এই যে শিখা ওই রিন্টিকে নিয়ে দাওয়ায় শুলো এ কি ভালো লাগে ? এমনিতেই শোওয়া নিয়ে ওর খুব খুঁত খুঁতুনি আছে । বিছানা চোদ্দবার ঝাড়বে। টান টান করে চাদর পাতবে। ঝেড়ে ঝুড়ে সুন্দর করে , সমান করে মশারি খাটাবে। তারপর ঘুমোতে যাবে। চাদর মশারি একটু ময়লা হবার জো নেই। সপ্তাহে দু বার সব কেচে ধপধপে করবে। মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করে সেই চাদর পাতবে। আর দেখো সেই মানুষ নিজের সাধের বিছানা ফেলে আজ দাওয়ায় মাদুর আর তার ওপর চাদর পেতে শুয়েছে। ঘুমোতে পারবে ও ? কতবার বলল সুখেন , “তুমি মেয়েটাকে নিয়ে ঘরে বিছানায় শোও। আমি বাইরে শুচ্ছি। ”
শুনলো কথা ? ওই জেদ ! রাগও বটে। সুখেন না বলে কয়ে, না ভেবে চিন্তে মেয়েটাকে নিয়ে এসে তুলেছে। তাই নিজেকে শাস্তি দিয়ে ওকে এইভাবে জব্দ করবে শিখা। অথচ সব বলেছে সুখেন। কী পরিস্থিতিতে মেয়েটাকে আনতে বাধ্য হয়েছে ও সেটাও। কিন্তু ওই শোনা পর্যন্তই। কাজ করবে নিজের মর্জিতেই। এখন এনেই যখন ফেলেছে যতদিন না কিছু ব্যবস্থা হয় মেয়েটাকে ওদের কাছেই তো রাখতে হবে। রাস্তায় তো আর বার করে দিতে পারে না ও। আর যতদিন থাকবে মেয়েটা ততদিন ওই খানে, ওই দাওয়ায়, ওভাবে শোবে শিখা? আর ঘরে এই বিছানায় সুখেন একা ? এটা একটা কথা হল ? না সমাধান হল? ভাবতেই তো বুকের ভেতর ছটফটিয়ে ওঠে ওর। মোটে তো এক বছর বিয়ে হয়েছে ওদের। এখন আলাদা শুতে ভালো লাগে কারুর ? নাহ ! শিখা যাই বলুক। আজকের রাতটা কেটে যাক। কাল থেকে কিছুতেই ওকে বাইরে শুতে দেবে না ও। হয় নিজে শোবে নাহলে –— কিন্তু তাহলেও তো সেই একাই শোয়া। আচ্ছা ওই মেয়েটা একা শুতে পারবে না বাইরের দাওয়ায় ? কেন পারবে না ? আলবাত পারবে। বাচ্চা তো নয়। রীতি মত আঠেরো উনিশ বছর বয়স। আর বাইরের দিকেও নয় দাওয়াটা। ওদের ঘরের ভেতর দিকেই তো। কোন বিপদের সম্ভাবনাও তো নেই। তবে ? উত্তেজনায় বিছানায় উঠে বসে সুখেন। তাহলে মিছিমিছি শিখার ওকে নিয়ে বাইরে শোবার দরকার কি? এখানে যে কদিন থাকবে বাইরেই শুতে হবে। তারপর শিখা যদি কোন কাজ টাজ জোগাড় করে দিতে পারে তখন তো সব ঝামেলা মিটেই যাবে। আশ্চর্য ! এই কথাটা ও ভাবতে পারল আর শিখা পারল না ? হুম। খুব পেরেছে। মনে মনে হাসে সুখেন। আসলে ও দেখছে সুখেন কী বলে। হঠাৎ এনে তুলেছে তো মেয়েটাকে। অন্য কিছু ভাবছে হয়ত। সেই একই রকম রয়ে গেল শিখা। একটুতেই অভিমান আর জেদ। অবিশ্যি এই জেদটুকু ছিল বলেই ওদের বিয়েটা হয়েছে। সংসার হয়েছে। নইলে কোথায় ভেসে যেত সুখেন ? তখন সবে সবে গ্রাম থেকে এসেছে। কিছুই চেনে না। ওর জেদাজেদিতেই ওদের গ্রামের নিমাইদার সঙ্গেই শেষ পর্যন্ত ওকে কলকাতায় পাঠিয়েছিল পিসি। ততদিনে টেনেটুনে নাইন অব্দি পড়ে ইস্কুল ছেড়েছে সুখেন। বয়সও গড়িয়েছে কুড়ির ওপারে। পিসি চেয়েছিল গ্রামে থেকেই চাষবাস করুক।জমি জায়গা দেখাশোনা করুক। বুঝে শুনে চলতে পারল একটা পেট চলে যাবে। প্রথমদিকে বেশ কিছু বছর করেও ছিল তাই। কিন্তু মন মানছিল না। ততদিনে দেখা হয়ে গেছে ওর যারা গ্রাম থেকে শহরে গেছে তাদের চিকচিকিনি। ওই নিমাই দা, ওই পবন বৈরাগীর জামাই বসন্ত। ওহ ! কী সব চুলের ছাঁট ! কী জামাকাপড়ের বাহার ! হাতে কাঁচা পয়সা কত ! ওদের কাছেই তো শুনেছিল সুখেন কারখানায় কাজ করলেই নগদ পয়সা। আর কলকাতা তো ফুর্তির জায়গা। ওদের গ্রামে অবশ্য ততদিনে সিনেমা হলও খুলেছিল একটা। বাংলা ছবির সঙ্গে দু একখানা হিন্দি ছবিও দেখানো হত। তো সেই খানেই সিনেমা দেখতে এসে নিমাইদার কী হাসি ! এই নাকি সিনেমা হল ! কলকাতায় — আর শুধু কলকাতায়ই বা কেন ? একটু ছোটখাটো শহরেও যা সিনেমা হল হয়েছে এখন ! সে দেখলে চোখ কপালে উঠে যাবে। ঠাণ্ডা ঘরে গদিতে আরাম করে বসে কোল্ড ড্রিঙ্কস খেতে খেতে সিনেমা দেখা। শুধু পয়সা ফেললেই হল। মুখের সামনে খাবার, কোল্ড ড্রিঙ্কস পৌঁছে যাবে। আর শুধু কি সিনেমা হল ? দোকান, বাজার, শপিং মল, কত নামি দামী খাবারের দোকান। কী নেই কলকাতায়?
আগামী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম