একটু আগেই যে চিন্তার মেঘ গোটা বাড়িতে ঘনিয়ে ছিল হঠাৎই তা উধাও। খেতে বসে বাবা বললে “সামনের মাসে মাইনে পেলে আগে জানালার কপাট লাগাব।এমন করে কী থাকা যায়! সবাই হাসলেও মা চুপ করে রইল। বাবা বলল “কিছুই বললে না যে”? মা মৃদু হাসলে। বললে “যা মাইনে পাও তাতে সারা মাস চলে না। ছেলে মেয়ের মুখে একটু ভালো খাবার তুলে দিতে পারিনা। এরপর যদি জানালার খরচা হয় তবে খাবো কী?” বাবা আর কথা বলে না। মা বলে “ছেলে মেয়ের দশা দেখেছ। মাছ না,মাংস না। ভাবছিলাম কদিন দুধের রোজ করব।ইস্কুলে পড়া ছেলে মেয়ে। ওদের বুদ্ধি হবে কী খেয়ে শুনি? আর আমার গয়না বলতে কটা খাদ মেশানো চুড়ি। ভাবছিলাম ওগুলো বেচে দেবো। একটা বাছুর কিনবো। কয়েক বছর পাললে দুধ ঘি এর অভাব থাকবে না। গোবর থেকে ঘুঁটে হবে। এক পোন ঘুঁটে পঁচিশ টাকায় বিকোবে।”
রাতে স্ত্রী পুরুষ কত আলোচনা করে। অনেক কথা কানে আসে মালবিকার। মা বলছে “এক কাজ করব। চালের টাকাতে আগালি কিনে নেবো।তাহলে পরিমাণে অনেক হবে। আমার সন্তানেরা তাই সোনামুখ করে খেয়ে নেবে”। মালবিকার মনে হয় একদিন সে কিছু একটা করবেই। এমনি করে দুঃসহ দারিদ্র সে সহ্য করবে না”।
কিন্তু কোন সেই রাস্তা? যেটা খুঁজে পেলে সে পেয়ে যাবে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। সেদিন স্কুলের স্যার বলেছেন মরুভূমির পথে উট হেঁটে চলে। খাদ্য পায় না তবুও চলে।পানীয় পায় না তবুও চলে। অসীম ধৈর্য চাই। এসব নাকি রবি ঠাকুরের কথা। স্যার বলেছেন। গান গেয়েছেন। কী সুন্দর সেই গান। গুনগুন করে গায় মালবিকা “খরবায়ু বয় বেগে/ চারিদিক ছায় মেঘে/ ওগো নেয়ে নাও খানি বাইও”।
মালবিকা স্যার এর সাথে গলা মিলিয়েছিল। স্যার বলেছিলেন “তোমার এত সুন্দর গানের গলা। অথচ গান শেখোনি”। মালবিকার হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয় “মানুষ সব পারে। সব পারে”। বাবার আত্মসম্মান জ্ঞান ভীষণ। কেউ অযাচিত কিছু দিলে বাবার রাগ হয়। এই তো সেদিন। মালবিকার বড়মামার ছেলে এসেছিল। মাকে কিছু টাকা দিয়েছিল। তাতে ভীষণ রেগে গিয়েছিল বাবা। বলেছিল আমার যেমন জোটে তেমন খাবো। কারো করুণা চাই না। মা এইসময় চুপ করেই থাকে।
গান শেখানোর সামর্থ্য বাবার নেই। মালবিকা থেমে থাকে না। খুব সুন্দর আবৃত্তি করে। স্কুলের হয়ে আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় যায়। প্রাইজ আনে। কী সুন্দর ওর কণ্ঠ।
নবম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করল মালবিকা। এখন সবাই জেনে গেছে স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবে ওই মেয়েটা। নিন্দুকরা বললে ও মেয়ে তো দিনরাত বই নিয়ে পড়ে থাকে। ওর রেজাল্ট ভালো হতেই পারে। ও তো বই এর পোকা। আমাদের ছেলেমেয়েরা অমন পড়লে নিশ্চয়ই পারতো। মালবিকা বুঝে গেছে এসব কথা ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে হয়। এগুলো শুধুই অকর্মণ্য দের আস্ফালন। সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি। এর মধ্যেই দিনমজুর খাটা দুজন আদিবাসী মহিলা মালবিকার কাছে এল। বললে “আমাদের বাচ্ছাগুলোকে পড়াও। আমরা লেখাপড়া জানি না। মাথা পিছু চল্লিশ টাকা করে দেবো। মালবিকা রাজী হয়ে গেল। স্কুল থেকে এসে সে পড়াবে। বেশ কিছু আয় হবে। সংসারের খরচ মিটবে। এরমধ্যেই পাড়ায় বিরাট নাট্যোৎসব করছে ছেলে ছোকরার দল।কলকাতা থেকে অনেক নাট্যগোষ্ঠী এসেছে। তাদের খাবার তৈরি করতে হবে। সবাই মালবিকার কাছে এল। বললে “মাংস ভাত রান্না করে দিতে হবে তোমাকে। আর নাট্যোৎসব এর উদ্বোধনী সঙ্গীত সমবেত ভাবে হবে। তোমাকে গলা মেলাতে হবে। আশ্চর্য এক অনুভূতিতে পূর্ণ হয়ে গেল মালবিকার মন। নিজেকে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ মনে হল। কিন্তু নাট্যোৎসব তার জীবনে আর একটা দরজা খুলে দিল।