“লীলাবতী“
✍ নিলয় বরণ সোম
-“দূর দূর।, মেয়েরা আবার অংক পারে নাকি ! কাঁচা, ডাহা কাঁচা হয় ওরা অংকে !”
-“কী যা তা বলছিস ! কাজল ম্যাম এত ভাল অংক বোঝান কি করে ?”
-অরে এক্সেপশন প্রুভ্স দি রুল – শুনিস কি কখনো !
আসলে প্রণবেশ ওরকমই I অংকে অসম্ভব তুখোড় ছেলেটি মাঝে মাঝেই প্রেমে পড়ে যেত I কিন্তু ওর প্রেম কিছুতেই এগোতে না, আর প্রেম কেঁচে যাবার কারণ, প্রেমিকারা অংকে কাঁচা!সে কথা বোঝাতে দু একটি স্যাম্পলই যথেষ্ট I
ফার্স্ট ইয়ারে কলেজে ঢুকেই প্রণবেশ, বনানীর প্রেমে ঘায়েল। বনানী মোটামুটি বড়লোকের মেয়ে , সুতরাং প্রেম পর্বে প্রণবেশ তাকে যতই অরুণদার ক্যান্টিনের সিঙ্গারা খাওয়াতে চেষ্টা করুক, বনানী তাকে নিয়ে গেল পার্ক স্ট্রিটের মাঝারি রকম একটা রেস্টুরেন্টে । দোকানটি বেশ সরগরম I টোটো কোম্পনির সেলস্ ম্যানদের আড্ডা মূলত I দোকানটি আবার ফেলো কড়ি মাখো তেল টাইপের I অর্থাৎ, প্রথমে দাম দিতে হবে , কাউন্টার বয় একটা কুপন কেটে দেবে – তারপর কুপন ধরে ডাক দিলেই খাদ্য খাদক মুখোমুখি ।
বনানী হাবিজাবি কিছু অর্ডার করল – মোট্ একশ কুড়ি টাকার ভরপেট অর্ডার । ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে সে দেড়শ টাকা বের করে কাউন্টার বয় -এর হাতে দিতেই সে তাকে তিরিশ টাকা ফেরত দিল I অবশ্য সে সময়টা প্রনবেশ , মন দিয়ে রেস্টুরেন্টের দেয়ালে ঝোলানো ম্যাডোনার ব্লো-আপ খানি দেখছিল ।
কিন্তু অর্ডার দিয়ে ওরা বসেই রইল, কুপন আর আসে না I এদিকে টোটোবাবুদের পটাপট ডাক পড়ছে I প্রণবেশের ইতরবিশেষ খুব একটা হচ্ছিল না, প্রেমিকাকে পাশে বসিয়ে সে তখন জব্বর একখানা ডিফারেনটিয়াল ক্যালকুলাসের অংক সমাধান করছে মনে মনে I কিন্তু মিশিবাবা টাইপের বনানী তো এরকম অপেক্ষা করতে অভ্যস্ত নয়, আর বাড়ির কারো সঙ্গে এলে সে ফ্লুরিজ এর নীচে কোনো রেস্তোরায় ঢোকেও না ।
মাথা গরম করে সে প্রণবেশকে সঙ্গে নিয়ে নিয়ে এলো কাউন্টারে – ” আমাদের ২৩ নম্বরের কুপনটা ডাকছেন না কেন ?” একটি দুটি কথা কাটাকাটি হতেই বনানী, অর্ডার ক্যানসেল করতে চাইলো I কাউন্টার বয় তাকে ১২০ টাকা ফেরত দিয়েও দিল । দেখা গেল, বনানী সঙ্গে সঙ্গে দোকানদার কে কুড়ি টাকা ফেরত দিয়ে আবার একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে দিয়ে বলল , – “আমি তো আপনাকে দেড়শ টাকা দিয়েছিলাম !” কাউন্টার বয় ও বনানীর বাক্যবিনিমযে মাঝখানেই প্রণবেশের আশঙ্কা প্রমাণিত হল I বনানী অংকে একেবারে লীলাবতী I বাকি রাস্তা টুকু সে মাথা গোঁজ করে রইল – কথাও বলল না মোটে।
আস্তে আস্তে দুজনের প্রেম ফিকে হতে লাগলো – বনানী তার প্রতি এই বীতরাগের কারণ ঠিক বুঝতে না পারলেও আমরা ব্যাপারটা ঠিকই ধরতে পেরেছিলাম।
এর পরে থার্ড ইয়ারের প্রথম দিকে অংক অনার্সের সহপাঠিনী সংগীতার সঙ্গে যখন প্রণবেশের ঘনিষ্ঠতা শুরু হল, তখন আমরা একটু আশান্বিত হলাম I যাক, প্রেমটি ‘সাকসেস’ হলে প্রনবেশ একজন অংক জানা বউ পাবে ! যদিও প্রণবেশের থিওরিতে সংগীতা নাকি অংক বোঝে কম, মনে রাখে বেশী, তাও আমরা ভাবলাম, দুটিতে মিলে শুভঙ্করের সিঁড়ি ভেঙেই এগিয়ে যাবে জীবনের পথে I কিন্তু বিধি বাম I আমরা কেউই বুঝি নি , বনানীর থেকেও বড়লোক, সুন্দরী সংগীতা, টিপিক্যাল এক্সপোর্ট কোয়ালিটি প্রোডাক্ট I ফাইনাল পরীক্ষার আগেই তার এনগেজমেন্ট হয়ে গেল বি টেক টেকেন এক প্রবাসীর সঙ্গে।
ব্যর্থ প্রেমে ধরাশায়ী প্রণবেশ তখন আশ্রয় পেলো পল সায়েন্সের মনিকার কাছে । এই প্রেমের পরিণতি নিয়ে আমরা কিছুটা আশঙ্কা প্রকাশ করলেও প্রনবেশ দার্শনিকের মত মুখ করে বলত , আসলে জীবনের অংক অনেক বড় রে !দুটি মন যদি ইন্টিগ্রেটেড হয়ে যায়, তার থেকে ভাল কিছু আছে ?
এ হেন প্রণবেশ একদিন দুহাত দিয়ে মাথা চেপে বসে রইল I একটু চাপ দিতেই বলে উঠলো, ” নো, সি ক্যান্ট বি মাই পার্টনার ফর লাইফ ! এভরিথিং হ্যাস এ লিমিট !”
আমরা চেপে ধরতেই সে সব খুলে বলল I
তখন ইমরান খান খান সবে বিয়ে করেছেন আধ বয়সী জেমাইমাকে I ইমরান ৪২, জেমাইমা ২১I মনিকা নাকি আজ সদ্য সদ্য প্রনবেশ কে বলেছে এই বিয়েটা খুব গোলমেলে I প্রণবেশ নাকি উদার হেসে বলেছিল , বিদেশী স্বদেশী কোনো ব্যাপার নয়-আসল হচ্ছে ভালোবাসা – এই বিয়েতে কোনো গোলমাল নেই I মনিকা নাকি বুঝিয়ে বলেছিল- গোলমালটা অন্য জায়গায় I মনিকার মতে , এই ডবল বয়সে বিয়ে করাটা খুব সাংঘাতিক ব্যাপার I অংক কষে সে দেখিয়েছিল, জেমাইমার যখন তিরিশ বছর হবে, ইমরানের তখন ষাট , যখন চল্লিশ, ইমরান আশি !
এই সাংঘাতিক হিসেব শোনার পর আমরাও অবিশ্যি প্রণবেশকে ভরসা যোগাই নি আর I
এর পর অনেক বছর কেটে গেছে I প্রণবেশ কে প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম I হঠাৎ সেদিন আমাদের পাড়ার কেবল ডিস্ট্রিবিউটরের অফিসে দেখা হয়ে গেল তার সঙ্গে I আজকাল পে চ্যানেল নিয়ে একটা হুজ্জুতি চলছে, আমাদের কেবল অপারেটর অনেকটা এলাকা জুড়ে ব্যবসা করেন, সুতরাং দোকান লোকে ছয়লাপ I
অনেক বছর পরে দেখা হওয়ায় স্বাভাবিক উচ্ছাসে আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম I কাঁচা পাকা চুলের প্রণবেশ তার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো- প্রায় ইমরান জেমাইমা কেস ! প্রনবেশ জানালে, সে একটা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে অংকের শিক্ষকতা করে,আর এই বছর খানেক হল বিয়ে করেছে ! স্ত্রীর নাম বলল , লীলাবতী !
কুশল বিনিময়ের পর দেখা গেল , প্রণবেশের টার্ন এসে গেছে – সে আর তার স্ত্রী অনেক শলা করে দশ বারোটি চ্যানেল পছন্দ করে নিল I এরপর কেবলের ছেলেটি বলল, আপনাদের অমুক টাকা লাগবে, তার সঙ্গে এইটিন পার্সেন্ট জি এস টি !
প্রণবেশ্য ভার্যা ভ্রুতে প্রশ্ন জাগিয়ে ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আছে জি এস টি প্রত্যেকটা চ্যানেলের দামের সঙ্গে আলাদা আলাদা যোগ হবে, না টোটালের উপর ?”
কেবলের ছেলেটা কি যেন বলতে লাগল , আমার কানে গেল না I শুধু দেখলাম, প্রণবেশ তার স্ত্রীর হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে অফিসের বাইরে I
আমার বুকটা ধড়াস করে উঠলো, কেবল অফিসের উলটোদিকে অ্যাড্ভোকেট মিঃ ধাড়ার সাইনবোর্ডটা কি তার প্রণবেশের নজরে পড়বে, – এইচ এম ধাড়া – , বি এ ,এল এল বি, ( এক্সপার্ট ইন প্রপার্টি এন্ড ম্যারিট্যাল কেসেস !)
–~০০০X X০০০~–