“পরিবেশের উপর প্লাস্টিক বর্জ্যের ক্ষতিকর প্রভাব”
দিনে দিনে ‘অসম্ভব’ শব্দটি বাংলা অভিধান থেকে মুছে যাচ্ছে। কেননা আধুনিক বিজ্ঞানের এই যুগে অসম্ভব বলে কোন শব্দ নেই। মানুষের জীবনযাপন করাটা এখন অনেক সহজ। চাইলেই হাতের কাছে সবকিছু পাওয়া যায়। তথ্য প্রযুক্তি প্রায় সবকিছুকেই আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। কিন্তু এত আধুনিকতার মাঝখানে কোথাও যেন একটু ফাঁক থেকে যাচ্ছে। মানব সভ্যতা যতই সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ততই আমরা কিছু অমিমাংসিত সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়ছি। ‘জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত সমস্যা’ তেমনই একটি জটিল সমস্যা।
জলবায়ুর পরিবর্তন বলতে আমরা বুঝি এর উপাদান যেমন— আর্দ্রতা, বায়ুচাপ, তাপমাত্রা এসবের পরিবর্তন। বিভিন্ন কারনে এসব উপাদানের পরিবর্তন হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়- জলবায়ু প্রাকৃতিক প্রভাবে যতটা না পরিবর্তিত হয় তার চেয়ে বেশি পরিবর্তিত হয় মানবসৃষ্ট কারণে। মানুষ বিভিন্নভাবে পরিবেশ দূষিত করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে প্লাস্টিক দূষণ।
আমরা যেসব প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্যাদি ব্যবহার করি সেগুলো তৈরি হয় তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে। যখন এসব জ্বালানি খনি থেকে নিষ্কাশন করা হয়, তখন বিপুল পরিমাণ দূষিত পদার্থের নির্গমন ঘটে। এসব পদার্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড, বেনজিন এবং মিথেন। এসব গ্যাসকে গ্রীনহাউস গ্যাস বলা হয়। আর গ্রীনহাউস গ্যাস বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে হিমালয়ের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে।
গ্রীনহাউসে প্লাস্টিকের প্রভাব :-
প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ কীভাবে গ্রীনহাউসে ভূমিকা রাখবে তা একটি উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমরা যে সমস্ত প্লাস্টিক বোতল দেখি তার মূল উপাদান হলো পলিইথিলিন। গবেষণায় দেখা গেছে এক আউন্স পলিইথিলিন তৈরি করতে গেলে পাঁচ আউন্স কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস নির্গত হয়। অর্থাৎ আমরা যে পরিমাণ প্লাস্টিকদ্রব্য প্রস্তুত করছি তার চেয়ে বেশি পরিমাণ দূষিত পদার্থ বায়ুতে নির্গমন করছি। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বিভিন্ন পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য প্লাস্টিকের চাহিদা ব্যাপক। ফলে এটা খুব সহজেই অনুমান করা যায় যে, শিল্পোন্নত দেশগুলো শিল্পায়নে বাজিমাত করতে গিয়ে কী পরিমাণ পরিবেশ দূষণ করছে।
সামুদ্রিক পরিবেশ দূষণে প্লাস্টিকের প্রভাব
গবেষণায় দেখা গেছে পৃথিবীতে উৎপাদিত মোট প্লাস্টিকের শতকরা ২ ভাগ গিয়ে জমা হচ্ছে মহাসাগরে। ফলে সামুদ্রিক জীববৈচিত্রের ওপর এর প্রভাব দিনের পর দিন ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। ১৯৫০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অপরিশোধিত তেল দিয়ে তৈরি হয় ৮.৩ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ এখনও গৃহস্থালি, গাড়ি বা কারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে। আরো ১০ শতাংশ প্লাস্টিক পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আর বাকি ৬০ শতাংশ প্লাস্টিকের খোঁজ মেলে নি। এ প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো কোথাও না কোথাও পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে যার বেশিরভাগই যাচ্ছে মহাসাগরে। এছাড়া তুলনামূলক সস্তা হওয়ায় বেশিরভাগ কাপড়ে সিনথেটিক ফাইবারের ব্যবহার বেড়েছে।
সীটল সমুদ্র সৈকতে একটি মৃত বিশালদেহী তিমিকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। পরে এই তিমির দেহ ব্যবচ্ছেদ করে দেখা যায় যে, এর পাকস্থলী ভর্তি বহু প্লাস্টিক পদার্থ দিয়ে। গবেষকরা ধারণা করেন এসব প্লাস্টিক পদার্থই তিমিটির মৃত্যুর কারণ।
প্রতি বছর প্রায় ৮০০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী সমুদ্রযানের নানা বর্জ্য পদার্থ দিয়ে আক্রান্ত হয়। আর এসব বর্জ্যের প্রায় ৮০ শতাংশই প্লাস্টিক, যা নিতান্তই আমাদের দায়বদ্ধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রায় অর্ধেক সামুদ্রিক কচ্ছপ প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ গলাধঃকরণ করছে এবং এর ফলে অনেক কচ্ছপই মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে। শুধ তা-ই নয়, প্লাস্টিক দ্রব্যাদি জলজ জীবকূলের প্রজননে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
পরিবেশ বিপর্যয়ে প্লাস্টিকের প্রভাব:-
কিছু প্লাস্টিকের বিয়োজিত হতে প্রায় হাজার বছর লেগে যায়। আর আমরা জানি, যে জিনিস পরিবেশে বিয়োজিত হতে বেশি সময় নেয় তা পরিবেশের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আমাদের নাগরিক সমাজে অল্প বৃষ্টিপাত হলেই এর কুপ্রভাব সহজেই চোখে পড়ে। প্লাস্টিকজাত বর্জ্য দিয়ে খাল, নালা, ড্রেন ইত্যাদি ভর্তি হয়ে থাকে। ফলে অল্প বৃষ্টি হলেই রাস্তাঘাটে পানি জমে যায়। এসব দেখে নিজের বিবেককেই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, এসবের জন্য দায়ী কে?
মানবদেহে প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব :-
প্লাস্টিক পরিবেশের পাশাপাশি মানবস্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব বিস্তার করে আসছে। প্লাস্টিক উৎপাদনে ব্যবহৃত উপাদান মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। মূলত তিন পদ্ধতিতে প্লাস্টিক মানবদেহে প্রবেশ করে। সাধারণ পরিবেশ যেমন বাতাস ও পানির মধ্য দিয়ে, খাবার খাওয়ার ফলে (যেসকল প্রাণী প্লাস্টিক খেয়ে ফেলে যেমন- মাছ) এবং প্লাস্টিক পণ্যগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে।
পলি ভিনাইল ক্লোরাইড বা পিভিসি প্লাস্টিক পদার্থগুলো হলো- প্রসাদনসামগ্রী রাখার পাত্র, খেলনা, পানির পাইপ, টাইলস, গৃহসজ্জার সামগ্রী, শিশুদের সুইমিং পুল ইত্যাদি। এগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহারের কারণে ক্যান্সার, জন্মগত ত্রুটি, জেনেটিক পরিবর্তন, দীর্ঘস্থায়ী ব্রংকাইটিস, আলসার, বধিরতা, চর্মরোগ, লিভার সমস্যা হতে পারে।
থ্যালেট বা প্লাস্টিসাইজারজাত প্লাস্টিক যেমন- জুতা, ছাপার কালি, চিকিৎসা ও ল্যাবরেটরির সরঞ্জামাদি প্রভৃতি। এগুলো ব্যবহার করলে হাঁপানি, ক্যান্সার জন্মত্রুটি, হরমোন পরিবর্তন, শুক্রাণু সংখ্যা হ্রাস, বন্ধ্যাত্ব, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়।
পানির বোতল তৈরি হয় বিসফেনল নামক প্লাস্টিক থেকে। এটি ব্যবহার করলে ক্যান্সার, প্রতিবন্ধী প্রবণতা, দ্রুত বয়ঃসন্ধি, স্থূলতা, ডায়াবেটিস প্রভৃতি রোগ হতে পারে।
পনির ও দই রাখার পাত্র, ফোম ও শক্ত প্লেট, অডিও ক্যাসেট হাউজিং, সিডি কেস, বিল্ডিং ইনসুলেশন, বরফের ছাঁচ, দেয়ালের টাইলস, ট্রে প্রভৃতিতে পলিস্টাইরিন থাকে। এসব তৈরির কারখানার শ্রমিকদের চোখে জ্বালাপোড়া, নাক ও গলায় অস্বস্তি, মাথা ঘোরা, অচেতনতা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়।
সময় এসেছে এখন জীবকূলের এই ভয়াবহ সংকট থেকে নিরসনের উপায় খুঁজবার। আমাদের এখনই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত কীভাবে আমরা জলবায়ু সংকট কিছুটা হলেও উতরাতে পারি। প্রথম পদক্ষেপেই আমাদেরকে প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ বর্জন করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনবোধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। সাধারণ মানুষকে পাটজাত দ্রব্যের ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। এতে করে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। পাট তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে এবং আমাদের পরিবেশও সুরক্ষিত থাকবে।
–~০০০XX০০০~–