ভিটের টানে ( দ্বিতীয় পর্ব)
সলিল চক্রবর্ত্তী
“প্রখর দারুণ অতি দীর্ঘ দগ্ধ দিন”, মান্না দের বিখ্যাত গানের লাইনটা মনে পড়ে গেল। সকাল থেকে সূর্যের প্রখর তাপ। ঘুম ভাঙলে সকাল আর হচ্ছেনা, সরাসরি দুপুর। ভবখানা যেন সূর্যি মামা বলতে চাইছেন, বাংলাদেশে আমার তেজ কেমন বাইরে বেরিয়ে একটু দেখে যাও। আমি নত মস্তকে সূর্য দেবের কাছে পরাজয় স্বীকার করে দিনের প্রথমার্ধ ব্যালকনিতে কাটিয়ে দিলাম। সত্যি কথা বলতে কি এত ভূমির অপ্রতুলতা যে স্বাভাবিক উদ্ভিদ তেমন আমার চোখে পড়েনি। ফলে নিচে কংক্রিটের জঙ্গল,আর উপরে সূর্যি মামার প্রখর তেজ, ফলে রৌদ্রকরজ্জল গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে খুব প্রয়োজন না পড়লে ভুলেও কেউ বাইরে বার হচ্ছে না। সর্বপরি বর্তমানে চলছে রোজার মাস, দিনের বেলায় চারদিক যেন শুনশান। ঠিক তখনি পেছনে এসে দাড়াল বিপ্র গাঙ্গুলি ওরফে বিপ্র বাবু। অন্তর্যামীর মত বলল, কি ভাবছ দাদু,ঢাকা শহর এত শুনশান কেন? বিকাল হোক ঢাকা শহরের আসল রূপ দেখতে পাবে।
ঢাকা মেট্রসিটি বেশ কয়েকটি এলাকায় ভাগ করা, যেমন উত্তরা,গুলশান,বনানী, বসুন্ধরা ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রতিটি এলাকা আবার সেক্টরে ভাগ করা। নিউ ঢাকা একটা প্লানিং সিটি। প্রতিটি রোডে পরপর একটা করে ছ’তলা বিল্ডিং। সেক্টর অনুযায়ী বিল্ডিং এর উচ্চতা নির্ভর করে। কোলকাতার মতো গলি বা তস্যগলি বলে এখানে কিছু নেই। চিন আর জাপানের কোলাবোরেশানে শহরটি সেজে উঠছে। সব বাড়ি একই কর্পোরেশনের রুলস অফ রেগুলেশন মেনে তৈরি। আমাদের বাসার কাছাকাছি একটা নুতন বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের সামনের অংশ ভাঙার কাজ চলছে, কারন জানলাম, রাস্তার দিকে দুই ফুট বেড়ে যাওয়ায় কর্পোরেশনের এই সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ টাকা দিয়ে কর্পোরেশনের নিয়ম বদলানো যাবেনা। প্রতিটি রাস্তায় চলন্ত রিকশা বর্তমান। বাসা থেকে বেরিয়ে গেটের সামনে এসে মিনিট খানিক অপেক্ষা করতে হয় না ভবঘুরে রিকশা এসে দাড়ায়। শর্ট ডিস্টেন্সে রিকশাই এখানকার প্রধান যানবাহন। এছাড়া প্রাইভেট গাড়ি। এখানে মোট যানবাহনের এগারো শতাংশ প্রাইভেট গাড়ি। গাড়িগুলো নব্বই শতাংশই জাপানি, নাম্বার প্লেট পরিষ্কার বাংলায় লেখা। রোজা মাস চলছে বলে খাবারের দোকান সব পর্দায় মোড়া। হিন্দু ধর্মের মানুষদের পেট তো সে কথা শুনবে না, ফলে স্নানের প্রস্তুতি নিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম।
দুপুরে খেতে বসার আগে তমা লজ্জিত ভাবে বলল-” মেসো, আজ বিকালে গ্যাসের লাইন চালু হয়ে যাবে, আপাতত রাইস কুকারে তৈরি সেদ্ধ ভাত খাওয়াচ্ছি।” আমি ওকে আস্বস্ত করে বললাম, উদর ভোজনে খুশি,গুনগত মান নির্ণয় করে জিহ্বা। ভেবনা আমি নিরামিষ ভালবাসি, এই বলে খেতে বসে সেদ্ধ ভাতের বহর দেখে আমি স্তম্ভিত। প্রায় দশ বারো রকমের ভর্তা দিয়ে খাবার সাজানো। সেদ্ধ যে এত সব্জীর হয়, আজ না দেখলে আমি বিশ্বাসই করতাম না। খেতে-খেতে তমাকে বললাম, গ্যাস নেই তাতেই এত পদ,গ্যাস এলে তো খাওয়ার ভয়ে পালাতে হবে। তমা হেসে বলল-” পালাবেন কোথায়? ‘টকের ভয়ে পালিয়ে এসে তেঁতুল তলায় বাস’।” কাজ নেই, কর্ম নেই, এতো খেলে হজম হবে কিভাবে! আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বিপ্র বাবু বলল-” চিন্তা কোরো না দাদু, বিকালে তোমাকে কাছাকাছি এলাকাটা পায়ে হাঁটিয়ে ঘুরিয়ে আনব।”
সন্ধ্যা ছ’টা কাছাকাছি স্বপ্ন নামে একটা মলে ঢুকে পড়লাম। আমাদের কোলকাতার মলের সাথে দ্রব্যমূল্য ছাড়া বিশেষ কোন পার্থক্য দেখলাম না। কেনা বেচাই আমার পেশা, যেহেতু জিনিস পত্রের দরদামে আমি ওয়াকিবহাল, ফলে আমি যথেষ্ট বিস্মিত হলাম। মনে হল আমি ঢাকাতে আছি না নিউইয়র্ক! উদাহরণস্বরূপ, একটা ডাব বা নারকেল,১২০ টাকা। একটা গন্ধরাজ লেবু ৩০ টাকা, পাঁচশো গ্রাম কচুর লতি ১০০টাকা, মাছের নাম বললাম না,কোলকাতার বাজার দরের তিন গুন। যে ইলিশ,চিংড়ি, কাঁকড়ার জন্যে বাংলাদেশ বিখ্যাত তার দাম কোলকাতার থেকে অনেক, অনেক বেশি। মিষ্টি ৬৫০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা কেজি। দই ৪৫০ টাকা কেজি। ফলে হাত দেওয়া আর আগুনে হাত দেওয়া একই ব্যাপার। তবে পেয়ারা আর সিলেটি আনারস তুলনা মূলক ভাবে সস্তা। দ্রব্যমূল্য নিয়ে আর বললাম না, তাহলে একটা পর্ব শেষ হয়ে যাবে। মোদ্দা কথা, সমস্ত বিশ্ব ঘুরলেও কোলকাতার থেকে বাজার দর সস্তা আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। তার অনেক কারনের মধ্যে মূল কারন হল, কমপিটিশন, ফলে মিনিমাম মার্জিনে দ্রব্য বিক্রয়,সর্বপরি দ্রব্যের যোগান। যাইহোক, খালি হাতে এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া আমার কাছে অভদ্রতা মনে হল। সুতরাং সাড়ে আটশ গ্রাম ওজনের একটা দৈত্যাকার পেয়ারা আর একশো টাকায় চারটি আনারস কিনে মল থেকে বেরিয়ে এলাম। শুনলাম রমজান মাস বলে আগেই বিক্রি হয়ে গেছে,তা না হলে এক কেজি ওজনের পেয়ারা কিনতে পারতাম।
ফিরে আসি ঢাকার প্রসঙ্গে। যা বুঝলাম, ঢাকায় বসবাসকারী মানুষের মাসিক আয় সর্বনিম্ন এক লাখ টাকা হতে হবে, না হলে এখানে বসবাস করা মুশকিল।
বর্তমানে এখানে একটা শ্লোগান চারদিক মুখরিত করে তুলেছে- “ভারতীয় দ্রব্য বর্জন।” কিন্তু ব্যবসায়ীরা নির্বিকার। ডাক দিয়েছে এখানকার বিরোধী এক রাজনৈতিক দল। রুলিং পার্টির বক্তব্য এটা বিরোধী পক্ষের অস্তিত্ব রক্ষার ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক ইসু। আমি অতশত রাজনীতি বুঝি না। তাছাড়া বিদেশে এসে রাজনীতি নিয়ে মন্তব্য করাও আমার পক্ষে সমিচিন নয়। বুঝি সামান্য অর্থনীতি, সেই সূত্রে অল্প কথায় কিছু বলতে গেলে আমার ব্যাক্তিগত অভিমত, বৈদেশিক দ্রব্য বর্জনের পক্ষে। কারন, আমদানি কমিয়ে রপ্তানি বাড়াতে পারলে দেশের ভিত মজবুত হয়। তবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দ্রব্যটি দেশের চাহিদা অনুযায়ী যোগানে স্বনির্ভর কিনা অবশ্যই দেখতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় বাধ্য হয়ে চাহিদার পঞ্চাশ শতাংশ আমদানি করতে হচ্ছে, কারন, যখন উৎপাদন মূল্য আমদানি মূল্যের থেকে অনেক বেশি। আমদানি খরচ সর্বনিম্ন করার জন্য নিকটতম রাষ্ট্রের উপর নির্ভর করতে হয়। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান অনুয়ায়ী যতগুলো স্থলপথে বর্ডার আছে তার সিংহ ভাগ ভারতের দিকে, ফলে ভারত থেকে আমদানি করলে সর্বনিন্ম খরচ পড়ে।
শুধু বাংলাদেশ নয়, এই নিতির উপর নির্ভর করে বিশ্বের স্বয়ম্ভর দেশ গুলোও দ্রব্য আমদানি করে। এবং এই সিস্টেমের উপর ভরসা করে বাংলাদেশ, ভারত, চিন,জাপানের সহযোগিতায় উত্তরোত্তর উন্নতি করে চলেছে।
২৯/০৩/২৪
বিকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আমরা পাঁচজন রাস্তায় বার হতেই যেমন আম, কাঁঠাল পাকলে তার গন্ধে কোথা থেকে ডুমো-ডুমো সবুজ মাছি চলে আসে ঠিক তেমনি সামনে চলে এলো একটা প্যাডেল রিকশা। আমরা পাঁচ জন দেখে প্রশ্ন না করেই বোতাম সেলফোন থেকে একটা ফোন করল। মিনিট খানিকের মধ্যে দুটো মটর লাগানো রিকশা চলে এলো। গন্তব্য স্থান সেক্টর সেভেন পার্ক।
আমি প্যাডেল রিকশায় উঠলাম। চালক বছর পঁয়ত্রিশের এক মুসলিম যুবক। আসুরিক শক্তি দিয়ে মটর লাগানো রিকশা দুটির সাথে পাল্লা দিয়ে চালাচ্ছে। রোড থেকে মেন রোড অতি সুন্দর পরিষ্কার ঝকঝকে। ১৪৬৩.৬০ বর্গ কিলোমিটার বা ৫৬৫ বর্গ মাইল আয়তন যুক্ত ঢাকার প্রতি বর্গ কিলমিটারে বসবাস করে প্রায় ২৩০০০ হাজার মানুষ। ঢাকার মেট্র সিটির মোট জনসংখ্যা ২০৫৭৭৩৬১ জন। জন ঘনত্বের বিচারে বিশ্বে এক নম্বরে অবস্থান করলেও আনফরচুনেটলি বিশ্বের সবচেয়ে ধীর গতির শহর বলা হয় দক্ষিণ এশিয়ার এই ঢাকা মেট্র সিটিকে। তার অবশ্যই অনেক গুলো কারণ আছে,তবে আপাত দৃষ্টিতে দুটি কারন আমার নজরে এসেছে। এক, রাস্তার অপ্রতুলতা, ট্রাফিক পুলিশ ও সিগনালিং এর অব্যবস্থা। যেটা বর্তমান সরকার আন্তরিকতার সাথে উন্নতি করার চেষ্টা করছে। দুই, ঢাকা শহরকে রিকশার নগরী বলা হয়, কারন সমস্ত শহর জুড়ে রিকশার প্রতুলতা। ঢাকা মেট্র সিটির যানবাহনের উনপঞ্চাশ শতাংশ রিকশা। যার উপর নির্ভর করে বারো থেকে পনেরো লাখ রিকশা চালক তাদের পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছে। ফলে বিনা পুনর্বাসনে রিকশা তুলে দেওয়া যুক্তি যুক্ত নয়। শুধু তাই নয়,এখানে রিকশা জাতীয় বাহন রূপেও অগ্রাধিকার পায়। পৃথিবীর বড়বড় শহর গুলোতে যখন রিকশা নিষিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, ঢাকা মেট্র সিটিতে তখন রিকশা স্বসম্মানে রাজত্ব করে চলেছে। এমন একটা যানবাহনের ইতিহাসটাও আমাদের অল্প কথায় জেনে নেওয়া ভালো —-
রিকশা আবিষ্কার নিয়ে মতভেদ আছে। কিছু ইতিহাস বিদের মতে রিকশা আবিষ্কার হয়েছিল জাপানে,আবার কেউ কেউ বলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আমি যেটুকু স্টাডি করেছি–এক মার্কিন ক্রিশ্চিয়ান মিশনারী, নাম জেনথান গোবলে রিকশার ডিজাইন করেন জাপানে বসে। এবং ডিজাইন করাটা তাঁর কাছে এক আকর্ষিক ঘটনা ছিল। মিস্টার জেনথান গোবলে ধর্ম প্রচারের কাজে সস্ত্রীক জাপানের ইয়োকোহামা শহরে থাকতেন। মিস্টার জেনথান গোবলের স্ত্রী এলিজা গোব
লে ছিলেন পোলিও রোগাক্রান্ত, পঙ্গু,একেবারেই হাঁটতে পারতেন না। এদিকে কৃত্রিম ও অকৃত্রিম শোভায় সজ্জিত ইয়োকোহামা শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিস্তারিত বর্ননা শুনতে শুনতে এলিজা গোবেল স্বামীকে অনুরোধ করলেন যে, তাঁকে যেন শহরটা একটু ঘুরিয়ে দেখানো হয়। হৃদয়বান মিস্টার জোনথান গোবলে অক্ষম স্ত্রীর ইচ্ছা পূর্ণ করতে ১৮৬৯ সালে দুই চাকার সামনে হাতল বিশিষ্ট বাহনের নকশা আঁকেন, এবং কাঠ দিয়ে তার বাস্তব রূপ দেন। তিনি বাহনটির নাম দেন জিনরিকশা। যা কালের বিবর্তনে রিকশা নামেই পরিচিতি পায়। তবে তখন ছিল সব টানা রিকশা। সেই রিকশারও বিবর্তন ঘটে। ১৯৩০ সালে কোলকাতায় প্রথম টানা রিকশার পাশাপাশি চালু হয় প্যাডল রিকশা। সেখান থেকেই ঢাকা সহ কয়েকটি শহরে চালু হয় প্যাডেল রিকশা, সময়টা ছিল ১৯৩৭ সাল। সেই সুরু বাংলাদেশের প্যাডেল রিকশার পথ চলা। বলে রাখা ভালো,টানা রিকশা ঢাকা শহরে কখনো ছিলোনা।
কথায় কথায় চলে এলাম সেক্টর সেভেন পার্ক। বিনামূল্যে প্রবেশাধিকার, সান্ধ্যনগরী, চায়না আলোতে সুসজ্জিতা পার্কের সান্ধ্যকালিন মায়াবী রূপ আমাদের মুগ্ধ করল। এখানে টেলিফিল্মের আউটডোর শুটিং হয়। তবে পার্কটি আমার খুব ভালো লাগার দুটি কারনের একটি হল, কংক্রিটের জঙ্গলে যেন ওয়েসিসের দেখা পেলাম, দুই সেই মরুদ্যানের উদ্ভিদরাজি- আম,কাঁঠাল,জাম,জামরুল, সবেদা কুল ইত্যাদি ইত্যাদি, যেটা সাধারনত কোনো ফাইভ স্টার পার্কে দেখা যায় না। দেখা যায়, ফুলের বাগান। আমরা সেটা থেকে-ও বঞ্চিত হইনি। আমরা সেখানে ঘন্টা খানিক থেকে অন্য সকলের মতো কিছু সেলফি তুলে সমাজ মাধ্যমে পোস্ট করলাম। ফেরার সময় ওখানকার ফুচকা খেতে ভুললাম না।
৩০/০৩/২০২৪
মধ্যাহ্ন ভোজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই চায়ের টেবিলে ব্রেকফাস্ট চলছে। এগারোটা নাগাদ ডোর বেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই দেখি প্রবাসী ভারতীয় রবীন হালদার মহাশয়ের একমাত্র সুযোগ্য পুত্র রজত হালদার ঢাউস এক সফ্ট ড্রিংকসের বোতল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখতে পেয়েই – “গুড মর্নিং কাকু, রেডি তো?”
— ভেরি গুড মর্নিং, কিন্তু এ-সব কি (সফ্ট ড্রিংকসের বোতলটা দেখিয়ে)!
— আমি জানিনা মা, বলে দিয়েছেন। (ভিতরে প্রবেশ করে) জানি আপনারা কিছু না খাইয়ে ছাড়বেন না,কুইক দুধ,চিনি ছাড়া এক কাপ লাল চা।
সকলে মিলে চা পান করে সাড়ে এগারোটা নাগাদ রওনা দিলাম। বছর চল্লিশের রজত হালদার একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। আসেন্টিস ইণ্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডে কোম্পানির এমপ্লয়ি। কোম্পানি দুই বছরের জন্য বাংলাদেশে ডেপুটেশনে পাঠিয়েছে। বর্তমানে ঢাকা গুলশনের নিকেতন হাউজিং কমপ্লেক্সে কোম্পানির দেওয়া ফ্লাটে বসবাস করে।
টোল চার্জ দিয়ে, চাইনিজ কোলাবোরেশনে ঝাঁ চকচকে রাস্তা ধরে জাপানি এসি টওটা গাড়িটি সাঁইসাঁই করে ছুটে চলেছে গুলশানের দিকে। ড্রাইভার মধ্য বয়সি এক মুসলিম ভদ্রলোক।
হঠাৎ ড্রাইভার সাহেবের সেলফোন বেজে উঠল—
—হ্যালো।
— হ্যালো,আপনি রেজাউলের আব্বা বলতিছেন?
— হ্যাঁ বলতিসি, ফোন দিলেন কেন? সমস্যা কি বলেন।
—রেজাউল স্কুলে তো ঠিকমতো আসতোই না। সামনে পরীক্ষা, এখন স্পেশাল ক্লাসও করতে আসতেছে না।
— (একটু উত্তেজিত হয়ে) আজ যাইনি?
— না, ওকে ফোন দিলাম, রিসিভ করল না। ওর আম্মুকে ফোন দিলাম, না পেয়ে আপনাকে—।
— শুনুন মাস্টার, আমি আধা ঘন্টার মধ্যে পোলারে আপনার ওখানে পাঠাচ্ছি, ও না যাওয়ার কারন জানতি চাবেন না। সময় মতো যায়নি বলে চরম শাস্তি দেবেন। আমি বাড়ি গিয়ে দেখি যেন ওর হাতে রক্ত জমে আছে। যন্ত্রনা যত বাড়বে,পড়তে না যাওয়ার কথা তত মনে থাকবে।
—- না মানে এখন তো—
— (একই উত্তেজনা নিয়ে) আরে রাখেন আপনাদের সরকারি নিয়ম, গোল্লায় গেল দেশটা। আমি রেজাউলের বাপ, আমি আপনারে বলতিসি। যা বললাম পারেন তো ভাল, না পারলে আমারে আর ফোন দেবেন না। আমি রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছি, রাখলাম।
গাড়ি চালাতে চালাতে ফোন ডিসকানেক্ট করে আবার ফোন করে, রিং হয়ে যায়। না ধরায়, বিরক্ত হয়ে পুনরায় ফোন করে। কয়েকবার রিং হওয়ার পর অপর প্রান্তে ফোন রিসিভ করে।
— হ্যালো??
— (অতি উত্তেজনায়) কোথায় ছিলা?
— খালুর ঘরে ঝামেলা বাধছে–
— তুমি মেটাইতে গেছিলা, তাই তো?
— না মানে–
—না মানে কি,নিজের সংসার চুলায় যায়, তুমি যাও পরের সংসার সামলাইতে।
— কি উলটা পালটা কইছ!
— উলটা পালটা কওনের লগে তোমাকে ফোন দেইনাই। হকাল হকাল দুশো টাকা চাইলা রেজাউল চুল কাটাবো বইলা, পোলাডা যে পড়তে যাইনি সে খেয়াল আছে?
— কইল যে ছুটি!
— ছুটি, কোই হারামজাদা?
—ঘরে, মোবাইল দেখছে।
— আমি বাড়ি যাই, মোবাইল ঘাঁটা জম্মের মতো ঘোচাব। শোন, এক্ষুনি রেজাউলকে পড়তে যেতে বল। আমি আধা ঘন্টা পরে মাস্টারকে ফোন দিয়ে জেনে নেব। যদি না যায় আমি বাড়ি গিয়া তোমার আর ওর দুইডা মোবাইল চুলায় ফ্যালায়ে জ্বালাইয়া দিবো। এই ক্যয়া দিলাম।
আমি স্তম্ভিত হয়ে ফোনের কথপোকথন শুনছিলাম। একেই বলে শাসন, এই না হলে বাবা!! আমরাও সন্তান মানুষ করি,শাসন শিকেয় তুলে। স্কুলে মাস্টারদের এখন আর শাসন করার অধিকার নেই। যদি করে ফেলে তো আমরা এফ আই আর পর্যন্ত করি। যাইহোক ফোন রেখে তুলনা মূলক নরম সুরে রজতকে বলল-” যানেন স্যার, নিজে বেশি লেখাপড়া শিখতে পারিনি। দুই হাত দিয়ে ছেলেটার লেখাপড়ার জন্যে খরচ করি,যাতে ও একটু মানুষ হয়। কিন্তু ঘরের মেয়েছেলে যদি ভাল না হয় –। রজত পরিস্থিতিটা হালকা করতে বলল-” না না, মায়েরা আর কি করবে, এখনকার জেনারেশন মা বাবার কথা শোনেই না।” না স্যার, আপনি জানেন না। ঘরের লোকের আস্কারায় পোলাপান গোল্লায় যাচ্ছে। এই দেখুন, আমি দুবাইতে একটা হোটেলে শেফের কাজ করি। এখন ছ’মাসের ছুটিতে বাড়ি আছি, তা বসে থাকব, গাড়িটা কিনে চালাচ্ছি। চলে যাওয়ার সময় কোম্পানিতে ভাড়া দিয়ে যাব। আরে বসে খেলে তো রাজার ধনও শেষ হয়ে যায়। ছেলেটাকে বললাম, ড্রাইভিংটা শেখ, তা নয় ওকে স্মার্ট ফোন কিনে দিতে হবে। আমি দিতে চাইনি, পোলার থেকে পোলার আম্মুর বায়না বেশি। শেষ পর্যন্ত পঞ্চাশ হাজার টাকার ফোন কিনে দিতে হলো।
কথায় কথায় ঘন্টা খানিকের মধ্যে আমাদের গাড়ি একটা হাই রাইজ বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়াল। লিফটে করে সম্ভবত সিক্সথ ফ্লোরে গিয়ে উঠলাম। অটো সিস্টেম চায়না লিফট ওপেন হতেই দেখি, লিফটের সামনে দণ্ডায়মান, দাদা রবীন্দ্রনাথ হালদার, রিতা বৌদি,বৌমা অর্পিতা ও তাঁদের আড়াই বছরের যমজ নাতি জয়মাল্য ও নাতনি জয়স্মিতা। ওনারা আমার পূর্ব পরিচিত, কিন্তু আমার স্ত্রীর নয়। ফলে আমার স্ত্রীর মনটা একটু কিন্তু কিন্তু করছিল। সেই পরিস্থিতিটা রিতা বৌদি এক মুহূর্তে ভেঙে খানখান করে দিলেন। আমার স্ত্রীকে এমন ভাবে জড়িয়ে ধরলেন যেন বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে বিশ বৎসর পর ছোটো বোনের সাথে দেখা হল। রবিনদা হাসি মুখে এই মধুর মিলন যেন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন। আমি বিস্মিত। নির্বাক দৃষ্টিতে ছোটো-ছোটো দুটি শিশু জয়মাল্য ও জয়স্মিতা তাকিয়ে আছে, একটু যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। পরিস্থিতিটা তাদের কাছে খুব সড়গড় নয়। রবিনদা নাতিকে বললেন-” তোমাদের একটা দাদু আর একটা আম্মা।” ছোট্ট জয়মাল্য দাদুর কথা শেষ না হতেই বলল -“অন্য আম্মা,অন্য দাদু।” সকলে হো হো করে হেসে উঠল। অর্পিতা মুখ ভরা হাসি নিয়ে বলল-” সবাই ভেতরে চল, এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি!”
হাইফাই মডিউলার থ্রি বি এইচ কে ফ্লাট। পনেরোশো স্কয়ার ফিট্ তো হবেই। সাজানো ফ্লাট, কি নেই সেখানে। চা পানের কাপ প্লেট পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছে। রবিনদা হাসতে হাসতে বললেন-” আমরা শুধু জামা কাপড় গুলোই ইন্ডিয়া থেকে এনেছি।” আমি দেখে মুগ্ধ, রজতকে ভাড়া কত জিজ্ঞেস করতে ও হেসে বলল-” আশি হাজার টাকা, আমাকে পে করতে হয়না বলে থাকতে পারছি।” রবিনদা হাসতে হাসতে বললেন-” ডিরেক্ট পে করতে হয়না ঠিকই, প্যাকেজে ইনক্লুড হয়ে আছে।” গুলশান এলাকায় বাংলাদেশের বেশিরভাগ নেতা মন্ত্রীদের বসবাস। এই বিল্ডিংয়ের কয়েকটা পরের বিল্ডিংয়ে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী খালেদা জিয়া থাকেন।
দুপুরে খাওয়ার সময় বৌদি যা খাবার সাজিয়েছেন তা দেখে মনে হচ্ছে যেন নুতন জামাই এসেছে প্রথমবার জামাই ষষ্ঠীতে। আমি অবাক হয়ে বলি-” এখানকার মানুষ না হয় জানেনা, কিন্তু আপনি তো জানেন কোলকাতার লোক সাধারণত তিন পদের বেশি খেতে পারে না।” বৌদি হেসে জবাব দিলেন-” যষ্মিনদেশে যদাচার, কাছা খুলে নদী পার। আমাদেরও তো ইচ্ছে করে। আমরা মা মেয়েতে মিলে রান্না করেছি,এখন আপনারা তৃপ্তি করে খেলে আমাদেরও তো ভালো লাগবে।
আমার স্ত্রী কাছে ডাকলে জয়মাল্য আর জয়স্মিতা কিছুক্ষণ আমার স্ত্রীর কাছাকাছি না এসে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ সম্পর্কে থাকল। তারপর একসময় মায়ার সমুদ্রে এমন ঝাঁপ দিলো যে অর্পিতা ওদের আর দুপুরে ঘুম পাড়াতে পারছিল না। দুপুরে আমরা কেউই বিশ্রাম নিলাম না। বিদেশে বসে কলকাতার গল্প করতে বেশ ভাল লাগছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় টুকু সকলে মিলে চেটেপুটে উপভোগ করলাম। রিতা বৌদি মনেপ্রাণে চাইছিলেন আমরা অন্ততপক্ষে একটা রাত কাটাই। পরদিনের প্রোগ্রাম সেট হয়ে থাকার জন্যে কথা রাখতে পারলাম না। সত্যি কথা বলতে দ্বিধা নেই,পূর্ব সম্পর্কটা যেন নিখাঁদ খাঁটি সোনায় পরিনত হল। ওনাদের আতিথিয়েতা প্রমান করল, রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও একাত্ম হওয়া যায়।
সন্ধ্যার পর কথামতো গাড়ি চলে এলো। এবার আমাদের ফেরার পালা। জয়মাল্য, জয়স্মিতার খেলার আকাশে মেঘের ঘনঘটা। মেঘ আমাদের মনেও কম জমেনি। রিতা বৌদির চোখের কোনায় অশ্রু বিন্দু চিক চিক করে উঠল। ছোট্ট দুটি শিশুরও এমন সিচুয়েশন যে একদম পছন্দ হচ্ছেনা সেটা ওদের মুখো মন্ডল বুঝিয়ে দিচ্ছে। অগত্যা এমন একটা মনোমুগ্ধকর পরিবেশকে নিরুপায় হয়ে বিদায় জানাতে হল।
গাড়িটা যতক্ষণ পর্যন্ত জয়মাল্য ও জয়স্মিতার চোখের আড়াল না হলো, ততক্ষণ আমাদের নজরে আসছিল কচি কচি দুটি হাত নেড় বিদায় জানিয়ে চলেছে।
+++++++(ক্রমশ)+++++++