“এই এলাকায় মিঞারে মনে হয় নতুন দেখতিছি।” আম গাছের দিক থেকে কথাটা ভেসে আসায় সেই দিকে তাকিয়ে দেখি, আম গাছের গোড়ায় শীর্ণকায় এক বৃদ্ধ বসে বসে হুকো টানছে। পরনে লুঙ্গি ও ফতুয়া, মাথায় সাদা টুপি। বৃদ্ধ যে ওখানে বসে হুকো টানছে এতক্ষণে সেটা আমার চোখে পড়ল না!! রীতিমত অবাক হলাম। ভাবলাম হয়তো সেভাবে খেয়াল করিনি। এক পা দুই পা করে বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে গেলাম। বৃদ্ধ বুরুক বুরুক শব্দে কয়েকবার হুকোয় টান দিয়ে খানিকটা কেশে নিয়ে আমার দিকে ফিরে বললেন-” তা জন মনিষ্যিহীন কবর খানায় কি মনে করি?” আমি বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে এসে আমতাআমতা করে বলি যে, এই গোরস্থানের নাকি একটা ইতিহাস আছে সেটাই জা-ন-তে—! — তা আসা হচ্ছে কোথা থেকি? — কোলকাতা। — কো-ল-কা-তা!! সে-তো এখন ভারতের মধ্যি পড়ে। তা মিঞার নাম কি? আমি নাম বলতেই কেমন যেন ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকালেন, নামটা মনে হয় পছন্দ হলনা। আবার হুকোতে দু’টো টান দিয়ে বললেন- ” বামুনের পো, তা মুসলমানের কবর খানার ইতিহাস জানি কি হবে??” — না মানে আমি টুকটাক লে-খা-লে-খি ক-রি সে-ই জ-ন্যে—-। —- দেখি তো মনি হচ্ছে শিক্ষিত নোক,তা জিন পরীতে বিশ্বাস আছে?? — আছে বলেই তো গোরস্থানের ইতিহাসটা জানতে এসেছি। — ইতিহাস যদি হিন্দুদের বিরুদ্ধি হয়,তাহলি লেকপেন? — নিশ্চই লিখব, তা না হলে তো প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করা হবে। আপনাকে একটা প্রশ্ন করব? — বলুন কি জানতি চান? — ছবি শেখ আপনার কে হন? আমার প্রশ্ন শুনে বৃদ্ধ একটু চমকে উঠে আমার দিকে এমন ক্রুর ভাবে তাকালেন যেন মনে হল খুব খুশি হলেন না। কর্কশ স্বর তো আছেই, তার উপর গম্ভীর ভাবে না বলতে চাওয়ার মতো বললেন-” আ-মি ও-না-র আ-ত্মী-য়।” আমার প্রশ্নে বৃদ্ধ অসন্তুষ্ট হচ্ছেন বুঝেও জিজ্ঞেস করলাম, ফুলের স্তবক রাখা কবরটি কার? এবার মনে হল অসন্তুষ্ট না হয়েই বললেন-” ১৯৩০ সালে আজকের দিনি ছবি শেখের ওই জায়গায় গোর দেওয়া হয়।” আমি আর প্রশ্ন করিনা, বুঝতে পারি ধুপ মোমবাতি জ্বালিয়ে কে পুষ্পস্তবক রেখেছেন। বৃদ্ধ একটু অখুশি হয়ে বললেন- — আপনি কি ছবি শেখের গোরস্থানের ইতিহাস জানতি চান, না আমারে প্রশ্ন করি বিব্রত করতি চান? — অমি দুঃখিত, আপনি বলুন। বৃদ্ধ আবার হুকোতে দু’টো টান দিয়ে, একটু কেশে বললেন-” বসেন এই হানে।” আমি বৃদ্ধের থেকে ফুট তিনেক দুরে সান বাঁধানো গাছের গোড়ায় বসলাম। বৃদ্ধ শুরু করলেন ছবি শেখের জীবন কাহিনি —– “১৮৮০ সাল হবে সম্ভবত। সুন্দরবনের আয়তন তখন আজকের দ্বিগুণ ছেল। এখনকার মতো অতো সরকারী বিধিনিষেধ ছেলনা। তকন জঙ্গলের পাশের গেরামের মানুষদের প্রধান জীবিকা ছেল,জঙ্গল থেকে কাঠ, মধু, মাছ সংগ্রহ করা। দশ পনের জনের এক-একটা দল নৌকা করে গভীর জঙ্গলে চলি যেত কাঠ, মধু সংগ্রহের জন্যি। দলে থাকত একজন করে গুণিন, যার কাজ ছেল, দলটি যে হানে কাঠ বা মধু সংগ্রহ করবে সেই এলাকাটা মন্ত্রবলে বাঁধি দেওয়া। যাতি ও-ই এলাকার মধ্যি বাঘ ঢুকতি না পারে।
ছবি শেখের বয়স তখন দশ কি এগারো। পড়াশোনায় মন বসতো না, বনেবাদাড়ে ঘুরিফিরি বেড়াত। বাড়িতি না জানিয়ে একবার এক দলের সাথে সে জঙ্গলে চলি গেল। উদ্দেশ্য একটাই, গুণিন কোন মন্ত্রবলে বাঘরে আটকায় সেটা জানার।
নৌকা যখন বড়ো নদী থেকে খাঁড়িতি ঢুকি পড়ল তখন চারদিক অন্ধকার হয়ি এল। গুণিন সতর্ক করি দে কলে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নৌকো থেকি নাবতি হবে। সময় নষ্ট না করি দলটি জঙ্গলে নামি পড়লে। কাছি দে নৌকা বাঁধতি না বাঁধতিই শুরু হল প্রবল ঝড়, সেই সাথে মুশলধারায় বিষ্টি এবং বজ্রপাত। দলের সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে লণ্ডভণ্ড হইয়ে গেল। ভয়ে আতঙ্কে ছবি শেখ একটা গাছের গুড়ি ধরি ঘন্টা দুয়েক দাঁড়ায়ে থাকল। তারপর পকিতির বিপর্যয় থামলি ভিজে শরীলে সঙ্গীদের খুঁজতি থাকল। গভীর জঙ্গলে দিশাহারা অবস্থায় সঙ্গীদের ডাকতি ডাকতি আরো গভীর জঙ্গলে ঢুকি পড়ি পথ হারালো। শ্বাপদসংকুল জায়গায় কি করবে, বাচ্চা পোলা বুঝি উঠতি পারতেসে না, ঠিক তখনি নজরে পড়লে একটা কুমির দ্রুত পায়ে এগুচ্ছে। ছবি শেখ অনুমান করলে কুমির যেদিকি যাচ্ছে, নিশ্চই সেদিকি নদী হবে। এই ভেবে সে কুমিরের পিছু নেলে, এবং হলও তাই। কিন্তু দুর্ভাগ্য ততক্ষণি তার সঙ্গী হয়ি গেছে। নদী তো পেল, পেল না সঙ্গী সাথীদের। তখনকার দিনি এমন পরিস্থিতিতে যদি কেউ দলছুট হয়ি যেত তো ধরি নেওয়া হতো দলছুট মানুষটারে বাঘে খেয়ে ফেলিছে। তাঁদের দলটিও সেই চিন্তা ভাবনা করি ছবি শেখকে জঙ্গলে ফেলি চলি আসে। এদিকি ছবি শেখ রীতি মতো ভয় পেয়ে চিৎকার করি সঙ্গী সাথীদের ডাকতি থাকে। লাভ তো কিছু হলই না,বরং এক বাঘ তার গলার আওয়াজ পেয়ি গুটি গুটি পায়ে তার দিকি এগিয়ে আসতি থাকে। উদ্ভ্রান্ত ছবি শেখ চিৎকার করি ডাকতি ডাকতি দূরে বাঘটারে দেখতি পায়। এবং কি করবে বুঝতি না পারি তাড়াতাড়ি সামনের একটা লম্বা কেওড়া গাছে উঠি পড়ে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার কত্তি থাকে।
খোদে বিবি, এক মাত্র বুড়ি যে সুন্দরবনের এই নির্জন দ্বীপি একা থাকে। অনেকেই তারে জঙ্গলে থাকতি নিষেধ করেছে, কিন্তু কেডা শোনে কার কথা। তার একই বক্তব্য স্বামীর কবরের পাশেই আমৃত্যু সে থাকপে, এবং মরার পরে যেন তারেও স্বামীর কবরের পাশেই কবর দেওয়া হয়। আজ প্রায় কুড়ি বছর সে সুন্দরবনের গহীন জঙ্গলে কুটির বেঁধি বাস করতেছে। বুড়ি নাম করা গুনিন, তার মন্ত্র বলে বাঘ যেমন বন্দী হয়,তেমন জিন পরিও বশ্যতা স্বীকার করে। জঙ্গলের বাইরের গ্রামের লোকেদের প্রয়োজন পড়লি নৌকো করি খোদে বিবিরে নে যায়। কাজ শেষে ফেরার সময় জালা ভর্তি করি পানি,চাল, ডাল,তেল,নুন, ইত্যাদি রসদ নিয়ে জঙ্গলে ফেরে। খোদে বিবির স্বামী আবদুল বক্সও ছেল নাম করা গুণিন। খোদে বিবির শিক্ষা তার হাত ধরি। একবার হয়েছে কি আবদুল বক্স একটা বড়ো দলের সাথে এসিছিল জঙ্গলে। খাঁড়ির গা ঘেঁষে জঙ্গলে বেশ কিছুটা এলাকা বাঘবন্দি করি দেয়। তারপর দলের লোকজন কাঠ কাটা, মাছ ধরার কাজে লাগি পড়ে। আবদুল বক্স অবসর সময় কাটাতি খাঁড়ির চরে শুয়ে শুয়ে একটা বিড়ি টানতি টানতি ফুরফুরে বাতাসে কখন যেন ঘুমায়ি পড়ে। এদিকি খাঁড়ি থেকে একটা কুমির নিঃসাড়ে চরে উঠি আসে, এবং খুব সাবধানে আগায়ি আসি ঘুমন্ত অবস্থায় আবদুল বক্সের মাথা এক কামড়ে ধরি হিড়হিড় করি জলের দিকি টানি নে যায়। সঙ্গী সাথীরা যখন টের পায়, তখন আবদুল বক্সের পা দুটো জলের উপরে ছেল। সকলে ছুটি আসে, কাছে জাল থাকায় জাল ফেলি আবদুল বক্সকে খোঁজার যথেষ্ট চেষ্টা চলানোর পর উদ্ধার করা হয় বটে,তবে জ্যান্ত না,মরা।
খবর যায় নিঃসন্তান খোদে বিবির কাছে। সে আসি মৃত স্বামীরে দেখি স্বাভাবিক ভাবে ভাঙি পড়ে। তারপর একটু স্বাভাবিক হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, স্বামীরে এই জঙ্গলেই গোর দেবে, এবং গোরের পাশে কুটির বাঁধি এখানেই যতদিন বাঁচপে ততোদিন থেকি যাবে। প্রায় কুড়ি বছর খোদে বিবি সেখানেই আছে।
ওই ভাবেই চলতিছিল। সেদিন খোদে বিবি এক জিনে ধরা নতুন বৌয়ের ঘাড় থেকে জিন তাড়িয়ে কুঁড়ে ঘরে ফিরতেছে। নৌকো থেকে নামি হঠাৎ একটা কিশোরের গলার আওয়াজে অবাক হয়ি সেই দিকি গিয়ে দেখে দশ বারো বছরের একটা ছেলে সরু কেওড়া গাছের মগডালে উঠে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতেছে, আর দুরে একটা বাঘ গুটি গুটি পায়ে গাছের দিকে এগিয়ে আসতেছে। খোদে বিবি এই পরিস্থিতি দেখি তৎক্ষণাৎ মন্ত্রবলে গাছের গোড়া বাঁধি ফেলে। মন্ত্রশক্তি বলে বাঘটাও দুর্বল হয়ি পড়ে এবং সেখান থেকি অন্যত্র চলি যায়। বাঘ চলি যেতি, খোদে বিবি কিশোররে অভয় দে গাছ থেকি নামি আসতি কলে। কিশোরটি হল ছবি শেখ। গাছ থেকি কোনক্রমে নামি অসুস্থ হয়ি পড়ে। খোদে বিবি কুটিরে নিয়ে আসি সেবাশুশ্রূষা করি তারে সুস্থ করি তোলে। তারপর ছবি শেখের কাছে সমস্ত ঘটনা শুনি কলে-” আমার তিনকুলি কেউ নেই, তুই বরং আমার কাছে থাক। তোর ইচ্ছে গুণিন হবি, তা-ই তো জঙ্গলে এইলি। আমার বয়স হয়েছে, কবে আছি কবে নেই, আমার মন্ত্র আমি তোরে দে যাব।” ছবি শেখও ভাবল, তার জীবনের লক্ষ্য তো গুণিন হওয়া, সেটা যখন এই হানে শিখতি পারবে,তবে খোদে বিবির কথা মতো চলাই ভাল। তারপর আরো প্রায় কুড়ি বছর ছবি শেখ খোদে বিবির সাথে থাকি বাঘবন্দি বিদ্যা,জিন,পরীর উপর বশীকরণ বিদ্যা রপ্ত করি ফ্যাল্লে। বিভিন্ন জায়গা থেকি ডাক আসলি খোদে বিবি না গে ছবি শেখ যেত। এই ভাবেই তার হাত পাকতি থাকে।
এক সময় খোদে বিবি অসুস্থ হয়ি পড়লি, ছবি শেখ নিজির মা-র মতোন খোদে বিবিরে সেবাশুশ্রূষা করিছে। এমতাবস্থায় খোদে বিবি একদিন ছবি শেখকে ডাকি কলে-” শোন খোকা, আজ তোর হাতে এক বিরাট ক্ষ্যামতা সম্পন্ন জিনরে তুলি দেব। কিন্তু প্রয়োজনে খুব সন্মান এবং ছেদ্দার সাথে তারে কাজে লাগাবি।” অবাক হয়ি ছবিশেখ জিজ্ঞেস করে-” কি এমন জিন যে তারে এত সন্মান করতি হবে।” খোদে বিবি বুঝলেন ঘটনাটা না বললি ছবি শেখ বুঝতি চাবে না। সুতরাং সে জিনের পরিচয় বলা শুরু করলে—-
“বছর দশেক আগের কথা, ভরা শীত কাল মাঘের দুই তিন তারিখ হবে। ভোরের কুয়াশা চারদিক গ্রাস করি রাখিছে। দু’হাত দূরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। কোনো একটা কাজে আমি খাঁড়ির দিকি গেলাম। তখন সবে ভাটার শুরু, পানি সমুদ্রের পানে টানতেছে। হঠাৎ নজরে পড়ল,একটা মরা মানুষ হেঁতেল গাছের ঝাড়ে আটকে রয়েছে। আমি গিয়ে মরা মানুষটারে টেনি তোললাম। আলগা গায়ে,সাদা থান পরা। গলায় পৈতে, মাথায় লম্বা চুল। মনি হল সাধু গোছের মানুষ ছেল। মন্ত্র পড়ে মরা মানুষটার আত্মারে ডাকলাম। এলো যখন আমি তো অবাক এ দেখি বেহ্মদত্যি। শুধোলাম এটাকি তোর শরীল? কলে-” হ্যাঁগো বুঁড়ি। গঙ্গাসাঁগরের মেলায় পুঁন্নি কঁরতে এসে জঁলে ডুঁবে মঁরিচি। আঁমার মুখে এঁকটু আঁগুন দেঁ-না বুড়ি, আঁমি নিষ্কৃতি পাঁই।” আমি দ্যাখলাম এই সুযোগ। জিনের থেকে বেহ্মদত্যির ক্ষ্যামতা অনেক বেশি। যে কাজ জিন পারেনা, সে কাজ বেহ্মদত্যি অনায়াসে করি ফেলতি পারে। আমি তখন বুদ্যি খাটায়ে কলাম -মুখি আগুন দিতি পারি,তবে কথা দে ডাকলিই আসপি, বেহ্মদত্যি কলে, আসপে তবে তারে অসন্মান করলি হবে না। আমি তাতেই রাজি হয়ে মরার মুখে আগুন দে জলে ভাসিয়ে দেলাম। সেখান থেকি বেহ্মদত্যি আমার হাতে বন্দী। জিনরে দে যখন কাজ হয়না, তখন তারে ডাকি। আজ আমি ওরে ডেকি তোর হাতে তুলি দেব। তবে বেহ্মদত্যির শর্তটা মাথায় রাখিস। তাতে তোর লাভ হবে।”
এরপর খোদে বিবি আর মাস তিনেক বাঁচি ছিল। খোদে বিবি মরে যাওয়ার পর ছবি শেখ খোদে বিবির ইচ্ছেমতো আবদুল বক্সের কবরের পাশে তারে কবর দে জঙ্গলের পাট চুকিয়ে গেরামে ফিরি আসে।
ছবি শেখ গ্রামে ফেরার পর তারে পথম দিকি কেউ চিনতি পারেনা। বাড়ির লোকজনকে বোঝাতি তার হিমশিম খেতি হয়েচে। কারন তারা এটাই জানে কুড়ি বাইশ বছর আগে ছবি শেখকে বাঘে খেয়েছে। সমস্ত ঘটনা আদ্যোপান্ত বর্ণনা করি তবে বিশ্বাস করাতি হল, সে-ই ছবি শেখ। গেরামে অসি পথম দিকি একটা দু’টো কাজ যা পেত তাতে সফলতা আসে। সুন্দরবনে যাওয়ার ডাক অনেক আসত কিন্তু সে যাতি চেতো না, কারন বনের উপর তার একটা ঘেন্না জন্মি গেলো। এদিকে গ্রামে গঞ্জে ধীরে ধীরে তার হাতযশের কথা ছড়াতি থাকল। শুধু মাত্র জিনে ধরা রুগী না,কঠিন কঠিন ব্যামো ছবি শেখের হাতযশে ভাল হতি থাকল। সমস্ত কাজ ছবি শেখ করাত বেহ্মদত্যির জিনরে দে, এমন কি রাতবিরেতে ডাক আসলি তার পালকির বাহকের কাজটাও বেহ্মদত্যির জিনরে দে করাত। কারন নিমেষেই জায়গা মতোন পৌঁছাতি পারত। বেহ্মদত্যি এমন ভাবে চাকরের মত খাটতি রাজি হত না। যেহেতু ছবি শেখের হাতে সে বন্দী ফলে বাধ্যি হয়ে করতি হত,বেঁকে বসলি কপালে জুটতো শাস্তি। এই ভাবে বাইশ চবিশ বছর কাটি গেল। ছবি শেখের পরিবার অর্থ সম্পদে ফুলি ফেঁপি উঠল। এই যে কবরখানা,বাঁশবাগান, এমন কি গোটা তল্লাটটা এক সময় ছবি শেখের ছেল।” বৃদ্ধ এবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন-” আজ কি কেউ বিশ্বাস করবে! ভাবপে সব গল্প কতা।” হতাশা মিশ্রিত কথাগুলো বলে আবার ভুরুক ভুরুক করে হুকো টানতে শুরু করলেন। আমি বৃদ্ধের ভাব বুঝে বললাম, বলুন না আমার তো শুনতে খুব ভালো লাগছে। বৃদ্ধ হুকো মুখ থেকে সরিয়ে আবার ছবি শেখের কাহিনি শুরু করলেন—– “ছিরিকান্ত বিশ্বাস,পাড়ার লোকে ডাকতো ভদ্রতরুয়া বলি। চররঘুনাথপুর গেরামের বলেশ্বর নদীর কাছে তার বাড়ি। বছর তিরিশের ডাকাবুকো পোলা। বে থা করলি কি হবে সংসারে মন কম। এক মাইয়া, বউ মাইয়াকে দেখে বড় ভাইতে। ভদ্রতরুয়া সমাজ সেবা করি বেড়ায়। এলাকায় কেউ মলি মরা নে যায় পোড়াতি,মুসলমান হলি কবর দিতি। আবার কেউ অসুস্থ হলি নে ছোটে বদ্দির কাছে। ঝড়ে কারোর ঘর ভেঙে গেলি সারায়ি দেওয়ার ব্যাবস্থা করে। এই সব নে থাকে।
একবার হয়েসে কি বরসা কালে ভর সন্ধে বেলা ভদ্রতরুয়া সাত আট জনের সঙ্গে মরা নে গেস শ্মশানে। সঙ্গে কাঁচা আমকাঠ, কেরসিন,খোন্তা সব কিছু। বলেশ্বর নদীর তীরে চিতা সাজায়ে আগুন লাগিয়ে দেলে। মরা মানুষডার কপাল ভাল ছেলনা। আধ ঘণ্টা পর টিপটিপ করে বিষ্টি পড়া শুরু হল। আম কাঠের আঠার গুনি কাঠ চড়চড় করি পুড়ি গেল। পুড়ল না মরাডা। কাট তো আর নি। তেকন কি হবে! জোরে বিসটি আসতি পারে, আকাশ ভরা মেঘ। তকন সবাই মিলি সেদ্ধান্ত নেলে,মরার শরীলটারে মাটি কাটা খোন্তা দে টুকরো টুকরো করি কাটি বলেশ্বর নদীতি ভাসায়ে দেবে। সেদ্ধান্ত তো হল, কিন্তু টুকরো করে কে?? টুকরো করার সাদ্ধি কারোর হয় না। তকন ডাকাবুকো ভদ্রতরুয়া কলে কি –” রাত হয়ে যাচ্ছে, বৃষ্টি জোরে আসলে মুশকিল হয়ে যাবে। আমি-ই টুকরো করে নদীর জলে ফেলে দিচ্ছি।” ভদ্রতরুয়া কতামতো মরার শরীলটারে যকন খোন্তাদে টুকরো টুকরো করতেসে তকন এতো জোরে বাতাস বইতি থকলো যে ভদ্রতরুয়ার মরা কাটতি অসুবিধে হতি থাকল। যেন কেউ তারে মরা কাটতি বাধা দেচ্ছে। যোয়ান পোলা গায় জিনির মতন শক্তি। বাতাসের বাধা সত্ত্বেও টুকরো টুকরো করি নদীতি ফেলায়ে দেলে।
এই ঘটনার মাস তিনিক পরে ভদ্রতরুয়া একদিন সন্ধেবেলা ঝড় বিষ্টি হওয়ার পর হাট থেকে বাড়ি ফিরতেসে। বাড়ির পেছনে ছেল বাঁশ বাগান। সেকান দে আসতি গে দেখে, রাস্তার উপর দুটো বাঁশ পড়ি আছে। ভদ্রতরুয়া আধা অন্ধকারে বুঝতি না পারি যেই দুটো বাঁশের মাঝখানে পা দেসে অমনি বাঁশ দুটো জোড়া লাগি ভদ্রতরুয়ার পা চাপি ধরিছে। ভদ্রতরুয়া চিৎকার করি বাড়ির নোক ডাকতিই সকলে ছুটি আসি বাঁশ ফাকা করি তার পা টানি বার করে। তারপর রাত্তিরে সেকি জ্বর। নেপ কম্বল মুড়ি দে-ও সেই জ্বর কমেনা। সারা রাত মাথায় পানি ডালিও সুবিদে হল নি। সকালের দিকি দেখা গেল ভদ্রতরুয়ার দুই হাত অসাড় হয়ে গেছে, কোনো কাজ করতি পারতেসে না,আর ভুলভাল বকতেসে। নিজির কতা না বলে অন্যের কতা বলে চলেসে। বাড়ির নোক ক’দিন দেখে বেগতিক বুঝে ডাকলে ছবি শেখরে।
ছবি শেখ আসি পথমে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলে। প্রথমে জান্তি চালে বাড়ির চারদিকি কোন কিছু ঘটতেসে কিনা?? বাড়ির লোক কলে -” সারাদিন বাড়ির চারদিকে কালো কুকুর ঘোরাঘুরি করে আর ডাকাডাকি করে বিরক্ত করে, আপদগুলো রাতে বেশি ডাকে। আবার রাতে টিনের চালে ঢিল পড়ে। তারপর সন্ধ্যা হলেই কোথা থেকে যে পচা দুর্গন্ধ আসে কে জানে। তার মধ্যে ভদ্রতরুয়ার এই অবস্থা।” এবার ছবি শেখে ভদ্রতরুয়ার ভুলভাল বকাটা মন দিয়ে শোনলে, তারপর অনেকক্ষণ ধরি চোক বন্ধ করি কি যেন ভাবতি থাকলে। এদিকি ছবি শেখরে দেখার পর থেকি ভদ্রতরুয়া কেমন যেন অস্বাভাবিক আচরন কত্তি লাগলে। ছবি শেখ চোক খুলে কলে-” এমন কোন লোক এ পাড়ায় আছে যে টাকা ধার করি শোধ দেয় না। কোনো জোগ্যি বাড়ি নেমন্তন্ন না করলিও ভোজ খেতি চলি যায়। বেশ গুছিয়ে মিথ্যে কথা কয়। ছবি শেখের কথা শুনি বাড়ির লোক কলে, “ছিল চরণ মণ্ডল, কিন্তু সে তো মাস চারিক আগে মারা গেছে।” শুধু তাই না শ্মশানে গে চরণ মণ্ডলের মরা শরীলটা নে কি হইল সেটাও শোনলে। কথাগুলা শুনি ছবি শেখের মুক দেখি মনে হল, পেথম ধাপে সে যেন পাস করে গেস। এই বার ছবি শেখ মন্ত্র উচ্চারণ করি ভদ্রতরুয়ার উপর ঝাড়ফুক করতি থাকল। আস্তে আস্তে ভদ্রতরুয়ার চোক মুখির ভাব পাল্টে যেতি থাকল। এক সময় ঝাড়ফুক বন্ধ করি ছবি শেখ ভদ্রতরুয়ারে কলে– — তোর নাম কি? — চরণ মণ্ডল। — তুই তো মরে গিছিস। — হ্যাঁ। — তা হলি তুই ভদ্রতরুয়ার শরীরে ঢুকিছিস কেন? — বেশ করিছি ঢুকিছি তাতে তোর বাপের কি। — আমার বাপের কি তুই একটু পরে বুঝতি পারবি। ছবি শেখ ভদ্রতরুয়ার শরীলে আবার ঝাড়ফুক করতি করতি কলে — বল,কেন ওর ঘাড়ে চাপলি? — আর ঝাঁটার বাড়ি মারিস নে, বলতিছি। — মারব না,বল? — ভদ্রতরুয়া আমারে টুকরো টুকরো করি কাটি বলেশ্বর নদীর জলে ভাসায়ে দেল। — সে তো তোর শরীরটা পুড়িনি তাই। — কেন,আমারে কি সাপে কেটিল,যে ভাসায়ে দেবে। — কাঠ ছিলো না তা কি করবে? এখন তুই ঘাড় থেকে নামবি কিনা বল? — না। —- নামবি না, তা ওর ঘাড়ে বসে তুই কি করবি? — এরে তিল তিল করি মারি ফ্যালব। এদের বাড়ির সবাই রে অতিষ্টি করি তোলব। — তোরে তো আমি সে সুযোগ দেবনি। — তোর ওঝাগিরি ভাঙি দেব। তোর চোদ্দগুষ্টির সর্বনাশ করি ছাড়ব। — সে না হয় চেষ্টা করে দেখিস। এখন ওর ঘাড় থেকে নামবি না অন্য ব্যাবস্থা করতি হবে? — তোর যা খুশি তুই তাই কর, আমি এর ঘাড় থেকে নামব না। ছবি শেখ ভদ্রতরুয়ার উপর মন্ত্র উচ্চারণ করি করি ঝাঁটার বাড়ি, জুতোর বাড়ি, অগুনের সেঁকা অনেক কিছুই করলে, কিন্তু কিছুতি কিচ্ছু হলো না। আসলে যে জিনরে দে ছবি শেখ ভদ্রতরুয়ার ঘাড়ের জিন তাড়াতি চাচ্ছিল। সেই বন্দী করা জিনির ক্ষ্যামতা নেই যে সে ভদ্রতরুয়ার ঘাড়ের জিনরে তাড়াবে। অগত্যা ছবি শেখ মন্ত্রবলে বেহ্মদত্যির জিন কোথায় আছে যানি, পনের মিনিটির মধ্যি তার কাছে চলে আসতি কলে। এদিকি ভদ্রতরুয়ার ঘাড়ে চাপি চরণ মণ্ডলের জিন কিছু একটা অনুমান করি খুব উৎপাত করতি থাকে। ছবি শেখ তারে শান্ত করতি হিমশিম খেতি থাকে। এই কত্তি কত্তি আধ ঘন্টা পার হয়ে যায়। বেহ্মদত্যি তকনো না আসায়,ছবি শেখ আবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা। অবশেষে পঁয়তাল্লিশ মিনিটির মাথায় বেহ্মদত্যি এসে বসলে পাশের জামরুল গাছে। ছবি শেখ জামরুল গাছের পাশ থেকে সবাইরে সরে যেতি বললে। দেরিতে আসার জন্যি রেগে গিয়ে ছবি শেখ মুড়ো ঝাঁটা নিয়ে জামরুল গাছে বাড়ি মারতি থাকে, আর জামরুল গাছডা এ-তো জোরে নড়তি থাকে যেন এক্ষুনি ভেঙে পড়বে। তারপর জামরুল গাছের ভিতর থেকে আওয়াজ এল–” আঁমাকে এঁভাবে ঝাঁটার বাঁড়ি মারিস নেঁ। আঁমি ইচ্ছে করে দেঁরি করিনি।” ছবি শেখ রেগে বলল-” ইচ্ছে করে দেরি করিসনি মানে? কেন দেরি হলো? — আঁমার মতো এঁকটা জিন রাঁস্তায় আঁমাকে বাঁধা দিয়েছিল। —- প্রমান কি তুই সত্যি কথা বলতিছিস। — আঁমি মিথ্যা কঁথা বঁলি নাঁ। আঁমার মতো আঁর এঁকটা আঁত্মা বঁসে ছিল রূপসা নঁদীর ফেঁরিঘাটের পাঁশে বঁড়ো তাঁল গাছটায়। তাঁর সাঁথে আমার লঁড়াই হঁয়। তাঁকে হারিয়ে তঁবে আসি। — তুই যে সত্যি বলতিছিস তার প্রমাণ কি? — রূপসা নঁদীর ফেঁরি ঘাটের পাঁশে যে তাঁল গাঁছটা আছে ওঁটা লঁড়াইয়ের সময় মাঝখান থেঁকে ভেঁঙে যায়। — শোন,ভদ্রতরুয়ার ঘাড়ে চরণ মণ্ডলের জিন ভর করিছে। ওকে তাড়িয়ে এলাকা ছাড়া করতি হবে। —- এঁ লঁড়াই আঁমার আর ভাঁলো লাগে নাঁ। আঁমাকে অঁন্য কাজে ডাঁকতে পাঁরিস নে। — তুই আমার কথা মত কাজ করবি না ঝাঁটার বাড়ি খাবি? এরপর ভদ্রতরুয়া মরার মতো পড়ি থকলে, আর কিছুটা দুরি একটা সুপুরি গাছ ঝড়ে দোলার মোতন দুলতি থাকলে। যেখানে সব গাছ স্থির হয়ে আছে। খানিকক্ষণ পর সুপুরি গাছ স্থির হয়ে গেল। ভদ্রতরুয়া উঠে বসে আবার গালিগালাজ করতি থাকে। ছবি শেখও ঝাটার বাড়ি মারে আর মন্ত্র বলতি থাকে। ভদ্রতরুয়া খানিকটা ঝাঁটা জুতোর বাড়ি খেয়ে বলে ওঠে-” আর মারিস নে, কি চাস বল।” ছবি শেখে মন্ত্র-তন্ত্র বন্ধ করি একটা সাফল্যের হাসি হেসে বলে-” কিছুই চাইনে। তুই শুধু এলাকা ছাড়া হয়ে সুন্দরবনের জঙ্গলে চলি যাবি। আর কথা দিয়ে যাবি,এখানে আর কখনো আসবি নে।” — আচ্ছ, এবার আমারে ছাড়,আমি চলি যাচ্ছি। — তুই যে চলি যাচ্ছিস সেটা আমি বুঝবো কি করি? — জামরুল গাছের একটা ডাল ভেঙে চলি যাব। — বেশ,তাই কর। এবার ভদ্রতরুয়া উঠে দাঁড়িয়ে জামরুল গাছের দিকে ছুটতে থাকল, এবং জামরুল গাছের গোড়ায় গিয়ে ঝপ করি পড়ি গেল। তারপর ঝড় নি, বাতাস নি জামরুল গাছের একটা মোটা ডাল মড়মড় করি ভাঙি গেল। ছবি শেখ ভদ্রতরুয়ার বাড়ির লোকদের কলে-” যা-ও ভদ্রতরুয়াকে তুলি চান করিয়ে বিছানায় শুইয়ে দাও। আর যেখানে ঝাঁটার কাঠি ফুটে কেটে ছড়ে গেছে সেখানে এই ওষুধটা লাগিয়ে দাও।” তারপর বেহ্মদত্যিরেও ছাড়ি দেলে। ভদ্রতরুয়া সুস্থ হয়ি গেল,আর ছবি শেখ পাওনাগণ্ডা বুঝে নে গেরামে ফিরি গেল। এদিকি বেহ্মদত্যির জিন চরণ মণ্ডলের জিনির সাথে শলাপরামর্শ করলে, ছবি শেখরে শেষ করতি না পারলি তাদের স্বাধীনতা বলতে কিছুই থাকে না। এর একটা বিহিত করতিই হবে। আপাতত নিরুপায় হয়ে ভদ্রতরুয়ার ঘার থেকে সহজে নামি গেল। এই ঘটনার মাস তিনিক পর ছবি শেখের কলেরা হল। বদ্দি ডাকিনি, নিজির চিকিৎসা নিজিই করতি লাগলে। সারাদিনি বারো চোদ্দো বার বাগানে গে বসতি হয়েসে। সন্ধে বেলার দিকি এমন চাপ লাগিসে ছবি শেখ কোন রকমে বদনাটা নিয়ে বাঁশ বাগানে ছোটে। বেগের জ্বালায় শরীল বাঁধতি ভুলি যায়। এদিকি বাঁশ বাগানে ওতপেতে বসি ছিল বেহ্মদত্যি জিন আর চরণ মণ্ডলের জিন। তারা সুযোগটারে কাজে লাগাল। ছবি শেখের বসা অবস্থায় তার ঘাড় মটকে দেলে শেষ করে। মারার আগে বেহ্মদত্যি কলে-” এঁত বঁছরে আঁমার উপর অঁনেক অঁত্যাচার কঁরেছিস, আঁমাকে দিয়ে নোংরা নোংরা কাঁজকর্ম কঁরিয়েছিস, অঁপমান কঁরেছিস। অঁমি দিন গুঁনছিলাম, সুঁযোগ এঁকদিন আঁমারও আঁসবে।” যেখানে ঘাড় মটকে মেরিলো সেখানেই ছবি শেখরে কবর দেওয়া হয়।” বৃদ্ধ এই পর্যন্ত বলে বেস কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকে। তারপর বার দুই হুকোয় টান দিয়ে বলেন-” ছবি শেখের জীবন তো শেষ হল,তবে ছবি শেখের আত্মা আজও এই গোরস্থানের চারদিকি ঘুরে বেড়ায়। হিন্দুদের এই কবর খোলায় আসা সে মোটে সহ্যি করতি পারে না, বামুন হলি তো কথাই নেই। আপনি তো বামুনের পো,তবে আপনার শরীলে একটা শক্তি আছে, তা না হলি আপনি এই নির্জন কবরখানা থেকি পেরাণ নে ফিরতি পারতেন না।”
কথাগুলো শুনে আমি নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি যে বৃদ্ধের পাশে বসে আছি এটা স্বপ্ন না তো!!! আমার গায়ের লোম সব খাঁড়া হয়ে উঠল। এর মধ্যে গোরস্থানের গেটের দিকে একটা গুঞ্জন ( লা হি লাহা ইল্লালাহু মহম্মদ রসুলুল্লাহ ) শুনতে পেলাম। সেই দিকে ফিরে দেখি বেশ কিছু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ শব নিয়ে গোর দিতে আসছে। এখানে আমার আর থাকা সমীচীন নয় বুঝে বৃদ্ধের কাছ থেকে বিদায় নেব বলে পাশ ফিরে দেখি বৃদ্ধ নেই। গেট দিয়ে জীবিত মানুষ গুলো না ঢুকে পড়লে আমার হয়ত হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত। আমি নিজে এখনো জীবিত কিনা বুঝতে পারছি না। আমার বুঝতে অসুবিধা হলোনা কে ওই বৃদ্ধ!! তাড়াহুড়ো না করে গোরস্থান থেকে বেরিয়ে আসছি, শব নিয়ে আসা মানুষ গুলো কৌতুহল বশত আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকল। আমি কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে যে পথে এসেছিলাম সেই পথ ধরে বেরিয়ে আসলাম। আমি অনুভব করছি, আমি একা ফিরছি না। আমার পিছনে কেউ নেই, কিন্তু পদধ্বনি আছে।
পিছন না ফিরে হাঁটার একটু জোর বাড়ালাম। কয়েকটি কুকুর আমাকে দেখে খুব ডাকাডাকি করতে থাকল, যেন এখনি ছুটে এসে কামড়ে দেয়। কিন্তু কুকুর গুলো আমার কাছে ঘেঁষল না। একটা বাঁধা গরু আমার দিকে তাকিয়ে ‘হাম্বা’ স্বরে খোটা থেকে দড়ি ছিড়ে ল্যাজ তুলে দৌড়াল। পশুগুলোর আচরণ আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগলেও ভয় যেন সয়ে গেছে। মনে মনে স্বর্গগত পিতা মাতাকে স্মরণ করে গায়ত্রী জপ করতে করতে জোরে জোরে হাঁটতে থাকি। কিছুটা আসার পর নজরে পড়ল গাজীরহাট মোড়ের মাথায় বারোয়ারী মন্দির। যাওয়ার সময় যত সময় লেগেছিল, ফিরলাম তার চার ভাগের একভাগ সময়ে। যেন আমি দৌড়ে এলাম। যাইহোক মন্দিরে এসে ইষ্ট দেবতাকে স্মরণ করে প্রণাম করার পর মনটা একটু হালকা হল। এখন আর মনে হচ্ছে না কেউ আমাকে অনুসরণ করছে।
মন্দিরের পাশেই একটা চায়ের দোকানে বসে আগে ঢকঢক করে খানিকটা জল খেলাম। তারপর একটা কাঁচের কাপ ভরে রেড টি নিয়ে খেতেখেতে ভাবছি বড়ো বাঁচা তো বেঁচে গেলাম, কিন্তু কি এমন শক্তি আমার মধ্যে আছে যার জন্যে ছবি শেখের আত্মা সুযোগ পেয়েও আমাকে স্পর্শ করতে পারল না!! খানিকক্ষণ ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল, যোগেশগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ের মাস্টার মশাই ‘মুকুলিত – শাশ্বত সংজ্ঞাদর্পণ’ এর সংকলক দেবীরঞ্জন রায় তাঁর বইয়ের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আমাকে বলেছিলেন -” যদি কোনো পৈতেধারী ব্রাহ্মণ সন্তান প্রতিদিন গায়ত্রী মন্ত্র জপ করে, এবং মৃত পিতামাতার চরণস্পর্শ করে প্রণাম করে তবে তাকে কোনো অশুভশক্তি স্পর্শ করতে পারে না।” ওনার কথাটা আমার জীবনে এতোটা প্রাসঙ্গিক হবে, সেটা আমার কল্পনাতীত ছিল। যাইহোক ব্যাপারটা শ্যালিকার বাড়িতে গিয়ে কিছুই বলা যাবে না, কারন শ্যালিকার ভুত প্রেতে বিশ্বাস নেই বলেই অমন ভুতুড়ে বাড়িতে একাএকা দিব্যি থাকেন। ভয় না পেলে ভয় দেখানো ভুতের বাপেরও সাধ্যি নেই। তবে আমার কাছে ছবি শেখের কাহিনি শুনে যদি বিশ্বাস জন্মে যায় তো তাঁকে নিয়ে পল্লবের খুব সমস্যা হবে।
আগামীকাল, অর্থাৎ ০৭/০৪/২০২৪ তারিখ, আমরা কোলকাতায় ফিরব। মনে পড়লে অবশ্যই মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে আমার সহধর্মিণীর ভারাক্রান্ত মুখটি আমি অগ্রিম অনুমান করতে পারছি, কারন আবার কখনো আসা হবে কি হবেনা! এত বড় দেশের অনেক দ্রষ্টব্য স্থান দু’সপ্তাহের মধ্যে দেখে ফেলা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। তবে পারতপক্ষে ঢাকা, খুলনা, যশোর ঘুরে যেটুকু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, তাতেই আমি ধন্য। অতুলনীয় আতিথেয়তা, অখ্যাত মানুষ হয়েও খ্যাতিমানের সমতুল্য সম্মান প্রাপ্তি, সর্বোপরি বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার অনেক অজানাকে জানা। দেখেছি মসজিদ নগরী ঢাকা মেট্র সিটির বৈভব, আবার খুলনা, যশোরে প্রান্তিক মানুষের করুন দুর্দশা। যে গুলোর সবকিছু সময়াভাবে দেখা হয়ে উঠেনি–পুরাতন ঢাকা নগরী, ঢাকেশ্বরী মন্দির, রামনা কালী মন্দির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার খুলনা যশোরেও অনেক অদেখা থেকে গেল যেমন, খুলনা বাংলাদেশের তৃতীয় জনবহুল চিংড়ির শহর, দেশের চিংড়ি রপ্তানির পঁচাত্তর শতাংশ এ-ই শহর থেকেই হয়। অনেক প্রথিতযশা মানুষের জন্ম হয় এই শহরে। যেমন, ১৮৬১ সালের দোসরা অগাস্ট প্রখ্যাত বাঙালি রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় জন্ম গ্রহন করেন। আবার ১৮৭৪ সালের ২৩শে নভেম্বর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহধর্মিণী মৃণালিনী দেবী এই শহরেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আরো অনেক দ্রষ্টব্য স্থান আছে যেগুলোও অদেখা থেকে গেল। এবার আসি যশোরের কথায়, কথিত আছে গৌড়ের যশ হরন করে এই স্থানে নবরূপে শ্রীবৃদ্ধির জন্য প্রতিষ্ঠিত করা হয়, ফলে এই স্থানের নাম হয় যশোহর, পরবর্তীকালে অপভ্রংশ হয়ে যশোর নামে পরিচিতি পায়। ২৫শে জানুয়ারি ১৮২৪ সালে যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে অবস্থিত বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম হয়। তাঁর ভিটে বাড়ি (মধুপল্লী)। চাঁচড়া শিব মন্দির ও জমিদার বাড়ির ঐতিহাসিক সৌন্দর্য মণ্ডিত স্থাপত্যশৈলী অজও জ্বলজ্বল করছে। গঁদখালি ফুলের বাগানের কথা না বললেই নয়। সুতরাং সবকিছু তো দেখা সম্ভব হলনা যেটুকু দেখেছি, আত্মস্থ করেছি, সমৃদ্ধ হয়েছি সেটুকুই পাঠকগণের সাথে ভাগ করে নিলাম। যদি আবার আসার সুযোগ হয়, নিশ্চই না দেখা দ্রষ্টব্য স্থান গুলো দেখার চেষ্টা করব।