ভিটের টানে (পঞ্চম পর্ব)
সলিল চক্রবর্ত্তী
“এই কূলে আমি, আর ওই কূলে তুমি,মাঝখানে নদী ওই বয়ে চলে যায়।” মান্না দের বিখ্যাত গানের লাইনগুলো আবার মনে পড়ে গেল। ঠিক তাই, মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে ইছামতী নদী, যার এ কূলে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, আর ও কূলে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা। নদীর প্রস্থ এখানে তুলনা মূলক ভাবে কম। এতটাই কাছে যে টাকির গেস্টহাউজ, হাসনাবাদে নদীর উপর ব্রিজ, ইঁট ভাঁটা সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। হাত নেড়ে ওপারের মানুষকে জানানো যায় যে আমি এপারে আছি।
আনোয়ার ভাইয়ের মোটরসাইকেলে চলেছি মিনি সুন্দরবন, পেছনে বসে আমি আর পল্লব। বাঁধের উপর দিয়ে ফুট তিনেকের সরু পথ, কোনো ভাবে কাত হলে আর গতি নেই, এক দিকে ভেড়ি,আর অন্য দিকে নদী। এ যেন ‘জলে কুমির ডাঙায় বাঘ’ অবস্থা। নদীর চরে এক জায়গায় নজরে পড়ল কিছু পোড়া কাঠ। অনেকটা বান জ্বালিয়ে খেজুর রসের গুড় তৈরি করে চলে যাওয়ার পরবর্তী অবস্থা। কৌতুহল বশত পল্লবের কাছে জানতে চাইলাম ওখানে কি হয়। যখন জানলাম ওটা একটা শ্মশান, আমি ভীষন হতাশ হলাম। একে কি শ্মশান বলে!! নেই কোনো শ্মশানকালীর স্থান,নেই কোনো সরকারি দপ্তর, এমন কি এক আধটা দোকানও চোখে পড়ছে না। দেখতে পাচ্ছি শুধু একটা বি ডি আর ক্যাম্প,আর জেলে বসতি। কিছু জেলে যারা ভেরির কাজে ব্যাস্ত। আমি একটু তাচ্ছিল্যের সুরে বলি, এটা যদি শ্মশান হয় তো গোরস্থান কেমন হবে?? মুসলিম সম্প্রদায় সংখ্যাধিক্য দেশ বলে গোরস্থান আশাকরি অনেক আধুনিক হবে, সেই বিমাতৃসুলভ আচরনের কথা ভেবে বলা। আমার তাচ্ছিল্যের সুর বুঝতে না পেরে আনোয়ার ভাই বলল-” মামা, কবর যদি দেখতে চান তো গাজীরহাট মোড় থেকে মিনিট পনেরো হাটা পথে ছবি শেখের কবরখানাটা দেখে আসতে পারেন।” আমি জানতে চাই ছবি শেখের গোরস্থানের কি কোনো বিশেষত্ব আছে?? আনোয়ার ভাই আমতাআমতা করে বলল-” না মানে আপনি তো লেখেন,ওখানকার একটা ইতিহাস আছে, যদি আপনার লেখার কাজে লাগে, তাই আর কি —–”
কথায় কথায় আমাদের মোটরসাইকেলটা একটা বড়ো গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। গেটটা কংক্রিটের তৈরি বড়বড় দুটো বাঘদা চিংড়ি দিয়ে সাজানো। বেশ নতুনত্ব আছে, আগে যা দেখেছি তা বেশির ভাগ সিংহ দুয়ার। গেটের উপর সিংহ বসানো থাকে।
পল্লব বলল-” আমরা এসে গেছি, ও-সব কবর শ্মশানের কথা বাদ দেন। মরে গেলে সব সমান, হিন্দুকে যদি কবর দেয় আর মুসলমান কে যদি পোড়ায় তো মৃত শরীরের কি এলো গেল!! মরি শুধু আমরা লড়াই করে।”
আনোয়ার ভাই মিনি সুন্দরবনের ভিতরে ঢুকলো না। কুড়ি টাকা মূল্যের দুটো টিকিট সংগ্রহ করে আমি আর পল্লব বনানীতে প্রবেশ করলাম।
সুন্দরবনে সাধারণত যে সব স্বাভাবিক উদ্ভিদ দেখা যায়, এখানেও তেমনি সুন্দরী,গরান, গোল, হেতেল,কেওড়া ইত্যাদি গাছ বসিয়ে ঘন জঙ্গল তৈরি করা হয়েছে। প্রশস্ত নদী পাড় নিয়ে তৈরি ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের ভিতরে প্রবেশ করার জন্যে কাঠের সাঁকো করা আছে, যার উপর নির্ভর করে সমস্ত জঙ্গল প্রদক্ষিণ করে নদীর কিনারায় চলে গেলাম। এখানে জঙ্গল সাজানোর কাজ চলছে। পশু নেই বটে,তবে স্বাভাবিক ( বক,শামুকখোল, কাদাখোঁচা, চাতক,চিল,গাঙশালিক, ইত্যাদি ইত্যাদি) পাখি প্রচুর আছে। নদীর কিনারায় দাঁড়িয়ে উল্টোদিকে পরিষ্কার টাকি, হাসনাবাদ অঞ্চলটা দেখে মনে হল,পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত গরীব মানুষ গুলো যারা সবকিছু অনিচ্ছাকৃত ভাবে ছেড়ে ওপারে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। তারা তো জন্মভূমির অদম্য টান মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেননি, তারা টাকির ওই পাড়ে এসে দাঁড়াতে পারলে নিদেনপক্ষে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটত। পল্লবের কাছে শুনলাম, প্রতি বছর বিজয়াদশমীতে দুই দেশের সরকার নিষেধাজ্ঞা শিথিল করায় ভীষণ জাঁকজমক ভাবে এই নদীর বুকে নৌকায় শোভাযাত্রার মাধ্যমে প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। সেদিন মনে হয় দুই বাংলা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ভালো লাগছে ঘুরে ঘুরে দেখতে, মডেল কুমির,বাঘ, হরিণ, বানর,পক্ষি দিয়ে জঙ্গলটাকে বেশ সাজিয়েছে। এই গরমে লোকজন নেই ফাঁকা বটে,তবে হলি ডে-তে দর্শক সমাগম হয়,বেশি হয় উইন্টার সিজেনে। নদীর কুল ঘেষে একটা নৌকা পাল তুলে চলেছে। ছোটো বেলার কথা মনে পড়ে গেল, মাঝিদের সাথে নৌকা করে এই ইছামতীর বুকে মাঝ গাঙে চলে যেতাম। হোসেন চাচা নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরত। আমি মাছ কুড়াতাম। মাছ যা হত হোসেন চাচা নিত, আর কাঁকড়া যা হতো আমার। আমি নস্টালজিক হয়ে পড়ি। মনটা এতটাই উৎফুল্ল হল যে মুখ ফস্কে মাঝিদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললাম, কোই যা-ও মাঝিভাই?? ওরাও যেন আমার প্রশ্নের অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে ছিল, বাতাসের ধাক্কায় কাটা কাটা শব্দে উত্তর এলো-” মোল্লাখালির হাটে যাচ্ছি হাঁড়ি কলসি নিয়ে।” ধীরগতিতে পালতোলা নৌকাটা বাতাসের অভিমুখে এগিয়ে চলেছে। বিস্তৃত টলটলে জলরাশিতে সূর্যের আলো পড়ে প্রতিফলিত হয়ে মুক্তোর মতো বিকিরণে চোখ ঝাপসা হয়ে উঠল। পেছন থেকে পল্লব এসে বলল-“চলুন মেসো ফেরা যাক।”
ফেরার সময় আনোয়ার ভাই আমাদের একটা মসজিদ দেখাতে নিয়ে গেল। আ-হা মসজিদ তো নয়, যেন আগ্রার তাজমহল। সাদা প্লাসটার অফ পেরিসের কোডিং এ তৈরি নয়নাভিরাম মসজিদটির উপর সূর্যের আলো পড়ায় যেন শুভ্রতার বিচ্ছুরণ ঘটছে। ইচ্ছে হলো ফটো তোলার। আনোয়ার ভাই নিষেধ করে বোর্ড দেখালেন যেখানে পরিষ্কার লেখা আছে, কোন রকম ফটো বা ভিডিও করা যাবেনা। আমার ভিতরে গিয়ে দেখার ইচ্ছে ছিল। শুনলাম সেখানেও বিধিনিষেধ আছে। রোজা পালনকারী ব্যক্তি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ। কোনো ধর্মের নিয়ম কানুনকে সম্মান প্রদর্শন করাই ধার্মিক মানুষের উচিত কাজ। ফলে একটু হতাশ হয়ে বাইরে থেকেই মনোমুগ্ধকর মসজিদটা দেখে ফিরে এলাম।
বিকালে বেরিয়েছিলাম গাছপাকা বেল কিনতে। রাস্তার উপর দুইএকটা ফলের দোকান দেখলাম সেখানে পাকা বেল আছে, কিন্তু পল্লবের সেটা পছন্দ হলনা। পল্লব আমাকে নিয়ে গেল একটা কাঠ গোলার সামনে। সেখানে গিয়ে দেখি ছয় সাতজন বসে তাস খেলছে। তাদের সামনে বস্তা পাতিয়ে সাজানো আছে বেল,কলা, কচু,চুবড়িআলু ইত্যাদি ইত্যাদি। পল্লব বলল-” ও রসুল চাচা বেল কার?” গোঁফ কামানো দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক খদ্দের দেখেই এক লাফে তাসের আসর থেকে উঠে এসে বলল-” পল্লবদা, গাছ থেকে পড়া বেল, চল্লিশ টাকা করে। তুমি দুটো নাও পঁচাত্তর টাকা দাও।” পাশে গাছপাকা বিচি কলা দেখে খুব লোভ হল, কোলকাতায় এটা দুর্লভ বস্তু। দাম করতেই তাস খেলায়রত আরেক ভদ্রলোক উঠে এসে বলে -” ভাল কলা, আমার গাছের, নেন কুড়ি টাকা কিলো।” দাম শুনে আমি অবাক, এত সস্তা!! পল্লব হেঁসে বলল-” এই কলা খাওয়ার ধৈর্য আমার নেই।” এই সাধারন বেল,কলা কেনা-বেচার কথা গুলো লিখলাম এই জন্যে, আমার মনে হল এটা একটা অর্থনৈতিক অলস সময় যাপন। যেটা রথ দেখা কলা বেচার প্রকৃষ্ট উদাহরন।
০৫/০৪/২০২৪
সাকালের টিফিন খাওয়া শেষ হতে না হতেই গাড়ির হর্ণ বেজে উঠল। পল্লব বলল-” আধ ঘন্টার মধ্যে রেডি হয়ে নাও, অনেকটা পথ, তোমরা আবার ফিরবে।” আমি অবাক হয়ে বলি আমরা ফিরব মানে? পল্লব বলল-” আমরা এখন যশোর জেলার ঝিকরগাছায় সঙ্ঘমিত্রার বাড়িতে যাব। ওখানে দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে আমি ওখান থেকে ঢাকা চলে যাব। সামনে ঈদ, কাল সকাল দশটার মধ্যে মোকামে যেতে হবে, রোজা মাস পেমেন্ট, মাল ডেলিভারি অনেক কাজ পড়ে আছে।” আমি চিন্তায় পড়ে গেলম,ওকে বললাম, তুমি চলে যাবে, আমরা যে পরশুদিন বাড়ি ফিরব! পল্লব হেঁসে বলল-” ও নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না,আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। পরশুদিন অর্থাৎ ( ০৭/০৪/২০২৪) দুপুর বারোটায় টোটো আসবে, তাপস আপনাদের সঙ্গে থাকবে। ও ভোমরা বর্ডার পর্যন্ত আপনাদের নিয়ে যাবে। বর্ডারে আমার লোক ঠিক করা থাকবে ওরাই আপনাকে পার করে ইণ্ডিয়ায় নিয়ে গিয়ে বসিরহাট রেল স্টেশনের যাওয়ার অটো ঠিক করে দেবে।” ওর পরিকল্পনা সাজানো এবং তার রূপায়ন দেখে মনে মনে বললাম, একেই বলে ম্যানেজার।
গাড়ি চলেছে যশোহর রোড ধরে। ঝাঁ চকচকে মসৃণ ইন্টারন্যাশনাল রোড। শুরুর সময়টা ছিল ঠিক এর উল্টো —
আজ থেকে একশো চুরাশি বছর আগে নড়াইলের জমিদার কালী পোদ্দার মহাশয়ের মায়ের ইচ্ছা হল, তিনি কালি ঘাটের আদি গঙ্গায় স্নান করে মা কালি দর্শন করবেন। ভাবনা যতটা সোজা বাস্তবে ইচ্ছে পূরণ ততটাই কঠিন এবং ব্যয়বহুলও বটে। হলে কি হবে, জমিদার কালি পোদ্দার মাতৃ আজ্ঞা পালনে বদ্ধপরিকর। তিনি কালক্ষেপ না করে ১৮৪০ খ্রীস্টাব্দে যশোরের বকচর থেকে শুরু করলেন রাস্তার কাজ। শেষ করলেন দক্ষিণ কোলকাতার কালিঘাটে এসে। কয়েক হাজার শ্রমিকের দুই বছরের কঠোর পরিশ্রমে দুই লক্ষ আটান্ন হাজার টাকা খরচ করে ১৮৪২ খ্রীস্টাব্দে শেষ করলেন এই রাস্তার কাজ। পথিকদের বিশ্রাম ও ছায়ার জন্যে রাস্তার দুই পাশে অসংখ্য বৃক্ষ রোপণ করেন। শতবর্ষী সেই বৃক্ষরাজি আজও কালের সাক্ষী হয়ে দণ্ডায়মান। তবে সেই রাস্তা ছিল অনেক অনুন্নত ও শ্বাপদশঙ্কুল। সাধারণত পথিক হেঁটেই এই পথ ব্যবহার করত। তুলনামূলক অবস্থাপন্ন লোকেরা গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, পালকি ব্যবহার করতেন। এর বহু বছর পরে বৃটিশ গভর্মেন্টে তাদের প্রশাসনিক সুবিধার্থে অধুনা বাংলাদেশের বকচর থেকে ভারতের শ্যামবাজার পর্যন্ত ১২৫ কিলোমিটার পথ সংস্কার করে। যশোরের বকচর থেকে বেনাপোল পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার রাস্তা যশোর বেনাপোল রোড নামেই পরিচিত। এবং বেনাপোল থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত ৯০ কিলোমিটার রাস্তা যশোর রোড নামে পরিচিত।
যশোর রোড ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময়কার অনেক মর্মান্তিক নির্মম ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে—–
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃসংশ বর্বরতার হাত থেকে বাঁচতে পূর্ব বাংলা থেকে হাজার হাজার মানুষ ভিটে মাটি ছেড়ে শরনার্থী হয়ে দলেদলে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে আসে। বেনাপোল বর্ডার দিয়ে সেই কপর্দকহীন আতঙ্কগ্রস্ত ক্ষুদার্থ মানুষগুলো যশোর রোড ধরে হাঁটতে থাকে ত্রাণ শিবিরের আশায়। বাস বা ট্রেন তাদের কাছে বিলাসিতা মাত্র। কত মানুষ না খেতে পেয়ে, অসুস্থ হয়ে পথেই মারা গেছে। স্বজনরা মৃতের মায়া নিতান্ত বাধ্য হয়ে ত্যাগ করে চলে গেছে। পথের ধারেই মরে পড়ে থেকেছে, দাহ করা তো দুরের কথা মুখে আগুন দেওয়ার লোক টুকু নেই। কত শিশু রোগগ্রস্ত হয়ে মায়ের কোলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছ। ভাবলে আজও গা শিউরে ওঠে। এই সব কিছুর জ্বলন্ত সাক্ষী এই যশোর রোড। ঠিক এই সময় ভারতে এসেছিলেন বিখ্যাত সমানুভূতি সম্পন্ন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ। যশোররোডের উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে পাড়ি দেওয়া অসুস্থ ক্ষুদার্থ স্বজনহারা শীর্ণকায় মানুষ গুলোকে কায়মনোবাক্যে পর্যবেক্ষণ করে তাঁর হৃদয় নাড়িয়ে দিয়েছিল। যার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখে ফেললেন ১৫২ লাইনের এক কবিতা, যার নাম দিলেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। অ্যালেন গিন্সবার্গের ওই কবিতায় সুর এবং কণ্ঠ দিয়ে সেই গানকে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন পৃথিবী বিখ্যাত সঙ্গীত স্রষ্ঠা বব ডিলান। পূর্ব এশিয়ার এক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সাধারন মানুষের করুন পরিনতি অনুভব করেছিল সমস্ত বিশ্ববাসী।
এই প্রসঙ্গে আমার একটা স্মৃতিচারণ করতে ইচ্ছে করছে। ১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল বছর চারেক। ভাসাভাসা মনে আছে। আমরা তখন থাকতাম বসিরহাটের এক প্রত্যন্ত গ্রাম ধলতিথায় বড়ো এক জমিদার বাড়িতে। সেই বাড়ির নিচে ছিল শরনার্থী শিবির। এখনো স্পষ্ট মনে আছে বহুদিন পেটপুরে না খেতে পাওয়া মহিলারা তাদের কোলের শীর্ণকায় শিশুদের খাওয়ার জন্যে আমার মায়ের কাছে ভাতের ফ্যান নিতে আসত। মা ফ্যানের মধ্যে কিছুটা করে ভাত দিয়ে দিতেন। একটু লবন সহযোগে সেটাই শিশুগুলো অমৃতের মতো খেত। বড়দের দেখেছি রাস্তার ধারে গজিয়ে ওঠা স্বাভাবিক শাকপাতা তুলে লবণ দিয়ে সেদ্ধ করে খেত, ভাত জুটত না,ওটা ছিল বিলাসি খাবার। অল্প বয়সী যুবতীদের লজ্জা নিবারণে আমার মা তাঁর নিজের পরা বেশির ভাগ শাড়ি দিয়ে দিয়েছিলেন। একটা শাড়ি দুই ভাগ করে তারা লজ্জা নিবারণ করত। এক বয়স্ক ভদ্রমহিলাকে আমার মা শেষ সম্বল নুতন শাড়িটা দিয়ে দিলে,সেই বয়স্কা ভদ্রমহিলা কেঁদে ফেলেন,এবং আমার মাকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন-” মা গো তোমার কোনোদিন ভাত কাপড়ের অভাব হবেনা।” সত্যিই সেই আশীর্বাদ মায়ের জীবনে অক্ষরে-অক্ষরে খেটে গিয়েছিল। সেদিনের কথাগুলো মনে পড়লে আজও গা শিউরে ওঠে।
যাইহোক, আমাদের গাড়ি যশোর রোড ধরে ছুটছে,কিন্তু কোন যশোর রোড বোঝা মুশকিল, বাংলাদেশের না ভারতের! কারণ রাস্তার ধারের পরিবেশ গাছপালা ঘরবাড়ি সবই এক। মনে হচ্ছে যেন দত্তপুকুর বা হাবড়া হয়ে যশোর রোড ধরে বনগাঁর দিকে চলেছি। ঝিকরগাছা পৌঁছাতে আমাদের ঘণ্টা আড়াই সময় লাগল। আমার শ্যালিকার একমাত্র কন্যা সঙ্ঘমিত্রার বাড়ি। একেবারেই গ্রাম্য পরিবেশ। সঙ্ঘমিত্রার স্বামীর নাম সমির চক্রবর্ত্তী। ওদের দুটি সন্তান। কন্যা অঙ্কিতা চক্রবর্ত্তী, পুত্র সোম চক্রবর্ত্তী। এক ভিটের মধ্যে সমিররা তিন ভাই বৃদ্ধ বাবা মা কে নিয়ে এক সাথে থাকে। আজকের দিনে এমন একান্নবর্তী পরিবারের কথা ভাবাই যায় না। শুধু এক জায়গায় থাকা নয়, আন্তরিকতা সাথে মিলেমিশে থাকা। আসলে প্রতিটা মানুষের মানিয়ে চলার অন্তর্নিহিত ইচ্ছাতেই সম্ভব হয়েছে। আজকের যুগে গ্রাম হলে কি হবে, বাড়িঘরে শহুরে কেতাব বর্তমান। প্লেট ভরা মিষ্টি, সফ্টড্রিংকস সহযোগে আপ্যায়নের সূচনা। আমার স্ত্রী তার ভাগ্নিকে বলল-“তোরা কি আমাদের দুপুরে খেতে দিবি না। এই মিষ্টি খাইয়ে বিদায় করবি!” সঙ্ঘমিত্রা জিভ কেটে বলল-” সেকি মাসি, তেমার পছন্দের খাবার গুলো আমি নিজে হাতে রান্না করেছি।” মিলি হেঁসে বলল-” বেশ, তাহলে প্লেটের ভার কমা।” এদিকে আমি সমিরের সাথে আড্ডায় বসে গেছি। এত গুনি ছেলে এখানে না এলে জানতেই পারতাম না। একটা ছোটখাটো সোনার দোকান আছে।,তাছাড়া কিবোর্ড বাজায়, সর্বোপরি জীবনমুখী গানের গীতিকার, সুরকার,এবং গায়ক। ওদের একটা ব্যণ্ড আছে, যার নাম ‘কলের গান’। একজন বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষ। যশোরের বড়ো বড়ো কবি সাহিত্যিকদের সাথে ওর ওঠাবসা। ওদের পরিবারের সাথে একাত্ম হয়ে আছেন সাহিত্যিক সফিয়ার রহমান। সমির বলল-” আপনার কথা ওনাকে বলেছি, সফিয়ার স্যারেরও ইচ্ছে আপনার সাথে পরিচয় করার। আপনি বলছেন থাকতে পারবেন না। দু’দিন থেকে গেলে এখানে আমার পরিচিত অনেক জ্ঞানী গুণী মানুষ আছেন তাঁদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতাম। তাঁরাও খুশি হতেন,আপনারও ভাল লাগত। দেখি সফিয়ার স্যারকে একটা ফোন দেই।” এই বলে সমির মোবাইলে কল করল,
— হ্যালো স্যার, আমি সমির বলছি।
— হ্যাঁ, বলো।
— বলছি, আমার মেসো সলিল চক্রবর্ত্তী এসেছেন।
— বাঃ, খুব ভাল খবর, আমি কাল সকালে তোমার বাড়িতে যাব।
— কিন্তু স্যার ইনি তো বিকালেই ফিরে যাচ্ছেন।
— ওনার সাথে পরিচিত হওয়ার যে খুব ইচ্ছে ছিল, ফোনটা উনার কাছে দাও।
সমির ফোনটা আমাকে দিয়ে বলল-” এই নিন মেসো, স্যার আপনার সাথে কথা বলবেন।”
—- হ্যালো।
— হ্যাঁ স্যার, আমি সফিয়ার রহমান বলছি, নমস্কার, ভাল আছেন তো?
— নমস্কার, আমি ভালো আছি বলেই তো এতদূর আসতে পোরেছি, আপনিও নিশ্চই ভালো আছেন।
— হ্যাঁ, নিশ্চই, নিশ্চই। আজ রোজা মাসের শেষ শুক্রবার। আমি অনেক দূরে একটা ইফতার পার্টিতে এসেছি। আপনি রাতে থাকলে আমি কাল সকালেই—।
— দুঃখিত, উপায় নেই, আমাদের নিশ্চই পরে কখনো দেখা হবে।
— আমার কিছু বই আপনার হাতে তুলে দিতে পারলে আমার খুব ভাল লাগতো।
— আমার দুর্ভাগ্য, এমন একটা সুযোগ কে হাতছাড়া করতে হচ্ছে। তবে আপনি যদি কোলকাতা বুক ফেয়ারে আসেন, আমি নিশ্চই আপনার সাথে যোগাযোগ করব।
— ঠিক আছে, আপনার বাংলাদেশ ভ্রমণ সার্থক হোক।
— ধন্যবাদ।
ফোন ছাড়তেই সমির একটা বই আমাকে দিয়ে বলল-” এই বইটা সোফিয়ার স্যারের লেখা।” আমি বইটি উল্টেপাল্টে দেখছি। “রঙ্গ-রসিকতায় রবীন্দ্র ও নজরুল” সফিয়ার রহমান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের জীবনে ঘটে যাওয়া ছোট ছোট মজার টুকরো ঘটনা নয়ে সম্পাদনা করা বইটিতে ডুবে গেলাম। এরই মধ্যে সোম এসে বলল-” বাবা তোমাদের খেতে দেছে।”
খাওয়ার টেবিলে সেই একই সমস্যা। এক ঘণ্টা আগে টিফিন খেয়েছি,পেটে জায়গা কোথায়! টেবিলে সাজানো সাত আট রকমের পদ। শেষ পর্যন্ত অনেক বুঝিয়ে কাটছাঁট করে ভেজন পর্ব শেষ করলাম।
খাওয়ার পর শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে সাহিত্যিক সফিয়ার রহমানের সম্পাদনার বইটা দেখছি, এর মধ্যে সমিরের মেজদা এসে আমাকে ওনার ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে দু’টো ডায়েরি এবং দুটি কলম উপহার দিয়ে বললেন-” আমি দুপুরে বাড়িতে এসে শুনলাম আপনি এসেছেন। আপনি ডায়েরি দুটো নিলে আমার খুব ভাল লাগবে।” ভদ্রলোক যে ভাবে আমাকে অভিনন্দ জ্ঞাপন করলেন তাতে আমি আপ্লুত, উপলব্ধি করলাম, আমি যত না লিখি তার থেকে এপার বাংলায় এসে লেখক সম্মান পাচ্ছি অনেক বেশি। গল্পে কথায় সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ল। পল্লব যাত্রা করল ঢাকার উদ্দেশ্যে, আর আমরা খুলনার সাতক্ষীরা।
০৬/০৪/২০২৪
সকালে ব্রেকফাস্ট করে অলস ভাবে বসে আছি। সময় কাটাই কিভাবে। পল্লব থাকলে গল্পগুজব করে কেটে যেত। হঠাৎ মনে পড়ে গেল আনোয়ার ভাই বলেছিল, ছবি শেখের গোরস্থানটা পারলে দেখে আসতে। অচেনা জায়গা কি করব ভাবছি, এরি মধ্যে তাপস একটা দেশি মোরগ নিয়ে হাজির হল,এবং দা,বঁটি নিয়ে কলতলায় বসে গেল কাটবে বলে। আমি তাপসকে ছবি শেখের গোরস্থানের ঠিকানাটা জানতে চাইলাম। দিদি শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,ওই ঠিকানা জেনে আমি কি করব। তাপস বলল-” না না, ও সব জায়গায় না যাওয়াই ভালো।” ওরা যেতে নিষেধ করায় আমার যাওয়ার আগ্রহ বেড়ে গেল। আমি দিদিকে বুঝিয়ে বললাম যে, বাড়িতে বসে বসে বোর হয়ে যাচ্ছি, তার থেকে আনোয়ার ভাই যখন বলল একটু না হয় ঘুরেই আসি। দিদি একটু অনিচ্ছা প্রকাশ করে বললেন-” ওই সব জীন,পরী,ভুত,প্রেতের জায়গায় না যাওয়াটা ভাল।” আমি হাসতে হাসতে বলি,আপনার তো ভুতে বিশ্বাস নেই,তবে সমস্যা কোথায়? যাইহোক ওদের বুঝিয়ে ঠিকানাটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
আম বাগান, নারকেল বাগান, সুপারি বাগান, ধানখেত, ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে এক মুসলমান পাড়ায় ঢুকলাম। পথ তাদের ঘরের উঠোনের উপর দিয়ে চলে গেছে। বাড়ি গুলোর সীমানায় সব সুপারি অথবা কলা গাছের শুকনো পাতা দিয়ে বেড়া দেওয়া। তার গা ঘেঁষে পথ, আমি সেই পথ ধরে চলেছি। কয়েকটি শিশু আদুল গায়ে ছুটে এসে আমাকে আবাক হয়ে দেখতে থাকল,বাড়ির উঠনে একটা মুরগী তার গণ্ডাখানেক ছানা নিয়ে খাদ্যের সন্ধানে ঘুরে-ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছু মহিলা ঘোমটা টেনে আমার দিকে উঁকিঝুঁকি মারতে থাকল, কল তলায় বসে এক বৃদ্ধা কাঠের জ্বালে রান্না করা কালো কালো হাঁড়ি কড়া ঝামা দিয়ে ‘ঘসঘস’ শব্দে এক মনে ঘসে চলে যাচ্ছে। পাশে বাঁধা ছাগল ছানাটা ব্যা ব্যা করে ডেকে চলেছে। যেন ভীন গ্রহের কোন প্রণী এই এলাকায় ঢুকে পড়েছে। এলিয়েন ভাবলেও উপায় নেই, বেরিয়ে যখন পড়েছি,গন্তব্যস্থলে তখন যেতেই হবে। একটা নেড়ি কুকুর আমাকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে বার দুই ‘ঘেউঘেউ ‘ শব্দ করে এমন ভাবে লেজ নাড়তে নাড়তে সামনের দিকে এগিয়ে গেল,যেন ও বলতে চাইছে আমাকে অনুসরণ করো। আমি আমার মতো এগিয়ে চলেছি। এক সময় অনেক টিনের তৈরি বাড়ির মধ্যে আমার চলার পথটা হারিয়ে ফেললাম। সরু আঁকাবাঁকা স্যাঁতসেঁতে দু’টো পথ দেখে থমকে গেলাম। কোন পথ ধরব বুঝতে পারছিনা। কয়েকটি ল্যাংটা বাচ্চা আমাকে অনুসরণ করছে বটে তবে ওদের কাছে জিজ্ঞেস করা সমীচীন মনে হল না। পাশে একটা কুঁড়ে ঘরের দাওয়াতে বসে এক বৃদ্ধ মাছ ধরার জাল বুনছে। আমকে দেখতে পেয়ে বললেন-” মিঞার কোথায় যাওয়া হবে?” আমি ছবি শেখের গোরস্থানের কথা বলতে আমার দিকে কেমন কৌতুহলের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন-” এই পথ দিয়ে সোজা চলে যান, কিছুটা গিয়ে একটা পুকুর পড়বে,পুকুরের ডানদিকে একটু এগিয়ে বড়ো বাঁশ বাগান পড়বে, বাঁশ বাগানের বাম দিকে পাঁচিল তুলে ঘেরা কবর খানা।” আমি নির্দেশ মতো কিছুটা এগিয়ে পুকুরটা দেখতে পেলাম। আর খানিকটা এগিয়ে দেখি রাস্তা কোথায় এ যে বিশাল বাঁশবন। তারই একদিকে ভাঙাচোরা পাঁচিল তুলে বিঘা খানিক জায়গা ঘেরা। বুঝলাম এইটাই সেই ছবি শেখের গোরস্থান। সামনে একটা বাঁশের তৈরি খোলা গেট।
গেট সরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে খানিকটা হতাশ হলাম। যা ভেবেছিলাম তা নয়, নাম করা গোরস্থানের এই দশা। সারিবদ্ধ শব শায়িত, যেটা নতুন পুরোনো মাটি চাপা দেওয়া দেখে বোঝা যাচ্ছে। পাঁচিলের এক কোনে একটা বড়ো আমগাছ আছে। যাতে আম তো দুরের কথা নুতন পাতা গজায় কিনা সন্দহ আছে। কালো পাতায় ভরা ঝাঁকড়া গাছটি দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে যেন গোরস্থান পাহারা দিচ্ছে। গাছের গোড়াটা সান বাঁধানো। গেরস্থানের বাইরে বাঁশ ঝাড়ের বাঁশে বাঁশে হাওয়ায় ঘষা লেগে ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ হয়ে চলেছে। সবই তো হল,কিন্তু ছবি শেখের কবর কোনটা আমি বুঝব কি করে? তাছাড়া এই গা ছমছমে নির্জন বাগানে কার কাছে গোরস্থান সম্পর্কে জানব। ভাবলাম ফিরে গিয়ে ওই জাল বোনা বৃদ্ধের সাথে কথা বলবো, যদি কিছু জানা যায়। এই চিন্তা করে ফিরে আসবো ভাবছি,হঠাৎ দেখি গোরস্থানের মাঝ বরাবর এক জায়গা থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে৷ আর একটা অচেনা মিষ্টি গন্ধ নাকে অসছে। পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেলাম। কাছে গিয়ে দেখি একটা বহু পুরনো কবর, চুন সুরকির বেদী করা। বড় বড় ঘাস গজিয়ে স্থানটিকে আবৃত করে রেখেছে। বেদী মাথার দিকে কিছু লেখা আছে বটে তবে এতটাই অস্পষ্ট যে উদ্ধার করার উপায় নেই। কবরের বুকের উপর এক গোছা আধজ্বলা ধুপ ও একটা নিভু নিভু মোমবাতি জ্বলছে। পাশে রাখা এক গোছা রজনীগন্ধা ফুলের স্টিক। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে,যাঁর বডি শায়িত আছে তাঁর আপনজন কেউ খানিকক্ষণ আগে নিশ্চই শ্রদ্ধা নিবেদন করে গেছে। কিন্তু আমি আসার সময় তো কাউকে ফিরতে দেখলাম না। এমন কি এত বড়ো গোরস্থানে কাউকে দেখতেও পাচ্ছিনা!! সব কেমন অদ্ভুতুরে কাণ্ডকীর্তি। যেন একটা ভৌতিক স্থানে আমার অনধিকার প্রবেশ ঘটেছে। ভবলাম এখানে আর থাকা সমীচীন নয়। দিদি,তাপস ঠিকই বলেছিলেন, ” জীন,পরি, ভুত,প্রেতের জায়গায় একা না যাওয়াই ভাল।” গা-টা একটু ভার হয়ে গেল,মনে হতে লাগল কারা যেন আমাকে লুকিয়ে লক্ষ্য করছে। পিছনে ঘুরে ফিরে আসছি হঠাৎ একটা কর্কশ কন্ঠস্বরে চমকে উঠি —-
(শেষ পর্ব আগামী সংখ্যায়)