! আর ভয় করছে না তো ! বরং একটা অদ্ভুত মমতা থেকে থেকে এসে উঁকি দিচ্ছে মনের মধ্যে। এমন ভালো ছেলেটা ! এইভাবে মরে গেল ! মৃত্যুর একটা তদন্ত হল না ? আত্মার মুক্তি হল না ? এইভাবে গুমরে গুমরে কষ্ট পাচ্ছে হতভাগা !
“ কোথায় টাকা ? “
“ আপনাকে একটু কষ্ট করে নিচে যেতে হবে স্যার। মানে আমি যে ঘরে থাকতাম আর কি __ প্লিজ স্যার __”
“ কিন্তু কেউ দেখে ফেলে যদি ?”
“ সবাই ঘুমোচ্ছে। কেউ দেখবে না। “
“আর কর্মচারীরা কেউ ?”
“ভূতের ভয়ে আজকাল আর রাতে কেউ বেরোয় না ঘর থেকে “
আবার অস্পষ্ট হাসল ছেলেটা। নাকি কান্নার রূপান্তর ? ঠিক বুঝল না তপন। বেরিয়ে এল ঘর থেকে। সিঁড়ি বেয়ে একেবারে নিচে রান্নাঘরের পাশে। দরজায় তালা দেওয়া। ইশারায় কয়লার গাদায় পড়ে থাকা একটা পেরেক নির্দেশ করল ছেলেটা। সেটা দিয়ে সামান্য চাড় দিতেই খুলে গেল তালাটা। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল তপন। কোনের দিকে হাতড়ে আলো ও জ্বেলে ফেলল। ঘুপচি ঘর। এক কোণে একটা মাদুর আর বালিশ জড়ানো বিছানা। তারে দু একটা জামা কাপড়। কুলুঙ্গি তে মা কালীর ছবি। টাকা কই ?
মুখ ফিরিয়ে তাকালো তপন। ইশারায় কুলুঙ্গি তে হাত ঢোকাতে বলল ছেলেটা। একটু ইতস্তত করে হাত বাড়ালো তপন। আর পরক্ষনেই চমকে গেল। হাত ঠেকেছে কিসে একটা ! মা কালীর ছবির পিছনে। একটা চৌকো মত কি যেন ! একটু চাড় দিতেই উঠে আসে বাক্স টা। বোঝা যায় ভেতরে কোন গর্তের মধ্যে বসানো ছিল।
“ বাক্স টা খুলুন স্যার। “
কাঁপা কাঁপা হাতে ডালাটা খোলে তপন। ভেতরে নোট খুচরো সব মিলিয়ে প্রায় উপচে পড়া বাক্স।
“ আমার গোনা আছে স্যার। দশ হাজার । এই টাকাটা আমি লুকিয়ে জমাচ্ছিলাম । খুব ইচ্ছে ছিল জানেন একটা জমি কিনব। ছোট্ট ছোট্ট দুটো ঘর তুলব। মা আমি আর ভাই তিনজনের থাকার মত। সারাজীবন মা বস্তিতে ভাঙ্গা ঘরে কাটালো স্যার। শেষ বয়সে মাকে একটু সুখ দেব। হল না। আপনি স্যার দয়া করে যদি টাকাটা ভাইকে পৌঁছে দেন __ ঠিকানা ওই বাক্সেই পাবেন। যান স্যার এবার রুমে ফিরে যান। ভোরও হয়ে এলো। আমারও যাবার সময় হল। মুক্তি দিলেন আমাকে স্যার। এই জন্যই তো ছেড়ে যেতে পারছিলাম না। অনেক ধন্যবাদ।“
বিহ্বলের মত রুমে ফিরে এলো তপন। আশ্চর্য ! ঘরটা আর ঠান্ডা নেই তো ! সেই অসহ্য শীতলতা উধাও হয়ে গেছে। সব স্বাভাবিক। বিছানা, বালিশ, চাদর সব একই রকম। তবে কি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল ? না না। তাই বা কি করে হয় ? হাতের বাক্স টা ? সেটাই তো প্রমাণ !
পৌঁছে দিতে হবে । কালীঘাট তো ওরই এলাকা। খুঁজে নিতে হবে জায়গাটা। বাক্সটা আবার খুলল তপন। কত যেন বলল ছেলেটা ? দশ হাজার ? না না। ভুল। নিঃশব্দে নিজের মানিব্যাগ থেকে আরো একটা একশো টাকার নোট বাক্সে রাখল ও। বারে ! আজকের টিপস টাই বা বাদ যায় কেন বেচারীর ?
–:: সমাপ্ত ::–