“মাস্টার মশাই, আপনি কিছু দেখেন নি,আপনি কিছু শোনেন নি”।– কানের কাছে ফিসফিস করে কে যেন বলে গেল অবণী মাস্টার মশাইকে।
যেন সতর্কবার্তা জানিয়ে গেল তাকে অতি সনতর্পনে। অবণীবাবু তখন দাঁড়িয়েছিলেন স্থানীয় থানার সামনে; মনে মনে ভাবছেন ভিতরে প্রবেশ করবেন কি না!
পেশায় তিনি ছিলেন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক, বছর দুয়েক আগে রিটায়ার্ড হয়েছেন, বর্তমানে পাড়ায় কয়েকটা বাড়িতে বাচ্চাদের টিউশন পড়ান। দুই বিবাহযোগ্যা চাকুরিরতা কন্যা আছে ঘরে।–
মাস্টার মশাই আতঙ্কিত হয়ে ভাল করে চারিদিকে দেখলেন, দেখলেন হাত চারেক দূর থেকে একটা ছেলে তাকে দেখছে- ঠিক যেন ছেলেটি তাঁকে নজরে নজরে রাখছে। চশমার কাঁচটা পকেটের রুমাল দিয়ে ভাল করে মুছে নিলেন, চশমা চোখে দিয়ে দেখলেন ছেলেটি অন্য কেউ নয়- ২০১৯ সালে মাধ্যমিকে স্কুলের সবথেকে বেশি নম্বর পাওয়া সুরঞ্জন, তিনি তাকে আদর করে ডাকতেন ‘রঞ্জু’ বলে।
ভয়ে দিশাহারা হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে কোনোরকমে বাড়িতে পৌঁছলেন, হতভম্ব হয়ে সোফায় বসে পড়লেন। সন্ত্রস্ত গলায় মেয়েরা ফিরেছে কিনা তা গিন্নিকে সুধালেন, মেয়েদের জীবন নিয়েও তিনি ভীষণ চিন্তিত।
দিন সাতেক আগে টিউশন সেরে বাড়ি ফেরার পথে নয়া নির্মীয়মাণ ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে একটা আর্তনাদ শুনতে পেলেন, ধীরে ধীরে ভিতরে ঢুকতেই দেখলেন- চারজন মাঝবয়সী ছেলে একটা মেয়েকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, পোস্টের আলোয় দেখলেন মেয়েটি প্রায় অর্ধনগ্ন, নেতিয়ে পড়ে আছে। একজনের হাতে একটা চাকু পোস্টের আলোয় চকচক করে উঠল, একজন বলছে,” মেরে দে ওকে, বেঁচে ফিরলে আমাদেরই বিপদ”, অমনি একটা চিৎকার, চাকু দিয়ে মেয়েটার গলা কেটে দিল। আঁতকে উঠলেন মাস্টার মশাই, কিছু বলবেন কি– সেই মুহূর্তে কানের কাছে এসে একজন বলল, “মাস্টার মশাই,আপনি কিছু দেখেননি,আপনি কিছু শোনেননি”। আলো-আঁধারে রঞ্জুকে চিনতে অসুবিধা হল না, একি অধঃপতন হয়েছে ছেলেটার লকডাউনের এই তিন বছরে! হতবাক নয়ন তাকিয়ে রইলেন, তারপর টেনে একটা চড় কষালেন তিনি রঞ্জুকে। মুহূর্তের মধ্যেই বাকী তিনজন ঘিরে ধরল মাস্টার মশাইকে, একজন বলে ফেলল,”লাশ ফেলে দেব”, অন্য একজন বলল,”আপনার ঘরেও দুটো বেশ সুন্দরী আছে”! সঙ্গে সঙ্গেই রঞ্জু বলে উঠল,”ছেড়ে দে তোরা মাস্টার মশাইকে, ওটা আমি বুঝে নেবো”। — এই বলে রঞ্জু অবণীবাবুকে বলল,– “মাস্টার মশাই, আপনি বাড়ি যান আর মনে রাখবেন — আপনি কিছু দেখেন নি, আপনি কিছু শোনেন নি”।
পরের দিন কৌতুহল বশতঃ অবণীবাবু সেই জায়গায় গেলেন, লোকে লোকারণ্য, পুলিশ এসেছে, বডিটা সাদা কাপড়ে ঢাকা। শোনা গেল – কয়েকজন দুর্বিত্ত ধর্ষণ করে মেরে ফেলে গেছে, অবণীবাবু পুলিশকে বলতে যাবে কি রঞ্জু কানের কাছে বলল, “মাস্টার মশাই আপনি কিছু দেখেননি, আপনি কিছু শোনেন নি”।
মাস্টার মশাইয়ের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হল না, মনে মনে তিনি গুমড়ে ওঠেন, কাউকে কিছু বলতেও পারলেন না, আতঙ্কে মেয়ে দুটোকে বাইরে যেতে বাধা দেন। মেয়েরা চাপ দেওয়ায় তিনি বাড়িতে সেই রাতের ঘটনা বললেন, শুনে মেয়েরা এক্কেবারে ক্ষেপে উঠলো। বুঝিয়ে সুঝিয়ে পরের দিন তারা বাবাকে থানায় নিয়ে গেল, দূর থেকে রঞ্জু নজর রাখল,কিছু বলল না। কিন্তু তার চোখের দৃষ্টিতে বুঝিয়ে দিল মাস্টার মশাই ঠিক করছেন না, এর ফল ভাল হবে না, ভয় পেয়ে তারা রিপোর্ট না করেই ফিরে গেল।
পরের দিন বড় মেয়ে,মিনু অফিস থেকে বাড়ি ফিরছে, পাড়ার আলো-আঁধারী রাস্তা দিয়ে সন্ধ্যাবেলায় হেঁটে যাচ্ছে, হঠাৎই তার গায়ে কি যেন পড়ল, সঙ্গে সঙ্গেই মুখটা জ্বলে উঠল, বুঝলো অ্যাসিড পড়ল। চিৎকার শুনে ক’জন সহৃদয় মানুষ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চেয়ে অ্যাসিডে মুখ ঝলসে গেল মিনুর, ছোট মেয়ে, নীলু রাত দশটা পর্যন্ত বাড়ি ফিরছে না দেখে মাস্টার মশাই নীলুকে খুঁজতে দরজা খুলে বাইরে বের হতেই চোখে পড়ল নীলু মাথা নীচু করে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, অন্ধকারের মধ্য থেকে সেই গুরু গম্ভীর কণ্ঠস্বর– “আজ নীলুকে কোনো রকমে ওদের হাত থেকে বাঁচিয়ে এনেছি, এরপর প্রতিবাদের চেষ্টা করলে আর বাঁচাতে পারব না”। মাস্টার মশাই আতঙ্কে নির্বাক হয়ে মেয়েকে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন।
অবণীবাবুর এক ছাত্রের বাবা আই পি এস অফিসার, তিনি মাস্টার মশাইয়ের অবস্থা দেখে সব কথা শুনলেন। যথেষ্ট তৎপরতার সঙ্গে তিনি ঘটনার তদন্ত করলেন, দুদিনের মধ্যেই রঞ্জু সহ বাকী তিনজনকে গ্রেফতার করলেন।
বর্তমান সমাজের বেশিরভাগটাই এমন ধরনের- চোখের সামনে অপরাধ হতে দেখলেও ক্ষমতাশালী না হলে প্রতিবাদ করা যাবে না,বরং আতঙ্কে থাকতে হয়– কোন্ সময়ে নিজেদেরই না কোনো বিপদ হয়ে যায়। তবে “অসির চেয়ে মসী” বড়-এই কথাটা সবাই জানি, লেখনী নামক অস্ত্র দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আঘাত হানি। সমাজের বদল ঘটাতে মসী লড়াই করেছে সর্বযুগে, প্রতিবাদ করেছে কাব্যে-কবিতা-গল্পে মানুষ যুগে যুগে। ক্ষমতার দম্ভে মেতেছে যারা ধিকৃত হয়েছে বারেবারে, হারিয়ে গিয়েছে চিরতরে বিস্মৃতির অতল অন্ধকারে। মনীষী যাঁরা মানবতার কল্যাণে লিখেছেন প্রতিবাদের বাণী, মানবসভ্যতার ইতিহাসে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়েছেন তারা জ্ঞানী।