ভারতীয় ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টের রুলস অফ রেগুলেশন মোতাবেক বডি – লাগেজ চেকিং, পাসপোর্টে শিলমোহর বসিয়ে কোলকাতা স্টেশনের প্লাটফর্মে প্রবেশ করলাম সকাল সাড়ে ছটায়। ইন্টারন্যাশনাল মৈত্রী এক্সপ্রেস দৈত্যের মতো চেহারা নিয়ে ইঞ্জিনের গোঁ গোঁ শব্দে প্লাটফর্মের সামনে দণ্ডায়মান, সময় মতো যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরুর অপেক্ষায়। সস্ত্রীক, টিকিটে কোচ নাম্বার ‘বি১’ দেখে কোচের গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেট খোলার অপেক্ষায় থাকলাম। পৌনে সাতটায় কন্ডাকটর এসে গেট খুলে টিকিট চেক করে ট্রেনের ভিতরে প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিল। ধীরে ধীরে ভিতরে প্রবেশ করে আসন নাম্বার দেখে আসন গ্রহন করলাম। ভেবেছিলাম এক্সপ্রেস ট্রেনটি ইন্টারন্যাশানাল ট্রেন হওয়ায় অন্তত একটা লাক্সারি ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন থাকবে। হতাশ হলাম ভারতীয় নরমাল এক্সপ্রেস ট্রেনের সাথে কোনো পার্থক্য না দেখে। যাইহোক পাঁচ মিনিট বিলম্বে সাতটা পনের মিনিটে ট্রেন ছাড়ল, ডেসটিনেশন স্টেশন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, ভায়া গেদে।
কাকভোরে এক কাপ চিনি ছাড়া লাল চা খেয়ে বেরিয়েছি। আই আর সি টি সির একজন পরিসেবক ‘কফি’ বলে যেই হাঁক পাড়ল, মনটাও কফি খাওয়ার বায়না ধরল। অদম্য বায়নার কাছে পরাজিত হয়ে কুড়ি টাকা দিয়ে এক লিটার জল কিনলাম, সাথে ফ্রী পেলাম পাঁচ টাকার একটা চকোলেট এবং দুটো কফি, মূল্য তিরিশ টাকা। ট্রেন ছুটছে, কফি খেতে-খেতে মনের মধ্যে গুটি কয়েক ভাবনার উদয় হল,সেটাই শেয়ার করি– আমার জন্ম সুন্দরবন এলাকার হিঙ্গলগঞ্জে। অর্থাৎ জন্মসূত্রে আমি ভারতীয়, তবে স্বর্গগত বাবা-মা এর জন্ম ওপার বাংলার খুলনায়। মজার ব্যাপার হলো তাঁরা যখন এপার বাংলায় চলে আসেন, সেটা ছিল ১৯৪৫ সাল সম্ভবত। অবিভক্ত ভারত, পাকিস্তানেরই জন্ম হয়নি, তো বাংলাদেশ। ফলে আমার যে খুব বাংলাদেশে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল তা নয়। তবে আমার স্ত্রীর জ্ঞান চক্ষুর উন্মেষ ঘটেছে ওপার বাংলার সাতক্ষীরায়, ফলে নাড়ীর টান যে একটা থাকবে সেটা বলাইবাহুল্য। এমনি ইচ্ছা অনিচ্ছার মধ্যে এসে গেল মা সরস্বতীর আশীর্বাদে এক অনাকাঙ্ক্ষিত সুবর্ণ সুযোগ। পেশার পাশাপাশি অল্পস্বল্প লেখার নেশায় গোটা দুয়েক বই প্রকাশিত হয়েছে যার একটি বই (রামধনু) শ্রদ্ধেয় দেবব্রত গুহ মহাশয়ের হাত ধরে বাংলাদেশের ফিল্ম ডাইরেক্টর শৌর্যদীপ্ত সূর্য, ওরফে পিযুষ কুমার দাস মহাশয়ের হাতে পড়ে। বই এ-র ছোট গল্পগুলো পড়ে তাঁর পছন্দ হয় এবং তিনি টেলিফিল্ম করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সেইসূত্রে আমার বাংলাদেশ ভ্রমণের এই উদ্যোগ।
এক দমে সকাল ৯ টা ১০ মিনিটে গেদে পৌঁছে মৈত্রী এক্সপ্রেস প্রথম নিশ্বাস ফেলল। কারন কোলকাতা স্টেশন ছাড়ার পর এই প্রথম ভারতের সীমান্তবর্তী স্টেশন গেদে এসে দাঁড়াল। এখানে ভারতীয় রেল কর্মীরা সব ট্রেন থেকে নেমে গেল, এক মাত্র চালক ছাড়া। তবে কোন যাত্রীর প্লাটফর্মে নামার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। মিনিট কুড়ি দাঁড়িয়ে ন’টা তিরিশ মিনিট নাগাদ ট্রেন ছাড়ল নোম্যান্সল্যান্ডে ক্রস করে বাংলাদেশের প্রথম স্টেশন দর্শনার উদ্দেশ্যে। মনটা উৎফুল্লই ছিল,হঠাৎ কেন জানি অতি উৎফুল্লতায় চিত্ত বিগলিত হয়ে উঠল। মনে হয় একেই বলে পূর্ব পুরুষের ভিটের টান। এক ঝাঁক বক দর্শনার দিক থেকে উড়তে উড়তে গেদের দিকে চলে গেল। এরা জন্ম নিয়েছে ভারত বা বাংলাদেশে নয়, এই পৃথিবীতে, যেটা ব্যাক্তিগত কারোরই সম্পত্তি নয়,সমগ্র প্রাণীকুলের। ফলে কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে ওদের আটকানো যায়না, বিচরন ওদের সমগ্র। এদিকে মিনিট পাঁচেক চলে ৯ টা৩৫ মিনিট নাগাদ ওপার বাংলার সীমান্তবর্তী প্রথম স্টেশন দর্শনাতে পৌঁছুল। এখানেও যাত্রীদের ট্রেন থেকে নামার কোনো সুযোগ নেই। যাত্রীদের পরিসেবা দিতে বাংলাদেশ রেলের স্টাফরা উঠল। মিনিট পঁচিশ দাঁড়িয়ে ১০-০০ টা নাগাদ ট্রেন ছাড়ল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশ্যে।
“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রানে বাজায় বাঁশি, সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি ——“ আরে,আমি গুনগুনিয়ে কখন রবি ঠাকুরের লেখা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে চলেছি আমি নিজেই বুঝতে পারিনি। এটাই মনে হয় জিন ঘটিত পূর্ব পুরুষের ভিটের অমোঘ আকর্ষণ, অবচেতনে আমার মনকে জানতে না দিয়ে মুখ দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। তেঁতুল বিছের মতো দৈত্যাকার ট্রেনটা এঁকে বেঁকে হুহু করে ছুটে চলেছে। মনটা হাওয়ার মতো ফুরফুরে হয়ে আছে। কাজের চাপে পরিবারের সাথে বাড়তি কথা প্রায় হয়-ই না, এই সুযোগে স্ত্রীর মনে এই মুহুর্তে উঁকি মারা স্মৃতি গুলো বার করে আনার চেষ্টা করলাম। এরিমধ্যে ‘জল, জল’ বলে এগিয়ে এলো রেলের স্টাফ। দাম শুনে তাজ্জব,এক লিটার জল বাংলাদেশি টাকায় চল্লিশ টাকা। কোথায় পনের,কোথায় চল্লিশ,ডাহা লস,বাধ্য হয়ে কিনলাম,খরচা করতেই তো এসেছি ভেবে লাভ নেই। বয়টিকে জানালাম আমাদের কাছে বাংলাদেশের টাকা নেই। ছেলেটি হেঁসে জবাব দিল-” কিচ্ছু ভাববেন না স্যার, ঢাকা পর্যন্ত আপনার সাথে আছি, পাশেও আছি। পরে মানি এক্সচেঞ্জ লোক এসে আপনাকে বাংলাদেশের টাকা দিয়ে যাবে। দুই জনেই চুপচাপ। ননস্টপ ট্রেন ছুটছে, কখন আবার মনটা গুনগুনিয়ে উঠল— “ধনধান্যে পুষ্পে ভরা,আমাদের এই বসুন্ধরা, তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা। ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে যে, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।” আবার মনে একটা খটকা লাগল, দীজেন্দ্রলাল রায়ের গানের লাইনগুলো কেন মনে গুনগুনিয়ে উঠল!! জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, কেন গানের লাইনগুলো মাথায় এল — দুই দিকে যতদুর চোখ যায় কচি ধানের ক্ষেত সবুজে সবুজ। সরু আলদিয়ে কৃষক চলেছে মাথায় ধান গাছ নিয়ে। বড় একটা বিলকে চিরে দুই ভাগ করে দিয়েছে ফুট তিনেকের একটা সর্পিল লম্বা পথ। যে পথে এক রাখাল বালক মুখে ঠুসি বেঁধে গোটা কতক গরু ছাগল নিয়ে চলেছে চরানোর উদ্দেশ্যে। দুরে বিলের মধ্যে বিছিন্ন ভাবে বেশ কয়েকটি শ্যালো মেশিন ভটভট শব্দে ধানক্ষেতে জল দিচ্ছে। দু’জন চাষি বৌ পান্তাভাত গামছায় বেঁধে মাথায় নিয়ে চলেছে ক্ষুদার্ত স্বামীদের কাছে। ডি এল রায় যখন গানটি লেখেন তখন কোথায় পূর্ব পাকিস্তান! কোথায় বাংলাদেশ! জাতি, ধর্ম, একাত্ম হয়ে স্বমহিমায় বিরাজমান সমগ্র ভারতবর্ষ। এরি মধ্যে কফি এল হাঁকতে হাঁকতে। দুটো কফি নিয়ে দাম জানতে চাইলে শুনলাম ষাট টাকা বাংলাদেশের মুদ্রায়। অর্থাৎ আগে তিরিশ এবার ষাট, এবারও লস। ক্ষতির কথা না ভেবে কফি পানে মন দিলাম। কফি খেতে-খেতে স্ত্রীর সাথে বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার কল্পনাটা কেমন ম্যাচ করছে সেটাই আলোচনা করছি, এরিমধ্যে টাকা এক্সচেঞ্জ করতে আসলে ভারতীয় এক হাজার টাকা দিলাম, তিনি আমাকে ফেরত দিলেন বাংলাদেশের তেরশ টাকা। টাকাটা হাতে পেয়ে মনটা বলে উঠল,”যাক বাবা এবার তিন’শ টাকা লাভ হল।” আসলে সবটাই মজা করেই লিখছিলাম। ডলারের নিরিখে বাংলাদেশের একশো টাকা ভারতের সত্তর টাকার সমান। তারউপর খুচরো কেনা বেচায় স্থান কাল অনুযায়ী একটা পার্থক্য তো থাকেই। আমার ভবনার মধ্যেই ট্রেন ছুটে অনেকটা পথ চলে এসেছে। হঠাৎ গতি অনেক কমিয়ে ট্রেনটির গতিশীল চাকা স্পর্শ করল বঙ্গবন্ধু সেতু। যমুনা নদীর উপরে অবস্থিত একত্রীত রেল ও সড়ক সেতু। ৪.৮ কি:মি দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট এই সেতুটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সেতু। যমুনা নদীর পূর্ব তীরে টাঙ্গাইল জেলার ভূঞাপুর এবং পশ্চিম তীরের পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জকে যুক্ত করেছে। মিনিট কুড়ি চলার পর পার হল যমুনা সেতু। যদিও পাশেই নুতন রেলসেতুর কাজ চলছে এক চিনা কোম্পানির দায়িত্বে। বাংলাদেশের এক সহযাত্রী বললেন চালু সেতুটি সড়ক এবং রেলের ভার বহন করতে পারছে না। চুয়াডাঙা,ঈশ্বরদি,টাঙ্গাইল, ভূঞাপুর, সিরাজগঞ্জ ইত্যাদি স্টেশন গুলেকে পিছনে ফেলে মৈত্রী এক্সপ্রেস সাই-সাই করে এগিয়ে চলেছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দিকে। বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা। আমরা সকলেই হয়তো জানি, পূর্বে ঢাকা ছিল সমগ্র বাংলার ( অধুনা দুই বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা) রাজধানী, এবং এই শহরের নাম তখন ছিল জাহাঙ্গীর নগর। কারণ ১৬১০ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সুবেদার ইসলাম খান চিশতি ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থাপন করেন। সেই প্রথম ঢাকা রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। সুবেদার ইসলাম খান চিশতি জাহাঙ্গীরের নামানুসারে ঢাকার নাম পরিবর্তন করেন। তারপর পদ্মা,যমুনা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। শেষে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলে, ঢাকা শহর পুনরায় তার রাজধানীর কৌলিন্য ফিরে পায়। যদিও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ছিল ঢাকা।
আমার ঘড়িতে বিকাল চারটে পনের, বাংলাদেশের সময় ভারতের সময়ের থেকে আধ ঘন্টা এগিয়ে থাকায় পৌঁনে পাঁচটায় মৈত্রী এক্সপ্রেস ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে পৌঁছুল। প্লাটফর্ম ট্রেনের পাদানি থেকে অনেকটা নিচু হওয়ায় সিঁড়ি দিয়ে নামতে একটু সমস্যা হল বটে,তবে ছোটখাট নানা সমস্যার মতো মেনে নিলাম। যাইহোক লাগেজ নিয়ে অভিবাসন দফতরে গিয়ে পুনরায় পাসপোর্টে বাংলাদেশের সিলমোহর লাগিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলাম। বাইরে একটা সিএনজি ভাড়া করে এক গাল হাসিমাখা মুখ নিয়ে অপেক্ষা করছিল আমাদের ভাগনেবৌ, তমা গাঙ্গুলি। ছিপছিপে গড়ন, টুকটুকে ফরসা, উর্বর মস্তিষ্ক। বুদ্ধিদীপ্ত স্মার্ট লেডি। একটা কর্পোরেট সংস্থায় জব করে। ছোট স্টেশন, ভিড়ভাট্টা নেই,ফলে তমাই আমাদের খুঁজে নিল। পারলে আমাদের সব লাগেজই সিএনজিতে তোলে, ভাবখানা ও থাকতে আমাদের গায়ে যেন পরিশ্রমের আঁচ না লাগে। আমাদের তিনজনকে তুলে সিএনজি ছাড়ল। তমা শুধু বলল-” উত্তরার সেক্টর ১১# রোড ১৫ # হাউস ৭৩, ব্যাস, সিএনজি ছুটল ঢাকার ব্যাস্ততম শহর উত্তরার দিকে। সিএনজি এর ফুল ফর্ম, কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস। এই গ্যাসে এখানকার অটোরিক্সা চলে। ফলে লোকমুখে অপভ্রংশ হয়ে বর্তমানে অটোরিক্সার নাম হয়ে গেছে সিএনজি। ভাল লাগল এর বৈশিষ্ট্য দেখে, তিনজনের বেশি যাত্রী বহন করে না। সমগ্র অটোরিকশাটাই লোহার নেট দিয়ে ঘেরা দরজা সিস্টেম। চলতে চলতে সিএনজিটা একটা জ্যামে আটকে গেল মিনিট দশেক পরে জ্যামমুক্ত হতে দেখে মুক ফসকে বলে ফেললাম–” আজ বুঝলাম, ঢাকাকে কেন বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর বলা হয়।” তমা মুচকি হেঁসে বলল-” রমজান মাস চলছে তো, এটাকে আমরা ফাঁকা রাস্তা বলি। ফরচুনেটলি ঢাকা মেট্র সিটির জ্যামের অনুভূতি মনে হয় আপনার কপালে নেই।” এতক্ষণ সিএনজি চালক চুপচাপ ড্রাইভ করছিল, সে তমাকে জিজ্ঞেস করল যে,আমরা বিদেশী মেহমান কিনা। যখনি শুনল আমরা কোলকাতা থেকে আসছি,সে বেশ অনুরোধের সুরে বলল-” এক দিন আমার বাড়ি আসুন, আমার খুব ভালো লাগবে। কাছেই আমার বাসা, আমি গাড়ি করে নিয়ে যাব আবার দিয়ে যাব” (ড্রাইভারের কথাগুলো আমার আমার মতো করে লিখলাম।) ড্রাইভারের কথা শুনে আমার খুব ভাল লাগল,ওকে আস্বস্ত করে বললাম-“তুমি যে আমাদের এত আন্তরিকতার সঙ্গে আমন্ত্রন জানালে আমরা তাতেই ধন্য হয়ে গেলাম।” ছেলেটি একটুখানি সঙ্কোচ করেই বলল-” অমন ভাবে বলবেন না। আসলে আমার আব্বা, আম্মু মারা যাওয়ার পর আমার বাড়িতে আর কোনো মেহমান আসেনা।” আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম—” বাবা,মা মারা যাওয়ার সাথে বাড়িতে আত্মীয় সজন না আসার কারনটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।” সিএনজি চালাতে চালাতে ছেলেটি বলল-” কারণটা ছোটো করে বলি তাহলে বুঝবেন– আমার আব্বার দুই বিয়ে, প্রথম পক্ষের আমি একই সন্তান। আমার আম্মু মারা যাওয়ার পর আব্বা আবার বিয়ে করেন, আমার তখন বছর আটেক বয়স। সৎআম্মু তো আম্মুই, আমার আম্মু নেই বলে তাঁকেই নিজের আম্মুর জায়গায় বসিয়েছিলাম। প্রথম প্রথম ঠিকই ছিল, সম্পর্কের দুরত্ব বাড়া শুরু হল আমার তিন ভাই একে একে জন্ম নেওয়ার পর থেকে। আমার খু্ব আনন্দ হয়েছিল খেলার সঙ্গি পেয়ে। কিন্তুু আম্মুর চিন্তা বাড়ল আব্বার অল্প সম্পত্তি চারজন শরিক ভেবে। তাঁর চিন্তা ভাবনার প্রতিক্রিয়ার ফল আমি দশ বছর বয়স থেকেই বুঝতে পারছিলাম। যাইহোক অনাদরে, স্বল্পাহারে অতি কষ্টে বছর দশেক পার করলাম। এবার আম্মুর হুকুম হল, ‘আর পড়াশুনা করে লাভ নেই, অভাবের সংসারে আয়ের পথ দেখো।’ যেখানে ছোট তিন ভাই দিব্যি ইসকুলে যাচ্ছে। অগত্যা পড়াশুনা শিকেয় তুলে কাজ খুঁজতে থাকলাম। আমার নিজের আম্মুর খালাত ভাই আনোয়ার মামুর হাত ধরে নোয়াখালী থেকে ঢাকায় চলে এলাম। মামু রিক্সা চালাত, আমাকে নিযুক্ত করে দিল মসজিদে নমাজ পড়তে আসা ধার্মিক মানুষদের জুতো পাহারার কাজে। আমি মাসে একবার বাড়ি গিয়ে যতটুকু টাকা জমাতে পারতাম সবটাই আম্মুর হাতে তুলে দিয়ে আসতাম। বুঝতাম আমার রোজগারের টাকা হাতে পেয়ে আম্মুর মন ভরতো না। এইভাবে আরো দশটা বছর কেটে গেল। আমি তখন রিক্সা চালাই, একটা ঝুপড়ি ভাড়া করে থাকি। আয়পত্র কিছুটা বেড়েছে। সেবার ঈদের সময় সকলের জন্যে জামাকাপড় নিয়ে বাড়ি গিয়েছি, কত আনন্দ করব। কিন্তু খোদার যে সে ইচ্ছে নেই। বাড়ি গিয়ে বুঝতে পারি, আম্মু আব্বার উপর চাপ সৃষ্টি করে তাঁর সব সম্পত্তি ছোট তিনভাইকে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছে। আমাকে দেখে আব্বার চোখ ছলছল করছিল। আম্মুর কোনো তাপ উত্তাপ নেই, ঈদে কেনা পোশাক দেখতেই ব্যস্ত। রাগে দুঃখে মাথার ঠিক রাখতে পারিনি। পরদিনই ঢাকায় চলে আসি। বছর সাত আটেক আর বাড়ি যাইনি। আনোয়ার মামুর সহযোগিতায় আমি সংসার পাতি। সুখে না থাকলেও স্ত্রীকে নিয়ে শান্তিতে ছিলাম।” আমি ওকে জিজ্ঞেস করি তার সন্তানসন্ততি কয়টি। সে একটু হেসে উত্তর দেয়-” একটি মামা (ভদ্রলোকেদের সাথে এখানে মামা সম্মোধনে কথা হয়),গরীব মানুষের বেশি সন্তান না হওয়া উচিত, তার জলজ্যান্ত উদাহরন তো আমি নিজে। তাছাড়া ঢাকা শহর কটিপতির শহর একটা মানুষ করতেই টের পাচ্ছি। যাইহোক যেটা বলছিলাম–, একদিন ঢাকা শহরে রিক্সা চালাচ্ছি হঠাৎ আমার রিক্সায় চেপে বসল আমাদেরই গ্রামের মকবুল চাচা,ঢাকায় এসেছিলেন চিকিৎসা করাতে। তার কাছে আব্বা আম্মুর খবর নিতে জানতে পারলাম, ভাইরা সব বিয়ে করেই আব্বা আম্মুকে তাদের ঘর থেকে বার করে দিয়েছে। বাইরের একটা পুরোনো গোয়াল ঘরে থাকে। টুক টাক কাজকর্ম করে কোনোমতে দিনপাত করে। ছেলেরা খেতে পরতে দেয়না। মকবুল চাচা রাগান্বিত স্বরে বলল- “হবেনি, পাপ বাপকেও ছাড়ে না।” মকবুল চাচা যাই বলুক, কথাগুলো শুনে আমার মনটা কেঁদে উঠল। হাজার অপরাধ হোক তবুও আমার আব্বা আম্মু তো!! পরদিনই ছুটলাম নোয়াখালী। আমাকে জড়িয়ে ধরে আব্বার সে কি কান্না! একটা পুরোনো ভাঙা গোয়াল ঘর, আলো বাতাস নেই কারেন্ট নেই, প্রচণ্ড গরমে দুজনে হাসফাস করছে। অথচ আব্বুর তৈরি বাড়িতে ইলেকট্রিক ফ্যান লাইট সবই আছে। ইলেকট্রিক বিল মেটানোর ভয়ে দুজন বয়স্ক মানুষকে আলো বাতাসের সুখ থেকে বঞ্চিত করা। আম্মু মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছে, হয়ত নিজ কৃত কর্মের জন্যে অনুতপ্ত। আমি আম্মুকে সান্তনার সুরে বললাম, আমার উপর তোমার কিসের অভিমান আম্মু! নিজের আম্মু মারা যাওয়ার পর আমি যে তোমাকেই সেই জায়গায় বসিয়েছি। তুমি পুরোনো কথা ভুলে যাও। আমি তোমাদের নিয়ে যেতে এসেছি। আমার কথা শেষ না হতেই আম্মু ডুকরে কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।
আমার ছোট্ট ভাড়া বাসায় পাঁচ জন মানুষ একসাথে থাকা খুবই কষ্টের, ফলে ঢাকা মেট্র সিটি থেকে একটু দূরে তুলনা মূলক বড় বাসা ভাড়া নিলাম। ঢাকা মেট্র সিটিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। ফলে আয় না বাড়ালে চলবে না। এক জনের আয়ে পাঁচটা পেট চালানো বড় কঠিন ব্যাপার হয়ে উঠল। এরি মধ্যে এক সুযোগ এল, রুট সহ একটা সিএনজি বিক্র হবে। ভাগ্যক্রমে আমি সিএনজি চালাতে পারি। কিন্তু সিএনজি কেনার মতো অতো টাকা তো আমার নেই। লাখ তিনেক টাকা শর্ট পড়ে গেল। এই কথাটা আম্মুর কানে যেতেই তিনি বৃদ্ধ বয়সের কথা ভেবে দীর্ঘদিন ধরে তিলতিল করে জমানো তিন লাখের কিছু বেশি টাকা আমার হতে তুলে দিতে চাইলেন। আমি রাজি না হলে তিনি বলেন-” নাও বাপ, টাকাটা তোমার কাজে লাগলে আমার থেকে কেউ বেশি খুশি হবেনা। রিক্সা ছেড়ে সিএনজি চালানো ধরলাম। আয় বাড়ল, চলছিল সব ঠিকঠাকই। হঠাৎ স্ট্রোকে আব্বা মারা গেলেন। গোরে মাটি দিতে এক ভাই এলো। পরে আম্মু বলেছিল, ভাইয়ের গোরে মাটি দেওয়ার ইচ্ছে যত না ছিল আব্বা,আম্মুকে কেমন ভাবে রেখেছি জানার ইচ্ছে ছিল বেশি। আব্বা মারা যাওয়ার বছর দুইয়ের মধ্যে আম্মুও মারা যায়। খবর দেওয়া সত্বেও কোনো ভাই আসেনি। আমি জানি কেন তারা আসেনি। “
তমা একটু উচ্চ স্বরে বলে উঠল-” দাঁড়াও এসে গেছি।” এতক্ষণ সিএনজি চালকের জীবনের করুন কাহিনি শুনতে শুনতে কখন যে বাসার সামনে চলে এসেছি বুঝতে পারিনি। তার সাথে মনটাও ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। সিএনজি চালককে সমবেদনা জানিয়ে ভাড়া চুকিয়ে বাসায় ঢুকলাম।
ভারি চমৎকার সাজানো গোছানো ফ্লাট। একটা বড় ঘর আমাদের জন্য ছেড়ে দিয়ে তমা বলল-” ফ্রেশ হয়ে নিন,আমি চা করি।” তমার মা,বাবা,স্বপুত্র বিপ্রকে নিয়ে তমা, আমি সহধর্মিণীকে নিয়ে ছয়জনের গোল টেবিলটা বেশ জমে উঠল। চা এর সাথে টা এর বহর দেখে আমি তো শিউরে উঠি, এ-তো আমার রাতের আহার। তমার মা দিদি হেঁসে বললেন-” তিন দিন গ্যাস নেই, তমা খাবার কিনে এনে নিজেই সন্তুষ্ট হতে পারেনি।” আমি অবাক হয়ে ভাবি, কোলকাতায় চায়ের সাথে টা মানে বিস্কুট, নিদেনপক্ষে একটু স্ন্যাকস। এখন বুঝলাম বাংলাদেশে চায়ের সাথে টা বলতে কি বুঝায়। প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি, ঢাকা মেট্র সিটিতে পাইপ লাইনে রান্নার গ্যাস সরবরাহ করা হয়। মিটার বসানো থাকে, মিটার অনুযায়ী বিল পে করতে হয়, ঠিক কোলকাতার ইলেকট্রিক বিলের মতো। সুবিধা অনেক, ছোট পরিসরে গ্যাস সিলিন্ডার রাখার জায়গা বাঁচে, বুকিং এর ঝঞ্ঝট নেই, ফুরিয়ে যাওয়ার ভয় নেই,ইত্যাদি, ইত্যাদি। এখানে বিদ্যুৎ পরিসেবা খুব উন্নত, তথাপি প্রতিটি আবাসনে সোলার সিস্টেম বাধ্যতামূলক । হাজার স্কোয়ার ফিটের নিচে ফ্লাট প্রায় হয়ই না। সেক্টর অনুযায়ী পঁচিশ হাজার থেকে এক লাখ টাকা অবদি ভাড়া গুনতে হয়। তমাদের ফ্লাট ভাড়া গুনতে হয়,মাসে পঁচিশ হাজার টাকা। এখানকার আবাসনের গল্প শুনতে শুনতে ফোন বেজে উঠল। ফ্ল্যাটে ওয়াই-ফাই থাকায় দর্শনাতে ডেড হওয়া ফোন পুনরায় প্রান ফিরে পেল। ফোন ধরতেই ফিল্ম ডাইরেক্টর শৌর্য দীপ্ত সূর্যের কণ্ঠস্বর, কুশল বিনিময়ের পর দুটি সিডিউল প্রোগ্রামের ডেট কনফার্ম করলেন। এক, ৩১/০৩/২৪ রবিবার উত্তরার সেক্টর #১৩, রোড # ৪ বিল্ডিং #২- এ যেতে হবে, ওখানে বাংলাদেশের খ্যাতনামা অভিনেতা মোশারফ করিম উপস্থিত থাকবেন। দুই, নৈশভোজের নিমন্ত্রণ করে জানালেন ০১/০৪/২৪ সোমবার সন্ধ্যা ছ’টায় উনি গাড়ি পাঠাবেন, আমরা যেন সস্ত্রীক যাওয়ার জন্য তৈরি থাকি। আমার কথা শেষ হতে না হতেই তমার ফোন বেজ উঠল। ভারত থেকে ফোনে ভাগনে পল্লব গাঙ্গুলি আমাদের আসার খোঁজ খবর নিচ্ছে। তমার ফোন ছাড়তে না ছাড়তে আবার আমার ফোন। প্রবাসী ভারতীয়, রবিন হালদার মহাশয়ের বাসা থেকে। এখানেও কুশল বিনিময়ের পর ওনাদের বাসায় যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক হল। প্যাকেজ টুরের মতো এসেছি তো, ফলে সময় সীমিত। এদিকে আমার ফোন ছাড়তে না ছাড়তে গিন্নীর ফোন বেজে উঠল, অসম,কোলকাতা থেকে দুই মেয়ে নিশ্চই নিশ্চন্ত হতে ফোন করেছে। ফলে গোলটেবিলের বৈঠকে ইতি পড়ল।