ঘোলাটে আকাশটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিবারণ মুখ ব্যাজার করে বললো, ‘কত্তা, আজ তো বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে, জল ধরাতেই হবে?’
থেলো হুঁকোটা এক পাশে নামিয়ে রেখে বৃদ্ধ তারিণী মুখুজ্জে খকখক করে কিছুক্ষণ কাশলেন। তারপর এক দলা কফ দালানের নিচে ফেলে খিঁচিয়ে উঠলেন, ‘বৃষ্টি হলে টোকা মাথায় দিয়ে জল ধরাবি রে হারামজাদা। ইস লবাবপুত্তুর এসেচেন আমার। বলি বৃষ্টির জল জমলে নালা কেটে গঙ্গায় নামাতে হবে না? পশ্চিমের চর একেই আল থেকে আট আঙুল উঁচু, জল জমে ধানগুলো হেজে গেলে কি তোর শ্বশুর এসে খেতিপূরণ দিয়ে যাবে? মাথাটা একেই ধরে আছে, আমাকে বেশি বকাসনে …বলি ও রাখহরি, বেলের পানা আনতে কি বিলেত চলে গেলি নাকি রে উনুনুমুখির ব্যাটা!’
শেষ কথাটা অন্দরমহলের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিয়ে তারিণী মুখুজ্জে মুখ ফিরিয়ে দেখলেন নিবারণ তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে ডান পায়ের নখ দিয়ে উঠোনে আঁকিবুঁকি কাটছে। নিবারণে স্পর্ধা দেখে তারিণী অবাক হয়ে গেলেন। কিন্তু মাথার ব্যথাটে এতটাই বেড়ে উঠেছে যে তিনি গলা ফাটিয়ে চিৎকারও করে উঠতে পারলেন না। লম্ফনোদ্যত বাঘের মত ভারি, চাপা গলায় তিনি বলে উঠলেন, ‘যাবিনে তাই তো?’
নিবারণ এবার কাতর কন্ঢে বলে উঠলো, ‘কত্তা, পশ্চিমের চরে রেতের বেলায় আমি যাব না। কি সব কয় লোকে, তাও আবার গা ঘেঁষে উদ্ধারণপুরের শ্মশান, ওই আপনার হুঁকোর মত চিতে জ্বলছে তো জ্বলছেই, তার উপর …’।
শ্মশানের ঘটনাটা তারিণী নিজেও শোনেননি এমন নয়। বুঝলেন ভয় পাওয়া নিবারণের উপরে চোটপাট করলে সে একেবারে বেঁকে বসবে। একটু ভেবে তিনি গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘আরে শোন না, শ্মশানের দিকে না গেলেই তো হলো। আর তোকে কি একা পাঠাচ্ছি? দু তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে যাস। আর তেনারা তেনাদের মত থাকবেন, তোরা তোদের মত …মুখোমুখি পড়তে হবে কে বলেছে? আর শোন না …’,চোখে একটা জ্বলজ্বলে আলোর ঢেউ তুলে তারিণী বললেন, ‘এ বর্ষাটা কাটিয়ে দে, প্রত্যেককে দু কাঠা ধান দেব আর ফলারে এই ঘন দুধ ,চাঁপা কলা, খই, হে হে …খেয়েছিস বাপের জন্মে ছোটলোকের বাচ্চা?’
নিবারণ তখনো আকাশটা দেখছিল। কালো মেঘ নয়। পচা ডিমের কুসুম রঙের মেঘ একটু একটু করে কালি ধরছে। আজ বোধহয় সারা রাতই এমন গুমোট থাকবে, বৃষ্টি নামতে নামতে ভোর রাত কি সকাল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। গরজ বড় বালাই। অসন্তুষ্ট গলায় সে বলে উঠলো, ‘ধেনো লাগবে কিন্তু এক বোতল। আর কে যাবে সঙ্গে?’
নিবারণ যখন দু জন ঠিকে মুনিষ নিয়ে পশ্চিমের চরে পৌঁছল ঘোলাটে মেঘের মুখ ঢেকে সন্ধ্যা নেমেছে। পূর্বে কুলকুল করে বয়ে চলা গঙ্গার শব্দ শোনা যায় শুধু, জল দেখা যায় না। দক্ষিণে উদ্ধারণপুরের বিরাট শ্মশান, থেকে থেকে ক্ষীণ হরিধ্বনি ভেসে আসছে থেকে থেকে। শ্মশানে মড়া এসেছে। মনটাকে জোর করে অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিতে কোমর থেকে ধেনো মদের বোতলটা হাতে নিল নিবারণ। ঢক ঢক করে কিছুটা তরল গলা দিয়ে নামতে মনের অস্বস্তি ভাবটা অনেকটাই কমে গেল নিবারণের। বোতলটা বাকি দুজনের দিকে এগিয়ে দিয়ে জলসেচের জন্য নদীর পাড় বরাবর রাখা ডোঙাটার দিকে এগিয়ে গেল সে । ওই ডোঙাটি করেই জল নদী থেকে তুলে এনে গড়িয়ে দেওয়া হবে ধানের জমিতে। নদীর উত্তর বাঁকে আকাশের গায়ে খুব ক্ষীণ হলদেটে বিদ্যুতের রেখা দেখা যায়। ডিঙিটার বাঁধনগুলো ভালো করে দেখে নিতে নিবারণ বিড়বিড় করতে থাকে, ‘বিষ নেই কুলোপনা চক্কর, কোথায় পড়ে রয়েচে জলঝড়, ঝিলকানি দেখো না, যেন দাঁত মেলে রয়েছে, গুখেগোর ব্যাটা’।
ডোঙার ছুঁচলো মাথাটা টেনে নদীর জলে নামাতে নামাতে নিবারণ শ্মশানের দিক থেকে ভেসে আসা প্রবল হরিধ্বনি শুনতে পেলো আর একই সঙ্গে কাঁসি, করতালের সঙ্গত। শ্মশানের চিতা জ্বলে উঠেছে। সে দিকে করজোড়ে একটা প্রণাম করে ডিঙিটার দিকে ফিরতেই নিবারণ এক মুহুর্তের মধ্যে পাথর হয়ে গেল। উত্তর দিগন্তে আবার বিদ্যুৎ চমকালো। নিবারণের গোঙানি শুনে অন্য চাষীদুটিও ছুটে এলো পড়িমরি করে।
নিবারণ যেখানে ছবির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তার কিছুটা ডান দিক ঘেঁষে শ্মশানের একটি ঘাট রয়েছে আর সেই ঘাটের ঠিক কিনারায় একটা অন্ধকারে ঢাকা মূর্তি জলের মধ্যে হাত দিয়ে কিছু একটা করছে আর পরক্ষণেই ছুটে যাচ্ছে শ্মশানের দিকে। কিন্তু কিছুদূর গিয়েই আবার ফিরে আসছে জলের কাছে। জলের মধ্যে খলবল করে শব্দ হচ্ছে, শোনা যাচ্ছে রাগের একটা চাপা গজরানি। বেশ কয়েকবার ছুটোছুটি করার পর মূর্তিটা থমকে গেল। কালো অবয়বটার মধ্যে দুটো হলদে আলোর বিন্দু জ্বলে উঠতেই ওরা তিনজন বুঝতে পারলো ওটা এখন নিবারণদের দিকে তাকিয়েই থমকে গেছে। ঝিঁঝিগুলোর ডাক অনেক আগেই থেমে গিয়েছিল। গঙ্গার কুলকুল ধ্বনিকে মনে হচ্ছে কোনো অতিপ্রাকৃত জীব যেন খলখল করে হেসে চলেছে অনাদি কাল থেকে।
হঠাৎ অন্ধকারের স্তূপটা ছুটে এলো নিবারণদের দিকে। কাছে আসতেই তার প্রকৃত রূপ আরও স্পষ্ট করে বোঝা গেল। মানুষের মত দুটো হাত দুটো পা বোঝা যায় তার, কিন্তু শরীরের বাকি অংশে মাংসের তাল যেন যেমন করে খুশি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। একটা কাঁধ অনেকটা উঁচু, অন্য কাঁধ প্রায় কঙ্কালসার, মুখে চোখ নাক ঠোঁট আলাদা করে বোঝা যায় না। গর্জন করতে করতে অদ্ভুতভাবে থপ থপ করে পা ফেলে সেটা এগিয়ে এলো, নিবারণের দিকে কিছুক্ষণ হলুদ চোখ মেলে তাকিয়ে রইলো আর ঠিক তারপরই প্রবল এক টানে ডোঙাটার দড়িদড়া ছিঁড়ে ফেললো। একটা চাপা উল্লাসের গোঙানি বেরিয়ে এলো জীবটার গলা থেকে। সেই অদ্ভুতভাবেই থপ থপ করতে করতে জলের মধ্যে নেমে গেল পিশাচটা। ডোঙাটাকে জলে ভর্তি করে এক প্রচণ্ড শক্তিতে সেটাকে কাঁধে তুলে নিল আর ছুটে গেল শ্মশানের দিকে যেখানে সবে মাত্র জ্বলে উঠেছে চিতাটা।
নিবারণরা কতক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের কিছুই মনে নেই। সম্বিত ফিরলো শ্মশানযাত্রীদের সম্মিলিত ভয়ার্ত চিৎকারে। অনেক মানুষ একত্রে পরিত্রাহি চিৎকার করছে, ‘পালাও …পালাআআআও!’
মন্ত্রমুগ্ধের মত নিবারণ চাষজমি আর শ্মশানের সীমানায় গিয়ে দাঁড়ালো। জ্বলন্ত চিতার আলোতে দেখতি পেলো একটা কিম্ভূতকিমাকার মাংসের স্তূপ ডোঙার জল ঢেলে দিচ্ছে চিতার উপরে, আবার ছুটে যাচ্ছে নদীর দিকে। বেশ কয়েকবার জল ঢালার পর চিতার আগুন নিভু নিভু হয়ে এলো। ডোঙাটাকে একপাশে ছুঁড়ে ফেলে পিশাচটা জ্বলন্ত কাঠের ভিতর থেকে টেনে বার করে আনলো অর্ধদগ্ধ মৃতদেহটা। তার মাথার উপর দিয়ে দিগন্তে আরেকবার ঝলসে উঠলো বিদ্যুৎ। সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে পিশাচটা বসে পড়লো আধপোড়া মৃতদেহটার সামনে আর কোনো দিকে না তাকিয়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো ঝলসানো মাংসের স্তূপে।
নিবারণের বাকশক্তি রোধ হয়ে গিয়েছিল। সে শুধু অনুভব করতে পারলো তার হাত ধরে চাষীদুটি ছুটে চলেছে গ্রামের দিকে। তার চোখের সামনে দুলে দুলে উঠছে উদ্ধারণপুরের শ্মশান, কালীবর্ণ গঙ্গার ধারা, বাঁশঝাড়, ধানী জমি …তারপর সব হঠাৎ ডুব দিল নিকষ কালো অন্ধকারে। শুধু গভীর সুপ্তির মধ্যেও দুটি দীপ্তিমান হলুদ বিন্দু জ্বলে রইলো অশনিসংকেতের মত।
।। দুই।।
উঠোন থেকে রাস্তায় পড়ার মুখেই পিছুডাক শুনলেন হরিহর চক্রবর্তী। গৃহিনী সাধনাদেবী দুর্বল অসুস্থ গলায় বলে উঠলেন, “এই অবেলায় ধুতি জুতো পরে চললে কোথায়?” এই কুলক্ষণগুলি খুব মানেন হরিহর। পিছুডাক, বেড়ালের রাস্তা কাটা, …কিছুতেই ‘দুর কিছু হবে না’ করে উড়িয়ে দিতে পারেন না। উর্ধ্বতন পাঁচ পুরুষের শাক্ত পরিবার তাঁদের। প্রপিতামহ কালীদাস চক্রবর্তী ছিলেন নামকরা তান্ত্রিক। উদ্ধারণপুরের ঘাটে তাঁর পঞ্চমুণ্ডীর আসন আজও দেখা যায়। পরিবারের গৃহদেবতা আর কেউ নন, স্বয়ং কালরাত্রিরূপিনী মহাকালী। শত্রুর যে সকল শিথিল আচার আচরণের সুযোগ নিয়ে তাঁর পূর্বপুরুষ মারণ, উচাটন প্রয়োগ করে এসেছেন সে সকল শিথিলতা নিজের জীবনে পারতপক্ষে ঘটতে দেন না হরিহর। তাই যাত্রার শুরুতেই গৃহিনীর ডাকে মেজাজটা খিঁচড়ে গেল তাঁর। তবে অসুস্থ গৃহিনীর কাতর মুখখানি চোখে পড়তেই রাগ সামলে নিলেন। ধীর পায়ে ফিরে এসে বারান্দার পাশটিতে বসে পড়লেন। সাধনাও বুঝতে পেরেছিলেন তিনি ভুল করেছেন। চল্লিশ বছরের সংসারে তিনি বেশ বুঝেছেন লোকটির বিশ্বাস, অবিশ্বাসগুলি। যথাসম্ভব মেনেও চলেন। তবে আজকের দিনটাই এমন, এমন সব ভুল হয়ে যাওয়ার মতই। দুপুর থেকে একটা জোলো হাওয়া বইছে গঙ্গার দিক থেকে। রোদ পুরো নিভে যায়নি, তবুও জোরালো ভাবটাই যেন তার নাই। উঠোনের বড় নারকেল গাছের মাথাগুলো দুলছে মাথা নাড়িয়ে আর ওখানেই যা একটু রোদের দেখা মেলে। অপেক্ষাকৃত নীচু আম, জাম, কাঁঠালের মাথা পার হয়ে সূর্যের আলোটুকু যেন খুব কষ্টে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নেমে আসছে। এমন কালচে রঙের রোদ একদম ভালো নয়, বুড়োবুড়িরা বলে। দুদিন থেকে সাধনার শরীরটা একদমই ভালো নয়। তার উপর গরুটা পা মুচড়ে পড়ে আছে আজ এক সপ্তাহ। ছেলে রয়েছে দুবাই গত মাস থেকে, বউটা ঘরে একা। তবুও সাধনার কিছু মনে হতো না, যদি আবহাওয়া একটু ভালো থাকত। নীচু গলায় তিনি বললেন, “আজ যেতেই হবে? এই হাওয়া বাতাস, গরুটা, বউটা …আমার কথা নাই বা ভাবলে।” চক্রবর্তী লাল চোখ তুলে তাকালেন। “কাল চতুর্দশী খ্যাল আছে তোমাদের? লাল চন্দন, ধূপ কিছু আছে ঘরে? যিনি চালাচ্ছেন তাঁর কথাই ভুলে বসে আছে সবাই।” “কি আশ্চর্য, সকালে গেলেও তো হয়, বাড়িতে এই অবস্থা!” চক্রবর্তী আর কথা বাড়ালেন না। মা ব্রহ্মময়ীর নাম জপ করতে করতে পথের দিকে এগোলেন। আর কেউ পিছু ডাকল না। চক্রবর্তীর মনে হল, বাড়ির দিক থেকে একটা প্রচণ্ড ঝড়ের শব্দ ভেসে আসছে। চারদিকে হাওয়া বইছে বটে, তবে এমন শব্দ হওয়ার মত তো ঝোড়ো হাওয়া তা নয়। একটু কান পাততেই কিন্তু শব্দটা আর শোনা গেল না। নিজেরই কানের ভুল ভেবে নিয়ে চক্রবর্তী উদ্ধারণপুর ফেরীঘাটের দিকে পা বাড়ালেন। ঘাটে এসে চক্রবর্তী দেখলেন পারাপারের লোকও আজ খুব কম। চার পাঁচটি মজুর কাটোয়া অথবা দাঁইহাট থেকে রোজ এদিকে দিনমজুরি করতে আসে, তারাই রয়েছে। নৌকার ঠিক মাঝামাঝি জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে তারিণী মুখুজ্জের বাঁধা মুনিষ নিবারণ। হাঁটুদুটো মুখের কাছে তুলে চুপ করে আছে সে। একটা ডানা ভাঙ্গা বকের মত লাগছে তাকে। নৌকোয় উঠতেই মাঝি বলে উঠল, “ঠাকুরমশায়ের কাজ কতক্ষণের?” এমন প্রশ্ন সচরাচর নিতাই করে না। খুব বেশি কথার মানুষও সে নয়। চক্রবর্তী একটু থমকে গিয়ে বললেন, “কেন বলো তো নিতাই?” হরিহর নিতাইয়ের পাশটিতেই বসেছিলেন। নৌকার ইঞ্জিনটা চালু করে নিতাই হাল ধরে থিতু হয়ে বসল। গলা নামিয়ে বলল, “মেয়েটাকে দুপুর থেকে খুঁজে পাচ্ছি না ঠাকুরমশাই।” চক্রবর্তী অবাক হলেন। “বলো কি? সে তো ভালো করে চলতেও পারে না!” “তাই তো বলছি। ওর মা বলছিল সকাল থেকে দুবার করে বাড়ি থেকে রাস্তা অবধি চলে গিয়েছিল। বিকেলের দিকে সে মুদীখানা থেকে ফিরে দেখে মেয়ে নেই তো নেইই।” চক্রবর্তী খিঁচিয়ে উঠলেন, “আচ্ছা আহম্মুক তো হে। থানায় না গিয়ে নাও ভাসালে যে বড়!” “এরা তা হলে কী করে ফিরত ঠাকুরমশাই? এই তো এখন বাজার করে ঘরে ফিরবে, তারপর হাঁড়ি চড়বে, তার উপর নিবারণের বাড়ি আবার দাঁইহাট অগ্রদ্বীপের মাঝামাঝি, ট্রেন ছাড়া উপায় নেই। আর কাটোয়ার দিকেই তো যাচ্ছি, আপনিও সঙ্গে রয়েছেন, একবার কাটোয়া থানাটা ঘুরেই না হয় আসব।” চক্রবর্তী ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন নিতাইয়ের দিকে। তারপর নরম গলায় বললেন, “কিন্তু বাবা, কাটোয়া থানায় তো কেস নেবে না। আমরা পড়ি হলাম গিয়ে কেতুগ্রাম দুই নম্বর থানার ভিতরে। ইস, কী যে ভুল করলে!” নিতাই ধরা গলায় বলল, “ও মেয়ে তো মা অর্ধেক নিয়েই রেখেছেন, গেলেই বা কী?” চক্রবর্তী রেগে গেলেন। “কী যা তা বলছ নিতাই? মা আমাদের শুধু দিয়েই যান, কিছুই নেন না। পাগলী তোমার শুধু চাট্টি ফুল, চন্দন আর নিরাসক্ত ভক্তি পেলেই খুশি। তোমার মেয়ে তুমি পেয়ে যাবে।” কাটোয়া নগরীর আলোকময় নদী ঘাট ক্রমে এগিয়ে আসতে লাগল। নিতাইয়ের চোখে সে আলো যেন আরও আরও উজ্জ্বল হয়ে ধরা পড়ছে। চক্রবর্তীর কথায় তার মনে আশা জেগে উঠেছে। এক হাঁটু ধুলো নিয়ে চাষী মানুষগুলি নেমে গেল। নিবারণ সময় নিল। তার মধ্যে স্পষ্ট একটা ঘোর লাগা কাজ করছে। নৌকার কাছি বাঁধতে বাঁধতে দেখা গেল একটা কীর্তনের দল জলের ঠিক কিনারায় বসে উদ্দাম ভাবে খোল করতাল বাজিয়ে হরিনাম করছে। নিবারণ যেন হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠলো। সে ধীর পায়ে পিছু ফিরে তাকাতে তাকাতে নেমে যাওয়ার পরেও চক্রবর্তী কিছুক্ষণ বসে রইলেন। পশ্চিমে অজয়ের ধারাটি রক্তিম হয়ে আছে এখনও, আর এদিকের ভাগীরথীর জলে আঁধার ঘনিয়েছে। নিতাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন চক্রবর্তী, “তুমি মিনিট কুড়ি দাঁড়াও হে, আমার এই ঘাটের বাজারেই কাজ।”
নিতাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আজ আর একা ফেরার সাহস নেই ঠাকুরমশাই। আপনি আসুন, তারপরই যাব।” শ্রাবণের এ ঝোড়ো সন্ধ্যায় আর কেউ উদ্ধারণপুরমুখী হবে না বলেই মনে হয়। নিতাইকে বেশিক্ষণ বসিয়ে রাখা অন্যায় হবে ভাবতে ভাবতে চক্রবর্তী ঘাটবাজারের দিকে এগিয়ে গেলেন।
।। তিন।।
জনার্দনের সামন্ত তিন পুরুষ ধরে পূজাসামগ্রীর ব্যবসা করে আসছে। চক্রবর্তী তাদের বাঁধা খদ্দের। দূর থেকে তাঁকে আসতে দেখেই জনার্দনের মুখে হাসি ফুটল। হাত জোড় করে বলে উঠল, “আপনাকে দেখে হিংসে হয় ঠাকুরমশাই।” চক্রবর্তী পূজা সামগ্রীর তালিকা পকেট থেকে বার করতে করতে বললেন, “কেন হে সামন্ত, আমার নামে লটারি লেগেছে নাকি?” সামন্ত দু হাত কানে দিয়ে বলল, “টাকাপয়সায় আপনার মোহ আছে এ কথা মনে আনলেও সবংশে ধ্বংস হব যে ঠাকুরমশাই। আসলে এমন নিবিড় করে ব্রহ্মময়ীকে পেয়েছেন, দুর্যোগ উপেক্ষা করেও চতুর্দশীর উপাচার খরিদ করতে চলে এসেছেন। এমন নিবেদন আমাদের কোথায়?” অন্য দিন হলে চক্রবর্তী বসে যেতেন দু দশ কথা নিয়ে। কিন্তু আজ মনের মধ্যে বার বার নিতাইয়ের করুণ মুখটা ভেসে উঠছে। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, “কিছুই করতে পারিনি হে, সেই সংসারের ডোবাতেই আবদ্ধ হয়ে রইলুম। তুমি একটু তাড়াতাড়ি করো, নিতাইয়ের মেয়েটা আজ আবার কোনদিকে চলে গিয়েছে কাউকে না বলে। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।” সামন্ত আশ্চর্য হল। “নিতাই বলতে, আপনাদের গ্রামের সেই নৌকাওয়ালা? কিন্তু তার মেয়ের যে বলেছিলেন জন্ম থেকেই রোগ, বিরাট দেহ নিয়ে পায়খানা বাথরুম অবধি করতে পারে না, সে কোথাও যায় কী করে?” পূজার সামগ্রী বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। দাম মিটিয়ে চক্রবর্তী বললেন, “সেটাই তো আশ্চর্য লাগছে। দেখি কাল একবার থানার দিকে যেতে হবে রাতের মধ্যে হদিশ না মিললে।” “মায়ের কাছে একবার বলবেন না?” চক্রবর্তী চমকে উঠলেন। তারপর কোনো উত্তর না দিয়ে সামন্তের দোকান ছেড়ে ঘাটের দিকে দ্রুতপদে এগিয়ে গেলেন। ঘাটের ঠিক আগের মোড়টা সরু গলির শেষ প্রান্তে। আলো নেই বললেই চলে এদিকটায়। দু দিকে প্রাচীন বাড়ির ছোট ইঁটের লাল দেওয়াল। আনমনে হাঁটছিলেন চক্রবর্তী। হঠাৎ দেওয়ালের পাশে জমে থাকা অন্ধকার থেকে একটি লোক খুব নীচু গলায় বলে উঠল, “ও ঠাকুর!” চক্রবর্তীর হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠেছিল। লোকটাকে চেনার পর একটু একটু করে হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক হতে লাগল। একটু আগেই সে চক্রবর্তীর সঙ্গে এক নৌকায় চড়ে নদী পার হয়েছে, তারিণী মুখুজ্জেদের বাঁধা কৃষক নিবারণ। যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থেকে চক্রবর্তী বলে উঠলেন, “কী ব্যাপার রে নিবারণ? তুই বাড়ি যাসনি?” “না ঠাকুর। তোমার জন্যই দাঁড়িয়ে ছিলাম।” “কেন রে, কিছু বলবি?” নিবারণ হাঁ করে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল কয়েকবার, তারপর কেটে কেটে বলল, “ঠাকুর, ওদিকে ও থাকে।” চক্রবর্তীর সময় বয়ে যায়। ওদিকে নিতাই বসে আছে তাঁর পথ চেয়ে। বিরক্ত হয়ে চলে আসছিলেন, নিবারণ এক দমে বলে ফেলল, “শ্মশানের দিকে ও থাকে ঠাকুর। মড়া পোড়ানো হয়ে গেলে চিতায় চিতায় ঘোরে।” চক্রবর্তী চমকে উঠলেন। “কে ঘোরে? কী সব বলছিস?” নিবারণ চোখ বড় বড় করে বলল, “আমরা জানি না ঠাকুর। রাতে ধানে জল ধরানোয় ডবল মজুরি, তাও আমরা আর যাই না।” “কার কথা বলছিস, সেটা তো পরিস্কার করে বল।” নিবারণ এগিয়ে এল খুব কাছে। তারপর হাত নেড়ে নেড়ে বলল, “জানি না। মাংস খায় কুকুর বেড়ালের, আধপোড়া মড়ার। আমি একবার সামনাসামনি পড়ে গিয়েছিলাম, কি করে যে বেঁচে ফিরেছি গোবিন্দই জানেন। ” লোকটার মুখ থেকে পচাইয়ের গন্ধ বেরিয়ে আসছে ভকভক করে। নাকে হাত দিয়ে চক্রবর্তী ধমকে উঠলেন, “দুর্ হ নেশাখোর।” সভয়ে পিছিয়ে গেল নিবারণ। চক্রবর্তী চলে আসছিলেন। পিছন থেকে নিবারণের অস্পষ্ট জড়ানো গলা ভেসে এল, “আমি নেশা করেছি, তা-ও বিশ্বাস করো ও ওখানে ঘোরে ঠাকুর, চিতায় চিতায় ঘোরে। ওদিকে রাতবিরেতে নিতাইয়ের মেয়েকে খুঁজতে কিন্তু যেও না ঠাকুর,নিতাইকেও যেতে দিও না। ” ঘাটের কাছে পৌঁছতেই চক্রবর্তীর বুকটা ধক্ করে উঠল। নিতাই ঘাড় গুঁজে বসে আছে নৌকার মধ্যে আর তার মাথার ঠিক সোজাসুজি অন্য পাড়ে জ্বলে উঠেছে শ্মশানভূমির চিতা। হঠাৎ দেখলে মনে হয় সে আগুনের লেলিহান শিখা বুঝি নিতাইয়ের মাথা থেকেই উঠে আসছে। এক লহমায় চক্রবর্তীর মনের মধ্যে খেলে গেল তাঁর পরিবারের সবকটি দৃশ্য, –পা ভাঙা গরু, অসুস্থ স্ত্রী, শূন্য ঘরে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে থাকা পুত্রবধূ, বাড়ি ছাড়ার মুহুর্তে কানে ভেসে আসা সোঁ সোঁ শব্দ। নৌকোর কাছে এসে চক্রবর্তী নিতাইকে জাগালেন। সে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। “মা, এসেছিস মা!” তারপরই চক্রবর্তীর মুখের দিকে কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, “ও, ঠাকুরমশাই!” নৌকার ইঞ্জিন চালু করে নিতাই আবার ঝিমিয়ে পড়ল। মাঝনদীতে পৌঁছতেই হঠাৎই হাওয়াটা বন্ধ হয়ে, প্রবলভাবে বৃষ্টি এল। নিতাইয়ের বিশেষ হেলদোল বোঝা গেল না। সে ভিজতে লাগল পাথরের মূর্তির মত। চক্রবর্তী দেখলেন উদ্ধারণপুরের শ্মশানে চিতার আগুন দপ করে নিভে গেল।
।। তিন।।
ঘাটে নৌকো বাঁধতে বাঁধতে নিতাই বলল, “আপনি এগোন ঠাকুরমশাই, আমি একটু বোনের বাড়ি ঘুরে আসি এনায়েৎপুরের দিকটায়।” চক্রবর্তী ছাতার আড়ালে সামগ্রী আর মাথা বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বৃষ্টির চড়বড় শব্দে অর্ধেক কথা শোনা যায় না। শুধু ‘এনায়েৎপুর’ শব্দটা আন্দাজ করে চেঁচিয়ে বললেন, “এই বৃষ্টির মধ্যে এতটা যাবে আবার, কাল গেলে হয় না?” নিতাই দৌড়ে ঘাট বেয়ে উঠে যেতে যেতে বলল, “না ঠাকুরমশাই, মেয়ের মা আমাকে ঘরে ঢুকতে দেবে না। আসি …” নিতাইয়ের বাকি কথা বৃষ্টির প্রচণ্ড শব্দে ডুবে গেল। চক্রবর্তী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে উঁচু রাস্তার দিকে চলতে শুরু করলেন। আজকের রাতটা যেন এ পৃথিবীর রাত নয়। গাছের মাথায় মাথায় দমকা বাতাস ছুটে বেড়াচ্ছে ক্ষুধার্ত রাক্ষসীর মত। ছিটকে পড়ছে ভাঙা ডালপালা, শূন্য পাখির বাসা। একটা বাতাসের গোঙানি আর বৃষ্টির শব্দ শুনে মনে হয় উদ্ধারণপুরের মানবাত্মা যেন ডুকরে কেঁদে উঠছে থেকে, ঝরিয়ে চলেছে চোখের জল।
‘মা, মা গো, ব্রহম্ময়ী মা, রক্ষা করো’, আকুল আর্তি বেরিয়ে এলো চক্রবর্তীর গলা থেকে। গলার পৈতেটা শক্ত করে ধরে তিনি খুব সাবধানে পিচ্ছিল খাড়াই পথে উঠতে লাগলেন। বাতাসের ঝাপটায় বেশি দূরে দৃষ্টি স্থির রাখা যায় না। তাই আন্দাজে পথ চলতে লাগলেন প্রৌঢ়।
কিছু দূর ওঠার পর তাঁর হঠাৎ মনে পড়ল শ্মশানের দিক থেকে অস্পষ্ট একটা চিৎকার ভেসে এল। প্রথমে ভেবেছিলেন তিনি ভুল শুনেছেন, কিন্তু পর পর দু তিনবার শোনার পর বুঝলেন এ শোনার ভুল নয়। হাতঘড়ি বলছে রাত আটটা। কিন্তু হাকুচে অন্ধকারে মনে হয় নিশুতি রাত। ল্যাম্পপোস্টের ভুতুড়ে আলোগুলো নিষ্প্রভ হয়ে এসেছে। চক্রবর্তীর মনে হলো আলোগুলো না থাকলেই বরং বেশি ভালো হতো। আধা আলো আধা অন্ধকারে চোখে ঘোর লেগে যায়, বিভ্রম সৃষ্টি করে। নুয়ে পড়া গুল্মগুলো দেখে হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়ে গাছপালার নিশ্ছিদ্র ছায়ার ঘেরাটোপ ছেড়ে কে যেন নিঃশব্দে আলোর বৃত্তের সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছে। গনগনে চোখে তার জিঘাংসা, মুখে কুটিল হাসি। দুই রাস্তার সংযোগস্থলে এসে চক্রবর্তী দাঁড়িয়ে পড়লেন। বাঁ দিকে এগোলে লোকালয়, ডানদিকে ঘাট থেকে দশ পা এগোলেই মহাশ্মশান। ঘাস গজিয়েছে বর্ষার জল পেয়ে, শ্মশানে ঢোকার মুখেই কয়েকটা বড় বড় মান্দার গাছ, কালকাসুন্দের ঝোপ। হলুদ ফুলগুলোর রং বোঝা যায় না নামমাত্র আলোতে। পাপড়িগুলো বৃষ্টির জলে সাড়া পেয়ে যেন ভয়ে কুঁকড়ে আছে। এদিকটায় আসার পর কিন্তু চিৎকারটা একবারের জন্যও শোনা যায়নি। চক্রবর্তী নির্বাপিতপ্রায় চিতার দিকে এগিয়ে গেলেন। বৃষ্টির তোড়ে চিতাটা পুরো নিভে গেছে। ঠিক তার নীচেই কলকল শব্দে বয়ে যাচ্ছে ভাগীরথী। চিতার আধপোড়া কাঠগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে দেখে চক্রবর্তী খুব অবাক হলেন। এমনটা তো ছড়িয়ে পড়ার কথা নয়। হঠাৎই একটা অসম্ভব প্রশ্ন মাথায় এল তাঁর। সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য চক্রের কাঠের চুলার ভিতরে দৃষ্টি ফেললেন। রাস্তার আলো এতদূরে এসে পৌঁছয় না। তবে যতটুকু দেখা যায়, তাতেই চক্রবর্তীর হাত পা ঠান্ডা হয়ে এল। শূন্য আধপোড়া চিতা! আর তার মধ্যে কোনো মরদেহ নেই! পিছু ফিরতে গিয়ে, কাদায় পিছলে পড়ে গেলেন চক্রবর্তী। সামনেই কালকাসুন্দের ঝোপ। কোমরে বেশ ব্যথা পেয়েছেন তিনি। মাটিতে ভর দিয়ে উঠতে গিয়ে তাঁর চোখ পড়ল অন্ধকার ঝোপের ভিতর। বৃষ্টির শব্দে বাকি সব শব্দ মুছে গিয়েছে আর কালকাসুন্দের হলুদ ফুলের দুটি গুচ্ছের মাঝখান দিয়ে দুটো চোখ তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে। প্রচণ্ড ভয়ে চিৎকার করে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন চক্রবর্তী। এ তো নিতাইয়ের মেয়ে আদুরি! কাদামাটির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে মেয়েটা। চক্রবর্তী তাড়াতাড়ি তার দিকে এগিয়ে গেলেন। মেয়েটা খাপছাড়া ভাবে হঠাৎ জড়ানো গলায় গড়গড় করে বলে উঠল, “দেতু, এদ্দম আতবে না এতানে, দাও, তলে দাও।” চক্রবর্তী পিছিয়ে এলেন। মেয়েটার যা অবস্থা যখন তখন হার্টফেল করবে। কিন্তু ওকে ফেলে গ্রামে খবর দিতে গেলে মেয়েটা আবার ঠাণ্ডায় নিউমোনিয়া বাধিয়ে রাখবে। তিনি দূর থেকে নরম গলায় বললেন, “তুই বাড়ি চল মা, তোর বাবা খুব কাঁদছে।” আদুরি মুখ উপর দিকে তুলল শুয়ে শুয়েই। “ন্ না, দাবো না …ও আতবে, ও মানতো থাওয়াবে, তুমি দাও দেতু …তোমাল ব্যাদে …বয় বয়!” চক্রবর্তী নিজের ব্যাগের দিকে তাকালেন। কাপড়ের থলি। উপরে সুতো দিয়ে বোনা বাঘের ছবি। আহা রে, মেয়েটা বাঘের ছবি দেখে ভয় পাচ্ছে। কোন শয়তান রুগ্ন মেয়েটাকে মাংস খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে শ্মশানে নিয়ে এসেছে জানতে পারলে নিজের হাতে তাকে মা ব্রহ্মময়ীর পায়ে বলি দিতেন। বাঘ আঁকা দিকটা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে তিনি হাত বাড়ালেন আদুরির দিকে। “আয় মা, বাড়ি চল। আমি তোকে মাংস খাওয়াব।” জ্বলজ্বল করে উঠল আদুরির চোখ। চক্রবর্তীকে অবাক করে দিয়ে চলৎশক্তিহীন মেয়েটা উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে এল ঝোপের ডালপালা ভেঙে। কাদামাখা মোটা মোটা পায়ের গোড়ালি জড়িয়ে আছে দুটো কেঁচো। গা গুলিয়ে উঠল চক্রবর্তীর। এ কাদামাটির জায়গা থেকে মেয়েটাকে বার করে নিয়ে যেতে পারলে তিনি বাঁচেন। ‘আয় আমার সঙ্গে’ বলে চক্রবর্তী এগিয়ে গেলেন কংক্রীট বাঁধানো রাস্তার দিকে। পিছনে ভারী শরীরটার এগিয়ে আসার শব্দ শুনতে পেলেন। অদ্ভুত চলার ধরণ, যেন দুটো শরীর এগিয়ে আসছে এক সঙ্গে। চক্রবর্তীর মনে হল আদুরির গলা থেকে একটা উল্লাসের গোঙানি বেরিয়ে আসছে। চট করে একবার মাথা ঘুরিয়ে দেখলেন, না তেমন কিছুই নয়। মাথা নীচু করে এগিয়ে আসছে মেয়েটা, রুক্ষ চুলগুলো পড়ে আছে মুখের উপর। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “তোকে কে ডেকে এনেছিল রে মাংস খাওয়ানোর কথা বলে?” আদুরি মুখ তুলল না। অস্পষ্ট সুরে বলল, “তিনি না তো। বননো, মানতো আদবে ততানে। তাপ্পর দিনো না। নিয়ে ওইতানে তলে দ্যালো।” হাত দিয়ে শ্মশানের পিছনে উঁচু হয়ে থাকা বাঁশঝাড়ের দিকে দেখালো আদুরি। চক্রবর্তীর শিরদাঁড়াটা ঝনঝন করে উঠল প্রবল ঠাণ্ডায়। তিনি বিহ্বল হয়ে প্রশ্ন করলেন, “কী নিয়ে গেল?” আদুরি জড়ানো গলায় বলল, “হি হি, মানতো, পোআ মানতো।”
।। চার।।
টর্চ জ্বালিয়ে বাড়ির উঠোনে ঢুকতেই চক্রবর্তী লক্ষ্য করলেন পশ্চিমের ঘরের আলো নিভে গেল, আর সে ঘরের পিছনের দরজা দিয়ে খুব আবছা একটা ছায়ামূর্তি বাড়ির পিছনের বেড়ার দিকে ছুটে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। চোয়াল শক্ত করে বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে চক্রবর্তী উচ্চকন্ঠে ডাকলেন, “সাধনা, একবার বাইরে এসো তো।” কেউ সাড়া দিল না। চক্রবর্তী আরও বারকয়েক ডাকার পর পশ্চিমের ঘরের দরজা খুলে পুত্রবধূ বেরিয়ে এল। তার চালচলনে একটা ত্রস্ত ভাব লক্ষ্য করলেন চক্রবর্তী। তীব্র স্বরে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “মিলি, তোমার মা কোথায়?” মাথা নীচু করে মিলি বলল, “মা ঘুমোচ্ছেন।” “ঘুমোচ্ছেন! এই সন্ধ্যা রাতে ঘুমোচ্ছেন মানে?” “জানি না বাবা।” “ওষুধ খেয়ে শুয়েছে নাকি?” মিলি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল। চক্রবর্তী বলে উঠলেন, “উত্তর দিচ্ছ না যে!” মিলি চোখ তুলে বলল, “হ্যাঁ, মায়ের ব্যথাটা বেড়েছিল, তাই আমিই ওষুধটা দিয়েছি।” চক্রবর্তী খুব ভালো করে মিলিকে লক্ষ্য করছিলেন। চোখের কাজল লেপটে গেছে, সিঁদুরের টিপটা ঠিক মাঝামাঝি নয় …এক পাশে সরে গেছে। ঠিক যেন অন্ধকারে আয়না ছাড়া তাড়াহুড়ো করে পরা টিপ। প্রচণ্ড রাগে কিছু একটা বলে উঠছিলেন চক্রবর্তী, এমন সময় বৃষ্টির শব্দের মধ্যেই পিছন থেকে ভেসে এল আদুরির ফিসফিসে গলা গলা, “ও দেতু …মানতো?” মিলি ভয়ে চাপা আর্তনাদ করে উঠল, “ওটা কে বাবা? আপনার পিছনে ও কে?” চক্রবর্তী মনের মধ্যে একটা ক্রূর আনন্দ উপভোগ করে উঠলেন। আদুরির হাত ধরে মিলির সামনে এনে দাঁড় করালেন তিনি। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “আদুরি, তুমি স্নান করে বৌদিদির ঘরে শোও আজ রাতটুকু। আজ তো বাজার বন্ধ, কাল তোমাকে মাংস এনে খাওয়াব। যাও।” মিলি আর্তনাদ করে উঠল। “এ কী বলছেন বাবা? না না, ও মানে …আদুরি, আপনি বুঝতে পারছেন না, একটা বাইরের মেয়ে আমার ঘরে …!” চক্রবর্তী বিবেকের উপর শেষ পাথরটি চাপিয়ে বললেন, “ও বাইরের ‘মেয়ে’তে অসুবিধে, বাইরের ‘লোকে’ অসুবিধে নেই?” মিলি বিস্ফারিত চোখে কিছুক্ষণ চক্রবর্তীর দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। আদুরিকে স্নানঘরটা দেখিয়ে দিয়ে চক্রবর্ত্তী গোয়ালঘরের দিকে যাবেন ঠিক করলেন। পা ভাঙা গরুটাকে অনেকক্ষণ দেখা হয়নি। অন্দরে ঘুমন্ত সাধনার শিয়র থেকে টর্চটা নিয়ে গোয়ালঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন চক্রবর্তী। আলো জ্বেলে গোয়ালঘরে ঢুকেই তাঁর হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে গলার কাছে চলে এল। গরুটা পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে আর তার একটা বাঁট কামড়ে পড়ে আছে ধূসর রঙের বিরাট একটা সাপ। মাঝে মাঝে সরু লেজটা নড়ে নড়ে উঠছে সরীসৃপটার। চক্রবর্তী চিৎকার করে উঠলেন। দরজার পাশেই একটা মোটা পাঁচনবাড়ি রাখা ছিল। সেটা হাতে নিয়ে সাপটার মাথা লক্ষ্য করে পাগলের মত চালাতে লাগলেন তিনি। পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহের ফলে তাঁর মাথা ঠিক ছিল না। কিছুক্ষণ পর সাপটা নেতিয়ে পড়ল। হু হু করে বৃষ্টি ছিটিয়ে ছুটে এল এক ঝলক ঝোড়ো হাওয়া। প্রবল আতঙ্কের সঙ্গে চক্রবর্তী লক্ষ্য করলেন, পাঁচনের আঘাতে গরুর বাঁট ফেটে গলগল করে বেরিয়ে আসছে রক্ত। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। ত্রয়োদশীর রাতে এ ঘোর মহাপাপ মা ব্রহ্মময়ী তাঁর হাত দিয়ে কেন ঘটালেন, ভাবতে ভাবতে স্খলিতপদে গোয়ালঘর থেকে বেরিয়ে এলেন চক্রবর্তী। ঝমঝম করে ঝরে পড়ছে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি। এ বৃষ্টির শেষ নেই, সমগ্র চরাচর ডুবিয়ে, তবেই যেন এ প্রলয়ঙ্কর ধারাপাতের পরিসমাপ্তি ঘটবে। টলতে টলতে নিজের ঘরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে দিলেন হরিহর চক্রবর্তী। সাধনার শিয়রে রাখা কাচের গ্লাস। তার পাশে ঘুমের ওষুধের টিনফয়েলটা পড়ে আছে। তা থেকে গত দু দিন দুটো ওষুধ খেয়েছে সাধনা। আরও আটটা ট্যাবলেট থাকার কথা। বুকে হাত দিয়ে বসে পড়লেন চক্রবর্তী। আর মাত্র দুটো ট্যাবলেট পড়ে আছে। গ্লাসের নীচে সাদা সাদা গুঁড়ো লেগে আছে। তার মানে …উঃ মা গো, সাধনা! চক্রবর্তী মেঝের উপরে শুয়ে পড়লেন। পায়ের আঘাতে থলে থেকে মেঝের উপরে ছড়িয়ে পড়ল রক্তচন্দন, সিঁদুর, ধূপকাঠি, ধুনো …আর ঘরের উজ্জ্বল আলোটা ঠিক তখনই কয়েকবার দপ দপ করে উঠে একেবারে নিভে গেল।
।। পাঁচ।।
স্যাঁতসেঁতে মেঝের উপর বুক দিয়ে পড়ে ছিলেন চক্রবর্তী। এক ফোঁটা জল চোখ ফেটে বেরিয়ে এল না, শোনা গেল না এক দমক দীর্ঘশ্বাসেরও। শুধু চরাচর জুড়ে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ। ভয় পাওয়া কুকুর হঠাৎ হঠাৎ ককিয়ে ওঠে বেড়ার পাশে। উঠোনে জমে থাকা বৃষ্টির জলে ছপ ছপ শব্দ তুলে ছুটে যেতে যেতে কোনো লঘু শরীর থমকে দাঁড়ায়, আবার ছুটে হারিয়ে যায় অন্ধকারে। মেঝেতে মিশে ছিলেন চক্রবর্তী, ভাবছিলেন এমন ঘোরের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু চলে আসে না কেন? তাঁর বেঁচে থাকার তো আর কোনো কারণ অবশিষ্ট রইল না। সহধর্মিণীকে বিষ খাইয়ে মেরেছে দুশ্চরিত্রা পুত্রবধূ, ব্রাহ্মণের ছেলে হয়ে নিজের হাতে গো -হত্যা করেছেন …এ জীবন আজ রাতেই ধ্বংস হয়ে যাক। হঠাৎ চক্রবর্তীর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল উঠোনের বিপরীত প্রান্তে অন্ধকারে ডুবে থাকা কালীমূর্তিটির উপর। আগুনের মত গরম হয়ে উঠল তাঁর সারা দেহ। কাঁপতে কাঁপতে উঠে পড়লেন মেঝে থেকে। টলতে টলতে ঘরের বাইরে এলেন। বারান্দার এক পাশে একটি কোদাল রাখা ছিল, সেটি হাতে নিয়ে তিনি উঠোনে নামলেন। গোড়ালি ডুবে গেল জলে, পিচ্ছিল উঠোন পার হয়ে ওপাশের টিন দিয়ে বানানো ঘরটির দিকে এগিয়ে চললেন। যাকে তিনি সারা জীবন পুজো করে এসেছেন, ব্রহ্মময়ীর সে মৃন্ময়ী মূর্তি আজ তিনি নিজের হাতে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেবেন। কিন্তু দুর্বল শরীরে কিছুদূর যাওয়ার পরই তাঁর মাথাটা ঘুরে উঠল। টাল সামলাতে না পেরে তিনি বসে পড়লেন উঠোনে, কাদা জলের মধ্যেই। একটা ঘোরের মধ্যে তিনি জলকাদার মধ্যে বসে ছিলেন। এমন সময় তাঁর মনে হল বাড়ির সামনের রাস্তা বেয়ে কয়েকজন এগিয়ে আসছে। টর্চের আলোগুলো দুলছে আর সে আলোর রশ্মি চোখে এসে পড়তেই চক্রবর্তীর দুর্বল ভাবটা কেটে গেল। আলোগুলো এগিয়ে এলে সামনের মানুষটিকে চেনা গেল। নিতাই। সে বিস্ফারিত চোখে চক্রবর্তীর দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হয়েছে ঠাকুরমশাই, এ অবস্থা হয়েছে কেন আপনার?” চক্রবর্তীর হাত দুটো ঝুলে পড়ল। অসম্ভব ভাঙা গলায় তিনি বললেন, “বৌমার ঘরে তোমার মেয়ে আছে নিতাই, চাইলে নিয়ে যেতে পারো, নয় তো সকালে বাদলা কমলে…” নিতাই বিস্মিত গলায় বলল, “কার কথা বলছেন ঠাকুরমশাই? মেয়ে তো বাড়িতেই, তার মায়ের সঙ্গে অভিমান করে চৌকির নীচে লুকিয়ে ছিল… আর আপনাকে সে কথা বলতেই এত রাতে এখানে আসা।” চক্রবর্তী প্রচণ্ড রাগে চিৎকার করে উঠলেন, “পাগল না গুলিখোর… কোনটা প্রমাণ করতে চাইছ আমাকে? এরপর বলবে, গোয়ালঘরে গরুটাকে, শোবার ঘরে সাধনাকে আমিই খুন করেছি, আর বৌমার ঘরে… হ্যাঁ নিতাই, বৌমার ঘরে ও কে তবে?আমি কাকে নিয়ে এলাম শ্মশান থেকে?” চক্রবর্তী উর্ধ্বশ্বাসে ছুটলেন মিলির ঘরের উদ্দেশ্যে, তাঁর পিছনে ছুটল নিতাই ও বাকি লোকগুলি। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। চক্রবর্তী দরজার উন্মাদের মত পদাঘাত করতে লাগলেন আর চিৎকার করতে লাগলেন, “ঘরের ভিতরে যেই থাকিস না কেন, দরজা খোল …আমি ব্রহ্মময়ীর পূজারি, এক তাঁকে ছাড়া কাউকে ডরাই না …ও নিতাই, হাঁ করে দেখছ কি? ভেঙে ফেল দরজা, ভাঙো …” উপর্যুপরি পদাঘাতে কাঠের দরজা ভেঙে পড়ল। নিতাইয়ের হাত থেকে টর্চ কেড়ে নিয়ে চক্রবর্তী সবার আগে ঘরে ঢুকে গেলেন। সারা ঘরের দেওয়াল মেঝে ঘুরে টর্চের আলো বিছানার উপর থিতু হল। চক্রবর্তী চাপা একটা আর্তনাদ করে পিছু হটতে হটতে পড়ে গেলেন। নিতাই এগিয়ে এসে চক্রবর্তীর হাত থেকে টর্চটা নিয়ে বিছানার উপরের ফেলল। বিছানা ভেসে যাচ্ছে তাজা টকটকে রক্তে। মিলির মাথাটা পিঠের দিকে সম্পূর্ণ মুচড়ে ঘুরিয়ে রাখা। বিস্ফারিত চোখদুটো সম্পূর্ণ খোলা। পেটের কাছে একগাদা নাড়িভুঁড়ি স্তূপীকৃত হয়ে আছে। আর সারা দেহ থেকে খুবলে খুবলে মাংস তুলে নেওয়া হয়েছে। নিতাই মাথা ঘুরে পড়ে গেল মেঝের উপরে। চক্রবর্তীর চোখ পড়ল ঘরের পিছনের দরজার দিকে। একটা স্থূলাকৃতি মূর্তি থপ থপ করে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমের বেড়ার দিকে। চক্রবর্তী থরথর করে কেঁপে উঠেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। — হরিহর চক্রবর্তীকে ষাট দিনের কাস্টডিতে পাঠিয়ে স্টেশন ইন্সপেক্টর শশীভূষণ সামন্ত কেতুগ্রাম থানায় ফিরছিলেন। কনস্টেবল হরেরাম নীচু গলায় তাঁকে বলল, “স্যার, কেসটা কেমন ওপেন অ্যান্ড শাট টাইপের হয়ে গেল না?” শশীভূষণ ধমকে উঠলেন, “কেন? আমার হয়রানি হল না বলে কি তোমার অম্বল বুকে জ্বালা ধরছে?” “স্যার সবই ঠিক আছে, বউ খুন, পোষা জন্তু খুন মানা যায় …কিন্তু কালীমূর্তি ভাঙা, তারপর ওই ছেলের বউকে অমন কামড়ে খাওয়া? আপনার কিছু খটকা লাগেনি? সবচেয়ে বড় কথা লোকটার কিন্তু কোনো ক্রিমিনাল ব্যাকগ্রাউন্ড নেই।” শশীভূষণ মরা চোখে হরেরামের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “তোমার ব্যাখ্যা শুনি।” হরেরাম কাছে এসে বলল, “লোকটাকে অ্যারেস্ট করার সময় ওর কাপড়ে, হাঁটুতে ভাগীরথীর এঁটেল মাটি দেখেছি আমি।” “খেয়েছে! শার্লক হোমসের প্রেতের সঙ্গে কাল রাতে শুয়েছিলে নাকি হে?” “চক্রবর্তীর বাড়ির দিকে গোটা গ্রামেই কিন্তু বালি মাটি, এক মাত্র শ্মশানের দিকেই এঁটেল মাটি।” শশীভূষণ কিছু একটা বলতে গিয়েও থমকে গেলেন। হরেরাম বলে চলল। “আমি এ অঞ্চলেরই লোক। এক সময় উদ্ধারণপুরের দেওয়ান ছিলেন উদ্ধারণ দত্ত। তাঁর নামেই উদ্ধারণপুর নাম। শোনা যায় তাঁর মৃতদেহের সৎকার হয়নি। তাই কৃষ্ণা ত্রয়োদশী থেকে অমাবস্যা …এই তিন দিন তিনি শুনেছি ফিরে আসেন আর শ্মশানভূমে বা সংলগ্ন গ্রামে কাউকে অরক্ষিত, দুর্বল অবস্থায় পেলে সে প্রেত তার সম্পূর্ণ পরিবারকে ধ্বংস করে।” শশীভূষণ ধমকে উঠলেন, “চুপ করো। উদ্ধারণ দত্তের কথা আমিও পড়েছি। তাঁর মৃতদেহের সৎকার স্বয়ং বলরাম করেছিলেন এবং সেই কারণেই উদ্ধারণের চৌদ্দপুরুষ নিত্যানন্দের অনুগামী। এ সব বোলো না হরেরাম, নবদ্বীপ, শান্তিপুরের বৈষ্ণবরা কেতুগ্রাম থানা জ্বালিয়ে দিয়ে যাবে।” হরেরাম মুচকি হাসল। “বেশ বেশ, স্বয়ং ‘ব ল রাআআ ম’ যখন সৎকার করেছেন, তখন আর কী যুক্তি থাকতে পারে?” শশীভূষণ মুখের একটা ভঙ্গী করে বললেন, “আর সম্পূর্ণ পরিবারই যদি ধ্বংস হবে, হরিহর চক্কোত্তির এক ছেলে তো শুনলাম ঢাকা না চাটগাঁ কোথায় থাকে, তার তো কিছু হল না।” হরেরাম চুপ করে গেল। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে পথের দু পাশে। ঘন গাছপালার ফাঁকে অজয়ের ঘোলা জল দেখা যায়। শশীভূষণের ফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা হাতে নিয়ে শশীভূষণের ভ্রু কুঁচকে গেল। হোম ডিপার্টমেন্টের ফোন। ফোনটা কানে দিয়ে দু একবার ‘ইয়েস ম্যাম, স্যিওর ম্যাম’ বলে শশীভূষণ ফোনটা পকেটে রেখে দিলেন। হরেরাম জানতে চাইলো, “কী হল! ও স্যার, ফ্যাকাশে মেরে গেলেন কেন?” শশীভূষণ ভয়ার্ত গলায় বললেন, “দমদম থেকে এয়ারপোর্ট পুলিশ একটা ইনফো ভেরিফাই করতে বলছে, হরপ্রসাদ চক্রবর্তী নামে কারও কেতুগ্রাম থানার আন্ডারে রেসিডেন্স কিনা?” “কেন স্যার?” “গত রাতে দমদম এয়ারপোর্টে চেক আউট করা সময় আকস্মিক হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মারা পড়েছে ব্যাটা। আর…” “আর কী স্যার?” “ছোঁড়ার বাপের নাম হরিহর চক্রবর্তী, গ্রাম …উদ্ধারণপুর।”