ফেলুদা ফ্যান ফিকশন
.,…………
কৃতজ্ঞতা স্বীকার – শ্রী সত্যজিৎ রায়
পুঁথি পত্র -রহস্য
******
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
(১)
শনিবারের সকাল। সকাল থেকে আজ হঠাৎ বাদলা বলে একটুক্ষণ বেশীক্ষণ বিছানায় আয়েসে চুপ করে শুয়েই ছিলাম। যদিও এখন বৃষ্টি থেমে গিয়ে দিনটা অহেতুক মেঘলা হয়ে আছে। আজ শনিবার এমনিতে স্কুল কলেজ সব বন্ধ বলে পাড়ার বন্ধুরা এসে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলার জন্য হাঁক দিয়ে ডাকার কথা।
কিন্তু আজ আর কারোর পাত্তাই নেই বলে একটু রাগ হলেও আবার পরক্ষণে হাসিও পেল।
ফেলুদা কিন্তু তাই বলে নিজে আলসেমি করেনি। এখন দু ঘন্টা ধরে ওর যোগাসনের সময়। আমি ঘুমোচ্ছিলাম বলে আর ডাকেনি। ওটা যদিও আমি ওর সাথেই অন্যদিন করি কিন্তু আজ বাধ্য হয়ে পাশের ঘরে ওকে একাই সারতে হচ্ছে।
ফেলুদা এসে আমায় শুয়ে থাকতে দেখলে আবার টিপ্পনী কাটবে। তাই আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। আমাদের বাড়ীতে দুটো কাগজের একটা ইংরেজী আর একটা বাংলা আসে । আমি প্রথমে বাংলাটায় চোখ বুলিয়ে এবার ইংরেজীটা নেব ভাবছি দেখি এরমধ্যে দেখি ফেলুদা বসবার ঘরে এসে হাজির। ও বলল ওর ঘাড়ে একটা ক্র্যাম্প মতন ধরেছে বলে ফ্রী হ্যান্ডে আজ একটু কম সময় দিতে পারল। শ্রীনাথকে ব্রেকফাস্টের জন্য বলতে বলে ও ইতিমধ্যে বাথরুমে স্নানে ঢুকে গেল।
ঘাড়ের ব্যথাটা ওকে হঠাৎ ভোগাচ্ছে বলে ওর মেজাজটাও যেন আগের থেকে একটু বদমেজাজী হয়ে আছে। আমি হাঁক পেড়ে শ্রীনাথকে ফেলুদার জন্য চিনি ছাড়া ওর ফেভারিট দার্জিলিং চা আর আমার জন্য এমনি দুধ-চা আর টোস্ট- অমলেট দিতে বলতে গিয়ে দেখলাম এরমধ্যেই যে সকাল সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। তারমানে আর একঘন্টার কিছু পড়েই জটায়ুও এসে পড়বেন। ভদ্রলোক এমনিতে শনি আর রবি এখানেই এসে সকালের চা- টা খান। সঙ্গে আবার
অবশ্য কিছু নোনতা আইটেম এমনকি চীনেবাদাম ভাজা হলেও সেটাও সঙ্গে করেই নিয়ে আসেন আমাদের সাথে ভাগ করে খাবেন বলেই।
…..
আজ ফেলুদার মুড্ অফ্ বলে মনে হচ্ছে অতটাও ডান হাতের ব্যাপারটা জমবে না। তবে ওঁর পূজোর নতুন রহস্য উপন্যাস ‘চটজলদি চমৎকার’ এর ফাইন্যাল খসড়াটা একবার জমা দেবার আগে ফেলুদাকে আর আমাকে শুনিয়ে নেবেন বলেছিলেন। সেটা নিয়ে যদিও শুনতে শুনতে একটু রগড় হবেনা অতটাও বেরসিক লোক অন্তত ফেলুদা নয়। আসলে এবারে কয়েকমাস ধরে ওর কাজের চাপটা বেড়েছে বলে আমরাও অনেকদিন কোথাও ঘুরতে যাইনি।
মনে হয় দিনকয়েক একটু কোথাও ঘুরে আসতে পারলে সেটা আমাদের সবার পক্ষেই বেশ ভাল হত। বাবা এখন অফিসের কাজে ব্যাঙ্গালোরে গেছেন দিনপাঁচেকের জন্য। আর মা এই সুযোগে গেছে মাসির বাড়ি খড়্দায়। বাড়ীতে কেবল আমরা দুজন আর চাকর শ্রীনাথ। এইসময় একটা রহস্যটহস্য হলে বেশ ভালোই হত।
ফেলুদা স্নান সেরে বেরতেই শ্রীনাথ ব্রেকফাস্ট নামিয়ে রেখে গেল। এবারে যেন ওকে এখন একটু বেটার মুডে বলে মনে হল। বাকীটা অবশ্য জলখাবার খাওয়ার পর লালমোহনবাবু আসলেই ওর মুডটা খুশি হয়েই উঠবে বলে মনে হয়।
…..
(২)
ফেলুদা চা টা খেয়ে একটা চারমিনার ধরিয়ে কিছুদিন আগে ওর পড়া জেনেটিক্সের ওপর একটা তাত্ত্বিক বই নিয়ে আমায় নানারকম জ্ঞান দিচ্ছিল। ও গম্ভীর হয়ে বলছিল যে ওই বইটায় জিনোলজি বা জেনেটিক্স বলে যে মানুষের সব ক্রিয়াকলাপের পিছনে তার পূর্বপুরুষের একটা যে প্রভাব থেকেই যায়। এটাকে আজ আর অস্বীকার করা যায়না সে মানুষটা বিখ্যাত বা কুখ্যাত হলেও ! এমনকি তার পূর্বপুরুষের হিস্ট্রীটা জানা থাকলে এই কমন জেনারেশনটাকেও বুঝতে অনেকাংশে সুবিধা হবার কথা। যদিও অপরাধতত্ত্বে সব ক্ষেত্রে জিনটাকে না মেনে তার বেড়ে ওঠার পরিবেশের ভূমিকাটাকে বাদ না দেওয়ার কথাই বলে। অন্তত ফরেনসিক সায়েন্স আর ক্রিমিনাল সাইকলজি তো এ কথার পক্ষে ঝুড়িঝুড়ি প্রমাণ দিতেও পারে।
ফেলুদা নিজেও সব ক্ষেত্রে জিন জিনিসটার ওপর অহেতুক দায় চাপাতে রাজী নয়। ওর মতে পরিবেশ পরিস্থিতিটাই আসল, যেটা একটা অপরাধপ্রবণ এমনকি নির্দোষ মানুষকেও আসলে একজন অপরাধীতে পরিণত করে। আর এই প্রবণতাটা অবিশ্যি জিনগত যে হবেই সেটা এখনো বিজ্ঞানে প্রমাণ হয়নি! এমনকি অপরাধীর তিনপুরুষ আগেকার মানুষটাকে যদি বা আমরা চিনিও বা তাও সেক্ষেত্রে আজকে সেই তথ্যটা কিই একস্ট্রারকমের সাহায্য করবে? আর এই সরলীকরণের বাইরে কি কোনো অপরাধ হচ্ছেনা?
এসব ইন্টারেস্টিং কথার ফাঁকেই আমাদের ডোরবেলটা হঠাৎ দু বার বেজে উঠল।তাহলে জটায়ু কি এত তাড়াতাড়ি আজকে চলে এলেন?
দরজা খুলতেই দেখলাম ধোপদূরস্ত ফরমাল পোশাকে একজন ভদ্রলোক ফেলুদার নাম ধরে এদিক সেদিক খুঁজছেন। ফেলুদা সঙ্গে সঙ্গে ওর সিগারেটটা নিবিয়ে ফেলে নিজের পরিচয় দিয়ে ভদ্রলোকটিকে ভেতরে আসতে বলল।
ভদ্রলোকের নাম প্রীতিশ সেন রায়। ওনাদের একটা বিল্ডিং মেটেরিয়াল সাপ্লাইএর ব্যবসা আছে ক্যামাক স্ট্রীটে। ভদ্রলোক ফেলুদাকে কিছু একটা বলতেই যে এসেছেন সেটা তাঁর ছটফটানি স্বভাবটাতেই বেশ বোঝা যাচ্ছে।
(৩)
ভদ্রলোককে চা বা কফি কিছু একটা অফার করা হলে উনি হাত নেড়ে না জানালেন। কাজেই যে কাজের জন্য এসেছেন কাজেই সেটা ছাড়া আর আলোচনা করার আর কিছুই থাকল না।
প্রীতিশবাবু আসলে যে একটা ঘোর বিপদে পড়েই ফেলুদার স্মরণাপন্ন হয়েছেন সেটা তো ওঁর আচরণেই এরমধ্যেই স্পষ্ট। ওঁর পৈতৃকবাড়ী ভবানীপুর এলাকায়। এককালে সব জয়েন্ট ফ্যামিলিই ছিল তবে এখন তাঁর এক কাকা কলকাতার কাছেই আলাদা বাসস্থান করে ওখানেই থাকেন। ভদ্রলোক নিজে যদিও এখনো বিয়ে থা করেননি । ওঁর সঙ্গে ওনার বিধবা বয়স্কা মা আর উন্মাদরোগগ্রস্ত এক ভাই থাকেন। ভাইটির মাথা খারাপ হলেও খুব একটা ভায়োলেন্ট নন। নিজের মতন থাকেন একপাশে। ওঁর ঠাকুর্দা ছিলেন হাইকোর্টের নামকরা উকিল। এ বাড়ীও ওঁরই বানানো। ওঁর বাবার ছিল এই ইমারতি মেটেরিয়ালের ব্যবসাটা। অবিশ্যি ওনার মৃত্যুর সাথে সাথেই এই ব্যবসাটা প্রীতিশ বাবুর ঘাড়ে এসে যায় কলেজে থার্ডইয়ারে গ্র্যাজুয়েশানে কমার্স পড়তেই। পরীক্ষা দিয়ে কোনওমতে তিনি গ্রাজুয়েশান ডিগ্রীটা আর পেশাগত দিকে ক্যামাকস্ট্রীটে এই অফিসঘরটিই যা পৈতৃকসম্পত্তি হিসাবে কেবল পেয়েছেন। এই খানে অবশ্য ওনার বাবা চন্ডীপ্রসাদ সেন রায়ের ব্যবসাটা মানে M/s Sen Roy & Co আগে থেকেই ছিল। কাজেই এখন অবশ্য নিজেকেই জাস্ট সবটা এবারে ওনাকে গুছিয়ে নিতে হয়েছে। এই মেটেরিয়াল সাপ্লাই ব্যবসাটায় যদিও এখন অনেক কম্পিটিটর এসে গেলেও সেটা যে মোটামুটি চলে আর সেটা বোধহয় বাপের সেই সুনামের জোরেই বোঝাই যাচ্ছে । তবে অর্ডার পাওয়া আর তার সময়মতন সাপ্লাইতে যে ব্যাপক খাটাখাটনিটাও সাথে আছে তার সাথে ভদ্রলোক সেটাও যোগ করলেন নিজের বক্তব্যে। আর ফেলুদার কাছে যে ওঁর মায়ের জন্যই যে আসা সেটা বারকয়েকের মধ্যে তিনবার বলেও ফেললেন ভদ্রলোক নিজেই।
আসলে গতমাস থেকে দিন তিনেকের গ্যাপে একটা করে ক্যুরিয়ারের খাম ওঁর নামে আসছিল হঠাৎ। আর সেগুলোর বিষয়টিও সত্যি বড় অদ্ভূত। কলকাতার আজব আজব বিষয়ের নাম ওই সব কাগজে গোটাগোটা করে উল্লেখ করে লেখা থাকত। যেমন প্রথমে এসেছিল ‘সুতানুটির গেরোয় -১ ‘ তারপরে ‘ পোস্তায় আগুন – ২ ‘, এরপরে ‘কালিঘাটের কপালে-৩’ আর ‘লালবাজারে ফাঁসি – ৪’ এরকম কটি অদ্ভূত কথা লেখা। সবার নীচেই এক – দুই করে নম্বর আর শেষ কাগজটা আপাতত এসেছে কালকে। সেটায় লেখা আছে শুধু ‘গঙ্গা ‘ আর নীচে নম্বরের জায়গায় লেখা।
‘শেষমেশ’ !
এইটা পেয়েই ওঁর মনে হয়েছে যে আসলে এগুলো কোন বিপদের পূর্বাভাস। কোন একটা বিপদ ওঁর জন্যে অপেক্ষা করে আছে নিশ্চয়। এর আগেরগুলোকে উনি ভেবেছিলেন কোন জিনিষের হয়তো আজকালকার নতুন ধরণের বিজ্ঞাপন। কিন্তু কালকের পরে ওঁর মা গঙ্গা টঙ্গা দেখে আর নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। ভদ্রলোক কাগজে ফেলুদার নাম জেনে একবার ছুটে এসেছেন যদি চিঠির অর্থ করতে পারেন সেই আশায়।
ফেলুদা একটু কেশে ওনাকে জিজ্ঞাসা করল,
” আচ্ছা! ঠিক কতদিন আগে আপনারা এখানের বাসিন্দা? মানে আপনারা এখন তো সেপারেট হলেও আপনাদের আসল পরিবারে আর কে কে আছেন?”
ভদ্রলোক একটু কেশে নিয়ে বললেন যে ওঁর ঠাকুর্দা রতনপ্রসাদের বাবা ছিলেন কবিরাজ কালীপ্রসাদ সেন রায় । এইটুকুই যা শুনেছেন।ওঁদের আদি বাড়ি ধরতে গেলে এই কলকাতাই। সেটা অবশ্য ভবানীপুরের কাছে নয় বোধহয় ওটা কালিঘাটের কাছে। তারপর এখানে ঠাকুর্দা বাড়ি টাড়ি বানিয়ে বসেন গত শতাব্দীর গোড়ার দিকেই। ওঁর বাবারা তিন ভাই এর মধ্যে ওনার বাবাকে ধরলে উনিই বড়। বাকীদুজনের মধ্যে মেজকাকা গিরিশপ্রসাদ বাঁশবেড়িয়ার চটকলে চাকরি করতেন। এখন রিটায়ার করে ওখানেই বাড়ি করেছেন। কাকীমাও ওখানকারই। আর ওনার ছোটকাকা গিরিজাপ্রসাদ বছর দুয়েক আগে মারা গেছেন পেপটিক আলসার হয়ে। উনি অবশ্য বিয়ে থাওয়া করেননি ছিলেন স্টেট বাসের কন্ডাকটার। কাজেই জীবিত বলতে ওঁর মেজকাকাই যা এখনো জীবিত আছেন। তবে উনি নিঃসন্তান। আর মেজকাকীমার শরীরটা এখন খারাপ বলে বছরে একবার করে ওই পুজোর সময় এসে ঘুরে যান বা আমি মাকে নিয়ে যাই। ভাইকেও বুঝতে পারছেন সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়াটাও খুব জরুরী। আসলে আমার মা- ই ওর সবটা এখনো দেখেন বলে আমি নিশ্চিন্তে ওদিকটা সামলাই।
– ” আপনার ভাই কি জন্ম থেকেই…? ” ফেলুদা যেন একটু দ্বিধার সাথেই কথাটা ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলো।
ভদ্রলোক বললেন ওঁর ভাই এর চোদ্দ বছর বয়সে ফুটবল খেলতে গিয়ে মাথায় একটা সজোরে চোট লাগে। তিনি তখন ওখানেই অজ্ঞান হয়ে যান। আস্তে আস্তে তাঁর জ্ঞান ফিরলেও মাথাটা কিন্তু ওই চোটের ফলে আস্তে আস্তে খারাপ হতে থাকে। বহু ডাক্তার দেখিয়েও ওটা সারেনি। কাজেই লেখাপড়াটাও তখন চালানো মুশকিল হয়ে যায়! কারণ বার দুয়েক ভাই এরপর স্কুলেও অজ্ঞান হয়ে যান। কাজেই সেই থেকে মণীশবাবু মানে ওঁর ভাই বাড়ীতেই থাকেন । এখনো অবশ্য পুরো উন্মাদ বলা চলেনা ঠিকই তবে মাঝে মাঝেই অসংলগ্ন হয়ে যান বলে লোকসমাজে আর বিশেষ বের হন না। এই ভদ্রলোকটিকে একমাত্র ওনার মা ই সামলান এখনো এই বয়সেও। তবে উনি পারিবারিক কোন পুজোটুজো থাকলে বাড়ীতে একদম সুস্থ লোকের মত গীতা পাঠ করতে বসেন। তখন কে বলবে ওঁর মাথার অসুখ আছে।
” আচ্ছা, আপনার ঠাকুর্দার কোন বিশেষ সম্পত্তি মানে শৌখিন পুরনো দ্রব্য ও বাড়িতে কি আছে? আসলে আপনাকে উদ্দেশ্য করে ওই পুরনো কলকাতা বলে উল্লেখ করা চিঠিগুলোর ব্যাপারটাই যা আমাকে এখন ভাবাচ্ছে। আর কে ওগুলো কেনই বা পাঠাচ্ছে সেটাও তো বার করা দরকার।”
ফেলুদার কপালটা কুঁচকে গেছে তারমানে ও এবার কেসটা নিয়ে ভাবছে। আর ওর সেই জিজ্ঞাস্যগুলো এখন একলাইনেই যাচ্ছে বলে প্রীতিশ বাবুও বোধহয় একটু স্বস্তি পেলেন।
” আপনি একবার আমাদের বাড়িতে আসুন না! আসলে আপনাকে দেখলে মাও আর কী… বোঝেনই তো বাবা চলে যাওয়ার পর আমিই একা রোজগেরে ছেলে..কাজেই আপনি একবারটি এসে সবটা নিজে দেখলে অনেকটা নিশ্চিন্ত হই। আজ অবিশ্যি আমার বড়বাজারে একটা অর্ডার পাওয়ার কথা আছে বলে অফিসটা এমনিতে দেরীতেই খুলব। তাই আর কি হেঁ হেঁ…কাল বা পরশু সকালে..” ভদ্রলোক বিনীত কন্ঠে এবার ফেলুদার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছেন বলে আমার নিজের বেশ মায়া লাগছিল।
ফেলুদা সব শুনে ওঁকে বলল, ” তা তো আমিই আপনাকে বলতে যাচ্ছিলাম। আপনার মাকে আশ্বস্ত করাটা এখন বেশী দরকার আর তার সাথে ওই চিঠিগুলোকেও চাক্ষুষ না করলে ওর আসল খেইটা আর পাওয়া যাবে না। কাজেই কাল সাড়ে নটা নাগাদ আমরা মানে আরও দু’জন আমার সাথেই যদি যান তবে কি খুব অসুবিধা হবে? ”
” না না, আপনারা দু’জন মানে তোপসে আর জটায়ু তো? তাহলে কিন্তু আমরা খুব খুশীই হব। বুঝতেই পারছেন আপনাদের অনেক গল্পই আমি আগে পড়েছি সেই কলেজের সময়ে আর এছাড়া হঠাৎ এই ঝামেলাটা এল বলেই তো আপনাদের মত গুণীমানুষ ও বাড়িতে যে আসছেন সেটাই বা আসলে কম কি…” প্রীতিশবাবু একটা মোলায়েম হাসি হেসে আপাতত বেরোতে যাচ্ছেন ঠিক সেইসময় জটায়ু সিঁড়ি দিয়ে উঠে এদিকেই আসছিলেন। ওঁর হাতে ধরা সেই বিখ্যাত দোকানটার সিঙ্গারার ঠোঙাটাও আজ আছে। ভদ্রলোকটিকে দেখে জটায়ু একটু পাজলড হয়ে তারপর সাইড দিয়ে ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়ালেন।
” তাহলে কাল সাড়ে নটায় দেখা হচ্ছে আপনাদের সাথে” – এই বলে ভদ্রলোক শেষপর্যন্ত আজকে বেরোলেন বলে এখনকারমতো ওঁর কথাটাও এখানেই শেষ হল। ফেলুদাও ওনাকে আশ্বস্ত করল যাওয়ার ব্যাপারে।
(৪)
জটায়ু আমাদের বাড়িতে এসে এই ঘটনার কিছুই না জানার জন্য প্রথমটায় খানিকটা অপ্রস্তুত হয়েই দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভদ্রলোক চলে যাবার পর আমরা ওঁর হাত থেকে সিঙ্গারাগুলোকে নিয়ে তিনজনেই ভাগাভাগি করে নিয়ে আর আরেক রাউন্ড চা আনতে শ্রীনাথকে আবার রিকোয়েস্ট করে এলাম।
ইতিমধ্যে ফেলুদা মোটামুটি ভদ্রলোককে সবটার একটা ব্রীফ দিয়ে দিয়েছে। আর লালমোহন বাবু জ্বলজ্বলে হাসিমুখে ওনার আনা সিঙ্গারায় কামড় দিতে দিতে ফেলুদার কাছে সেটাই শুনছিলেন।
যদিও এই রহস্যটায় ওই চিঠির ব্যাপারটা আসলে ওনার একটু খাপছাড়া লাগলেও সেটা ভবানীপুর না গিয়ে এ জটিলতা কাটবেনা সেটাই বারবার আমাকে উদ্দেশ্য করে বারবার বলতে লাগলেন।
অবিশ্যি ওনার গাড়িটা যে আমাদের কাজে লাগতে পারে সেটা ফেলুদা আগেথেকে ভেবেই রেখেছে। কিন্তু জটায়ুর সাথে মশকরা করতে ওনাকে ইচ্ছে করে শুনিয়ে বলল যে কাল আমি আর ফেলুদাই ট্যাক্সি নিয়ে ওই ভবানীপুরের বাড়িতে যাচ্ছি। এদিকে উনি যেমন আসেন তেমনই আসবেন আমরা তার মধ্যেই ওটা সেরে ওনাকে যথাসময়ে আপডেট করব।
এইকথাটা শুনে জটায়ু করুণ মুখে ফেলুদাকে বললেন যে তিনি তো এতদিন পর্যন্ত আর্লি রাইজারই ছিলেন। কাজেই রোববার সকালে উঠে হরিপদবাবুকে নিয়েই এখানে এসে তারপর ভবানীপুর গেলেই তো হয়। বরং এতসকালে হরিপদ বাবুকে ডেকে পরে না হয় একদিন হাফ ডে ডিউটি দিতে ওঁর আর কিসের আপত্তি!
আমি অবশ্যি নিজের মনে হাসি চাপছিলাম জটায়ুর করুণ মুখভঙ্গীটা দেখেই কিন্তু ফেলুদা এরমধ্যে নির্বিকার মুখে সিঙ্গারা খেতে খেতে জটায়ুকে লক্ষ্য করছিল আর গম্ভীর মুখটাকে আরো গম্ভীর করে রাখছিল ওঁকে রাগাবার জন্যেই। কাজেই আবার ওনাকে আড়ালে ডেকে সবটা আমিই বুঝিয়ে দিলাম একফাঁকে। আমার কাছে সব শুনেটুনে ভদ্রলোক একটু যেন আশ্বস্ত হলেন।
আসলে প্রীতিশ বাবুর রহস্যটাই আমারো গোলমেলে ঠেকছে। বিশেষতঃ ওই চিঠির ব্যাপারটা। ওনাদের কাছে কোন একটা দামী জিনিষ যদিও বা থেকেই থাকে সেটা ওঁর পক্ষে তো জানাটা উচিত নয় কি! অবশ্যি ওঁদের ভবানীপুরের বাড়িটায় গেলে এক্ষেত্রে একটা সলিউশান বেরোতে পারে। আর অযথা একটা নির্বিরোধী লোককে কেনই বা কেউ মস্করা করেও বা বিরক্ত করতে এতগুলো চিঠি লিখবে?
কাল সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে জটায়ু চলে আসবেন বলে ঠিক হল। এরপর আমরা ঠিক নটায় প্রীতীশবাবুদের বাড়ি হানা দিচ্ছি আর দুপুরে ফেলুদা আবার ‘ মিং জংস্ স্যাঙ্গু ভ্যালি’ বলে ওখানকার এরপর একটা পুরনো অথচ আধুনিক চীনা রেস্তোঁরায় আমাদের খাওয়াবে বলে রাখল।
প্রীতিশ বাবুদের বাড়িটা দোতলা হলেও সাত আটটা শোবার আর বসবার ঘর আছে বলে বাইরে থেকে বেশ বড়ই দেখায়। ওঁদের গৃহদেবতা হলেন নৃসিংহদেব নারায়ণ আর মুক্তেশ্বর শিব। এই মন্দিরটাও ওই বাড়ির সাথেই লাগানো। পুরনো দিনের এই ধরণের বাড়িগুলোয় আগে এগুলো হামেশাই থাকত বলে ফেলুদা আমাদেরকে ওর পুরনো বাড়ি আর মন্দির নিয়ে ছোট করে একটা লেকচার দিয়ে সবটা বুঝিয়ে দিল। জটায়ু আর আমি সেটাকে নির্বিকার ভাবেই হজম করলাম। আমার টেনশন ওই চিঠিগুলোকে নিয়েই। ওনার মাও ছেলের বিষয়ে একটু ঘাবড়েই আছেন বোঝা যাচ্ছে। ওই চিঠির ব্যাপারটাকেও নেহাত উড়িয়ে দেওয়া তো যায়না তাই উনি টেন্সড। ফেলুদা মন দিয়েই ওই চিঠিগুলোকে দেখছিল। মাঝে আবার ওর উল্টোদিকটা দু বার শুঁকেও দেখল। ওগুলো একদমই যে সাধারণ কম্পিউটারের প্রিন্ট সন্দেহ নেই। ফেলুদা তারপর বলল, ” যেই ওগুলো পাঠাক না কেন বেশ একটা ধাঁধায় যে ফেলেছে সেটা নেহাত সত্যি। ” প্রীতিশবাবুর মা এরমধ্যে আবার গরম লুচি আর আলুর দম করে আমাদের আপ্যায়ণ করেছেন। আর আমরা গরম গরম ওগুলোর সদ্ব্যবহারে নামলাম। ফেলুদা খেতে খেতেই প্রীতিশ বাবুর দিকে তাকিয়ে বলল,
” এই চিঠিগুলোর আসলে আপনাকে একটা ধোঁয়াশার মধ্যে রাখতে চাওয়াই যে প্রেরকটির উদ্দেশ্য সেটা অবিশ্যি দেখেটেখে মনেই হচ্ছে। আপনাদের মা এর সাথে কথাবার্তা বলে আমি যদি এই বাড়িটা যদি একটু ঘুরে দেখি আপত্তি নেই তো ! ”
প্রীতিশবাবুর মা সাধনা দেবীর সাথে কথা বলতে বলতে একটা ব্যাপার জানা গেল যেটা প্রীতিশ বাবু বলেননি। জগজীবন দাস নামের একজনের সাথে প্রীতিশ বাবুর বাবা এই বিল্ডিং মেটেরিয়ালের ব্যবসাটা আরম্ভ করেন। ওঁর ছোটছেলে তখন নেহাতই শিশু। সাতবছর ব্যবসাটা চলার পর ওই পার্টনার ভদ্রলোক নিজের নামে ব্যবসার টাকা সরাচ্ছিলেন একটু একটু। প্রীতিশ বাবুর বাবা চন্ডীপ্রসাদ সেন রায়ের চোখে ক্যাশের গরমিলটা ধরা পড়ে গেলে উনি জগজীবনকে খুব বকাঝকা করেন। তখন অবশ্য ওনাকে পুলিশ টুলিশে দেন নি। কারণ তিনি ছিলেন দয়ালু। বন্ধুকে আরও একবার বিশ্বাস করতে চেয়েছিলেন। আর সেটাই হল ওঁর মৃত্যুর কারণ।
উনি বাড়িতে খুব বেশী ব্যবসার কথা বলতেন না। কিন্তু মন ভেঙে যেতে জগজীবনের এই কাজটার কথা ওনার স্ত্রীকে একদিন হঠাৎই বলে ফেলেন।অবশ্যি এর কিছু বছর ওনাদের আর এইসব নিয়ে কোন গোলমাল ছিলনা। সাধনাদেবী এরপর আবার বলতে লাগলেন, ” কিন্তু ওঁর বড় ছেলের গ্রাজুয়েশনের একটু আগে একটা বড়সড় আর্থিক ক্ষতিতে উনি চোখে অন্ধকার দেখেন। আর তার জন্যে দায়ী ওঁর বন্ধু কাম স্লিপিং পার্টনার জগজীবন। দুজনের মধ্যে জোর বচসা হয় এমনকি পার্টনারশিপ ভেঙে নিজেই ব্যবসাটাকে সোল পার্টনারশীপে স্থানান্তর করেন। এরজন্য নিজের শরীর আর মন দুইই ভাঙতে থাকে ওঁর। তারপর হঠাৎই অফিসের টেবিলে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলেই গেলেন। প্রীতিশের তখন সবে গ্রাজুয়েশন শেষ হয়েছে আর মণীশের তখন বয়স ষোল কি সতেরো সাথে আবার মাথাটাও খারাপ! ” এতদূর বলে উনি থামলেন। ওনার দুচোখ দিয়ে জলের ধারা নামছিল।
” আচ্ছা ! এই জগজীবন রায় এখন কি করেন?” ফেলুদা একবার আস্তে করে একবার জিজ্ঞাসা করল ওঁকে।
উনি শুনে বললেন ” সে এখন একজন নামী ডেভেলপার হয়েছে। এবাড়ী ভেঙেও সে ওর বাবার মৃত্যুর দু বছর পর একটা ফ্ল্যাটবাড়ি বানাতে চেয়েছিল। আমি তখন বলেছিলাম না ! শুনে সে তখনকার মত সে অবশ্য হাল ছাড়ে। ইতিমধ্যে আমার ছোটদেওর হঠাৎ আলসারে মারা গেছেন বলে আমরা আর পরের দেওর গিরিশপ্রসাদওএ বাড়ির যৌথ মালিক হওয়ায় ও যে তক্কেতক্কে সুযোগের আশায় প্রায়সই ঘোরে সেটা অবশ্য আমিও বুঝি। ”
এরমধ্যে মণীশ বাবু একবার ওপরে এসে মা কে খুঁজছিলেন। সাধনা দেবী কাজেই আমাদের কাছ থেকে এখন বিদায় নিলেন।
প্রীতিশবাবুর মুখটা এখন গোমড়া। কি করবেন এবার সেটা বুঝতে পারছেন না বলে অসহায়ের মত ফেলুদাকে দেখছেন আর মাথা চুলকোচ্ছেন। জটায়ু আর আমি ওদের কথা শুনে একটু থ মেরে গেছি সেটা আর বলার কথা নয়।
ফেলুদা বলল, ” একটু দিন দুয়েক আমায় সময় দিন! যা বুঝছি একটু কয়েকটা খোঁজখবর করা দরকার। আমরা আজকে চলি বরং। আপনার কোন চিন্তা করার দরকার নেই। কিছু সন্দেহজনক দেখলে তৎক্ষণাৎ ফোন করবেন। অবশ্যি উঠে পড়ার আগে আপনাদের বাড়িটার আশপাশটা একটু বরং ঘুরে দেখি নি !”
(৫)
ফেলুদার সাথে আমরাও সবটা ঘুরে দেখতে লাগলাম। ওঁদের ঠাকুরঘরটা বেশ ইন্টারেস্টিং। সেটা এতটা সাবেকী স্টাইলে এই দক্ষিণ কলকাতায় আমি একদম ভাবিনি। ফেলুদা আবার ঠাকুরঘরের লাগোয়া একটা অন্য ঘর থেকে এরমধ্যেই একবার ঘুরে এসে একবার নিজের মনেই বলল ” ইন্টারেস্টিং ! তাহলে চিঠির অর্থটা একেবারে ফেলে দেওয়াটা যাচ্ছে না দেখছি।”
পুরোটা এক চক্কর মেরে ঘুরে দেখার পর বেলা বারোটার জাস্ট কিছু পরে আমরা “মিং জংস্ স্যাঙ্গু ভ্যালি ” রেস্তোঁরায় দুপুরের খাবার হিসাবে ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন খেলাম। খেতে বসে জটায়ু বললেন, ” কদিন আগেও এই পরিবারটি সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতাম না। অথচ দেখো তপেশ একটা ফ্যামিলির ভিতরে কত খিচুড়ি পোরাটাই না আছে!” ফেলুদার মুখটা এখন একটা জিলিপির মত পেঁচিয়ে আছে অর্থাৎ ওর মনের জট এখনো ছাড়েনি। একটাই কথা ও এখন শুধু বলল যে, ” এই সেন রায় পরিবারটি এই ভবানীপুরের বাড়িতে এখানে আছে মাত্র আড়াই পুরুষ আগে মানে প্রীতিশ বাবুর ঠাকুর্দার শেষবয়স থেকে। তার আগে কোনভাবেই নয়।”
বাড়ি ফিরে জটায়ু হরিপদ বাবুকে ছুটি দিয়ে আজকের দিনটা আমাদের সাথেই থেকে যাবেন বললেন। ফেলুদা অবিশ্যি তাতে কোন আপত্তি করে নি বলে আমিও বেশ একজন মনের খুশিমত সঙ্গী পেলাম। কদিন আগেই লালমোহন বাবু বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত পুরনো পুঁথিপত্রের ওপর একটা বই সম্প্রতি পেয়ে সেটা ফেলুদাকে গিফ্ট করেছেন। এসব বিষয়ে ওনার খুব একটা ইন্টারেস্ট নেই বলে বসবার ঘরে বসেই একটা ইংরেজী ক্রাইম থ্রিলার খুব মন দিয়ে পড়ছিলেন।
ফেলুদা এখন একা থাকতে চেয়ে আমায় অন্যঘরে যেতে বলে কি মনে করে জটায়ুর দেওয়া ওই বইটাই উল্টে পাল্টে দেখছিল।
একঘন্টা পর যখন ফেলুদা হাসিমুখে বেরিয়ে এল তখন বেলা তিনটে ছুঁইছুঁই। জটায়ুর বোধহয় ততোক্ষণে একটু তন্দ্রা মতন এসেছিল বলে উনি সোজা বসার ঘরে ডিভানে একটুক্ষণ আধশোয়া হয়ে ঘুমিয়ে গেছিলেন। কাজেই তিনি এখন ফেলুদাকে এ ঘরে আসতে দেখেননি।
ফেলুদা এসেই বলল, ” জটায়ুকে এই বইটার জন্য এখুনি একবার বিশেষ ধন্যবাদ দেওয়া দরকার। কারণ রহস্যের বারো আনা তো এখানে বসে বসেই সমাধান হল আর উনি এখন পড়ে পড়ে এখানে ঘুমোচ্ছেন ! ” জটায়ু অবশ্যি ততোক্ষণে জেগে উঠেছেন। বুঝলাম ফেলুদা রহস্যের একেবারে শেষটায় পৌঁছে এখন বিশেষভাবে উত্তেজিত। জটায়ুকে একটা লম্বা কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ও এবার আমাদের বলল,
” পলাশীর যুদ্ধের পরে পুরনো কলকাতার সুতানুটিতে আর পোস্তায় দুটো ভয়াল অগ্নিকান্ডের ফলে অনেক লোক মারা যান। এই ক্ষয়ক্ষতির ফলে লোকে শহরের দক্ষিণ অংশে আদিগঙ্গার আশেপাশে অন্যত্র বাসস্থান ঠিক করে পালিয়ে আসে। অর্থাৎ ওই দুটি চিঠির অংশবিশেষ মনে করে দেখ এবার ! দুটো সূত্রর খোঁজ তো ওই চিঠিতেই বেড়িয়েই আসে। অবিশ্যি এর থেকেও আরো জরুরী ইনফর্মেশন আছে ওই বইটাতে। সেটা যদিও ক্রমশ প্রকাশ্য। আরও দুটো খটকার ঠিক ঠিক ইনফর্মেশন মিললেই কাল প্রীতিশ বাবুদের বাড়িতে বাকিটাও যথাসময় বলা যাবে।
এই বইটা না পেলে যে ওইগুলো জানতে বেশ বেগ পেতে হত সেটা অবিশ্যি না বললেই নয়। ”
জটায়ু কেন আমিও এখন ফেলুদার কথায় থ মেরে তাকিয়ে আছি। প্রীতিশ বাবুদের রহস্যটা ও যে এত জলদি অনেকটা সলভ করে ফেলবে এটা যেন বিশ্বাস করাই কঠিন। আমি অন্তত ঘসেটি বেগমের জড়োয়ার কেসেও দেখেছি ফেলুদা ঠিক আসল ইনফর্মেশানটা বের করে আনতে ওস্তাদ আর এটাই যে ওর বুদ্ধির একটা বিশেষ পরিচয় দেয় সেটাও জানি।
পরদিন সকালে ফেলুদা ওর এক প্রোমোটার বন্ধুকে ফোন করে কেবল ‘হুঁ’ আর ‘হ্যাঁ’ করে শেষে একবার ‘ ঠিক তাই ‘ বলে রেখে দিল। ও যে সেই জগজীবন রায়ের ব্যাপারে এতক্ষণ খোঁজ নিচ্ছিল সেটা ওই প্রমোটার বন্ধুকে ফোন করাটা থেকেই আমি জানি।
এটাও জানি ও নিজে এখন রহস্যটার একদম লাস্ট স্টেজে পৌঁছে গেছে বলে ওকে এখন হাজার ঘাঁটালেও আর কিছুই আর বেরোবে না।
আমরা মঙ্গলবার সকাল নটায় সোজা ভবানীপুরে প্রীতিশ বাবুদের বাড়িতে তিনজনে এসে হাজির হলাম। গোটা রাস্তায় ও চুপ করে চিন্তা করছিল বলে আমি আর জটায়ু আর ওকে একদমই আর ঘাঁটাইনি। যবনিকা পতন আসন্ন বলে প্রীতিশ বাবু আর তাঁর মা কে বিশেষ করে আগেভাগেই ফেলুদা আমাদের আসার কথাটা ফোনেই জানিয়ে দিয়েছিল।
(শেষ পর্ব)
ফেলুদা তার ঝোলা থেকে একটা পাকানো কাগজ বের করে আমাদের সামনে রাখল। ওর থেকে বেরোল একটা পুরনো কলকাতার ম্যাপ যেটা আমাদের কাছেই এতদিন ছিল বলে আমিও অনেকবার নাড়াচাড়া করে ওটা দেখেছি। ও প্রথমেই ম্যাপটাকে একটা টেবিলের ওপর বিছিয়ে ধরল। তারপর ও বলল , ” আগে এই ম্যাপটা সবার দেখা দরকার। এই যে এটা হল কলকাতার এটা অন্যতম পুরনো রাস্তা এই ক্রিক রো। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু ঘটনা। একটা সময় এর পাশ দিয়ে একটা খাল বা ‘ক্রিক’ প্রবাহিত হত বলে জানা যায়। এখন অবশ্য সেটি মুছে গেছে। আর্চডিকন হাইড তাঁর ‘প্যারোকিয়াল অ্যানালস’ এবং ‘পেরিশ অব বেঙ্গল’ বই দুটিতে সেই বর্ণনা দিয়ে গেছেন— “The creek took a half turn round this battery and kept Eastwards beneath three gated bridges, until the fences turned downwards from it at Fancy Lane.” তখন খুব বেশি দিন হয়নি ইংরেজরা কলকাতায় এসেছে। এমনকি জোব চার্নক তখনও জীবিত ছিলেন আর তখনই এই সেন রায় বংশের পত্তন ওই ক্রিক রোর একটি বাড়িতে । ”
এবার ফেলুদা প্রীতিশ বাবুদের দিকে ফিরে বলতে লাগল ” সেইসময়ের কিছু পরে একটা অগ্নিকান্ডে এই পরিবার বহু ক্ষয়ক্ষতি সামলে উঠে আসে আদিগঙ্গার ধারে কালিঘাটের একটা বর্ধিষ্ণু যজমানের দেওয়া ওই বাড়িতে। সেসময় অবশ্য পৈতৃক সম্পত্তি হিসাবে দুটি পুঁথির সাথে একটা শালগ্রাম শিলা বাঁচিয়ে আনেন আপনার এক পূর্বপুরুষ কালীপ্রসাদ সেন রায় । উনি নিজে সেকালের একজন বেশ নামকরা সংস্কৃতজ্ঞ আর সুপন্ডিত মানুষও ছিলেন। ওনার এক ছেলের নাম হল জ্যোতিষার্ণব মূরলীপ্রসাদ সেন রায় যিনি আপনার ঠাকুর্দার পিতৃদেব। সেই তালপাতার ভূর্জপত্রে লেখা ওই পুঁথিগুলোর মধ্যে একটা হল ‘মনসামঙ্গল’ আর একটা হল ‘মনসাবিজয়ে’র হাতে লেখা আসল পুঁথি। বুঝতেই পারছেন এর অবিশ্যি আজকে দাম অনেক। আর আপনি সম্ভবত ওগুলোর অস্তিত্বই জানেন না।
ওই সব সামগ্রী এখন চোরাবাজারে চড়া দামে বিকোয় স্রেফ এগুলোর ঐতিহাসিক মূল্যের জন্যই। নানা কারণে আপনারা আজ নিজেরা বাড়ির ঠাকুরঘরে এই রত্নখনির সন্ধান না করলেও আপনার বাবার সেই বন্ধু কাম পার্টনার জগজীবন দাস কিন্তু আপনার বাবার কাছে এগুলো অনেকবারই নিজের চোখে দেখেছিলেন। কাজেই মাঝেমাঝেই তিনি ওঁকে নিয়মিত চাপ দিতেন এগুলো বেচে ব্যবসায় আরো টাকা লাগানোর জন্য। কারণ সেটা হলে বোধহয় তহবিল তছরূপে ওনার আর বোধহয় একটু বেশী সুবিধাই হত ।
কিন্তু বাধ সাধল আপনার বাবার সাথে ওঁর বনিবনা না হওয়াটা। উনি আবার অবিশ্যি স্নেহবশতঃ ওকে পুলিশে দিলেন না কেবল বিতাড়ণ করে ডীডটাকে বদলে দিলেন । ফলতঃ আপনার বাবার এসময়ে কাজের চাপ বাড়লো আর তার ধকলে হঠাৎ মৃত্যু হওয়ার ফলে এ ব্যাপারটাও এখানেই ধামাচাপা পড়ে গেল।
অবশ্য তার কদিন আগেই আপনার বাবা ওই দোকানের পার্টনারশীপটা ভেঙে দিয়ে ব্যবসাটাকে একাই চালাচ্ছিলেন। কাজেই স্লিপিং পার্টনারের আর এমনিতেও কিছু করার ছিলনা।
অবশ্য তিনি সবটা বলে আপনার বাঁশবেড়িয়ার মেজোকাকাকে আগেই হাত করেছিলেন মোটা অর্থের বিনিময়ে। কাজেই উনি বছরে একবার কি দু বার এসে আপনাদের ঠাকুরঘরে পাটাতনের নীচে রাখা ওই দুটো পুঁথিকে একবার দেখে আর সেগুলো এখনো অক্ষত আছে কিনা সেটা সেই নামকরা প্রমোটার আর অজস্র শপিং মলের মালিক জগজীবন দাসকে গোপনে রিপোর্ট দিতেন।
আপনারা যে মনসামঙ্গলের শ্রেষ্ঠ কবি মধুসূদন গুপ্তের কন্যার সূত্রে এক বংশধর সেটা অবিশ্যি আপনার কাকাও অনেকদিন অবধি বোধহয় নিজেও জানতেন না। আপনার বাবা হয়তো জানলেও কোনওদিন এসব কাউকে তিনিও বলেন নি। কারণ তিনি নিজে ব্যবসার যাবতীয় কাজে আর এককালের বন্ধু পার্টনারের অসততা নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতেন, বোধহয় তার জন্যেই মাথাটা ঠান্ডা করতে পারতেন না।
তবে আপনার মা জগজীবনকে ভালোই চেনেন আর তাই আপনাকে জড়িয়ে বিপদের একটা ভয় পেয়েছিলেন।
হাজার হোক জগজীবন দাস একজন এখন এক গণ্যমান্য লোক আর রিয়েল এস্টেটের একজন বিরাট কর্তা। উনি করতে পারেন না এমন কাজই বিরল। কিন্তু অবশ্যি ওই পুঁথির ব্যাপারটা আপনার মা ও বোধহয় জানতেন না।
আপনার কাকাকে লেখ জগজীবনের ওই সাংকেতিক চিঠিগুলো ভুল করে আপনার হাতে এসে পড়াটায় সম্ভবতঃ আবার ওনার মনে একটা নতুন করে ভয় ধরিয়ে দেয়। কারণ জগজীবন দাসের দ্বারা উনি যথেষ্ট অলরেডি ক্ষতির মুখ দেখে নিয়েছেন আর ওর কাজের দৌড়টাও ভাল করেই জানেন।
আপনার কাকা যে এখন আলাদা থাকেন সেটা অবশ্য জগজীবন এখন নিজেও ঠিক বুঝতে পারেন নি। কাজেই ওই চিঠিগুলো বেনামে আপনার কাকাকে উনি পাঠাতে থাকেন পুঁথি গুলো সরানোর একটা রিমাইন্ডার হিসাবে।
এই পুঁথি সংক্রান্ত তথ্যটি আর আপনার প্রপিতামহের নামটি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ প্রকাশিত একটা লেখায় পাই। সেখানে আরো লেখা আছে যে আপনার প্রপিতামহই হলেন মনসামঙ্গলের রচনাকারের একজন বংশধর। আর সেই লেখাটা আমায় আমার বন্ধু জটায়ু ওরফে লালমোহন গাঙ্গুলী হঠাৎ এনে আমায় দেখান। কাজেই এরজন্য একটা ধন্যবাদ ওঁরও প্রাপ্য হয়। ”
জটায়ুর মুডটা এখন বেশ চনমনে দেখাচ্ছে। প্রীতিশ বাবুর মা হাতজোড় করে মাথা নীচু করে ফেলুদার দিকে দাঁড়িয়ে আছেন। ওনাকে দেখে আমার নিজেরই বেশ খারাপ লাগছিল। ফেলুদা ইতিমধ্যে ওঁদের ঠাকুরঘরের পাটাতন সরিয়ে ওই পুঁথিগুলোকে বের করে ওনার মা’র হাতে তুলে দিল। সবাই আমরা যারপরনাই বিস্মিত হয়ে ওর কথা আর কাজের প্রদর্শনী দেখছি। ও আবার বলে উঠল ,
” মাসিমা এখন আপনাদের তিনটে কাজ বাকী। প্রথমে এই পুঁথিগুলোকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ লাইব্রেরী এ জমা দিয়ে আবিষ্কর্তা হিসেবে আপনার মৃত স্বামীর নামে একটা রসিদ লিখিয়ে নেওয়া, দ্বিতীয় ওই দুষ্টু জগজীবন দাসের বিরুদ্ধে একটা চুরির ষড়যন্ত্রের এফ আই আর দায়ের করানো আর তৃতীয় হল দুই পুত্রের সাথে নিশ্চিন্তে বাকি জীবনটাকে কাটানো। অবশ্য পুঁথিগুলোকে ভবিষ্যতের জন্য স্ক্যান করিয়ে প্রিন্ট করাটাও একইভাবে দরকার। এক কপি আপনাদের বাড়ীতে রাখবেন বলে আর এক কপি থাকলো স্রেফ আমার জন্যে। কারণ ওইটাই হল…. ” প্রীতিশ বাবু আর জটায়ু দন্তবিকশিত করে তৎক্ষণাৎ একসাথে বলে উঠলেন আপনার ” পারিশ্রমিক ! ”
…………………….
**********