মদ্যপ যে বার বার নিজেকেই অতিক্রম করে যায়, সে প্রায় নিজের অজান্তেই। কতগুলি প্রচলিত মীদের বাইরেও অসংখ্য এমন উদাহরণ রয়েছে এদের সম্বন্ধে, যে শুনলে মনে হবে এরা আদতে এ পৃথিবীর জীবই নয়।
কয়েকটি ছোটখাটো উদাহরণ দিই, তাহলে ব্যাপারটা একটু পরিস্কার হবে। আর না হলেই বা কি?মাতালের কথা পরিস্কার হয়েছেই বা কবে, ও তো আর ডিটারজেন্ট সাবান নয়।
আমাদের পাড়ায় ত্রিশটি’র ওপর গোপাল রয়েছেন। এবার তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে তাদের উল্লেখ করার সময় তো শুধু ‘গোপাল ‘বললে তো আর হয় না।নির্দিষ্ট করে ঠিক কার কথা বলা হচ্ছে তা বুঝতে অসুবিধা হয়। তাই ‘গোপাল ‘এর আগে বিশেষ কিছু একটা শব্দ জুড়ে দেওয়া হয় নির্দিষ্ট করার জন্য। যেমন, নাইল্যা গোপাল, অঞ্চল গোপাল, নাইপতা গোপাল, বামনা গোপাল–ইত্যাদি।
এরই মধ্যে এক গোপালের অতুলনীয় কিছু ক্রিয়াকলাপ বলি। এর বেশি স্পেসিফিক হতে বোলো না বাপুসকল, আমারও ঘাড়ে একটিই মাথা।
তা গোপালবাবু এক ঘুঘুডাকা হলুদ গ্রীষ্মের দুপুরে ছেলেদের খেলার মাঠের পাশের মাচায় শুয়ে আছেন। দশ হাত দূর থেকে দেশের আবগারি দপ্তরের বরকতের গন্ধ পাওয়া যায়। আমগাছ থেকে টুপটাপ করে মধুপোকার মধু ঝরে পড়ছে তার হাঁ মুখের ভিতরে, তবুও তাঁর নড়াচড়ার নামটি নেই। গৃহিনী বারদশেক ডাকাডাকি করে শেষে ক্লান্ত হয়ে ফিরে গেছেন। ইতিমধ্যে মাঠের খেলুড়ের দল হাজির হয়েছে ফুটবল পেটানোর জন্য। গোপালবাবুর অবস্থান লক্ষ্য করে তারা খেলা শুরুও করতে পারছে না। দুর্ঘটনাক্রমে যদি লাথানো বলটি গোপালবাবুর মুখ কি পাঁজরে একবার লেগে যায়, মাঠের তামাম খেলুড়েকে চাক্কি পিষিং অ্যান্ড পিষিং করে সারা জীবন কাটাতে হবে।
ভারি বিপদ। ওদিকে বেলা বয়ে যায়। তার উপর কালবৈশাখীর সম্ভাবনাও প্রবল। মোট কথা ছেলেরা হাল ছেড়েই দিয়েছিল, আজ আর খেলা হচ্ছে না। মন খারাপ করে তারা, মাঠের পাশে বসেই পকেট থেকে মোবাইল বার করেছে পাব -জি কি ফ্রি -ফায়ার খেলার জন্য।
এমন সময় নারায়ণবাবু টলতে টলতে হাজির। তিনি রোজ গলা পর্যন্ত তুরীয় তরলে পরিপূর্ণ হয়ে মাঠের পাশ থেকে ছেলেদের ফুটবল খেলা দেখেন। মাঝে মাঝে জ্ঞানগর্ভ উপদেশ ছুঁড়ে দেন মাঠের পাশ থেকে, “এ্যাই, অত আগে বল বাড়াবি না, স্ট্রাইকার অফ সাইডে পড়বে বা মাঠ বড় কর, এক দিকেই বারবার বল টানিস না। “–ইত্যাদি।
তা এইদিন, খেলুড়েদের গোমড়ামুখ দেখে তিনি যারপরনাই আশ্চর্য হলেন। ক্যাপ্টেন পলাশকে ডেকে বললেন, ‘কি বাওয়া, সব স্ক্রিনশট হয়ে বসে আচো কেন? খেলাধূলা হবে না আজ? “
পলাশ বিরক্তির সঙ্গে বললো,
-দ্যাখো না নাড়ুজেঠু, গোপালকাকা মাচার ওপর কেমন শুয়ে আছে, উঠতেই চাইছে না। এরপর যদি বলটল লেগে যায়, সবাই আমাদেরই দুষবে।
নারায়ণ ছিক্ করে একটা তাচ্ছিল্যের শব্দ করলেন মুখে। তারপর পকেট থেকে দিয়াশলাইটি বার করে মাচার দিকে এগোতে এগোতে বললেন,
-হুস্, তোরা টীম বানা, ও এখনই উঠে যাবে।
ছেলেরা আর টীম ভাগ করবে কি, হাঁ করে নারায়ণের দিকে তাকিয়ে রইলো। নারায়ণ মাচার খুব কাছে গিয়ে একবার খুব নরম সুরে বললেন,
-বাওয়া গোপাল, উঠবানা বাপ?
গোপালবাবু পাশ ফিরে শুলেন। হাত দিয়ে নাকে বসা মাছিটাকে এমনভাবে তাড়ালেন যেন নারায়ণকেই উড়িয়ে দিলেন। নারায়ণ আর বাক্যব্যয় না করে মাচার নীচে জমে থাকা শুকনো – ভিজে পাতায় আগুন ধরিয়ে দিলেন। তাতে আগুন খুব একটা হলো না,কিন্তু ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে উঠতে লাগলো উপরের দিকে। একটু তফাতে সরে এসে নারায়ণ চেঁচিয়ে উঠলেন,
বল হরি, হরি বোওওওল গোপাল জেলে, দিল গোওওওল …
আর যাবি কোথায়?
গোপাল একলাফে মাচা থেকে লাফিয়ে নীচে নামলেন। প্রথমে ধোঁয়ার ঘনঘটায় আর নেশার দমকে ব্যাপারটি ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি।তারপরই মাচার নীচে পাতার স্তূপটির দিকে চোখ পড়তেই সব মিনারেল ওয়াটারের মতো পরিস্কার হয়ে গেল। আর পারামাত্রই …ছেলেরা কানে আঙুল দিলে। যে সকল স্বরব্যঞ্জনসম্বলিত শব্দ গোপালের মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো, তাতে কানের পর্দায় গ্যাংগ্রীন হওয়াও আশ্চর্য নয়।
কিন্তু যার উদ্দেশ্যে যাবতীয় খেউড় বর্ষিত হচ্ছে, তার কোনো ভাবান্তর নেই। খুব সহজভাবে মাঠের একপাশে বসে তিনি বলে উঠলেন,
-কি হলো অবলাকান্ত? চালাও ফুটবল!
ছেলেরা মাঠে নেমে গেল।
গোপালবাবুর কীর্তিকলাপের অন্ত নেই। একবার পাড়ার এক বৃদ্ধের মরদেহ নিয়ে শ্মশান যাওয়ার পর,তিনি টানা তিনদিন উধাও হয়ে ছিলেন এই লকডাউনের বাজারেই।সবাই তো কিছুক্ষণের জন্য ধরেই নিয়েছিল যে তিনিও প্রস্থান করেছেন অমৃতলোকের উদ্দেশ্যে।
সে গল্প অন্য কোনোদিন বলবো …আজ এই নেশাটুকু কাটুক।
★★
” এ সে সময়ের কথা যখন বিশ্বাস করতুম মদ খেতে বসলে ‘আগামীকাল বলে কিছু হয় না ‘এমন ভেবে নিয়েই বসতে হয়। আর জীবনে যতদিন গিলেছি, বোতল বা টাকা হিসেব করে গিলিনি, ঘন্টা হিসেবে গিলেছি। আজ সকাল আটটা টু রাত বারোটা বা কাল সন্ধ্যা পাঁচটা টু পরদিন দুপুর অতটা …এমন।
তোমরা শুনে হয় তো ভাবছো, এখনও খেয়ে আছি বা নির্লজ্জ বা বরফাট্টাই মারছি। তবে পল্টু, সে সময় এমনই হয়েছিলাম। চুড়িওয়ালি যাওয়ার পর আর তেমন করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি নাকি? এখন যা দ্যাখো, তা হয় অভিনয় নয় প্রয়াস। আমিত্বটুকুকে খুঁজতে যাওয়া বৃথা হবে, কারণ সে আমি আর নেই। “
পল্টুদা জ্বলন্ত সিগ্রেটটায় একটা টান দিয়ে আদিত্যনারায়ণকে বললো,
-নারায়ণ বাবু, এমন কিছু ঘটেনি আপনার জীবনে, যা গতানুগতিকতার বাইরে? মানে আমি বলতে চাইছি, এই যে চুড়িওয়ালি বলুন বা কৃষ্ণকলি –এদের প্রেম তো স্বাভাবিক,এমনটা তো হতেই পারে। এমন কিছু হয়নি যা আপনার পরে মনে হয়েছে অনুচিত বা বিচ্ছেদ পূর্ববর্তী জীবনের আগেও অনৈতিক মনে হতো …বুঝতেই পারছেন কি বলতে চাইছি, সামথিং ইয়ে?
আদিত্যনারায়ণ জানালার কাছে দাঁড়ালেন। ধুতি পরা কালো লম্বা দেহটা আবছা দেখা যায় জানালার পাশে।আজকের সন্ধ্যাটি জানালার ঠিক নীচ থেকে খেই হারানো গল্পের মতো করে শুরু হয়েছে। তাতে চাঁদ নেই মেঘ নেই তারা নেই হাওয়া নেই …আদিত্যনারায়ণ হঠাৎ হেসে উঠলেন।
-সামথিং ইয়ে, য়্যু মীন স্ফাইসি? হ্যাঁ পল্টুবাবু, তা একটিবার হয়েছিল বৈ কি। তা তোমার খুড়তুতো ভাইটির সামনে বলা ঠিক হবে কি?
পল্টু আড়চোখে একবার বিস্টুর দিকে দেখে নিল। সে হাঁ করে শুনছিল আদিত্যনারায়ণের কথা। পল্টুর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে উঠে যাচ্ছিল। পল্টু তার হাত ধরে টেনে বসিয়ে বললো,
-আরে হ্যাঁ, সাতাশ বছর তো হলো বয়স। এ বয়সে তো আপনার বিয়েও হয়ে গিয়েছিল, তাই না? বলুন বলুন।
আদিত্যনারায়াণ আবার ইজিচেয়ারে লম্বমান হলেন। ঘোমটা টানা একজন বৌ মানুষ একটি ট্রে নিয়ে ঘরে এলেন। তাতে চা, নিমকি –কিছু মিষ্টি। পল্টু হেসে উঠলো,
-আমার সামনেও ঘোমটা?
আদিত্যনারায়ণ যেন ঘোরের মধ্যে বলে উঠলেন,
-হ্যাঁ, ওর সামনে আবার লজ্জা কিসের?
এক টুকরো সুগন্ধি হাসি ছড়িয়ে তিনি চলে গেলেন। পল্টু এক মুঠো নিমকি নিজের মুখে ফেলে বললো,
-হ্যাঁ, এবার বলুন।
আদিত্যনারায়ণ সদ্য আসা চায়ের কাপে চুমুক দিলেন ,
-শীতকালে রাত বুঝতে কেমন অসুবিধা হয় তা তো জানোই। আসর বসাতে বসাতে সন্ধ্যা একটু গড়িয়ে গেলেই রাত দুপুর। এবার তাতে আমার কিছু যেতো আসতো না, অসুবিধাটি হতো আমার পার্টনারের। আর গভীর রাত পর্যন্ত তো আর মদের সরবরাহ থাকে না।
তখন মাঘের প্রথমদিকে। আমার পার্টনারটি ছিলেন ফুলব্যবসায়ী।এবার মাঘের ওই সময়টায় মরশুমি ফুলের কেমন রমরমা সে তোমাদের তো আর অজানা নয়। বিস্টুদের নিজের নার্সারি রয়েছে, তারা আরও ভালো বুঝবে। এক একদিন তো এমন হতো শেষ খরিদ্দার ছাড়তে ছাড়তে আটটা সাড়ে আটটা বেজে যেতো। সেদিনও হয়েছে তেমনই।
আমার তো সন্ধ্যা ছটা বাজলেই ছোঁক ছোঁক। ও দিকে সাতটা, সাড়ে সাতটা বেজে যায়, সে আর আসে না। একে শীতের সন্ধ্যা, তায় গ্রামগঞ্জ এলাকা।বাজার এলাকা তো ফাঁকা হতে শুরু করলোই, যে সব আইনি বেআইনি মদের ঠেকগুলো ছিল, সেও বন্ধ হয় বলে। ভারি বিপদ। এর পর তো শ্যামও যাবে, কুলও যাবে। আমি আর পার্টনারের জন্য বসে না থেকে দুটো খাম্বা বগলে নিয়ে ডেরার দিকে রওনা দিলুম। ডেরা বলতে প্লাটফর্মের এক প্রান্তে একটা আধখাওয়া মেহগিনি গাছ, তার নীচের বাঁধানো বসার জায়গা। জনমনিষ্যিহীন, মাল টেনে বাওয়াল দাও, পড়ে থাকো কেউ খুঁজতেও আসবে না।
সেখানে গিয়ে বসেছি। কুয়াশায় সীট ভিজে জবজব করছে।জীবনে কোনোদিনও নিজে পেগ বানিয়ে খাইনি, মাপের আন্দাজও নেই। জল মাল গুলিয়ে ফেলেছি বেমালুম, তায় সঙ্গে শুকনো ছোলা ভাজা ছাড়া অন্য অনুপানও আনা হয়নি। পাঁচ ছ পেগের পর মাথাটা কেমন যেন ঝাঁকি মেরে উঠলো। আর তখনই গ্রামের এক দিকে পুরোনো পেপার মিলের পরিত্যক্ত জমিতে কুঁড়ে বেঁধে থাকা মেয়েগুলোর কথা মনে পড়ে গেল।সামগ্রিক ভাবে তাদের কিছু অর্থনৈতিক অসুবিধা ছিল। একে উদ্বাস্তু, তায় অনাথ। তারা মাঠে মুনিষও খাটতো, দেহব্যবসাও করতো।
আমার হঠাৎ মনে হলো সেখানে আমাকে যেতেই হবে।
গ্রামের বাইরে পরিত্যক্ত পেপার মিল। বেশ খানিকটা পথ। পথে অনেকটা কুয়াশা পড়ে ঘন, পড়ে অন্ধকার বাগান। সব পার হতে পারলে হঠাৎ চোখের সামনে লাফিয়ে ওঠে পেপার মিলের শূন্য চৌহদ্দি,এক পাশে কালো ঘাসের আল দেওয়া জমিতে ধপধপে সাদা ফুলকপি ফুটে আছে –হঠাৎ দেখলে মনে হয় ফুলকপিগুলো একটু আগেই এক জায়গায় হয়ে কথা বলছিল, আমাকে দেখেই তারা নড়েচড়ে আগের জায়গায় চলে গেল।
পেপার মিলের ফাঁকা জায়গাটার এক পাশে কুঁড়েগুলো। চালাগুলো গমের কাণ্ড দিয়ে তৈরি। দেখতে অনেকটা আফ্রিকান বোমার মতো,ছড়ানো কাঠামোটা কাঠি, গাছের ডাল দিয়ে তৈরি, শুধু চালা আছে এই যা।
বিস্টু চমকে উঠলো,
-বোমার মত ঘর! বলেন কি?
আদিত্যনারায়ণ মুচকি হাসলেন,
-এ বোমার ফাটার বোমা নয়। আফ্রিকান কিছু কিছু উপজাতি পোষা জীবজন্তু রাখার জন্য বড় উঠোন দেখে ডালপালা দিয়ে ঘিরে নেয়। এও তেমন।
যাই হোক। আমি এগোচ্ছি টলতে টলতে। কুয়াশায় পিছলে পিছলে চাঁদ তখন পশ্চিমে পৌঁছে গেছে। আমি বেমালুম ভুলে আছি যে, রাস্তা থেকে ওই ফাঁকা জায়গাটিতে পৌঁছতে গেলে একটা হাত দুয়েক গভীর বাঁধানো নালা পার হতে হয়। মাতালের আবার তাল! টলতে টলতে পড়েছি ওই নালার ভিতরে আর সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা ঠুকে গেল শক্ত কংক্রীটে। আর কিচ্ছু মনে নেই।
একটা ঝাঁকুনি দিয়ে জেগে উঠলাম, সামনেই একটি মেয়ে হাতের জলের মতো একটি পাত্র নিয়ে বসে আছে, মুখ খুব চিন্তিত। সে খুব আস্তে বললো,
-বাব্বা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি, না মরে উদ্ধার করেছ সোনা আমার। তা এদিকে মরতে এসেছিস কেন?
মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে অসহ্য যন্ত্রণায়। কানের পাশ দিয়ে গরম কিছু একটা গড়িয়ে নামছে। তাতে হাত দিয়ে চমকে উঠলাম। ভয়ে ভয়ে আরও দু বার সেখানে হাত দিলাম। মেয়েটি তার ঠাণ্ডা জলভেজা হাত আমার কাঁধে রেখে বললো,
-ও রক্ত বেরিয়ে গিয়ে ভালোই হয়েছে। ভয় পাস না। আর বললি না তো কেন এসেছিস?
কুঁড়ের দিকে একটাও আলো নেই। লোকজনের সাড়াও পাওয়া যায় না। বলে ফেললাম,
-তোর কাছেই এসেছি, তোর জন্য।
কিছুক্ষণ জ্যোৎস্না চুপ, চুপ শিশিরের টুপটাপ। হঠাৎ মেয়েটির হাসির সঙ্গে তারা এক সঙ্গে ফেটে পড়লো। খলখল করে হেসে উঠলো আলোকিত প্রান্তর। তার সঙ্গত দিলো হলদে চাঁদ। আমি রেগে গেলাম,
-অত হাসির কি আছে? পয়সা নিবি, শুবি, ব্যাস মিটে গেল।
মেয়েটি হাসি থামিয়ে বললো,
-আমার কাছে আসতে গিয়ে তো একটা বোতল ভেঙে রাখলি।বাকিটায় আছে কিছু?
বলেই বোতলটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে অনেকটা গিলে নিল। তারপর হাত বাড়িয়ে বললো,
-চাট কিছু থাকলে দে।
আমি পকেট থেকে ন্যাতানো ছোলা ভাজার প্যাকেটটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম। সে ঠোঙাটি হাতে নিয়ে খিঁচিয়ে উঠলো,
-ধুর্, শুকনো ছোলা? মাছটাছ নেই, ভাজা পোড়া?
আমি সুর করে বললাম,
-ইঃ, বালের আবার জুলফি! ওই মারাও।
দুজনে মিলে এক ঢোক দু ঢোক করে খেতে খেতে বোতল ফুরিয়ে এলো, আমার সঙ্গিনীটি ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো,
-আগে কত খেতাম রে, এগুলো নয়, প্যাকেটে থাকে যে, সেগুলো। ওঃ, একেবারে গলাবুক খামচে নেমে যায় সঙ্গে মাছপোড়া, মুরগীর ছাঁট। তারপর একদিন …
আমার আর তর সইছিলো না। ধমকে উঠলাম,
-পুরোনো হাঁড়ি ঘাঁটিস না তো। দিবি তো দে,নইলে চললাম।
সে আমার একেবারে সামনে এসে বসলো। কালো মেয়ে, নাকে একটি রুপোর না ঝুটো নাকছাবি কি জানি, রুপোলি রঙ।খুব নরম গলায় বললো,
-আর ওই যে ফর্সাপনা মেয়েটা, অনেক চুড়ি পরতো, সে দুঃখ পাবে না?
আমি থমকে গেলাম। আবার হাসি শুরু হয়েছে প্রান্তরে প্রান্তরে, এবার অসহ্য ব্যাঙ্গের হাসি, দু দিক থেকে মাথাটা ছেঁচে ফেলার হাসি। চিৎকার করে বলে উঠলাম,
-নেই, সে নেই, কোত্থাও নেই।
-তার উপর রাগ করে এখানে এসেছিস?
এবার আমি কেঁদে ফেললাম এক নিমেষে। এক লহমায় এক যুগের কান্না ঝরে পড়লো রাত বেয়ে। মাথা নীচু করে বসে রইলাম চুপ করে। আমার কাঁধে ঠাণ্ডা হাত রেখে সে মেয়ে বললো,
-কাল সাদা মুখে আয়, যদি ইচ্ছে হয় তো। নইলে আসিস না।
কালো মুখ, কালো চোখ। তার ঠিক মাঝখানে একটা সাদা ঝিলিক –রুপোর না ঝুটো নাকছাবি যেন।
দিন দুয়েক পর তারা আমাদের জমি নিড়োতে এসেছিল। আমি তাদের দুশোটি টাকা দিয়ে বললাম,
“পরশু দিন তোমাদেরই কে একজন যেন আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিল। এই টাকায় তোমরা মিষ্টি খেয়ে নিও।”
একজনের খুব চোখে চোখে কথা। সে বললো,
-গত দু মাস দূরে দূরে পটপটি কুড়িয়ে বেড়াচ্ছি আমরা। কাল বিকেলেই ফিরেছি। পরশু কি করে থাকবো? তা, অগ্রিম দিচ্ছ বললেই হয়। কখন আসবে গো?
আমি কিছুক্ষণ তাদের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে তারপর চলে এলাম। পিছনে হাসির ছররা উঠলো। ভর দুপুরে আমার চোখে জ্যোৎস্না ফুটে উঠলো, কালো মেয়ে, কালো চোখ –রুপো না ঝুটো নাকছাবির যেন ঝলকানি।
———————————————————–
অনেকক্ষণ পর বিস্টু বললো,
-তা হলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো?
পল্টু জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। আদিত্যনারায়ণ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন,