কুসুম’দিটা কালো ছিল
●বাসুদেব চন্দ
‘কুসুম’দি’ নামে আমার একটা দিদি ছিল। শুধু আমার কেন, গোটা পাড়ার লোকের ও দিদি ছিল।
যদ্দুর মনে পড়ে ওর বাড়ি ছিল বাঁকুড়ায়। সেখানে আপনজন কেউ না থাকায় ও আমাদের পাড়ার এক বামুন বাড়িতে থাকত।
আমার তখন ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়ার বয়স। থাকি বিধানপল্লী। কুসুমদি থাকে মধ্য-বিধানপল্লী। আমাদের বাড়ি থেকে দৌড়ে যেতে খুব বেশি হলে মিনিটখানেক লাগে।
শীতকালে সন্ধে হলেই রাত হওয়ার তাড়া লেগে যায়। আমরাও তাই শীতের তালে তাল মিলিয়ে খেলারমাঠের দাপাদাপি শেষ করে ঘরে ফিরে পড়তে বসে যাই। তাড়াতাড়ি পড়তে বসার একটা সুবিধাও ছিল, সুরে হোক বা বেসুরে ঘণ্টাখানেক চেঁচাতে পারলেই মা খুশি হয়ে যেত! তখনই ছুটে যেতাম ঐ কুসুমদির কাছে!
কুসুমদিও দিনভর বামুনবাড়ির কাজকম্ম সেরে সন্ধে হতে না হতেই বসে পড়ত খুন্তি আর কড়াই নিয়ে, আলুর চপ আর বেগুনি বানাবে বলে।
অফিস ফেরতাদের আনাগোনা তখন থেকেই শুরু হয়ে যেত। কারণ একটাই, খুব সস্তায় পেত!
ঐ আনাগোনাই সার, সে’দিদিটি কোনোদিনই লাভের মুখ দেখেনি! দেখবেটা কীকরে, সব খদ্দেরই তো আমার মতো- তিনদিন খায় তো একদিন পয়সা দেয়! মন মেজাজ ভালো না থাকলে তাও দেয় না!
তবুও এই কাজটা কুসুমদি খুব মন দিয়ে করে!
এই দিদিটি দেখতে কেমন ছিল সেটা একটু বলি-
বয়সটা ঠিক বলতে পারব না, তবে আমার মায়ের বয়সী অথবা একটু বেশিই হবে। আসলে সাদা-থান পরে বলে বেশি মনে হয়, নইলে একই।
চেহারাটা ছিল ছোটখাটো। গায়ের রং-টা কালো। কালো মানে যাচ্ছেতাই রকমের কালো! তবে হাসিটা ছিল নামের মতোই সুন্দর! কালো মানুষের অমন সাদা দাঁত কীকরে যে হল তা ভগবানই জানে!
আমি যতটুকু জানি- কুসুম’দির পান বা তামাক, কোনও নেশাই ছিল না, চপ ভাজা ছাড়া। হাতে-গলায় গয়নাগাটি দূরের কথা- একটা লোহার কাঠিও ছিল না!
তেমনই ছিল না ওর দোকানের ছিরি-
●রাস্তা লাগোয়া একটা উঠোন-
● উঠোনের এক ধারে ছোট্ট একটা উনুন-
● উনুনে গুনে গুনে তিনটে ইট-
● তিনটে ইটের মধ্যিখানে ছোট্ট
একটা গর্ত-
●গর্তের আগুনে পুড়ে যাওয়া ইটগুলোর রং কুঁচকুচে কালো-
●কালো কড়াই নাহলে চপ ভালো হয় না!
●কালো কড়াইয়ের সাথে সাদা খুন্তি মোটেও মানায় না!
উনুনের খিদে মেটানোর জন্য কুসুমদির বাঁ-দিকে রাখা রাখত বেশকিছু পাঁকাটি আর কিছু শুকনো ডালপালা।
আগুনের উত্তেজনা বাড়াবার জন্য একটা হাত-পাখাও ছিল।
সঙ্গ দোষে সেটাও ছিল কালো।
এত কালোর কোলাকুলি সত্ত্বেও কুসুমদির আলুরচপ আর বেগুনিকে টেক্কা দিতে পারে- এমন বান্দা ঐ তল্লাটে ছিল না!
কালোর কী জাদু রে ভাই…….!
সেই জাদুবলেই আমরা বন্ধুরা মিলে ওর গা-সেঁটে বসে থাকতাম!
ঝুঁকে পড়ে আগুনের উত্তাপ নিতাম আর হাঁ-করে আলু-বেগুন আর বেসনের মাখামাখি দেখতাম!
আমাদের ওভাবে হ্যাংলার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে ওরা ভারি লজ্জা পেত! তখন অগ্নিসাক্ষী করে কুসুমদি ওদের তেল-ভরতি কড়াইতে ছেড়ে দিত!
তারপর খুন্তি দিয়ে ভালো করে উল্টেপাল্টে যখন আমাদের পাতে তুলে দিত, তখন আমরা ফুঁ মেরে মেরে ওদের উদরস্থ করতাম আর জিভ দিয়ে ‘টকাস’ টাগড়া বাজাতম!
আমাদের দেখাদেখি বামুনবাড়ির পোষ্য কুকুর ‘কালু’ এবং পুষ্যি বিড়াল ‘ধলি’ও আমাদের গা-সেঁটে বসে থাকত! ওদের উদ্দেশ্যেও একই ছিল।
***
কুসুমদির বাঁধাধরা খদ্দের ছিলাম আমি। তাই ধার-বাকি খাওয়াতে কোনও বাধা ছিল না! অসুবিধা ছিল একটাই। সহজে পেতে পেতে মোট কত খেয়ে ফেলেছি তার কোনও ‘নোট’ ছিল না! না আমি, না কুসুমদি- কেউই তো কখনও হিসেব রাখার প্রয়োজন মনে করিনি!
তো একবার খেতে খেতে অনেক টাকা হয়ে গেল- ‘অনেক টাকা’- মানে কত টাকা বলতে পারব না!
আমার কথা শুনে কুসুমদি হাত-পা ঝেড়ে উত্তর দিল-
“আমি কি তুদের মুতো লেকাপড়া জানি যে হিসেব রাইকব! উসব বাবু তুয়ার কাজ বটে”!
তা বলে ওকে তো আর ঠকাতে পারি না! তাই ভেবেচিন্তে একদিন টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে নারকেল-তেলের কৌটোয় জমাতে শুরু করলাম। দুদিন বাদে বাদেই ঝাঁকিয়ে দেখতাম!
একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি মা’র মুখ ভার! ভাবলাম- বাবুর সঙ্গে কিছু হয়েছে বোধহয়!
যাই হোক, এই সময় একটু বুঝেশুনে চলাই ভালো। হাত-মুখ ধুয়েঠুয়ে অন্যদিনের তুলনায় একটু আগেই পড়তে বসে গেলাম- “খাওয়ার ডাক পেলে তবেই যাব”!
হঠাৎ নজরে পড়ল- সব বইখাতাগুলোই আছে, শুধু অঙ্ক খাতাটাই নেই! বুকটা ধড়াস্ করে উঠল- “কুসুমদির হিসেবটা তো ওখানেই আছে”!
যে ভয়টা পাচ্ছিলাম ঠিক সেটাই হল! মা এসে আমার সামনে ঐ খাতাটা ফেলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল-
“এগুলো কী? কবে থেকে চলছে এসব”?
আমি কোনও উত্তর দিতে পারলাম না! মা সঅবই দেখে ফেলেছে! ‘জল টসটসে’ চোখ নিয়ে
মাথা নীচু করে ঠাঁয় বসে রইলাম!
সেদিন দুপুরের খাওয়াটুকু ছাড়া কপালে আর কিছু জোটেনি!
“তোর আর স্কুলে যেতে হবে না- কালকেই গিয়ে নামটা কাটিয়ে দিয়ে আসব”!
বাকিতে খাওয়া যে এত বড় অপরাধ আগে তা বুঝিনি! আমাদের মাসের মুদিমাল তো চারু’কাকুর দোকান থেকেই আসে, পুরোটাই তো বাকিতে! তাহলে!
পরেরদিন সকালে মা টাকা নিয়ে ছুটল ঐ দিলীপ’কাকুদের বাড়িতে। মা’কে দেখেই কাকিমা ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। কুসুমদি এগিয়ে এসে বলল-
“কাল তুমার ছেলেটুকে দেখি লাই গ দিদি! ভালঅ আচে ত”?
“না গো, গতকাল রাত থেকে গা’টা বেশ গরম!
“সে কী গ”!
“কুসুমদি, তোমাকে একটা কথা বলব বলেই আমি এসেছি”!
“বলো না গ কী বুইলবেক”? – আনন্দে গদগদ হয়ে কুসুমদির প্রশ্ন।
“তুমি এভাবে রোজ রোজ ওকে ভাজাভুজিগুলো দিয়ো না! এই বয়সেই যদি এই অভ্যাস হয়ে যায় ভবিষ্যতে তাহলে কী করবে”!
মা’র কথা শুনে কুসুমদি এবং কাকিমা দুজনেই খুব দুঃখ পেলেন!
কাকিমা বললেন-
“এ বাবা! আপনি ছেলেটাকে নিশ্চই বকাবকি করেছেন?
“করব না! দিনের পর দিন কুসুমদির পয়সাগুলো আটকে রেখে ও খুবই অন্যায় করেছে”!
এবার দুজনই হাসতে শুরু করলেন-
“এ বাবা! আপনি তো ভুল বুঝেছেন দিদি! এই চপঠপগুলো কুসুমদি মোটেও পয়সায় জন্য করে না, পুরোটাই করে শখ থেকে!
আমাদের থেকে পয়সা-কড়ি যা পায় তার প্রায় সবটাই ঐ চপের পেছনে উড়িয়ে দেয়! আমরা ওকে অঅনেক বলেছি, অঅনেক বুঝিয়েছি! কিন্তু কেএ কার কথা শোনে”!
“সে কী”!
“আর বলেন কেন-
ও শুধু রোজগেরেদের থেকে সামান্য দুয়েক পয়সা নেয়, কিন্তু বাচ্চাদের থেকে ১ নয়া পয়সাও নয়!
দাঁড়ান, আপনাকে একটা জিনিস দেখাই, তবে যদি বিশ্বাস হয়”!
কাকিমা ঘরের ভিতরে চলে গেলে কুসুমদি ভেজা চোখে মা’কে জিজ্ঞেস করল-
“আজ দুটা আলুর চপ যদি তুমার ঘরকে পাঠাইন দিই, তুমি কি রাগ কৈরবেক গ দিদি? তুমার খুকাটু আমার হাতের আলুরচপ বড্ড ভালঅ বাসে গ! তাই বুলচিলাম…..
কাকিমা একটা টিফিন কৌটো নিয়ে এসে বললেন-
“এই দেখুন, কাল রাতে আপনার ছেলের জন্য অপেক্ষা করে করে শেষে এই চপ দুটো ঘরে এনে রেখে দিয়েছে!
আপনিই বলুন দিদি, এটা কি পয়সার জন্য?
কাকিমার কথা শুনে মা’র মুখ থেকে আর একটা কথাও বেরল না! টাকার প্রসঙ্গটা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল!
মা ফিরে এল বাড়িতে!
***
আমার অঙ্ক খাতার সেই পাতাটা মা অনেকদিন নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল!
● খাতাটায় পরপর অনেকগুলো তারিখ ছিল-
●প্রতিটি তারিখের পাশে একটি করে সংখ্যা ছিল-
●সংখ্যাগুলোর যোগফল অসমাপ্ত ছিল-
●অসমাপ্ত যোগফলের জায়গায় বড় একটি শূন্য ছিল-
●”শূন্য” সংখ্যাটি মস্ত একটি সাদাপাতা-জুড়ে ছিল-
●সাদা-পাতাটা অনেকটা রাজহংসের মতো দেখতে ছিল-
আমার কুসুমদিটাই দেখতে শুধু কালো ছিল!
—oooXXooo—