রোজকার মতো আজও ফোকলি কাজে বসতে না বসতেই হারুকে উত্যক্ত করতে শুরু করল! একটা জোয়ান মেয়ে যদি এভাবে রোজ রোজ চোখাচুখি করতে থাকে তাহলে কাজে মন বসে কীকরে! হারু তাই দেখেও না দেখার ভান করল।
“তোত্থেকে নিতি যাব কোন দুক্কে শুনি? আমাদের ব্যাপারে তোকে অত নাক গলাতি হবে নি! ছোট ছোটর মতো থাক দিকিনি”।
“তুই-ই তবে দেখ কেষ্ট- আসল কতা হচ্চে- কোনও না কোনও ছুতোয় আমার কাচে ওর আসা চাই-ই চাই! কাজের সময় এসব আমার মোটেও ভাল্লাগে না! হ্যাঁরা ফোকলি, তোকে না বলেচি- আমায় ‘দাদা’ বলে ডাকবি”?
“তা নয় ডাকব কোন, কিন্তু কাজের পরে তোকে কোতায় পাব সেটা তো আগে বল!
এই হুঁকোর গুড়গুড় আর বৃষ্টির অঙ্কে হারুর সকালটাই আজ মাটি! অন্যদিন এতক্ষণে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ টাকা সশব্দে মুখ থুবড়ে এসে থালায় পড়ে, সেখানে আজ মাত্র ষোল টাকা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে!
ফোকলির আনন্দ কিন্তু একআনাও কমেনি, বরং ষোলআনায় ভরপুর! ভিক্ষে আজ নাহয় কাল জুটবে, কিন্তু এমন বৃষ্টি রোজ রোজ না’ও জুটতে পারে!
বৃষ্টিভেজা-ফোকলির দিকে নজর পড়তেই হারু ভিজে জল হয়ে গেল! ফোকলি বেহায়া হলেও কুঁড়ি থেকে সদ্য ফুটে ওঠা সোমত্ত একটা মেয়ে; সম্মতি মাখানো লজ্জায় মাথাটা নামিয়ে নিল ঠিকই, তবে পরক্ষণেই নিজেকে মেলে ধরল ময়ূরের মতো করে!
ফোকলি তো এটাই চেয়েছিল। হারুর পেছন পেছন মন্দিরের বারান্দায় উঠে পুঁটুলী থেকে শুকনো গামছাটা বের করে হারুকে এগিয়ে দিল-
“গা’টা আগে মুচে নে।
আমি এলাম বলে রাগ কল্লি নে তো”?
হারু মাথা মুছতে মুছতে বলল-
“মন্দিট্টা তো আমার একার নয়, একেনে যে-কেউই আসতি পারে”!
“তারমানে তোর ঘরে গেলেই যত আপত্তি”?
হারু চুপ করে থাকায় ফোকলি খানিক ভরসা পেল। পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল- “কিছু বলচিস নে কেনে”?
“আমার ভাঙাঘরে তুই থাকতি পারবি নি”!
এবার ফোকলি হারুর হাতের ওপর হাত রেখে বলল-
“ভাঙা হলিও সেটা তোর নিজের ঘর”!
“আমার সঙ্গে ঘর বাদলি অকালে তোকে বেধবা হতি হবে”!
“অল্প কিছুদিন তো তোকে পাব, তাতিই হবে! চার আঙ্গুল কপালের জন্যি দশ আঙ্গুল ভাবনা ভেবে লাব কী? তুই রাজি আচিস কি না সেটা বল”?
এমন সময় পূজারীর ঘণ্টার আওয়াজ কানে আসায় ওরা চমকে উঠল! সঙ্গে সঙ্গে ফোকলি তফাতে গিয়ে দাঁড়াল!
ঠাকুরমশাই এগিয়ে এসে বললেন-
“প্রসাদ নেবে তো এসো”!
********ওরা দুজনে মিলে বাসা বাঁধল******
পাঁচদিন পর ওরা আজ কাজে ফিরল। নেহাত ফোকলি বলে রেখেছিল, তাই এ’কদিন কেষ্ট ওদের জায়গা দুটো পাহারা দিয়েছে! তা নাহলে ওদের পাশে বসার আর ইচ্ছে নেই! কিন্তু ফোকলিটা পাশে এসে বসতেই মনটা কেমন চনমনে হয়ে উঠল!
হ্যাঁ রা , তোকে যে কত করি আমাদের বে’তে আসতে বললুম, এলি না যে”!?
উত্তর না দেওয়ার মতো করে কেষ্ট উত্তর দিল-
“শরীরটা ভালো ছেল না রে”!
তারপর একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল- “ভাবছি কাল থেকে অন্য লাইনে গে বসব, একানকার মানুষজন বড্ড চিমটে-পানা হয়ে গেচে”!
“হঠাৎ তোর এমনধারা মনি হচ্চে কেনে কেষ্ট”?
“দেখচিস না, দিনদিন রোজকারপাতি কেমন কমে যাচ্চে”!
অন্য কথা বলে কেষ্ট প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দিল। ফোকলিও না বুঝে উত্তর দিল-
“অত অধৈয্য হলে চলে? দিন তো একদিন ফিত্তেও পারে”।
কেষ্টর দিন ফিরল কি-না তা সময়ই বলবে, তবে হারু-ফোকলির দিন যে ফিরে গেল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না!
দুজনের রোজগারে শুধু চেহারা নয়, সংসারের হালও ফিরেছে বেশ খানিকটা! তবে ফোকলির ‘খিদে’ যে একটু বেশিই সেটা হারু প্রথম দিনই টের পেয়েছে! তা কী আর করা যাবে, সবার ‘খিদে’ তো আর সমান হয় না!
**************বছরখানেক পরে********************
সবই ঠিক আছে, কিন্তু অনেক বোঝানো সত্ত্বেও একটা সন্তান নিতে কিছুতেই ফোকলি রাজি হল না! এনিয়ে বেশ কিছুদিন ওদের মধ্যে অশান্তি হল! কোনও লাভ হবে না বুঝে হারু শেষে আশাই ছেড়ে দিল!
************এর বছর দুয়েক বাদে****************
সরকারের তরফে শহরের সব রাস্তাঘাট পরিষ্কারের পাশাপাশি ঝাঁ চকচকে করার উদ্যোগ শুরু হল। কিছু কিছু জায়গায় ভিক্ষে করাই নিষিদ্ধ হয়ে গেল! ফলে ওরা পড়ল মহা বিপদে! এখানে-সেখানে ঘুরে ঘুরে কত আর রোজগার করা যায়!
জীবন-জীবিকার এই অনিশ্চয়তা যত বাড়তে লাগল হারু ততই ভাঙতে শুরু করল! অভাব-অনটন আর অশান্তিতে পুরোনো কাশিটাও থেকে থেকে চাগাড় দিয়ে উঠছে!
চিন্তায় হারুর ঘুম নেই, রাতের পর রাত জেগে আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকে- “এই বয়সেই বসে গেলে সংসার এগোবে কীকরে! ফোকলির ভবিষ্যৎ’এরই বা কী হবে”!
ফোকলি উপার্জনের পুরোটাই খরচা করে নিজের শখ-আহ্লাদের পেছনে! শুধু তাই নয়, আজকাল সংসারে মোটে মন নেই, হারুকেও বেশ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে!
একঘরে থাকলেও ওদের বিছানা আজ আলাদা!
*************** তবে কেষ্ট ভালো আছে***********
“এখন কেষ্ট ‘লালমোহন ঠিকাদার’-এর সঙ্গে শহরের বড় বড় রাস্তা তৈরির কাজে লেগে পড়েছে! এট্টা মোটর সাইকেলও কিনেচে! সপ্তাহে ছ’দিন কাচ করে, আর একদিন চুটিয়ে ফুত্তি করে! আর কী চাই জেবনে”- এসব কথা ফোকলি হারুকে রোজই শোনয়!
*************** হারুও পিছিয়ে নেই***************(
মাস তিনেক হল হৃদয়পুর-স্টেশনের টিকিট ঘরের সামনে বসার একটা জায়গা পেয়েছে! অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবে এটা হয়েছে! ফোকলি কিন্তু এসবের কিছুই জানে না, ইচ্ছে করেই হারু বলেনি ওকে!
**********এখানে ভিক্ষে ভালোই জুটচ্ছে************
ছুটির দিনগুলোতে হারু দেরি করে ঘরে ফেরে। কারণ পাশেই ‘তটিনী’ সিনেমা হল। ছুটিরদিনে খুব ভিড় হয় এখানে। “মনে আনন্দ থাকলে মানুষ ভিক্ষে দেয়” – এ অভিজ্ঞতা হারুর অনেকদিনকার!
কিন্তু জং ধরা কপালটাও তো সঙ্গে আছে! তাই আজ আবার বৃষ্টি শুরু হল! এখন যদি কাশি শুরু হয়ে যায় তাহলেই বিপদের পোয়াবারো! হারু তাই টিকিট ঘরের ভিতরে ঢুকে একটা কোণায় জবুথবু হয়ে বসে রইল! দেখতে দেখতে ঘরটা ভরে গেল, ছোটবড় সকলেই যে-যার মতো জায়গা নিয়েই মোবাইলে ডুবে গেল। একদম শেষে দুজোড়া পা এসে থামল হারুর ঠিক সামনে! হারু নিজেকে আরও গুটিয়ে নিল!
শরীর গুটিয়ে নিলেও নজর গেল ঐ দুজোড়া পায়ের দিকে- “মনে হয় ওদের নতুন বিয়ে হয়েছে! মেয়েটার চটিজোড়া নতুন হলেও ছেলেটার জুতোটা কেমন যেন, অন্যের জুতোতে পা গলালে যেমনটা হয়-ঠিক তেমন”!
যাগ্গে, আজকাল নিজের চোখের ওপরেও ভরসা হারিয়েছে হারু! তাই চোখ বুজে বৃষ্টি থামার অপক্ষায় রইল। কিন্তু ওদের একান্ত গোপন কথাগুলো যখন কানে এসে পৌঁছল তখন কানদুটো আবার জেগে উঠল-
ছেলেটা ফিসফিস করে বলল- “তখনই তোকে বারণ করেছিলাম, তুই তো শুনলি না আমার কথা! এখন আর আফসোস করে কী হবে বল? ‘ভাগ্য’ মনে করে এটাই মেনে নে”!
“কেন? তুই রাজি থাকলে এক্ষুণি ওকে আমি ডিভোর্স দিতে পারি! রোজ রোজ এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে তোর সঙ্গে দেখা করতে আর ভালো লাগছে না! তার থেকেও বড় কথা, ওর সঙ্গে এক মুহূর্তও আর থাকতে ইচ্ছে করছে না”!
“একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখ তুলি- আমার পক্ষে তোকে এখন বিয়ে করা সম্ভব নয়! ও যদি আমার পরিচিত না হতো তাহলে একবার ভেবে দেখতাম! আরেকটা কথা- ওর অবস্থা আজ খারাপ বলে কালও যে থাকবে তার তো কোনও মানে নেই, তখন ও তোকে আগের মতোই সবকিছু দিয়ে আগলে রাখবে, দেখে নিস”!
“এবার তোর কথাগুলো কেউ শুনতে পাচ্ছে না বুঝি”?
“সরি সরি”!
নিচু স্বরে মেয়েটা আরও বলল-
“ও আর কোনোদিন ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না! আমি এভাবেই একদিন শেষ হয়ে যাব -তুইও সেটা দেখে নিস”!
“প্লিজ তুলি, এভাবে বললে আমি যে কষ্ট পাই! আমি তো তোর সঙ্গে আছি না কি!? আচ্ছা ঠিক আছে, এখন এসব কথা বাদ দে। একদিন বসে এসব আলোচনা করা যাবে। বলছি, কাল কোথায় মিট করব”?
“বাড়িতেই চলে আয় না, দুপুরে তো আমি একাই থাকি”!
ছেলেটা এবার মেয়েটার হাতটা চেপে ধরে আদর করল মনে হয়!
এরপর বেশ কিছুক্ষণ ওরা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল…….।
বৃষ্টিও থেমে গেল। একে একে সবগুলো ‘পা’ বেরিয়ে গেল! ওরাও বেরোল, তবে যাওয়ার সময় মেয়েটি হারুর থালায় গোটা একটা দশ টাকার নোট ফেলে দিয়ে গেল!
প্রাপ্তির এমন নিঃশব্দ যন্ত্রনা এর আগে কখনও হারু অনুভব করেনি! তবুও কার্পণ্য করল না হারু, টাকাটা হাতে তুলে নিয়ে অস্ফুট উচ্চারণে বলল- “তোমাদের মঙ্গল হোক”!
এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা নাছোড়-কাশিটা এবার ছিটকে বাইরে বেরিয়ে এল, সঙ্গে কিছুটা রক্ত!
************জ্বর নিয়ে হারু ঘরে ফিরল*************
মাঝরাতে মনে হল ঘরের মধ্যে কেউ কিছু করছে, এর আগেও ফোকলি এমন খসখস শব্দ শুনেছিল!
“শীত কত্তিচে তো আমি কী করব, কেতা গায়ে দিয়ে ঘুইমে পড়- শীত কমে যাবে। মাজরেতে সোআগ কত্তি এসে আমার ঘুমের বারোটা বাজাস নে”!
একথা বলে চাদরটা গায়ে টেনে নিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল!
****************পরদিন ভোরবেলা*************
প্রথম ট্রেনের শব্দে ফোকলির যখন ঘুম ভাঙল তখন হারু নিষ্পাপ শিশুর মতো হাত-পা ছড়িয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে! সূর্যের প্রথম আলোতে ওকে খুব জীবন্ত লাগছিল! হারুকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে ফোকলি ঘাবড়ে গেল! বিছানায় রাখা জলের বোতলটা আনতে গিয়ে নজরে পড়ল কতগুলো কৌটো, ঘরের এক কোণে থরে থরে সাজানো! অনেকগুলো, অনেকগুলো কৌটো!
সবগুলোই ভরতি! অনেক পয়সা! শুধু পয়সা! এত পয়সা ফোকলি কোনোদিন চোখে দেখেনি! আনন্দ আর উত্তেজনায় সেগুলো হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই ঝনঝন শব্দে পুরো ঘরটা কেঁপে উঠল! মাটির এমন কম্পন ফোকলি সইতে পারল না, দুহাত দিয়ে কান চেপে ধরে উন্মাদের মতো চিৎকার করতে লাগল- “কে কোতায় আচো- বাচাও আমারে, বাচাও”!!!!!!