পাড়ার এক প্রতিবেশীর মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে ওঁরা দুইজন একসঙ্গে বিয়ে বাড়িতে গিয়ে পৌঁছেছেন। রাস্তার উপরে স্বল্প সজ্জিত প্যান্ডেলে আগত অতিথির বসার জন্য জায়গা করা হয়েছে। তখন সেখানে প্রায় ফাঁকা প্যান্ডেলে মিনিট দশেক বসবার পর সৌজন্যের উপহারটি পাত্রীর হাতে তুলে দিয়ে আবার এসে রাস্তায় সেই চেয়ারেই বসে রইলেন। ওই সময়ে সেখানে দু’চারজন ছাড়া তেমন কোন আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন না। তখন ফাঁকা প্যান্ডেলে তাঁদের দুজনের মধ্যে কথায় কথায় মিনিট কুড়ি কেটে গেল। একটু দূর থেকে ক্রমাগত চলাচলে পাত্রীর কাকা দেবদুলাল বাবুর সঙ্গে কয়েকবারই দৃষ্টি বিনিময় হলো কিন্তু কাছে এলেন না। দূর থেকেও একটুখানি হেসে, মাথা নেড়ে কিংবা হাত তুলে বসুন, বলেও কোন ইঙ্গিত প্রদর্শনও করলেন না। উনি ছাড়াও অতিথির উপস্থিতিতে পাত্রীপক্ষের তরফ থেকে অন্য কেউ কোনো রকম অভ্যর্থনা জানালেন না। বাড়িতে নিমন্ত্রিত অতিথির উপস্থিতিতে নূন্যতম আপ্যায়নে ভদ্রতার এমন অবল্যুপ্তি দেখে তাঁরা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। অত্যন্ত ভিড়ের মাঝে দেখা না হওয়াটা, আলাদা ব্যাপার কিন্তু পাত্রীর স্বয়ং কাকা আমন্ত্রিতদের দেখেও একদম নীরব নির্লিপ্ত থাকায় ভীষণ দৃষ্টি কটু লাগতে লাগলো। যদিও পাড়া প্রতিবেশী হিসাবে তাদের এমন ব্যবহারের কথা প্রায় সকলেই একটু আধটু জানতো। তবুও নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে ভদ্রতার খাতিরে উপস্থিত হওয়াটা একটা মানবিক কর্তব্যের অঙ্গ মনে করে তাঁরা সেদিন উপস্থিত হল। যদিও অনেকে কথার ছলে ওদের সম্পর্কে বলেই ফ্যালে – “সমাজে বাস করলেও ওরা একদম অসামাজিক জীব—–!” তবুও এমন ব্যবহার চাক্ষুষ দেখতে পেয়ে মনে মনে ভাবতে লাগলেন – সভ্য যুগের এ কোন্ ধরনের ভদ্রতা? আসলে বাস্তবে কিছু কিছু স্মরণীয় ঘটনা থেকে অর্জিত হয় নানা রকম অভিজ্ঞতা।সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের সত্যিকারের আসল রূপ চেনা যায়। ঐভাবে বসে থাকা অবস্থায় দূর থেকেও দেবদুলাল বাবুর বার তিনেক ‘শুভদৃষ্টি’ হলেও অতিথি আপ্যায়নে কোনই সৌজন্যবোধ দেখালেন না। ছাদের প্যান্ডেল থেকে একজন সবেমাত্র ফিরে এসে বললেন এক্ষুনি একটা ব্যাচ শুরু হোতে চলেছে। সংক্ষিপ্ত জায়গায় সিট আর অবশিষ্ট নাই। একইভাবে মিনিট কুড়ি বসে থাকার পর কারও কাছ থেকে কোন রকমের নূন্যতম আপ্যায়নের সৌজন্যবোধের সাড়া না পেয়ে সুষেন বাবু যেন বডড অস্বস্তি বোধ করছিলেন। ঠিক এই একই কারণে সঙ্গে থাকা তার জামাইবাবুও উঠে আসতে চাইলেন কিন্তু ওই অবস্থায় প্রীতিভোজে অংশগ্রহণ না করে চলে আসাটা নিকটবর্তী পাড়া প্রতিবেশী হিসাবে সমুচিত হবে না ভেবে আরও মিনিট পাঁচেক বসে রইলেন। তার মাঝেও দেখলেন পাত্রীর কাকাবাবু চলাচলের পথে তাঁদের দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু মনে হল যেন দেখেও দেখছেন না। এবার অস্বস্তি গেল আরও বেড়ে। সিদ্ধান্ত নিলেন এইভাবে ওখানে আদেখলার মতো অস্বস্তির মধ্যে বসে না থেকে বাড়িতে গিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আবার একবার আসবেন। যেমন চিন্তা তেমন কাজ। চলে গেলেন বাড়ি, আধা ঘন্টা পর বাধ্য হয়ে আদর্শ প্রতিবেশী হিসেবে আবার ফিরে গেলেন। কিন্তু তখনও ঠিক ওই একই অবস্থা। নিমন্ত্রিত যারা তারা তাদের নিজ নিজ উদ্যোগে কর্তব্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে সোজা উঠে যাচ্ছে ছাদে। তখন আবার তাদের সঙ্গে দেবদুলাল বাবু হেসে হেসে কথা বললেন। তবে যে যাই করুক না কেন, তাঁরা দুইজনে আগের মত সেই রাস্তার চেয়ারেই বসে রইলেন। যেহেতু আগেরবার দেখেও আপ্যায়ন তো দুরের কথা-কাছে এসেও কোনরকম কথাও বলেনি। তাই এবারও পাত্রীপক্ষের হাবভাব দেখে মনে হল নিমন্ত্রণ যখন বাড়িতে গিয়ে করে এসেছি তখন সেই নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে অভ্যর্থনা না জানালেও নিজ নিজ দায়িত্বে প্রীতিভোজে অংশ নিয়ে কর্তব্য সম্পন্ন করবে। কিন্তু সেই নীতিতে ওঁরা সহমত পোষণ করতে পারলেন না। বাড়িতে কোন লোক এলে ভদ্রতার খাতিরে ন্যূনতম শুভেচ্ছা বিনিময়টুকু তো ভদ্রতার একটা অঙ্গ। তাহলে এখানে কেন চলছে এমন অবস্থাতে লুকোচুরি? তাই এমন পরিস্থিতিতে চরম অস্বস্তি বোধ করায় এবার সিদ্ধান্ত নিলেন বাড়ি ফিরে আসবেন। চলেও এলেন এবং ঘরে এসে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লেন। পরদিন সকালে সুষেন বাবু গোরা বাজার থেকে বাজার করে সাইকেল নিয়ে যখন ফিরছেন তখন আদর্শ বিদ্যাভবন এর সামনে দূর থেকে তাঁকে দেখেই পথের মাঝে নদীয়ার নিমাইয়ের মতো হাত দুখানি উঁচুতে তুলে দাঁড় করিয়ে যখন দেবদুলাল বাবু বললেন- “আপনি আর আপনার জামাইবাবু দু’জনে গতকাল রাত্রে আমার ভাইঝির বিয়েতে না খেয়েদেয়ে চলে এসেছেন। রাত্রে এ খবর পেয়ে আমি মনে প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছি। এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি। আপনাদের যে এতটাই তাড়া ছিল তা যদি একটু ঘুনাক্ষরেও জানতে পারতাম তাহলে আমি আপনাদের আগে খেতে বসবার ব্যবস্থা করে দিতাম। আপনাদের কি আর কোনদিন আমাদের বাড়িতে এমন অনুষ্ঠানে উপস্থিত করাবার সুযোগ হবে? এমনটা কি আপনারা ঠিক করেছেন———–?” এমন কথা শুনে সুষেন বাবু একদিকে ক্ষোভ,আর অন্যদিকে হাসি চেপে রেখে বললেন- “তাতে কি হয়েছে? আসলে কাজের বাড়িতে কন্যাদায়গ্রস্থ পরিবারের পক্ষে সবদিকে লক্ষ্য রাখা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। তাছাড়া দূর দুরান্ত থেকে যে সকল নিমন্ত্রিতরা এসেছেন তাদের সম্মান রক্ষা করাটাই অগ্রগণ্য তাই আপনি আমাদের কয়েকবার দূর থেকে দেখে কাছে না এলেও আমরা তা প্রত্যক্ষ করেও কিন্তু কিছুই মনে করিনি—–। যাইহোক, সে যা হবার তা তো হয়েই গেছে—। একজন আদর্শ প্রতিবেশী হিসেবে এমন ঘটনার জন্য আমরা কিন্তু কিছুই মনে করিনি। আরে, আপনি কেন এত মন খারাপ করছেন? আপনার ভাইজি- আমারই তো মেয়ের সমতুল্য। তাই এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আপনি কিছু মনে রাখবেন না—–।” মুখের উপরে গত রাতে সত্যিকারের এমন বিরুপ ব্যবহারের কথা শুনে দেবদুলাল বাবুর ফর্সা মুখখানা মুহুর্তেই লাল হয়ে উঠলো—! মুখের উপরেই এমন মিছরির ছুরির আঘাতে যেন নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হতে লাগলো—–! বাজার করে ফিরে আসার সময় পথের ‘পরে প্রকাশ্যে উভয়ের কথাবার্তা চলা কালীন চলমান পথযাত্রীরা জানতে পেল গতরাতের এমন ঘটনাটি।কথা শেষ করেই স্বল্পদূরে সুষেন বাবুর বাড়ির গেটে প্রবেশ করতেই দেখা হয়ে গেল অশোক কাহারের সাথে। সে চলন্ত অবস্থায় হাসতে হাসতে গেটের কাছে এগিয়ে এলো। সেও একজন পাড়া-প্রতিবেশী।তার কাছে তখনই জানতে পারলেন গতকাল রাত্রে ঠিক একই রকম ব্যবহার করেছে প্রতিবেশী শ্রদ্ধেয় কৃষ্ণেন্দু বাবুর সঙ্গেও। তিনিও গিয়েছিলেন সঙ্গে তার নয় বছরের ছোট্ট ছেলেকে সাথে নিয়ে।তিনিও খাওয়া দাওয়া না করেই বাড়ি চলে যান—-। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অভুক্তাবস্থায় বাড়ি ফিরে আসার পথে ছোট্ট ছেলের নানান প্রশ্নের উত্তরে ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝাতে গিয়ে তাঁকে হোতে হয়েছে বড্ড নাজেহাল। কৃষ্ণেন্দু বাবু মনে মনে শুধু একটা কথাই ভাবতে লাগলেন-এতদিনে কিছু কিছু লোকের কানাঘুষায় ওদের বাড়ি সম্পর্কে যতটুকু জানতে পেরেছেন- আজ চাক্ষুষ দেখে তার সত্যতা সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারলেন। মুখে মুখে যখন এ কথা ছড়িয়ে পড়ল তখন সকলেই ভাবতে লাগলেন -আজকের এই সভ্য যুগে এ কোন্ ধরনের মানসিকতায় এমন বিরূপ অতিথি আপ্যায়ন?