“ভাষায় ভাসা“
◆◇◆◇◆◇◆◇◆
–:: নিলয় বরণ সোম ::–
(ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিস)
ভাষাবিদ হরিনাথ দে ৩৪ টি ভাষা জানতেন, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পামুলাপর্তি ভেঙ্কট নরসীমা রাও জানতেন ১৭ টিI আমি আপনি কাজ চালানোর মত দু-তিনটি ভাষা জেনে বা না জেনে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছি, তবে ভাষা শিক্ষা মূলত একটা উৎসাহের ব্যাপার।
আদতে উত্তরভারতীয়, কিন্তু আজন্ম মুম্বাইকার এক আমার এক তৎকালীন বস চেন্নাইতে পোস্টিত হওয়ার পর বেশ অল্পদিনেই তামিল ভাষা রপ্ত করে নিয়েছিলেনI ওঁর ভাষা শেখার পদ্ধতিটি ছিল চমৎকার – পিওন ও অন্যান্য গ্রূপ ডি কর্মচারীদের প্রতি ওঁর নির্দেশ ছিল – তামিল ছাড়া অন্য ভাষায় ওরা যেন কথা না বলে! এই একই পদ্ধতিতে অনেক মহিলা মূলত ঘরের কাজের সহায়িকাদের থেকে স্থানীয় ভাষা শিখে থাকেন। তবে ওই যে বললাম, ভাষা শেখা একটা উৎসাহের ব্যাপার, তাই আমার প্রাক্তন বসের তুলনায় দ্বিগুন সময়, অর্থাৎ চারটি বছর চেন্নাইতে থাকা সত্ত্বেও, ‘তিরিশ দিনগুলিতে তামিল শিক্ষা’ নামের বাংলার মাধ্যমে তামিল শেখার বই কেনা সত্ত্বেও, আমার তামিল জ্ঞান, তামিল তেরিয়াদি (তামিল জানি না ) থেকে তামিল তেরিমাতে (তামিল জানি ) উন্নীত হতে পারে নি; শৈশব কৈশোর ত্রিপুরায় মফস্বলে কাটালেও, অন্যতম আদিবাসী ভাষা রিয়াং ভাষায়, ফাইদি মানে এস, এর বেশি কিছু শেখা হয় নি, অধরা রয়ে গেছে কুমিল্লা নোয়াখালী সিলেটের অনেক উপভাষাওI
অল্পবয়সী ছেলেদের বিদেশী ভাষা শেখার আরেকটি তকনিক আয়ত্তে আছে, সেটি হল অপভাষা বা স্ল্যাঙের মাধ্যমে। চাকরিজীবনের প্রথম দিকে, আমার জুনিযার, এক ভালমানুষ বন্ধুকে হাড় বজ্জাত এক সহকর্মী, ব্যাচমেট একটি মেয়ের কাছে পাঠিয়েছিল, তার নিজস্ব ভাষায় একটি শব্দের অর্থ জানতে চেয়ে। তীক্ষ্ণবুদ্ধিধারী আদিবাসী মেয়েটি ছেলেটিকে সে শুধু শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করেছিল,” “তোমাকে কে পাঠিয়েছে সেটা বল!” কেস জন্ডিস দেখে ভালমানুষ বন্ধুটি পগার পার। তখনো বিশাখা নির্দেশিকা বেরোয় নি সেটা বড় কথা নয়, বজ্জাত বন্ধুটির কাজ কপিবুক যৌন হেনস্থার মধ্যেই পড়ে, আজ পরিণত বয়সে সেও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে! অপভাষার বিপদসংকুল পথ এড়িয়ে চলা যাকI
বিবিধ ভাষা জানা থাকলে সুবিধা হয় সত্যি, তবে বিশেষকরে রাজনীতিকরা, হয় দোভাষীর সাহায্যে, নয় উপস্থিতবৃদ্ধির দ্বারা ভাষাগত বাধা কাটিয়ে উঠতে পারেনI
ফ্ল্যাশব্যাক ১৯৮৪। সন্ত জেভিয়ার্স কলেজের ১২৫ তম বার্ষিকীর উদযাপনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, আমি তখন ফার্স্ট ইয়ার, আমি ফুল প্যান্ট। উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিং। নিরাপত্তার কারণে, দর্শক সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে, লটারী করে টিকিট বিলি হয়েছিল – আমার ভাগ্যে টিকিটের শিকে ছেঁড়ে নি, তবে ভাগ্যবানদের মুখে গল্প শুনেছিলাম।
দর্শকাসন খচাখচ পূর্ণ, মঞ্চে রাস্ট্রপতি, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, রেক্টর প্রিন্সিপাল ও আরো কয়েকজন গন্যমান্য ফাদার। পরিবেশটা খুব স্বাভাবিকভাবেই ইংলিশ ভিংলিশ। এদিকে রাষ্ট্রপতিজি হিন্দী ও পাঞ্জাবী ছাড়া অন্য ভাষায় স্বচ্ছন্দ ননI তবে এতদিনের অভিজ্ঞ রাজনীতিক, এরকম পরিবেশে আগেও কি আর পড়েন নি? স্বভাবসিদ্ধ রসিকতার ছলে বললেন, “আমি আমার ভাষণ হিন্দীতে দেব – আশা করি কারো বুঝতে অসুবিধা হবে নাI আর অসুবিধা হবেই বা কেন, এত সব অল্পবয়সী ছেলে মেয়ে রয়েছে, ওদের জন্য তো চোখের ইশারাই যথেষ্ট!” এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতাদের হাততালি! সত্যি, নিজের স্টাইলে খুব সুন্দর উদ্ভোধনী ভাষণ দিয়েছিলেন উনি। বোধহয়, সে স্রোতেই ভেসে, স্বভাবগম্ভীর জ্যোতি বসু, যিনি সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলের এলামনিও বটে, তাঁর ভাষণে বললেন, “এখনকার ছেলেরা খুব ভাগ্যবান – ওরা কো-এডে পড়তে পারছে !”
যাক সে গল্প, কর্ড লাইন থেকে মেন্ লাইনে ফিরি।
ভারতের জাতীয় সংগীতে, দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ তিনটি প্রদেশের নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হলেও, পূর্ব ভারতকে নিয়ে যে বৃহত্তর আর্যাবর্ত, তার অধিবাসীরা, অর্থাৎ আমরা যারা ‘নার্থ ইন্ডিয়ান’, তাদের কাছে চারটি দ্রাবিড় ভাষাই বেশ কঠিন। তবে চারটি প্রদেশেরই, শহরগুলিতে ইংরেজি মোটামুটি চলে বলে খুব অসুবিধা হয় না।
তামিলদের ইংরেজির অবশ্য কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে, যেমন ‘র’ আর ‘ড় ‘এর উচ্চারণে পার্থক্য বিশেষ কিছু নেই। তাছাড়া সাধারণ লোকের ইংরেজি ক্রিয়াপদের ব্যবহার বেশ গোলমেলে। যদি কেউ বলে , ‘He will be coming’ তার অর্থ বিবিধ হতে পারে অর্থাৎ সে এসেছিল, সে এসেছে অথবা সে আসবে! টেন্স ব্যাপারটা রীতিমত টেন্সড! পুরোনো আমলের হেড্মাস্টাররা এরকম ইংরেজি দেখলে জেল সেন্টেন্সের সুপারিশ করতেন হয়ত!
কথ্য ভাষায় আরেকটি ইংরেজি শব্দ হরবখত ব্যবহৃত হয়, সেটি হল ‘waste’, তার তামিল উচ্চারণ প্রায় বোয়েস্টে! ধরুন আপনি ঠিক করলেন, অফিসে অমুক বাবুকে নিজের কাছে নিয়ে আসবেন – তা আপনার বড়বাবুকে সে কথা বললেন। তার যদি উল্টো পরামর্শ দেওয়ার হয়, তাহলে অমুকবাবু সম্বন্ধে একটিই বিশেষণ উনি ব্যবহার করবেনা, অমুকবাবু বোয়েস্টে! তার সঙ্গে, জিভ দিয়ে দাঁতে ঘষে একটি মৃদু আওয়াজ ও করবেন বৈকি!
সেখানকার অফিসিযালডোমে ভাববাচ্যের ব্যবহারও কৌতুককর। তখন আমি চেন্নাইতে নতুন। অফিসে সহকারীকে বললাম, “আমার ঠিক মনে পড়ছে না, নোটিশের ফাইল তোমার কাছে আছে , না আমার কাছে?”
সহকারী গুণশেখরের উত্তর, “ওটা স্যারের কাছে আছেI ”
আমি আমার বাঙালী বুদ্ধিতে অবাক হয়ে ভাবলাম, আমার উপরওয়ালার কাছে তো ফাইলটি যাবার কথা নয় !
কিছুদিন যেতে বুঝলাম, উপরওয়ালাকে সামনাসামনি আপনি বা ইউ বলা ওখানে অন্তত সরকারী অফিসে প্রটোকল বিরুদ্ধ, সুতরাং ভাববাচ্যে উত্তর! অর্থাৎ গুণশেখর বোঝাতে চেয়েছিল, ফাইলটি আমার কাছেই আছে!
ভাষা নিয়ে খানিকটা আতান্তরে, আমিও পড়েছিলাম আমার বিদেশভূমিতে স্বল্পকালীন প্রবাসের আগে। কে আর জিরা তেজপাতা ধনেপাতার ইংরিজি মনে করে বসে থাকে? সুতরাং ওই যে চোঙা লাগিয়ে ঠেলা করে নানারকম বই বিক্রি হয়, হিন্দী সিনেমার হিট ১০০টি গান কিংবা ইংরেজিতে কী করে দরখাস্ত লিখতে হয় কিংবা বশীকরণের অব্যর্থ্য মন্ত্র সবকিছুর মুশকি, সেরকম একটি সহজে ইংরেজি শিক্ষার বই হাতে করে আমি দেশ ছেড়েছিলাম! তবে সুজির ইংরেজি আমাদের দেশে ইংরেজিতেও Suzy লেখা থাকে বলে সুজির রোম্যান্টিক নাম সেমোলিনা, সেটা ঠেকে শিখতে হয়েছিল। অরেঞ্জ বলে যা বিক্রি হয় ওখানে, তা যে আসলে মুসম্বি, সেও ঠেকে শেখা, আর কমলালেবুকে সেতসওয়ানা ভাষায় নার্জারিস বলে, সেটাও।
তবে আমাদের কিছুটা নাস্তানুবাদ হতে হয়ে ছিল ছেলের জন্য ‘মাঙ্কি ক্যাপ কিনতে গিয়ে। প্রতিটি সুশীল বাঙালী দম্পতির মত আমরাও চেয়েছিলাম শীতকালে ছেলেকে ‘এয়ারটাইট ‘ রাখতে, রাস্তাঘাটে বাঁদরটুপি নজরেও যে আসে নি তা নয়, কিন্তু দোকানে বুঝিয়ে বলা মুশকিল হচ্ছিল বেশ। অবশেষে কোন এক মলে, পেপ স্টোর নামের চেন স্টোরে, কোন এক সহৃদয় সেলসম্যান সহৃদয় হেসে বলেছিলেন, ও, একে তো কুপারহেড বলে!
আহা, একজোড়া কুপারহেড কিনে আমাদের মাথাব্যথা মুক্তি। তবে মজা পেয়েছিলাম স্থানীয় সেতসোয়ানা ভাষায় সমস্যাকে ‘ মাথাথা ‘ বলে জেনে, অথবা কোন আনন্দানুষ্ঠানে ওরা যখন উলুধ্বনির মত একটা আওয়াজ করে, তাকে ‘হুলু ‘ বলে জেনে! ফরাসী ভাষায় এই অনুভূতির কাছাকাছি শব্দ বোধহয় দেজা ভ্যু! ঠিক তেমনি, আমাদের দেশেও মারাঠি এবং তামিল দুটি ভাষাতেই চাবিকে যথাক্রমে চাবি ও সাবি বলে, সেটি জেনেও উল্লাসই হয়েছিল।
স্থানভেদে ইংরেজি শব্দের রকমফেরে আমাদের অনেকেই অপ্রস্তুত হতে দেখেছি। এখন ইয়াঙ্কি শব্দগুলোতে আমরা অনেক বেশি পরিচিত হওয়ায় ফ্লোর কে লেভেল, লিফ্ট কে এলিভেটর, ট্যাক্সিকে ক্যাব বা বিস্কুট কে কুকিজ বললে অবাক হই না, কিন্তু এই বছর ছয়েক আগেও জনৈক বন্ধুকে রেস্টরুমের অর্থ বিশ্রামাগার করতে শুনেছি !
আরেক সমস্যা বাগধারা নিয়েI বাগধারার ব্যাপারে এক কেলেঙ্কারির ইতিহাস আছে কলকাতার কোনো কলেজে ঘটা একটি অমর প্রেম নিবেদনের কাহিনীতেI ছেলেটির নাম ধরা যাক, তরুণ। মাঝারি মানের বাংলা মাধ্যম স্কুল থেকে অসাধারণ রেজাল্ট করে ভর্তি কোনো একটি মিশনারি কলেজে। সহশিক্ষার সেই কলেজে স্বাভাবিক ভাবেই বসন্তের সুপবন বইত এবং তার ছোঁয়া তরুনেরও লাগল I অনেক সাত পাঁচ ভেবে সে একদিন কাঙ্খিত নায়িকাকে প্রেম নিবদন করে বসলো। কিন্তু বাংলায় ভেবে, ইংরেজিতে বলা মস্ক করার পর, তার মুখ দিয়ে যে মধুর বাক্য নিঃসৃত হল, তা হল, “দেভিনা, আই ওয়ান্ট তো মেক লাভ উইথ ইউ!” নায়িকা নাকি কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু একটি কটাক্ষপাত করে গটগট করে লাইব্রেরির দিকে হেঁটে গিয়েছিলোI সেও বোধকরি তরুনের ইংরেজি জ্ঞানের বহর নিয়ে এতটাই নিশ্চিত ছিল যে এমন মারকাটারি ডায়ালগের পরও কোনো শোরগোল করেনিI
ভাষা নিয়ে বিব্রত পর্যটকদের জন্য এই ব্যবস্থা হয়ত অনেক দেশে, এমনকি আমাদের দেশেও আছে, তবে হপ্তাখানেকের চীন ভ্রমণ ছাড়া কোথাও আমাকে এই পথে যেতে হয় নি। ব্যাপারটা এরকম – হোটেলের রিসেপশন ডেস্কে একটি লিস্টিতে কতগুলো কথা ইংরেজি ও স্থানীয় ভাষায় দেওয়া থাকে, যেমন বাসস্টপ কত দূর? অমুক হোটেল টি কোন দিকে? এটির দাম কত? পর্যটক, গাইড ছাড়া রাস্তায় বেরোলে, ওই লিস্টি পকেটে পুরে একটু নিশ্চিন্তে ঘোরাঘুরি করতে পারে।
তবে আমার এক বন্ধু প্রবাসী ছেলের কাছে যাওয়ার সময় নিজের শাশুড়ি সম্বন্ধে বলেছিল, উনি নাকি সাধারণ ইংরেজির প্রশ্নের জবাবগুলো পরনের শাড়িতে পিন আপ করে নিয়েছিলেন এবং প্রশ্নকর্তার মুখের অভিব্যাক্তি ডেকে কখনো আঁচল, কখনো কুচি, কখনো কাঁধে সেঁটে থাকা উত্তর গুলো দেখিয়ে দিতেন, সেটি নির্ঘাত গুল!
সে যাই হোক , ‘খারাপ লোকের খপ্পরে বইতে, লেখক শংকর, দাদু ভবনাথ সেনের মুখ দিয়ে বলিয়াছিলেন, ‘মানি ইজ দ্য পেট্রল অব লাইফ ‘ – ব্যাপারটা ধ্রুব সত্য। তাই আজকাল দাক্ষিনাত্যেও দোকানদারেরা উত্তরভারতীয়দের সঙ্গে সাধ্যমত হিন্দীতে কথা বলে, চীনে গুগল নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও দোকানী আপনাকে জিজ্ঞাসা করবে, ভি পি এন আছে তো? তারপর গুগল ট্রান্সলেটের সাহায্যে দর দাম, বেচা কেনা সব সারবে।
এমনিতেও, গুগল ট্রান্সলেটের গুণের শেষ নেই। আমার এক পরিচিত দাদা, ইতালিতে গিয়েছিলেন মেয়েকে কোন একটি পাঠক্রমে ভর্তি করতে। অপেক্ষারত আরেক অভিভাবক ছিলেন ব্রাজিলীয়, ছেলের ভর্তির প্রত্যাশী। ঘটনাক্রমে দুই অভিভাবকই আড্ডাবাজ, কথা বলার জন্য উশখুশ করছিলেন। ভাষার বাধা টপকে দিল গুগল ট্রান্সলেট। তা গুগল ট্রান্সলেটরের সাহায্যে তাদের আড্ডা তো আর শেষ হয় না, ইন্টারভিউ শেষ হওয়ার পর, যুবক যুবতী দুটি তাদের বাবাদের একরকম টানতে টানতে আড্ডার পরিসমাপ্তি ঘটায়।
গুগলবাবা আমাকে ও একবার উদ্ধার করেছিল -বেশিদিনের কথা নয়, গত সেপ্টেম্বরের কথা। মহারাষ্ট্রে পার্বণী জেলায় এক গেস্ট হাউসে রয়েছি। জলখাবারে এক প্রমান সাইজের ওমলেট ছিল বটে, তবে তাতে একেবারে ঝাল নেই, অর্থাৎ ডিম্ ফাটানোর সময় লঙ্কা কুচি একেবারে পড়ে নি। রুমবয় ঘোটেকে আমি গোলমরিচ দেওয়ার জন্য বলব, কিন্তু গোলমরিচের হিন্দি যে ‘কালী মরিচ’ সেটা মাথায় আসছে না। অদৃশ্য গোলমরিচ দানির থেকে গোলমরিচ, অমলেটের উপর ঢালার চেষ্টা করে দেখলাম, সে কিছু বুঝল না। অতএব, হাত ধুয়ে, ওকে নিয়ে এলাম আমার ক্যাম্প অফিস তথা ড্রয়িং রুমে – কম্পিউট্যার চালু হল , পর্দায় গুগল ভেসে উঠল , গুগল ইমেজে গোলমরিচের ছবি দেখাতেই ঘোটের মুখে হাসি ফুটল কিছুক্ষন বাদে আমারও!
আবার ঘুরে ফিরে ইংরেজিতে। আমরা সত্তর – আশির দশকে যারা বড় হয়েছি, আমাদের ইংরেজি শিক্ষায় অনেকটা বড় ভূমিকা নিয়েছে রেডিওতে ইংরেজি ধারাবিবরণী। এমনিতে ইংরেজি নিয়ে আমাদের একটু অবসেশন আছে, আছে কৌতূহলও। সুতরাং অল্পবয়সেই আমরা ইংরেজদের উচ্চারণ আর অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডের উচ্চারণের পার্থক্য ধরতে পারি। ইংলেন্ডের স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় কোনো এক সানি ডে তে লর্ডসের মাঠ যদি ঝলমল করে, ওই একই রোদ এডিলেডের মাঠে আছড়ে পড়লে সেটি হয়ে ওঠে ‘সানি ড্যাই !’
তা ২০১৮ র জুন মাসে প্যারিস ভিত্তিক OECD আয়োজিত চীনের ইয়াংঝাউ ট্যাক্স একাডেমিতে যে আন্তর্জাতিক কর্মশালায় এই অধমও গিয়েছিল, তাতে চারজন প্রশিক্ষকের মধ্যে দুজন ছিলেন যথাক্রমে ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ার। আমার দেশি কানে দুজনের ইংরেজি উচ্চারণ শোনার অভিজ্ঞতা বেশ স্মরণীয়। অস্ট্রেলিয়ানের উচ্চারণ সম্বন্ধে ধারণা ছিলই, ফ্রান্স থেকে আগত প্রশিক্ষক সম্ভবত উৎসমূলে তুর্কীর- ওঁর সম্বন্ধে কোন ধারণা ছিল না আমার। নিজক্ষেত্রে অসম্ভব পারদর্শী এই ভদ্রলোকের ইউ এর উচ্চারণ শোনার মতন। যদি বাক্যটি হয়, ‘The umpire found it difficult to walk through the uneven filed with an umbrella in his hand,’ ওর গলায় সেটি শোনাবে,
“দ্য উমপাওয়ার ফউন্ড ইট ডিফিকুলট তো ওয়াক থ্রু দ্য উনইভেন ফিলড উইথ এন উমব্রেলা ইন হিস্ হ্যান্ড।“
ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ এতক্ষন একঘেয়ে হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। এবার দু একটি চলতি রসিকতার আলোচনা হোক।
প্রথমটি গোপাল ভাঁড়ের। গোপাল ভাঁড় বলতেই একরকম মোটা দাগের রসিকতার কথাই মনে আসে , এটি সে রকম নয়।
গল্পটি এই রকম। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভায় এক নতুন দিগগজের আবির্ভাব হয়েছিল – সে অনর্গল দশ বারোটি ভাষায় কথা বলতে পারে, এবং একেক দিন এক এক ভাষায় কথা বলে সবাইকে চমকে দেয়। রাজা নিজেও আগ্রহী ছিলেন লোকটি কোন দেশীয় সেটা জানতে , কারণ এই প্রশ্নের সরাসরি জবাব সে কখনো দিত না।
অগতির গতি গোপাল ভাঁড়ের উপর ভার পড়ল সেটি বের করারI গোপালও তক্কে তক্কে রইল। একদিন সুযোগ
বুঝে, অন্ধকার একটি সিঁড়িতে তাকে দিল এক ধাক্কা! লোকটির মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল – সরা অন্ধা! গোপাল এবং অন্যান্য সভাসদরা একমত হল, পন্ডিতি উৎকলবাসী না হয়ে যায় না!
এবার এক ভাষাবিদ দম্পতির গল্প। উইলিয়াম বাড়ি ফিরে দেখে স্ত্রী জেন, উইলিয়ামের ই এক বন্ধুর সঙ্গে
আপত্তিকর অবস্থায় আছে। উইলিয়াম ঠান্ডা মাথার মানুষ, গলার স্বরটিকে কঠিন করে বলল, " Why Jane, I am surprised!” জেন সোফা থেকে উঠে উইলিয়ামের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল, 'No, you are not surprised, you are astonished!”
পরের গল্পটি দুজন দোভাষীকে নিয়ে। করোনাকালে ট্যুরিস্ট নেই, দুজনে সমুদ্রের ধরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করল, " আই, তুই সাঁতার জানিস? " অন্যজন উত্তর করল, " না, সেটা জানি না, তবে জলে পড়ে গেলে, নয়টা ভাষায়, ‘বাঁচাও .বাঁচাও’ করে চেঁচাতে পারব ,তুই ?" পেশাদার দোভাষীদের নির্ভুল হওয়ার যে দায় থাকে, অনুবাদের দায়িত্ব ঘাড়ে পড়লে সকলের সেই শিল্পসম্মত অনুবাদের তাগিদ নাও থাকতে পারে। এই ঘটনাটি সত্য বলে জানি।
আসামীর ফাঁসির হুকুম হয়েছে। জজ সাহেব ইংরেজিতে লেখা তার দীর্ঘ রায়ে অপরাধের বিবরণ , অপরাধীর কার্যকলাপ, মনুষ্যচরিত্র, জীবনদর্শন, ঈশ্বরে সমর্পন ইত্যাদি ভাল ভাল কথা লিখে গেছেন। অধস্তন পেশকারের উপর ভার পড়ল রায়ের সারমর্ম আসামীকে শোনানোর। পেশকার সংক্ষিপ্ততম ভাষায় বুঝিয়ে দিল, ' শালা তোর ফাঁসি হয়েছে!" কালিদাসের প্রবাদপ্রতিম শুস্কং কাষ্ঠং তিষ্ঠতি অগ্রে বনাম নীরস তরুবর'। কাহিনীটার সঙ্গে এটির খানিক মিল
আছে না? আবার জীবনখাতায়।
পারফর্মিং আর্টসের যতগুলো ক্ষেত্র আছে, তার অধিকাংশতেই ভাষার ব্যবধান শিল্পের মূলরস উপভোগ করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না, তার একটা কৌতুককর উদাহরণ দেই। বোতসোয়ানায় আমার এক বিভাগীয় বসের বাড়িতে, জিম্বাবুয়ে থেকে আসা এক মহিলা প্রায় অনেকটা সময় থেকে ঘরের কাজে সাহায্য করত। কিন্তু ওখানকার সময় চারটা নাগাদ ওকে দিয়ে কোন কাজ করানো যেত না – গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে সে ঠায় বসে একতা
কাপুরের সিরিয়াল 'কুসুম ' দেখবে বলে! একতা কাপুরের কানে কথাটি নির্ঘাত যায় নি। গেলে, কুসুমের হয়ত একটি জিম্বাবুয়ান স্বামীর বন্দোবস্ত হত, সিরিয়ালটি আরেকটু দীর্ঘ করা যেত!
দায়ে পড়ে অনেক সময় সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করতে হয়, আমার পূর্ব বর্ণিত দাদার ক্ষেত্রে সেটি করতে হয়েছিল প্রায় প্রাণের দায়ে।
◆◇◆◇◆◇◆◇◆
◆◇◆◇◆