প্রহর শেষের আলো
********************
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
দশটা মশাল একসাথে জ্বলছে। অন্ধকারের প্রহরের সাথে এক অসম লড়াই এর জন্য বুক ঠুকছে সকলে। এরকম সময় কালের আবর্তে কমই এসেছে। কিন্তু এসেছে যখন বাঁধভাঙা বন্যার মত তা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সবকিছু। মানুষের জয় পরাজয়ের নিয়তিকে ছাপিয়ে যেতে পারে শুধু মানুষই, আর কেউ নয়।
হাঁপাতে হাঁপাতে বটতলায় ছুটে এল সিদিক মোল্লা। তার আজ বড় বিপদ। উড্ সাহেব সরকারী আমিন এনেছে জমি দাগাতে আজ। উপায়ন্তর না দেখে সে ছুটে এসেছে দিগম্বরদের কাছে।কোনওমতে সে বলে ওঠে,
“মুই বলবো কি জমিতি দাগ মারতি নাগলো, মোর বুকে যেন বিদে কাটি পুড়য়ে দিতি নাগলো।”
দিগম্বর চাষীদের মধ্যে নেতা গোছের লোক। তার গলায় সর্বদা প্রায় নতুন বাঁদিপোতার গামছা আর হাতে একটা তেল মাখানো লাঠি থাকে। যদিও বাঙালীর লাঠির সেদিনের গরিমা নেই ঠিকই, তবে তেমন পাকা লাঠিয়াল হলে বন্দুকের সামনেও লড়ে দেখিয়ে দিতে পারে। দিগম্বর তেমনই একজন পাকা লেঠেল বটে। তাদের দলে এরকম দশজন জোয়ান আছে। তোরাপ আলি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বলশালী। আউশ ধান কাটার সময় এসেছে এখন। ওরা লাঠি হাতে রাত জেগে ফসল পাহারা দেয়। জমিদারের অত্যাচার ছাড়াও সম্প্রতি আর এক উপদ্রব শুরু হয়েছে কয়েক বছর হল । তা হল নীলের চাষ। হ্যালিডে সাহেব নীলের পরোয়ানা দিয়েছে বেশ কিছু সাহেবদের হাতে। তারই জোরে জুলুম করে কুঠিয়ালরা নীলের চাষ করাচ্ছে চাষীদের। বাংলাদেশের কৃষকরা বংশ পরম্পরায় ধানেরই চাষ করে। জোর করে দাদন দিয়ে এমনকি গায়ের জোরে জমি জমা রেখে তাদের দিয়ে নীল চাষ করতে বাধ্য করাচ্ছে সাহেবরা। আশেপাশের কয়েকটা মৌজায় এসব হলেও চৌগাছায় এইবার হাত দিয়েছে ইংরেজরা। সিদিক এদের প্রথম শিকার বলে মনে হচ্ছে। স্বাভাবিক কারণেই সিদিক নীল চাষে রাজি নয়।
কলকাতার কিছু খবরের কাগজে এই নীলচাষের অত্যাচার নিয়ে লিখছে বেশ কিছু লোক। হরিশ মুখুজ্যে বলে এক যুবক বেশ কোমর বেঁধে নেমেছে। হিন্দু পেট্রিয়ট বলে তার কাগজটি এ বিষয়ে লেখালিখি করে সাহেবদের চক্ষুশূল হয়েছে।
বিষ্ণুচরণও জানায় সে উড্ সাহেবকে একটি সাদা ঘোড়ায় চেপে ফসল ভরা আউশের ক্ষেতে বেশ কিছু দলবল জুটিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে কদিন ধরে। লোকটার হাতে থাকে একটা চাবুক। এই চাবুককে তারা দেশীয় ভাষায় বলে শ্যামচাঁদ। বলা বাহুল্য এর আঘাত বেশ কিছু দরিদ্র চাষীর পৃষ্ঠদেশ প্রায়সই বিদীর্ণ করেছে।
দুদিন পর ব্যাপারটা আরো বাড়াবাড়ির পর্যায়ে গেল। সিদিক মোল্লা নীলচাষে রাজি না হওয়ায় উড্ সাহেবের পাইক লেঠেলের দল ঘর থেকে ওর পনের বছরের মেয়ে আদুরীকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে কুঠীতে আটকে রেখেছে। সিদিকের বউ প্রায় দশ বছর আগে অকালমৃতা। সিদিক প্রায় মা এর যত্নে আদুরীকে মানুষ করে তুলছিল, চৌগাছার হাটের পাইকার রহিম শেখের বড় ছেলে হাসানের সঙ্গে সামনের মাসেই তার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। ইতিমধ্যে এই বিপত্তি।
দিগম্বরের দলবল রাগে ফুঁসছে। এর একটা বিহিত না করলে নীল কুঠির কুঠিয়ালদের অত্যাচার সীমা ছাড়াবে এ বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই।
দশজনায় এরা সকলে জড়ো হয়েছে মশাল আর লাঠি হাতে। এদের নেতৃত্বে দিগম্বর আর তোরাপ। উড্ সাহেবের কুঠি আক্রমণ করতে হবে আজ রাতেই। আদুরীকে উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে উড্ সাহেব আর তার দলবলকেও উচিৎ শিক্ষা দিতে বিলম্ব করা চলবে না।
ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে স্বয়ং সিদিক। বেশ দাঙ্গা হবার উত্তেজনায় সবাই আজ বেশ চাঙ্গা। আজ রাতটাকে কাজে লাগাতে হবে বলে বিষ্ণুচরণ কোঁচড়ে বেঁধে একটা দেশীমদের বোতলও এনেছে। সাহসে টান পড়লে দু একটা চুমুক তার স্নায়ুকে বশে রাখবে ।
কুঠির বাইরে আস্তাবলের পাশে একটা ছোট কুঁড়ের ভিতরে আদুরীকে আচ্ছন্ন অবস্হায় পাওয়া গেল সহজেই। ধুতুরা বা সিদ্ধি মেশানো কিছু একটা খাইয়ে বেচারীকে এই অবস্হায় বেঁধে ফেলে রেখেছে পাষণ্ডের দল। দিগম্বরের দলের লাঠির ঘায়ে কুঠীর চার জন বাগদী পাহারাদার ততোক্ষণে খতম। তোরাপ আর সিদিক কুঠির একদিকে পরম আনন্দে আগুন ধরিয়ে দেয়। এত গন্ডোগোলের মধ্যে কিন্তু স্বয়ং উড্ সাহেব উধাও। গোলমালের আন্দাজ পেয়ে তবে কি ও পালালো?
কুঠির ভেতরে সাহেবের থাকবার ঘরের দরজা ভেঙে দিগম্বর একাই ঢোকে মশাল হাতে। উড্ কে পাওয়া গেলে তাকে আজ জ্যান্ত পোড়াবে বলে তারা ঠিক করেছে। কিন্তু ঘরের কোনও দিকেই উড্ এর চিহ্ন মাত্র নেই। বরং একটা ফোঁপানোর মত আওয়াজ আসছে ঘরের একটা কোণ থেকে। আওয়াজটার উৎস বড় আলমারির পেছনদিকে। দিগম্বর সেখানে আবিষ্কার করে এক অদ্ভূত দৃশ্য। সদ্যোজাত শিশুটিকে বুকে চেপে উড্ এর মেমসাহেব স্ত্রী এমিলি মৃত্যুভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। তারই কান্নার চাপা শব্দ ঘরের ভেতর গুমরে উঠছে থেকে থেকে।
দিগম্বর কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্হায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। উড্ এতবড় পাষণ্ড যে নিজের বউ বাচ্চাকে একা এভাবে ফেলে গা ঢাকা দিতে তার বাধলো না!
মেমসাহেবের চোখে ভীতা হরিণীর মিনতি। দিগম্বর মনটা দ্রব হয়ে যায় হঠাৎ। ঘরে ওর বউ আর মাসচারেকের পুত্র সন্তানটির ছবি উদয় হয় ওর সামনে। হাতের ইশারায় সে নির্ভয় মুদ্রা দেখায় মেমসাহেবকে। ততোক্ষণে নীলকুঠির চতুর্পাশ্ব অগ্নিবলয়ের মরণ আলিঙ্গনে ক্রমশ ঢাকতে চলেছে। সঙ্গী সিদ্ধেশ্বরকে গোপনে ডেকে নেয় দিগম্বর। উত্তেজিত বিদ্রোহী সঙ্গীদের নররক্তপানের সম্ভাবনায় সে নিশ্চিত। তার হাতে মেমসাহেব আর শিশুটিকে সঁপে দেয় নিরাপদে কুঠিঘাট পার করে কালেক্টরের আপিসে ভোরবেলার মধ্যে পৌঁছিয়ে দেবার জন্য।
দিগম্বরের বুকের ভিতর থেকে পাথর নামে। উড্ এর প্রাপ্য শাস্তি কিছুতেই তার নিরাপরাধ মেমসাহেব আর শিশুটিকে দেওয়া সমীচীন নয়।
এরপর উল্লাসের সাথে বাকীদের সঙ্গে নীল কুঠিটির অগ্নিসংস্কার আর কুঠির তহবিল লুঠে সে মেতে ওঠে নিশ্চিন্ত মনে।
নীল বিদ্রোহ এভাবেই ১৮৫৭র মহাবিদ্রোহের পর ধীরে ধীরে জাতীয়তাবাদী উন্মেষের একটি একটি করে ইঁট গাঁথতে শুরু করে। এর কয়েকবছর পরই জার্মানরা কৃত্রিম উপায়ে নীল বানাতে শিখে গেলে ভারতবর্ষ থেকে এই অভিশাপ দূর হয়ে যায় চিরতরে। শুধু মাঝের কয়েকটি বছর অত্যাচারী নীলকর আর দরিদ্র কৃষকদের অসম সংগ্রাম, হরিশ মুখোপাধ্যায়ের অকাল মৃত্যু আর মানব দরদী ফাদার জেমস লঙের কারাবরণে কলঙ্কিত হয়ে থাকে। চারণকবির গলায় ফাঁকা ভগ্নপ্রায় নীলকুঠির অন্দরে আজও কান পাতলে শুনতে পাওয়া যায় –
“নীলকর বিষধর বিষপোরা মুখ।
অনল শিখায় ফেলে দিল যত সুখ…”
***********************************
*(তথ্যঋণ –
# নীলদর্পণ – দীনবন্ধু মিত্র
# সেই সময় – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
# নীল বিদ্রোহ : বাংলায় নীল আন্দোলন(১৮৫৯ -১৮৬২) – ব্লেয়ার. বি. ক্লিঙগ্ )
—-০০০ XX ০০০—-