একপাল ছাগল নিয়েই বাড়ি থেকে বের হল পদ্ম। দীপু গুনে দেখে। চোখ দুটো লোভে চকচক করে। ওর ওই স্বভাব। টাকার গন্ধ পেলেই ছুঁকছুঁক করে।
পদ্মর ভালো নাম পদ্মা। কোনও কালে পদ্মাবতী ছিল। বয়স টা তো থেমে নেই। অনেক দিন আগে ও একটা গ্রামে থাকত। মাটির ঘর দোরে ন্যাতা দিত ওর মা। কী সুন্দর ছিল সেসব দিন। সে কী আর আজকের কথা গো! ওর মা বলেছিল “তোর বাপ রামযাত্রা শুনে এসে দেখলে মেয়ে হয়েছে। এমন ফসসা গায়ের রঙ দেখে নাম দিলে পদ্মাবতী”। পদ্ম বলত “পদ্মাবতী কে গা মা? মা বললে “সেই যে গো জয়দেব পদ্মাবতী পালার। খুব সতীসাধ্বী গো”। পদ্মা মাঠের শেষ প্রান্তে যেখানে ছোট্ট নদী কুলকুল করে বয়ে চলে তার পাশে ছোট্ট ছোট্ট ঘাসে ঢাকা প্রান্তরে ছাগল গুলোকে ছেড়ে দিয়ে চটের বস্তাটা পেতে এক ঘুম দেয়। আজ ঘুমাতে পারল না পদ্ম। কী সব চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। মা বলেছিল “সতীসাধ্বী যারা হয় তাদের পরথম জীবনে খুব কষ্ট “। পদ্মার এই কথাটা মাথাতে ই ঢোকে না। ওই যে তিলু কাকার বৌ টাকে সবাই বলে স্বৈরিণী। ক্যামন করে বলে সব। কতাতে আছে ভাত দেবার কেউ নেই গো/ কিল মারবার গোঁসাই। অমন কুঁড়েশুল বর নিয়েই তো সংসার করলে।
পদ্মার সংসার দেখো। কী কষ্টটা ও করে চলেছে জীবন ভোর। দীপু ওর বড় জামাই। শয়তানের ধারী আর পাজির পা ঝেড়ে সৃষ্টি হয়েছিল বোধ হয়। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে আড় ট্যাঙরা করে দিলে বাপু। খালি চিন্তা শাশুড়ির কোথায় কত টেকা আছে । শালার শকুনের চোখ। পদ্মার দুটো মেয়ে। আর একজন ছিল। সেই লম্বা। টিকালো নাক। সকালে কাজে বের হবার আগে পদ্মকে পেন্নাম করত। রলতো “আমার আস্তে দেরী হলে খেয়ে নিবি মাগো”! সেই ডাক ,সেই নাড়ি ছেঁড়া ধন কোন দেশে হারিয়ে ফেলেছে পদ্মা। মনে মনে কত ডাকে পদ্মা ‘মাকে ভুলে ক্যামনে আছিস বাবা। আয় সোনা আমার। মাণিক আমার “! চোখের জল আর কখনও শুকাবে না পদ্মর। বামুন দের দেবু বলছিল “সব থেকে বড় শোক পুত্র শোক”। পদ্মার মনে হয় ও তো সোয়ামী ছাড়া কখনও কাওকে চায় নি। নিজের যা জুটেছে খুদকুঁডো তা ই খেয়েছে। ওর কেন এমন হল! আজ সকালেই দীপু এসেছিল। বলেছিল “তোমার কাছে তিরিশ হাজার টেকা হবে?” পদ্মার সপাটে জবাব” কুতা পাবো। কী আছে আমার?” দীপুদের মতো মানুষেরা অন্যের অসুবিধা শোনে না। শুধুই নিজের কথা ভাবতে শিখেছে।
দীপুদের বাড়িটা পদ্ম র বাড়ির কাছেই। কিছুতেই দীপুকে মানতে পারে না পদ্ম। কেমন মেয়েটা স্কুলে যাচ্ছিল। নাইনে পড়ছিল। সবাই বলত “তোমার মেয়েটার মাথা ভালো”। ওটাই তো পদ্মর প্রথম সন্তান। তারপর খোকা আর তারপর ছোটো মেয়ে। ওই দীপু প্রতিদিন মেয়েটার পিছু নিত। আজ আইসক্রিম তো কাল পটপটি। ওই করে মেয়েটার মন জিতে নিলে।
সেবার পাড়ার বিশ্বকর্মা পুজোতে দীপুদের বাড়িতে ওদের একটা কুটুম এসেছিল। ঘুসটে ঘুসটে ঠিক এল পদ্মর কাছে। পাড়া গাঁয়ের ব্যাপার। পদ্ম তাকে ডেকে আদর যত্ন করলে। ওলের বড়া খাওয়ালে। র চা করলে। তাকে নোনতা বিস্কুট দিলে। জিজ্ঞেস করলে “তোমার বাড়ি কুতা গা?” ছেলেটা বললে “আমার বাড়ি চাঁপাডাঙা। দীপুর মা আমার মাসিমা হন। সেই হিসেব অনুযায়ী আপনিও আমার মাসিমা।বলেই একটা ঠক করে পেন্নাম করলে।
পদ্মার সাদা মনে কাদা নেই। বললে “ওই কোণের ঘরে আমার মেয়ে পড়ছে। তুমি ওর সাথে কথা বলো। আমার অনেক কাজ। গরু দুটোকে আজ চান করাবো”। ছেলেটা কদিন ধরেই আসছে। বেশ ভাব হয়ে গেছে সোনামণি আর মামণির সাথে। সেদিন স্কুলের ভাত বসিয়ে মাছ ধুচ্ছিল পদ্ম। আর সেই মুহূর্তেই আবার এল ছেলেটা। বলল “কী হচ্ছে মাসিমা?”
একমুখ হেসেছিল পদ্ম। বলেছিল “সোনামণি আমার ফানাভাত আলুসিদ্ধ আর মাছভাজা খেতে বড় ভালোবাসে বাবা”। ছেলেটা আর অপেক্ষা করল না। প্রতিদিন এর মতো আজও মেয়েদের ঘরে গেল। মামণি সামনের বছর হাই ইস্কুলে যাবে। হঠাৎই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মাকে বললে “মা! দীপুদাদা চিঠি দিয়েছে দিদিকে। ওই নতুন দাদাটা দিদিকে দিলে”। রেগে দপ করে জ্বলে উঠল পদ্ম। তার মানে ওই দীপুর চরগিরি হচ্ছে। ছুটল পদ্ম। হাতেনাতে ধরলে চিঠি। আর ছেলেটার গালে বসিয়ে দিলে এক চড়।
দীপু অনেক বড় সোনামণির থেকে। তার উপর কুটের হদ্দ। আর পদ্ম কী গরীব। ওরা আর ও হাভাতে। মেয়েটাকে বেশ করে ঠ্যাঙালো আজ। শয়তান মেয়ে!বল কী করেছিস?” না। পদ্ম কে কাঁচকলা দেখিয়ে মেয়েটা সেদিন ইস্কুল থেকেই পালিয়ে গেল দীপুর হাত ধরে। পদ্ম বিশ্বাস করতে পারে না আজও। পেটের শত্রু। খাল কেটে কুমির আনলে।পদ্ম কতদিন দীপুকে বাড়ির মধ্যেই ঢুকতে দেয় নি। কিন্তু পদ্ম যখন দেখলে মেয়েটার একটা অতিরিক্ত কাপড় নেই। ভাত জোটে না। রুখো চুল। মাতৃহৃদয় কেঁদে ওঠে।
পদ্ম ছাগল নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হল। সাঁঝের আগে যেতে হবে। তারপর কত কাজ। গরু গুলোর জল জাবনা করে গা ধুয়ে সন্ধ্যে ধোঁয়া দেবে। মোট পঁচিশ টা ছাগল আছে ওর। বেশ তাগড়াই। পাইকের গুলো খুব উঁকি দিচ্ছে ওর ঘরে। এই তো কদিন পরেই পুজো। কত দাম হবে মাংসের। আর যত কম টাকা দিয়ে সবাই শুধুই পদ্ম কে ঠকাতে চাইছে।
সব কাজ সেরে পদ্ম উনান জ্বাললো। আজ হাঁসের ডিম রাঁধবে। একটা সরা ভর্তি হাঁসের ডিম। এক পাল হাঁস পুষেছে পদ্ম। খোলেতে গাদা ডিম। আজ আর বার করবে না। একটু চা করে খেল। ভাতের হাঁড়িতে জল ফুটছে। কেমন সোঁওওও আওয়াজ। এই সময়টা বেশ লাগে। হাঁসের ডিম আর চাল ধুয়ে আনলে।
পদ্ম মনে ভাবে তার মায়ের কথা। মা বলত “পদ্ম। যা রাখবি তাই রাখবে। কথাতেই তো আছে ঘরের গাছা আর কোলের বাছা। ওরা তো দেখবে ই”। আবার মনটা হু হু করে। চোখে জল ভরে আসে।
আবার সেই একই ভুল। দুটো ডিম কেন এনেছে পদ্ম। আর একজন তো নেই। সে বলেছিল “মাগো। আমি তোকে কোনো কাজ করতেই দেবো না। তুই হলি আমার মা। তোকে গা ভর্তি গয়না দেবো। দালান কোঠা বাড়ি দেবো”। সব কথা মিথ্যে করে খোকা চলে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে মায়ের বুক থেকে। পদ্ম জানে ওই যে নক্ষত্রখচিত আকাশ ওই আশ্চর্যের মতো পৃথিবীতে অনেক অনেক আশ্চর্য আছে। ঈশ্বর এক আশ্চর্য। পদ্ম কে সবাই শুধুই ঠকিয়ে গেছে। সকাল হলেই যে ঈশ্বর এর নাম নেয় পদ্ম সে ও ঠকিয়েছে। একটা রতন ছিল তাও নিয়ে নিয়েছে।
পাইকের তার থেকে বেশি কী ঠকাবে? কতদিন হয়ে গেল খোকা নেই। তার উপর খোকার শোকে খোকার বাপটা ও চলে গেল। চল্লিশ বছর সংসার করেছে। বিয়ের সময় পদ্ম জেনেছিল কোন এক মুসলমান চাষীর বাড়িতে ওর বর জমি জায়গা দেখশোন করে। চাল নেই, চুলো নেই। অনেক গুলো ভাই এর একটা ঘরে কুঁদোকুঁদি। তারপর এই ভিটেটুকু দিল সেই চাচা। পদ্ম যেন বাঘিনীর বল ধরলে। কত পরিশ্রম। এইসব কথা ভাবছিল পদ্ম। হঠাৎই মা ডাকে সম্বিত ফিরল। সোনামণি এসেছে। বললে “কী রাঁধছিস মা”? পদ্ম মেয়েটাকে অসময়ে দেখে বললে “সাঁঝের বেলা সন্ধ্যে না দিয়ে ঘুরছিস কেনে”? সোনামণি আমতা আমতা করে। বলে “সকালে তোর জামাই কিছু বলে নি?” পদ্ম বুঝতে পারে টাকার ব্যাপার। বললে “আমার টেকা নেই। তোরা সংসার পেতেছিস আমার ভরসাতে নাকি?”
সোনামণির দুর্গতির শেষ নেই। দীপুর কথাতে ভুলে ইস্কুল থেকেই পালিয়ে গেল। দীপুর মাসির ছেলেকে চড় মারলে পদ্ম। আর কী রিরিংসে ওই দীপুর। একটা জামা পরে কতদিন ছিল সোনামণি। একটা কাপড়ের টাকাও দীপুর জোগাড় করার ক্ষমতা নেই।
আর পদ্ম ছেলে মানুষ করেছিল বটে। ছেলের নাম দিয়েছিল সুকুমার। সংসারের হাল ফিরিয়ে ছিল বটে। মরদ জোয়ান ব্যাটা। মাকে বললে “আমি সোনা রূপার কাজ শিখব”। পদ্ম বলেছিল “লেখাপড়া শিখবি নে খোকা?” সুকুমার বলেছিল “মাথার উপরি দুটো বোন। ভাঙা ঘরদোর। আমাকে উপার্জন করতে হবে। একফোঁটা চাষজমি নেই যে চাষ করে খাবো। বাবার বন্ধু অনাথকাকুর দোকানে আমি কাজ শিখব”।
ছেলে কথা রাখলে। খুব তাড়াতাড়ি কারিগর হয়ে গেল। তারপর গঞ্জের মোড়ে একটা দোকান ভাড়ার জন্য যখন কুড়ি হাজার সেলামি চাইলে বাড়ি ওলা তখন একটা দুধেলা গাই বেচেছিল পদ্ম।
কেমন ফুলে ফেঁপে উঠছিল সংসার খানা। মাসে তিরিশ হাজার টাকা উপার্জন করছে সুকুমার। পদ্ম কে কানের দুল,সোনার চেন, সকেট বাউটি ,আংটি আর একটা সোনার লোহা বাঁধানো করে দিলে। দীপুটা ঠিক সেই সময়ই সংসারে প্রবেশ করলে। দেখলে এদের বাড় বাড়ন্ত ভালো ই। সোনামণির কোমল মন জয় করে নিয়ে পালালে। চাল নেই, চুলো নেই। বিয়ে করলে। পদ্মা তো মানতেই চায় নি। সোজা গেল থানায়। বললে “আমার তেরো বছরের নাবালিকা মেয়েটাকে ফুসলে নিয়ে পালিয়েছে দীপু। অফিসার নারীপাচারের কেস দিচ্ছিল। তখন দীপু পদ্ম র পা ধরে কী কান্না। কুমীর এর কান্নাতে সেদিন সবাই ভুলে গেল।
সুকুমার বললে “বিয়ে হয়ে গেছে। এখন যদি ছাড়া ছাড়ি হয়ে যায় তবে এই গেরাম ঘরে সোনামণির বিয়ে হওয়া মুশকিল হবে। যা হবার হয়ে গেছে। এখন মেনে নেওয়া ছাড়া গতি নেই।
সেসব অনেক পুরাতন কথা। তবে খোকার সব কথাই স্পষ্ট মনে আছে পদ্মর। ওই যে ছাগল চরাতে গিয়ে নদীর ধারে ঘাসের নির্জন প্রান্তরে শুয়ে থাকে যখন তখন নদীটার কুলুকুলু ধ্বনি শোনে। প্রতিদিন শোনে। যতদিন এই শরীর টা থাকবে ততদিন শুধুই শুনতে থাকবে কলতান। কতদিন সেই আধো আধো বুলি সবকিছুই ভেদ করে উচ্চারণ করবে পৃথিবীর সেই অকৃত্রিম ডাক “মা আআআ। আমি শুধুই তোমার “। নদীর মতো পদ্ম গাইত ঘুম পাড়ানি গান। পাড়া গাঁয়ের অশিক্ষিত ছাগল চরানি পদ্ম এখন গান গাইতে ভুলে গেছে। এখন গান গাইলে খোকার ঘুম ভেঙে যাবে। সেই যে সেদিন ঘুমাল আর জাগলে না”।
সোনামণি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সাপে ছুঁচো গিলেছে যেন। উগরাতে ও পারছে না আবার গিলতে ও পারছে না। পদ্ম বললে “ডিম খাবি? অনেক ডিম জমেছে।খাস যদি নিয়ে যাস। কাল বাকি ডিম ওপাড়ার মাধুর মাকে দিয়ে দেবো। একটা ডিম সাত টেকা”। সোনামণির চোখে জল। বললে “তোর জামাই বলছিল ছাগলের অনেক দাম। পাঁচটা ছাগল বেচে ই তো তিরিশ হাজার হবে। তোর পঁচিশ টা ছাগল। তার থেকে মোটে পাঁচ টা মোটে দিবি। সবগুলোই তো আর চায় নি”।
চুপ করে থাকে পদ্ম। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলে “টাকাটা কী করবে ?” সোনামণির আশা জাগে। বলে “একটা মোটর সাইকেল কিনবে। একেবারেই নতুন। ওর এক বন্ধুর। বন্ধক রাখবে”।
কোনও উত্তর দেয় না পদ্ম। সোনামণি ডিম নিয়ে চলে যায়। আজকাল মাকে ভয় পায়। কেমন যেন বদলে গেছে মা। বিয়ের পর অনেক কিছুই দিয়েছিল মা। খাট, বিছানা, দীপুর সোনার আংটি, সোনামণির চেন,হাতের বালা,কানের দুল। তখন সুকুমার ছিল। তার আপন ভাই। সোনামণির যখন জমি কিনতে টাকার দরকার হয়েছিল তখনও মা টাকার বন্দোবস্ত করেছিল। মায়ের এলেম আছে। কিন্তু এতদিন বিয়ে হয়ে গেল মা কখনও তার ভিটেতে পা দেয় নি। একমুঠো ভাত খাওয়া তো দূরের কথা। রাতের খাওয়া হয়ে গেলে পদ্ম ঘরে এসে বসে। কাল ছোটো মেয়েটা আসবে। মেয়েটার রক্তে চিনি। পদ্ম এসব ভেবে পায় না। এত চিনি রক্তে ঢুকলে কী করে!
আজকাল নাতি নাতনিদের কথাই ভাবে পদ্ম। সোনামণির ছেলেটা খুব পড়ে। অত লেখাপড়া করলে জজ ব্যারিস্টার হবে। গড়গড় করে ইনজিরি বলে। হাল আমলের ছেলে। কত বোঝদার। সবসময়ই পদ্মর কাছে আসে। কোথায় দীপু আর কোথায় ওর ছেলে। বাপের সব কথা পদ্ম কে বলে দেয়। ঠিক খোকার মতো পদ্ম কে কত ভালোবাসে।
মামণির বিয়ে তো ঘটাপটা করে ই হয়েছিল। তখন খোকা নিজে দাঁড়িয়ে ছোট্ট বোনের বিয়ের সম্বন্ধ করলে। মামণিটা ওর বাপের মতোই কালো। আর জামাই হল কালো ঝিকুটি। পদ্ম বলেছিল দুজনেই কালো তবে ছেলেপুলে সব কালো হবে।
খোকা বললে “শিক্ষিত বংশ মাগো। তুই না করিস নে”। পদ্ম চুপ করে রৈলে। কত গয়না দিলে খোকা। বললে “বোনের বিয়ের পর কোঠা বাড়ি হবে।” পদ্ম কে রাখতে দিলে এক লাখ ষাট হাজার টাকা। আর বিধাতা পুরুষ হাসলে। আবার চোখের জল বাগ মানলো না। কত আশা ছিল ঘর করে রাঙা টুকটুকে ছেলের বৌ আসবে। কত স্বপ্ন। রাতে ভালো ঘুম হয় নি পদ্মর। সকালে উঠে কাজ শুরু করে দিয়েছে। নাতনিটা আজ আসবে। সোনামণির ছেলেটা খাবে। আজ মাংস রাঁধবে পদ্ম। ওগুলো এখন অন্ধের যষ্ঠি। আজ পদ্মর বাড়ি গমগম করবে। সবাই কে পুজোর জামা কাপড় কিনে দেবে পদ্ম। সোনামণির ছেলে বলেছে “কোঠা বাড়ি করো দিদা। ” পদ্মর মনে হয় যেন খোকা বলছে। এই ছেলেটার জন্য বড্ড টান। কেমন যেন খোকার মতো। কোঠা বাড়ি করার টাকাটা দীপুর জন্য নষ্ট হল। কোথাকার কোন কোম্পানির চিটিঙ ব্যবসা। বললে তিন বছরে টাকা ডবল। সব চলে গেল। কী বলবে সে দীপুকে। এখন আবার নতুন চাহিদা। মোটরবাইক। কেনাচ্ছি তোকে! পদ্ম গঞ্জের মোড়ের দোকান থেকেই মাংস কিনল। সবাই কে রান্না করে দেবে আজ। ইস্কুলের মাস্টার মশাই পদ্ম কে চেনেন। একগাল হেসে বললেন “আপনার নাতিটা আমাদের স্কুলের নাম উজ্জ্বল করবে। ওর যত্ন নেবেন। বড্ড ভালো ছেলে”। আনন্দে পদ্মর বুকের রক্ত যেন ছলকে উঠল। সব দুঃখ আজ ম্লান হয়ে গেছে পদ্মর। মনের আনন্দে আজ রাঁধতে বসল। হঠাৎই পদ্মর মনে পরিবর্তন এসেছে আজ। নিজেকে আজ বড্ড দামী মনে হল। মনে হল সে মা। সে জন্মঘর। পৃথিবীর পরম আশ্রয় সে। অজস্র জোনাকিদীপ অন্ধকারের মধ্যেও ওকে চকচকে করে রাখে। আগামী প্রজন্মের বার্তা পায় পদ্ম। তার অন্ধকারের উঠানে চাঁদের জ্যোৎস্না ফিনকি ফোটাবে। মা তো অকৃত্রিম।
রান্নার চালাটা বেশ সুন্দর করে গোবরমাটি দিয়ে লেপেছে পদ্ম। স্নান করে চালের পিটুলি দিয়ে আলপনা এঁকেছে ধানের গোলার কাছে। উঠান জুড়ে পাতা পড়েছিল। কাকভোরে ঝাঁট দিয়েছে। সবার আগে নাতি এল। পদ্ম বললে “তোর সাথে আমার কথা আছে। একটা হিসাব করব”। নাতি বললে “সেটা পরে হবে। এখন কী রান্না করছ সেটা তো বলো”! কান পর্যন্ত হাসে পদ্ম। নাতিকে বলে “আজ বিরাট ভোজপর্ব চলবে। সবাই আজ এখানে খাবে”।
বিরাট হাঁড়িতে মাংস হবে আজ। একে একে সবাই এল। পদ্ম আজ আনন্দে আত্মহারা। সোনামণিকে ডেকে বলছে “মাংস ভালো করে ধুয়ে আন। তার পর চুবড়িতে জল ঝরা। “ সোনামণির জড়তাকেটে যায়। মা ডেকেছে। মায়ের ডাক অবহেলা করার শক্তি কার আছে। মামণি বলে “আমি কী করবো মা?”
ভাত ফুটছে। পদ্ম বললে “অনেক টা পেঁয়াজ বেঁটে মাংস তে মাখা। যখন মশলার সাথে কষবো তখন দেখবি কেমন সুগন্ধ “।
সবাই কাজে ব্যস্ত আজ। পদ্ম এর ফাঁকে ই চলে যায় খোকার ঘরে। খোকার ছবিটা আজ হাসছে। নাতনিটা কখন একটা মালা গেঁথে ছবিতে দিয়ে গেছে। অনেক টা কাছে এল পদ্ম। হাতটা ছবিতে বোলাতেই থাকে। কত কষ্ট করে অতগুলো টাকা মাকে দিয়েছিল খোকা। কোঠা বাড়ির স্বপ্ন তার। তারপর যখন বললে “মাগো! আমি মোটরবাইক কিনব”। ভয় পেয়েছিল পদ্ম। বলেছিল “রাত দুপুরে ফিরিস। কী দরকার ওইসব এর”। খোকা সেদিন মায়ের কথা শোনে নি। তারপর সেদিনের সেই ছিন্ন ভিন্ন দেহটা!!!¡ মাগোওওওও!”
কখন নাতি পিছনে এসে গেছে। বললে ” কী এত রোজ রোজ কাঁদো? কী দরকার আছে বললে না তো!” খাতা পেন আনতে বলে পদ্ম।
দীপু কখন এসে হাজির। বললে “কী ব্যাপার!নাতির সাথে কীসের হিসাব হবে বুঝি?” পদ্ম বলে পঞ্চাশ হাজার করে চারটে গরু আর ছ হাজার করে পঁচিশ টা ছাগল বেচবো। আর কিছু গচ্ছিত সম্পদ আছে। মোট কত টাকা হয় সেই হিসেব “ দীপুর চোখ লোভে চকচক করে ওঠে। বলে “তাহলে বাইক কিনতে পারব”! পদ্মর স্পষ্ট জবাব “ঘর হবে ঘর। কত স্বপ্নের ঘর। আমার ভাবীকালের জন্মঘর। যে ঘরে স্নেহমাখা ঢেউ আছড়ে পরবে। প্রজাপতি মেলে দেবে রঙের বাহার। মাটিতে সবুজ গান শুনতে পাবে। আমার ভাবী মায়েরা খোকাকে ঘুম পাড়াবে ঘুম পাড়ানি গান গেয়ে “ধন ধন ধন মানিকরতন এ ধন যার ঘরে নাই বৃথাই জীবন বৃথাই জীবন “।