ফিরে দেখা ( শেষ পর্ব )
✍ কাকলি ঘোষ
এবার ফিরে আসি ‘চাকুরির বিড়ম্বনা’ নাটকের কথায় । এই নাটককে ঘিরে আমাদের আহ্লাদের সীমা ছিলো না। কারন সেই প্রথম আমরা আমাদের নাটকে ব্যবহার করতে চলেছিলাম পেশাদারি মঞ্চের মত স্ক্রীন,লাইট,মাইক।
নির্দিষ্ট দিনে মঞ্চসজ্জা কেমন চলছে জানার জন্য উপস্হিত হয়ে দেখি ষন্টুদাদা হাজির। এতটাও আশা করিনি। ভেবেছিলাম মনে করিয়ে দিতে হবে বা কাউকে দিয়ে ডেকে পাঠাতে হবে। কাজ বেশ সুচারুভাবেই চলছে।বারান্দার সেই মিটমিটে আলোর বদলে চড়া আলো। উপরে তার দিয়ে ঝোলানো মাইকের ব্যবস্হা ! দেখে শুনে মন একেবারে আহ্লাদে ভর ….পুর। ! ফলে নিশ্চিন্ত মনে অন্য দিকগুলো পরিদর্শনের কাজে চলে গেলাম। সেদিকেও সব ঠিকঠাক। মেকাপ শেষ। অভিনেতা,অভিনেত্রীরা তৈরী। শম্পাও প্রস্তুত। উদ্বোধনী সঙ্গীত শুরু হয়ে গেল। ওদিকে দর্শক সমাবেশ ও যথেষ্ট ।মানে সব মিলিয়ে উৎসাহ উদ্দীপনা একেবারে তুঙ্গে।
সকলকে নিয়ে স্টেজের কাছে পৌঁছে মাইকের দিকে চোখ পড়তেই আগুন জ্বলে উঠল মাথায়। এটা মাইক লাগানো হয়েছে!! আমরা তখন ( দু একজন ছাড়া ) প্রায় সকলেই সিক্স সেভেনের ছাত্রছাত্রী অর্থাৎ বয়স গড়ে দশ থেকে বারো এর মধ্যে। ওই বয়সের স্বাভাবিক উচ্চতার ছেলেমেয়েরা যেমন হয় তেমন-ই। আর মাইক লাগানো হয়েছে একেবারে টঙে মানে বারান্দার মাথায়। যেখানে সম্ভবত রনপা পরেও আমরা পৌঁছোতে পারব না। মোটের উপর ব্যাপারটা ভেবে দেখুন। অভিনেতাদের অভিনয় করতে হবে বকের মত গলা উঁচু করে উপরের দিকে চেয়ে। তাও মাইক পর্যন্ত গলা পৌঁছোবে কিনা সন্দেহ!
রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে যখন লাইটম্যানকে খুঁজে বেড়াচ্ছি দেখি সে তখন মামারবাড়ীর পিছনের পাঁচিলে বসে দাদু দিদার চোখ এড়িয়ে মৌজ করে বিড়ি ফুঁকছে। ওর ওই নিশ্চিন্ত ভাব আমার গায়ে যেন বিচুটির জ্বালা ধরিয়ে দিল।হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম ক্রোধে!
আজ ভাবলে একটু লজ্জাই পাই বয়সে কম করে আট দশ বছরের বড় দাদাকে কী হেনস্হাই না করেছিলাম! যথেচ্ছ তো বলেইছিলাম এমন কি ” তুই তোর লাইট.মাইক খুলে নিয়ে যা”. এই কথা বলতেও বাদ রাখিনি। সেও পিছিয়ে ছিলো না। নিজের কাজের স্বপক্ষে ঝুড়ি ঝুড়ি যুক্তি দেখিয়ে চড়া গলায় তর্ক করেছে এবং শেষে উঠোন ভর্তি দর্শকের সামনে লাইট মাইক খুলতেও উদ্যত হয়েছে।
শেষে সামাল দিলেন বড়মামীমাই। দু পক্ষকে শান্ত করে যে যার জায়গায় পাঠিয়ে নাটক শুরু করার কথা নিজেই ঘোষণা করে দিলেন।
গোড়াতেই আমার ভয় ছিল। অস্বস্তি ছিল। মাইকের ঘটনা সেটা আরো বাড়িয়ে দিল।
যাই হোক শুরু হল নাটক। রেবা নামে একটি মেয়ে আমাদের দলে ছিল। মোটাসোটা গোলগাল, হাস্যমুখী। একটু লাজুক। কথাও বলত আস্তে। নাটকে সে ছিল বাড়ীওয়ালার স্ত্রী। নাটক চলাকালীন লক্ষ্য করছিলাম সকলেরই নজর কেবল উঁচুতে লাগানো মাইকের দিকে। মানে দৃশ্যটা কল্পনা করে নিন। মঞ্চে কুশীলবরা হাঁটছে ,কথা বলছে উপরে অদৃশ্য কাউকে লক্ষ্য করে। সকলেরই উদ্দেশ্য মাইক অবধি নিজের গলা পৌঁছোনো। রেবার প্রচেষ্টা আরো বেশী। কারন তার গলা এমনিতেই আস্তে। ওইভাবে সংলাপ বলতে বলতে বিপজ্জনকভাবে স্টেজের ধারে চলে আসছিল ও। আবার মাথার মধ্যে বিপদের ঘন্টাধ্বনি! সাবধান করতে যাবো তার আগেই———–+
হ্যাঁ। ঠিক ধরেছেন। একটা চুড়ান্ত আবেগঘন দৃশ্য! সীন একেবারে ক্লাইম্যাক্সে! কী হয় ! কী হয়! দর্শক উৎকণ্ঠিত!
হোল ঠিক তখনই। রেবা স্টেজ থেকে সটান নীচে! মানে একেবারে যাকে বলে পপাত ধরনীতলে। দর্শকাসনে প্রথমে হায় হায়! পরে তুমুল হাস্যরোল!
কিন্তু ধন্য বটে অভিনেত্রী! ধন্য তার স্পিরিট! ওই অবস্হাতেই কোন দিকে দৃকপাত না করে, লাফিয়ে স্টেজে উঠে, খুলে যাওয়া শাড়ীর কুঁচি একহাতে সামলে ,বাকি ডায়লগ শেষ করে তবে মঞ্চ ছাড়ল সে। একই সঙ্গে একটা উপকারও করে গেল। লক্ষ্য করলাম এই ঘটনার পর থেকে কেউ আর মাইকের দিকে তাকাচ্ছেনা। রেবার পতন সম্ভবত সবাইকে সচেতন করে দিয়েছিল। কিন্তু এবার বিপদ এলো অন্য দিক থেকে।
নাটক প্রায় শেষের মুখে । শেষ দৃশ্যের আগের দৃশ্য! মঞ্চে প্রায় সব চরিত্রই উপস্হিত। এমন সময়
ও কী!! আলোটা এমন করে কেন! নিভে যাবে না কী রে বাবা!! আরে আরে!! এ কী!! যাঃ!!
না। লোডশেডিং নয়। আমাদের বিখ্যাত লাইটম্যান তার হাতের দ্বিতীয় কাজটি দেখালেন! সম্ভবত মাইকের মতোই লাইটের ক্ষেত্রেও নিজের বুদ্ধিই বেশী প্রয়োগ করেছিলেন আর তারই চমৎকার নিদর্শন নাটক চলাকালীন স্টেজের আলোটি নিভে যাওয়া।
তারপর সেই তুমুল অন্ধকারে মঞ্চের উপর সাত আটটি চরিত্র, নীচে আরো গোটা চারপাঁচ ,দর্শকাসনে কমপক্ষে তিরিশ চল্লিশ জন ——— সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে
” একেবারে দক্ষযজ্ঞ বাধিয়া গেল। ”
সব শেষেরই শুরু থাকে। তাই আলো ও আবার জ্বলল। নাটকও শেষ হল। ক’দিন মাত্র! আমরা ভুলে গেলাম এই সব বিড়ম্বনার স্মৃতি। আবার মেতে উঠলাম নাটকে। আবার রিহার্সাল! আবার মেকাপ! আবার অভিনয়! আবার! আবার!——
জীবনের চাকা ঘুরে চলল নিজস্ব ছন্দে। কবে কৈশোর পার হয়ে বৃহত্তর জীবনে প্রবেশ করে গেলাম। শুধু বুকের ভিতরে লুকোনো সোনার কৌটোয় রয়ে গেল সেই অফুরন্ত স্মৃতির ভান্ডার। চোখ তুললেই আনন্দে ভাস্বর হয়ে ওঠা কোন মুখ! অভিমানে ঝুঁকে পড়া কারো চোখ। , জানিনা আজ তারা কে কোথায়? জানিনা এমনি করে ‘ফিরে দেখা’ র স্মৃতি তাদেরও তাড়িয়ে বেড়ায় কিনা? দু হাত বাড়িয়ে পিছু ডাকে কিনা সেই সোনালী কৈশোর ?
মহাকালের অঙ্গুলি হেলনে জীবননাট্যের রঙ্গমঞ্চে যে যার ভুমিকায় অভিনয় রত। কার পালা কখন সাঙ্গ হবে ,নেমে আসবে কালের যবনিকা –তা একমাত্র সেই নির্দেশকই জানেন।
–~০০০XX০০০~–