“ব্লকলিস্টেড”
সুপ্তোত্থিতা সাথী
হঠাৎ একটা দুঃস্বপ্নের দমকে মাঝ রাতে চমকে উঠে বসলো কাঁকন। গলা শুকিয়ে কাঠ, বুকের বাঁদিকে যেন হাপর ওঠা নামা করছে। মাথার পাশে রাখা মুঠোফোনটা অন্ধকারে হাতড়ে স্ক্রিন অন করে দেখে নিলো টাইমটা। রাত প্রায় দেড়টা। মনকে অন্য দিকে ঘোরানোর জন্য ডেটা অন করলো ও।হঠাৎ ম্যাসেঞ্জারে টুং করে একটা ম্যাসেজ ঢুকলো যেনো।এই রাতে ম্যাসেঞ্জারে অন হতে ওর ইচ্ছে করছিলো না। এমনিতেই কাল সকাল থেকেই আয়োজন চলবে ওর ‘আইবুড়ো ভাত’-এর,সক্কাল সক্কাল আত্মীয় স্বজন এসে উপস্থিত হবে। আর মাত্র কয়েকটা দিন, তার পরেই ও পর হয়ে যাবে সমাজের নিয়মে। ভাবলেই কাঁকনের চোখ ফেটে জল আসছে।যাকে সে চেনে না,জানে না,তার সাথে সারা জীবন কাটাতে হবে মা বাবার ইচ্ছেতে।অনেক অভিমান বুকের মাঝে চেপে রেখেই ও বিয়েতে মত দিয়েছে।তবু কিছু একটা ব্যপারে মনটা প্রায়ই ওর খচখচ করে ওঠে ইদানিং।
তাচ্ছিল্যের মেজাজেই ম্যাসেঞ্জারের ইনবক্সটা খুলে নিজের চোখকেই ও যেন বিশ্বাস করতে পারলো না। বেশ ২-৩ সপ্তাহ আগে হঠাৎ বহু বছর পেরিয়ে পিয়াল ওকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট সেন্ড করেছিলো। দেখে হাতের আঙুল খানিক কেঁপেও গেছিলো কাঁকনের। রিকোয়েস্টটা অজান্তেই যেনো অ্যাকসেপ্টেড হয়ে গেছিলো সেদিন। শুধু অ্যাকসেপ্টই হয় নব্য সমাজের সো-কল্ড ফেসবুকীয় ফ্রেন্ডশিপ।
স্মৃতি খুঁড়তে খুঁড়তে একে একে মনে পড়ে গেলো কাঁকনের কলেজের সেই দিনগুলো…….
পিয়াল, হ্যা পিয়াল সেন,কলেজের সেরা হ্যান্ডসাম, আলাপী,বডি ল্যাঙ্গুয়েজে স্টাইল আইকন, গায়ক, ভাষ্যকার হিসেবে ক্যাম্পাসের বেশ নামজাদা নাম তখন পিয়াল সেনের।কাঁকন সবে কলেজ জয়েন করেই পিয়ালে মুগ্ধ। এক কথায় চুপি চুপি ওকে অনুসরণ করে যেতো কাঁকন।কলেজের সব সুন্দরীরা পিয়ালকে ঘিরে থাকতে চাইতো। পিয়ালও ব্যপারটা বেশ এঞ্জয় করতো। কিন্তু কাঁকন ওর মনকে পিয়ালের কাছে পৌছে দিতে পারতো না তখন,বলা ভালো একরাশ অভিমান আর তার ভালোবাসা নাকচ হয়ে যাবার ভয়তে কোনো দিনও পিয়ালের কাছে এগোতে পারেনি ও।দূর থেকে শুধু মুগ্ধের মতো অনুসরণ করে যেতো সিনিয়ার পিয়াল সেনকে।
প্রোফাইল ঘেঁটে কাঁকন জানতে পেরেছিলো, পিয়াল আজ বেশ প্রতিষ্ঠিত রেডিও জকি। বিভিন্ন নামী-দামী মানুষের সাথে উঠবস তার। গ্রুমিং হয়েছে আগের থেকে আরো অনেক বেশি,তাই পিয়ালকে এখন যেন একদম গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডেরই একজন লাগে।রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্টের দিন তাই বেশ চিন্তাতেই পড়ে গেছিলো কাঁকন। বার বার নিজের মনকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘যার আজ এত সুনাম,যার আজ গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের সাথে আনাগোনা- সে কিনা কলেজের মন মরা, চুপচাপ কাঁকন দত্তকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে?!’
আবার বেশ গর্বিত হয়ে সে ভেবেছিলো,’ যাক এতো চাকচিক্যের মাঝেও অতি সাধারণ এই মেয়েটাকে পিয়াল মনে তো রেখেছে, এটাই বা কম কিসের!’
কাঁকন কাউকে যেচে ম্যাসেঞ্জারে পিং করেনা,তাই পিয়ালের রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করার পর পেরিয়ে গেছিলো খুব সহজেই ২-৩ সপ্তাহ। যোগাযোগ সূত্রে টান পড়েনি দু’তরফেরই।কাঁকনও বেশ ব্যস্ হয়ে গেছিলো বিয়ের কেনাকাটায়।তাই প্রায় ভুলেই গেছিলো স্মৃতিতে আগলানো পিয়াল সেনের কথা।আজ হঠাৎ এতো রাতে মেসেজ পেয়ে তাই কাঁকন চমকে ওঠে। দেখতে পেলো ইনবক্সের উপর গ্রীন অ্যাকটিভ বাটনটা চকচক করছে পিয়ালেরই মতো। কিছুক্ষণ আগে যখন কাঁকন অফ ছিলো, তখনই ম্যাসেজ ছেড়েছিল পিয়াল। মেসেজ বক্সের সময় সেটারই প্রমাণ দিয়ে বসে আছে চুপচাপ।
—“হাইই কাঁকন!”
–“এতদিন পর তোকে আবার দেখলাম, কেমন আছিস বল?”
–“যাই বলিস, আগের থেকে কিন্তু দিব্বি খাসা দেখতে হয়েছিস তুই।”
—“প্রেম-ট্রেম করছিস নাকি?”
—“তা কি করা হয় তোর এখন?”
—“যাহ্, এলাম এদ্দিন বাদে,পাত্তাই দিচ্ছিস না,হয়তো ভাবছিস তোকে রাগাতে এসেছি।হয়তো ভাবছিস এমনি টাইম পাস করতে এসেছি।”
—“এনিওয়ে, নো চাপ বস্, ম্যাসেজ দেখলে রিপ্লাই দিস মন চাইলে, তোকে অনেক কথা বলার আছে।”
গ্যাপে গ্যাপে মেসেজ এসে, পর পর যেনো থরে থরে এক একটা ডিনামাইট সেট করে রেখেছে ইনবক্স।আর কাঁকনের বুকের ভেতরটায় যেনো এক একটা মেসেজ ব্লাস্ট ঘটাচ্ছে ডিনামাইটের।
লাস্ট ম্যাসেজের টুকরো ‘অনেক কথা বলার আছে’তে এসে কাঁকনের মন দুর্বল হয়ে গেলো খানিক।শুরু হলো কাঁপা আঙুলে টাইপিং।
—“হ্যাল্লো পিয়াল দা।”
–“কেমন আছো? কি মনে করে, আজ এতদিন পর?”
–“এত্ত যার নাম-যশ,সে আমায় হঠাৎ ইনবক্স করলো কেন?”
কিছুক্ষণ পর কাঁকনকে অবাক করে দিয়ে ইনবক্সে টাইপিং—–
—“নাম-যশ সবই আছে,তবে সোজাসুজি একটা কথা বলতে এসেছি তোকে,সময় থাকলে একবার শুনবি কি??”
কাঁকন—টাইপিং…….
—“বলে যাও,শুনছি।”
পিয়াল…….
—-“মন দিয়ে শোন কথা গুলো।হয়তো অবাক হবি,আমিও আজ বলে হালকা হতে চাই,তাই খুঁজে বার করেছি অবসর,শুধু তোর জন্য।”
—–“কলেজে সবাই আমায় পেতে,ছুঁতে চাইতো,প্রেম নিবেদনও করতো,কিন্তু আমি দূর থেকে আমার প্রতি তোর আকুলতা, টান,আমায় নখদর্পণে রেখে অনুসরণ করা- স-অ-ব খবর রাখতাম।কিন্তু তুই কখনো এগিয়ে আসিস নি আর আমিও কেরিয়ার না বানিয়ে তোর দিকে এগোতে পারিনি।”
—-“তবে ভয়ও পেয়েছিলাম,যদি আমার কেরিয়ার তৈরীর ফাঁকে তোর বিয়ে হয়ে যায়!তাও একটা আশা নিয়ে ফেবুতে তোর নাম সার্চ করলাম। দেখলাম তোর প্রোফাইল,তারপর রিকোয়েস্ট সেন্ড করি, যাতে একটু টাচে থাকিতে পারি তোর।”
—–“তুই সেই আগের মতই আত্মাভিমানী রয়ে গেলি,নিজে থেকে আমায় ম্যাসেজ করে জানতেও চাইলি না কিছু। এত্ত অভিমান আমার উপরে আজও?”
—-তবু কেনো জানিনা আজ আর থাকতে পারলাম না জানিস, ভয় ও পাচ্ছি, আরও দেরি করলে যদি তোকে হারিয়ে ফেলি?তাই আজ শেষ চেষ্টা করতে এসেছি।মনের কথা জানাতে এসেছি।”
—-“তুই আমার ভেতরটা বুঝতে পারছিস কিনা জানিনা, তবে এইটুকু বলবো- সেই কলেজ থেকেই তোকে অল্প অল্প করে জানতে জানতে কখন যে তোর প্রেমে পড়ে গেছিলাম জানা নেই।আজ সেই প্রেমের বহিঃপ্রকাশ করতে এসেছি।”
—–“আজ বলেই দিচ্ছি, তোকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি পাগলি,সারাজীবনের সঙ্গ দিবি আমায়?কথা দিচ্ছি, তোকে এত দিনের অপেক্ষা আর উপেক্ষার কষ্টগুলো আমি দ্বিগুণ ভালোবাসা দিয়ে মিটিয়ে দেবো।একবার তুই বল কাঁকন,তুই আজও আমায় ভালোবাসিস?আজও আমারই প্রতীক্ষায় আছিস??!!”
বুকের বাঁদিক আবার একবার হাঁপরের মত ওঠানামা করছে কাঁকনের। দম বন্ধ লাগছে ওর। চোখ ফেটে জল আসছে, এক রাশ অভিমান আর ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণায় কাঁকন স্তব্ধ।
‘কি রিপ্লাই দেবে ভালোবাসার প্রত্তুত্তরে?? সে যে ক’দিন পরেই অন্য কারোর হয়ে যাবে। সব যখন ঠিক হয়ে গেল এত প্রতীক্ষার পর, আর ঠিক তখনই আসতে হল পিয়াল সেনকে?? কেন এলো! আর এলোই যখন, তখন মনের কথা জানালোই বা কেন?’
বুকের ভেতর শয়ে শয়ে আছড়ে পড়ছে উথাল-পাথাল ঢেউ। গাল বেয়ে ঝরে যাচ্ছে অঝোর বারিধারা।
পিয়াল—–টাইপিং…….
—-“কি রে কাঁকন?? আর ইউ দেয়ার??”
—“ঘুমোলি নাকি?? ”
—“আজ প্লিজ উত্তর দে,নইলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। প্লিজ বল, আমায় আজও ভালোবাসিস??”
—“না বাসলেও বলবো, তুই যারই হ, সুখী হ,তোর মুখে সারা জীবন আনন্দের হাসি লেগে থাকুক,ভালো থাক আর ভালো রাখ মনের মানুষকে। আমি শুধু জেনেই খুশি হবো,যে তুই আজও আমায় ভালোবাসিস, আগেরই মতোই!”
—“বল,লক্ষ্মীটি, প্লিজ,চুপ থাকিস না,বল, উত্তর দে।”
পিয়ালের উৎকণ্ঠা ভঙ্গ করে কার্সার নড়ে চড়ে উঠলো।
কাঁকন—–টাইপিং…….
—–“আমি তোমায় খুব ভালোবাসি পিয়ালদা, যেমনটা আগেও বাসতাম, এখন হয়তো তার চাইতেও বেশি ভালোবাসি, কিন্তু সে ভালোবাসা আর তোমায় নিবেদন করার সময় বোধহয় ফুরিয়েছে।”
—-“এক সপ্তাহ পর আমার বিয়ে। আর কখনো তোমার জন্য অপেক্ষা করবো না পিয়ালদা। ভালোবাসি তোমায়, সেটাও জানান দিতে আসবো না আর। আমি যে পর হয়ে যাচ্ছি।”
—-“তোমার-আমার ভালোবাসা যেমন অধরা থাকলো, কেউই জানলো না সমাজের, পরিবারের। তেমন ফেসবুকের সম্পর্কটাও অধরাই থাক।”
—-“ভালো থেকো পিয়ালদা, জীবনে অনেক উন্নতি কোরো। মনের মানুষ খুঁজে নিয়ে সুখী হোয়ো।”
—–“আজ এই এখন থেকেই তুমি আমার ব্লক লিষ্টে স্থান পেলে।”
পিয়াল সেন….. ব্লক লিস্টেড।
——————–*******———————