কাব্যের উপেক্ষিতা
✍ ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
মহাকবি কালিদাস শকুন্তলা কে নায়িকা করলেন। অথচ প্রিয়ংবদা আর অনসূয়া রয়ে গেলেন কাব্যের উপেক্ষিতা হয়ে। কত গুণ ই না ছিল মেয়েদুটোর। তবু উপেক্ষা সম্বল।
আমাদের রঞ্জার ক্ষেত্রেও সেটাই সত্যি হল। বাপ মা চেয়েছিলেন তিনকন্যার পর একটা ছেলে হোক। বোসগিন্নি গলা ফাটিয়ে বলেছিল “ধর্ম ঠাকুরের দুয়ার ধর। উনি হলেন গিয়ে বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণের দেবতা”।
রঞ্জার বাপ বললে “কেন!আমাদের তিনটে মেয়ে আছে।বন্ধ্যাত্ব প্রসঙ্গ কেন?
বোসগিন্নি গাল ফুলিয়ে বললে “মেয়েদের কী ভূমিকা আছে? ছেলে না থাকলে হয়।সারা জীবনের কামাই/ভোগ করবে জামাই।
যা বলছি শোনো দেখি ।কেন?বৃদ্ধ রাজা কর্ণসেনকে সবাই যখন আঁটকুড়ো বলেছিল তখন ধম্মঠাকুরের কৃপায় ওদের ছেলে কি হয় নি?এ গল্প বাউনঠাকুর আমাকে শুনিয়েছে গো।”
ধম্মঠাকুরের দয়া কাজ করলো না। রায়বাড়িতে আবার মেয়ে জন্মালো।রায়গিন্নি কেঁদে আকুল।বললে
“এ তো মেয়ে নয়। আমার গর্ভের কলঙ্ক। ”
বাপ বীরেশ্বর রায় বললে “কাঁদিস না রে বৌ”।
বৌ বললে “কাঁদবো না তো কী!এমন কালো মেয়ে উদ্ধার হবে কী করে। এ যে মা কালী”।
বাপ নাম রাখলে রঞ্জা।
মা বললে “আদিখ্যেতা!একে নিয়ে জ্বলেপুড়ে মরতে হবে”।
বাস্তবিক তাই। পৃথিবীর ইতিহাস তাই বলে। নারীর গুণের কদর নেই। সারা গাঁ এর লোকের চিন্তার কারণ এই রঞ্জা। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর মহিলা মহলে আলোচ্য বিষয় রঞ্জা।সতীশের মা সেদিন তেঁতুলতলায় বসে রঞ্জার মা কে বললে ”
কী করে বিয়ে দিবি বৌ”।
কাটা ঘা এ নুনের ছিটে আর কী। এইসব শুনে মা এর প্রাণ হাহাকার করে মরে।
তবু বলে “রঞ্জা আমার গুণবতী।”
মুখবিকৃত করে সতীশের মা উত্তর দেয়
“পুড়বে নারী উড়বে ছাই/তবে নারীর গুণ গাই”।
বোসগিন্নি তাল মেলায় “আগে চাই দেখনধারী/পিছে গুণবিচারী।”
মা এর মন অজানা আশঙ্কায় ভরে ওঠে ।কতদিন রাতে নিদ্রামগ্ন মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
মনে মনে বলে “কোথায়!এ তো দেবশিশু। কেমন টানাটানা চোখ। নাকটা তীক্ষ্ণ।একমাথা চুল।শুধু গা এর রঙটাই যা একটু কালো।মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকে।হে ভগবান!মেয়েটাকে তুমি দেখো”।
শশীকলার মতো বেড়ে ওঠে রঞ্জা।দিদি দের একজন একজন করে উদ্ধার হয়ে যায়। চোখ নাক রঙ সব পরীক্ষায় দিদিরা উতরে গেছে। এবার তো রঞ্জার পালা।
স্কুলের স্যার তাপসকিরণ বাবু বীরেশ্বরকে ডেকে বলেন
“শোনো হে বীরেশ্বর। রঞ্জাবতীকে যেন বাল্যবিবাহ দিও না।মেয়েটির বুদ্ধিমত্তা আমাকে মুগ্ধ করে। আমাদের ভবিষ্যৎ”।
অবহেলা আর অনাদরের একটা আলাদা শক্তি আছে।রঞ্জাবতী রায় তা বুঝতে শিখেছে। লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলে সাধনার পথ প্রশস্ত হয়। স্কুলের দিদিমণি বুঝতে পারেন রঞ্জাকে।
বলেন “বড়ো মিষ্টি মেয়ে রে তুই রঞ্জা”
রঞ্জা বলে “দিদি!সবাই যে বলে আমি কালো। আমি কুৎসিত”।
দিদিমণি জড়িয়ে ধরেন সন্তানসম ছাত্রীকে। বলেন “এই বিরুদ্ধ সমালোচনার যোগ্য জবাব দিতে হবে তোমাকে। যারা তোমাকে বিদ্ধ করে যাচ্ছে প্রতি নিরন্তর একদিন দেখবে তাদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছ তুমি। তুমি হবে বিজয়িনী নায়িকা। সাফল্যের পদক ঝুলবে তোমার গলায়”।
দিদির কথায় কী যে আছে। রঞ্জার ভিতর থেকে কে যেন বলে “মানুষ সব পারে রঞ্জা। সব পারে”।
স্কুলে বাৎসরিক অনুষ্ঠানের মহড়া চলছে। একেবারে সাজো সাজো রব। কত কী আয়োজন। ছাত্র ছাত্রীরা কলকাকলিতে মুখর। অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন স্কুলের দিদিমণি। সুলতা দি সবার প্রিয়। আর রঞ্জা তো দিদি অন্তঃপ্রাণ।
রঞ্জাকে ডাকলেন সুলতা চৌধুরী। বললেন
“রঞ্জা এসো!তোমাকে গান গাইতে হবে”।
রঞ্জা বলে “আমি গান জানি না দিদি। ”
দিদি বলেন “আমি শিখিয়ে দেবো”।
বলেই দিদি ডাকলেন সুচরিতা কে। বললেন
“সুচরিতা। উদ্বোধনী সঙ্গীতে তোমার সাথে গলা মেলাবে রঞ্জাবতী”।
রঞ্জাবতী ভয় খায় ।বলে” দিদি ।আমি পারবো?”
রঞ্জাকে সাহস দেয় দিদি।
বলেন “পারতেই হবে”।
অন্ধকার রাত্রে ছাদে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে রাতের আকাশ কে দেখে রঞ্জা। কী সুন্দর আকাশ!ঈশ্বরের সৃষ্টি তে সব সুন্দর। ভোরের শিশির ,কুয়াশা ,শুভ্রতা যেমন সত্য ঠিক তেমনি রাতের চন্দ্রমা,তারামণ্ডল এর ঝিকমিক। রঞ্জা অভিভূত হয়। বলে “দিদি!আমি সুন্দর!আমাকে ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন।আমি পারি। আমি সব পারি।”
আবেগে আর দিদির প্রতি ভক্তিতে তার দুই নয়ন ভেসে যায়।অন্ধকার এ একান্তে গাইতে থাকে দিদির শেখানো গান “আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব/সারারাত ফোটাক তারা নব নব/পরানের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো/যেখানে পরবে সেথায় দেখবে আলো।”
“পৃথিবীতে যাঁরা মাস্টারমশাই তাঁদের অনেক ক্ষমতা।”বীরেশ্বর মেয়েকে বলে।
রঞ্জা বলে
“হ্যাঁ বাবা। তাপস স্যার বলেছেন শিক্ষক দ্বিতীয় পিতা”।
বীরেশ্বর মেয়ের দিকে অবাক হয়ে তাকায় আজকাল। দেখে ওই কালো শরীরের মধ্যে থেকে একটা সাপ যেন ফণা তুলছে।
সুলতাদির বাড়ি কেতুগ্ৰামে। তবে অবিবাহিত জীবনে স্কুল টাই তাঁর বেঁচে থাকার রসদ। শ্রীকৃষ্ণ পুরে থেকে গেছেন উনি। রঞ্জা সময় পেলেই চলে আসে এখানে। দিদি বলেন
“বুঝলে রঞ্জা। তোমরা হলে সলতে। আমি পাকিয়ে যাচ্ছি।একদিন সারা পৃথিবী আলোকিত করবে তোমরা। আর তোমাদের মাঝে আমি বেঁচে থাকবো।”
রঞ্জা অবাক হয় ।বলে “হ্যাঁ দিদি।তাপস স্যার ও বলেন আমরা নাকি ওনার ভবিষ্যত।”
সুলতা দি অবসর সময়ে গান শোনেন। রঞ্জার সামনেই মাধ্যমিক পরীক্ষা। মাঝে মাঝেই চলে আসে দিদির কাছে। দিদি উদ্দীপ্ত করেন।সাহস দেন। উসকে দেন রঞ্জাকে। বলেন “রঞ্জা। একটা লড়াই তোমার সামনে। পরিশ্রম করো। রাতে তাড়াতাড়ি এখন ঘুমাবে না। মনে রেখো যে বিষয়ে ভয় খাবে সেই বিষয়টাই পেয়ে বসবে।”
রঞ্জা বলে “আমার ভালো লাগছে না। মাথাটা ভার লাগছে”।
দিদি বলেন “বেশ তো। ভালো না লাগলে গান শোনো”।
রঞ্জা বলে “একটা গান করুন না দিদি। রবি ঠাকুরের সেই গানটা”।
দিদি হাসেন। আর গান ধরেন। যে গানটা গাইলে রঞ্জার চোয়াল টা শক্ত হয়ে যায়।
“কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি
কালো তারে বলে গাঁ এর লোক
মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে
কালোমেয়ের কালো হরিণ চোখ”
“রঞ্জাবতী রায়।তোমার অদম্য জেদ তোমাকে সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে যাবে” মনে মনে ভাবেন সুলতা চৌধুরী।
সুলতা দি দিনরাত ভাবেন। কী করে আরো ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। তাপসবাবুর সাথে আলোচনা করেন। বলেন
“রঞ্জার চোখে এক আকাশ স্বপ্ন। বুকে প্রতিবাদের বারুদ। ঠিক জায়গায় এর বিস্ফোরণ চাই”।
তাপস বাবু বলেন “কোন ব্যাপারটাতে ও রেগে যায়?”
দিদি বলেন “গা এর রঙ নিয়ে অনেক বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে ছোট থেকে।ওই ব্যাপার টা ওকে তাতিয়ে দেয়।
“স্যার বলেন “বেশ তো। ওটাই তুরুপের তাস করুন। বলুন অন্য মেধাবী ছাত্রীরা বলে ওই কেলে পিলসুজ কিছুই করতে পারবে না”।
ওষুধে কাজ হয়েছে। লেখা পড়ায় ডুবে আছে রঞ্জা।দেখিয়ে দেবে ও ফ্যালনা নয়।
মহাকালের গতি থেমে থাকে না। মাধ্যমিকে প্রথম স্থান অধিকার করেছে অজ পাড়া গাঁ এর কালো মেয়েটি। যার জন্মক্ষণে শাঁখ বাজেনি।
এরপর একের পর এক পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে যেদিন শ্রীকৃষ্ণপুরের ব্লক ডেভলপমেন্ট অফিসার হয়ে এলেন রঞ্জাবতী রায় সেদিন অনেক শুভেচ্ছা আর অভিনন্দনের মাঝে হৃদয়ে বাজছে সেই সুর।
“মেঘলা দিনে দেখেছিলাম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ”
গ্ৰামবাসীরা দেখলো তাঁদের বিডিও সাহেবা কাঁদছেন। সামনে কার একটা ছবি।
কিছুটা সামলে নিয়ে রঞ্জাবতী রায় বললেন
“বৃদ্ধা আর বিধবা নারীদের ভাতা প্রদানের ফাইলটা আগে নিয়ে আসুন।ওটা দিয়ে কাজ শুরু করি।”
–~০০০XX০০০~–