মর্নিং-গ্লোরী
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
‘এখন দয়া করে খবরের কাগজ থেকে মুখটা তুলে চা’টার সদ্ব্যবহার করলে ভাল হয়!’ আর একটু পরে ঠিক তেমনই কাংস্য বিনিন্দিত কন্ঠে আওয়াজ উঠল,
‘চান শেষ করে জামা পড়তে যে মেয়েদেরও হার মানালে দেখছি! চা আর জলখাবার কখন দিয়েছি! শুধুশুধু অফিসে দেরী হবে শুনিয়ে আমায় তাড়া দাও!’
সমরেশ বাবু এতক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। চশমাটা আর একবার ভাল করে মুছে জানলার আলসেতে রাখা মর্নিং গ্লোরী গাছটার দিকে তাকাতেই বয়সটা আটত্রিশ বছর পিছিয়ে গেল। সেদিন তরুণ সমরেশ স্নান সেরে পাউডার মাখছেন সারা ঘরে পাউডার ছড়িয়ে আর সেই পিচ্ছিল মেঝেতে পা ফসকাচ্ছেন এক অন্য মর্নিং গ্লোরী, তাঁর সদ্য বিবাহিত ধর্মপত্নী সুদক্ষিণা। বলাবাহুল্য একপ্রস্থ অকাল বসন্তের আবির্ভাবে সেদিন আর অফিস যাওয়াটা হয়নি তরুণ সমরেশের।
……
তারপর দেখতে দেখতে কখন যেন বেলা গড়িয়ে চুলে পাক ধরলো, চোখের চশমার কাঁচ মোটা হতে হতে চালসে পড়ল। হৈ চৈ করে কাটিয়ে দেওয়া অফিস বেলাটাও একদিন চুকেবুকে গিয়ে একজন রিটায়ার্ড মধ্যবয়সী সদ্য প্রৌঢ় হতে হতেই বিছানার পাশটা একদিন খালি করে চিরকালের মত সুদক্ষিণাটাও হঠাৎ কোথায় যেন চলে গেল।
সবে ষাট পেরিয়ে বাষট্টিতে পড়েছেন ততোদিনে। নিজেদের ছেলেপুলে অবশ্য তাঁদের ছিলনা তবে ভাইপো, ভাইঝি, ভাগ্নে, ভাগ্নীদের নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন সমরেশ-সুদক্ষিণা এতদিন। তবে এখন ব্যাপারটা খানিক আলাদা। সবাই যে যার মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নীল রংএর এই গ্রহটির নানা প্রান্তে, অথচ আত্মিক টান এই ব্যাপারটা যেন কারোর সাথে কারো আজকাল থেকেও নেই।
……
যদিও বছরে একবার কি দু’বার সবাই এসে একবার মেলে বটে তাদের পুরনো বাড়ির সীমানায় এসে, তবুও সেই কংক্রিটের সীমানার বাইরে তিনি দেখতে পান যে সবাই তাদের আজকাল কার কতটা পায়াভারী সেই পরিচয়ের রোজনামচাকেই ভিন্ন ভিন্ন কায়দায় যত্ন করতে ব্যস্ত।
সমরেশ বাজারের এবারে থলেটাকে বগলদাবা করলেন। না! না! ঠিক বগলদাবা নয়, বিগতবেলার আলো মেখে ওটাকে যেন চেয়ে নিলেন সুদক্ষিণার শাঁখা-পলা পরা মোলায়েম হাতটি থেকে। আর বাজার যাওয়া! সে তো এখন ছলনামাত্র। আড্ডাটাই আসল! একা মানুষের দু’বেলা রান্না চাঁপার মা এসে দিয়ে যায় নামমাত্র পয়সার বিনিময়ে। সেটাই অবশ্য খান চেটেপুটে তবুও যেন সেই চেনা স্পর্শটুকুর অভাব অনুভব করেন খেতে বসার একান্তচারণে।
……
‘ এই যে মশাই! এতোক্ষণে আসা হল! এদিকে কাতলার কষা কষা রান্না খাওয়ার বায়না ! আরে, গুঁড়ো গরম মশলাটা ফুরিয়েছে বলেই তো আবার করে মান্নার দোকানে যেতে বললাম!আর সেখানে তুমি এত বেলা বইয়ে দিলে!’
কথাটা কানে ভাসছিল এতক্ষণ। নিতান্তই বাধ্য গৃহস্থের মত সমরেশবাবু একচক্কর বাজার থেকে ঘুরে এলেন। বাজার থেকে ফেরার পথে মল্লিক মশায়ের খবরটা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। রমেশ মল্লিকের সাথে গ্রীনপার্কের বেঞ্চিতে তো এই ক’দিন আগেই কথা হল। তাহলে সুদক্ষিণার পরে কি করোনারি থ্রম্বোসিস এবারে ওঁর বন্ধুদের দিকেও হাত বাড়াচ্ছে?
……
‘শোন কটা পেরেক পারলে এনো তো! দরজার ওপরে লাগাবো। আর কম্বলটা ওপরের লফট্ থেকে নামিয়ে দিও। শীত পড়ছে। ওটা কেচে রেডি করতে হবে তো!’
দুজনের কম্বলের উত্তাপ যে কবেই চলে গেছে সেটা যদি সুদক্ষিণা আজ জানতে পারত। ইনসমনিয়া ধরছে বলে ঘুমটাই কমে এসেছে আজকাল! শোবার ঘরে সুদক্ষিণা দেওয়াল থেকে হাসছে যেন। তবে এটা বোঝেন সমরেশ বাবু যে ঘুমিয়ে পড়লে যেন মায়াবী হাস্নুহেনার গন্ধ ছড়িয়ে সুদক্ষিণা এখনও খাটে এসে বসে।
তারপর কোমল হাত ঠিক বুলিয়ে দেয় কপালে, যেন জ্বর দেখছে ! এমনকি আহ্লাদী গলায় অভিমান করে মেনী বেড়ালদের মত। তবে তিনি আজকাল ওকে দেখতে পান না মোটেও। খালি টের পান বলে যাওয়া ওই কাংস্যবিনিন্দিত অসংখ্যকন্ঠস্বর আর অদেখা ছোঁয়ার সেই মূল্যবান যুগলবন্দী। তখন বুকে খানিক উত্তেজনা জাগলেও পরম নিশ্চিন্তে পাশবালিশ আঁকড়ে শেষ রাতে ঘুম এসে যায় নিয়ম মত।
……
সেদিন একটা জম্পেশ ঘুমের পরে ঘোর লাগা একটা সকালবেলায় দেখলেন ত সবটা যেন একস মায়াবী কুয়াশার চাদরে ঢাকা। বোঝেননি যে তো এবছর এত তাড়াতাড়ি শীত পড়ে গেল বুঝি!
আসলে সুদক্ষিণা না থাকায় এবছরে তো লফটেও হাত পড়েনি আর কম্বলটাও নামানো হয়নি! বাড়ির আসল কেয়ারটেকার না থাকলে তো এমনি হয়! ধুসস্!
কি ভেবে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখলেন সুদক্ষিণার ছবিটা আর দেওয়ালে টাঙানো নেই। যা-ব্বা-বা ! কাল রাত্তিরে শুতে যাওয়ার সমযয় তো ওটা যথাস্থানেই ছিল!
……
পঁয়ষট্টিতে যদিও পড়বেন পড়বেন করছেন তাও এরকম করে প্র্যাক্টিকাল জোক আজকাল কি কেউ করে?
সামনে তাকাতেই দেখলেন একজন মাঝবয়সী মহিলাকে। ঘিয়ে রং এর গরদের কাপড় আর কপালে দু’চারটে সাদা চুলের বাহারে মোহময়ী মহিলাটিকে যেন সমরেশ কোথায় দেখেছেন! খুব চেনা! চেনা।
……
এবার আঁচলের আড়াল থেকে একটা মর্নিংগ্লোরী বের করে মহিলাটি সমরেশের হাতে দিয়ে বললেন, ‘ উফফ্! হয়েছে! হয়েছে! একাএকা অনেক বীরত্ব দেখিয়েছ কদিন! এবারে চুপচাপ এস তো এদিকে! ‘
—oooXXooo—