আজ স্কুলে রেজাল্ট বেরোবে। সবাই তটস্থ। প্রথম সারির ছেলেরা নিজেদের পজিশন কী হবে এই নিয়ে ভয় খাচ্ছে। আর অন্যান্য রা অনেকেই দু একটা বিষয়ে ফেল করে বৈতরণী পার হবে। কিন্তু সমস্যাটা হল অজয়কে নিয়ে। অজয়কে সকাল থেকেই ভীষণ ভীত দেখাচ্ছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান করে ফেলেছে আজ। তারপর মন্দিরে গেল। রাধা দামোদর এর মন্দিরে পুজারি তখনও ছিল। ওই পুজারীর ছেলে শঙ্কর। অজয়ের থেকে বছর পাঁচেকের বড়ো হলে কী হবে অজয়কে খুব ভালোবাসে। অজয় ওদের বাড়িতে মাঝে মাঝেই চলে যায়। শঙ্করের মা সেবার সরস্বতী পুজোতে খুব সুন্দর খিচুড়ি রেঁধেছিল। এত ঠাকুর দেবতাকে পেন্নাম করে অজয় তবুও অঙ্ক ইংরাজি তার মাথাতে কেন যে ঢোকে না কী জানি!
অজয়ের এখন অষ্টম শ্রেণি। এবার পাশ করলে নবম শ্রেণিতে বসবে। আর ওর ক্লাসের ছেলে মেয়েরা ওর থেকে অনেক ছোটো। আঠার বছর বয়সে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। হবে নাই বা কেন। প্রতি ক্লাসে দুবার করে থাকা। স্কুলে ওর নাম হয়েছে ফেলুদা।
অজয় এসবের তোয়াক্কা করে না। তবে বাবাকে সে খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করে। আর বাবা রাশভারী মানুষ। অজয়কে নিয়ে তাঁর চিন্তার শেষ নেই। গতকাল বাবা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন “এবার যদি ফেল করো আর বাড়িতে ঢুকবে না। আমার একটা সম্মান আছে। আমি চাই তোমার জীবন তুমি বুঝে নেবে। বছর বছর ফেল করবে আর লোকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করবে আমাকে। এই কী তোমার থেকে আমার পাওনা ছিল”। একথায় আড়ালে কেঁদে ফেলেছে অজয়।
অজয় জানে তার জন্য বাবাকে কত হেয় হতে হয়। এই তো সেদিন। জিতেন মুখুজ্জে এসেছিল। লোকটা প্রায় ই আসে। কফি আর কুমড়ো ফুলের বড়া দিলে মা। বাবার দুর্বল জায়গা। সেখানেই আঘাত করলে “তাহলে ছেলের কোন ক্লাস হল। রেজাল্ট আউট কবে?” বাবা আমতা আমতা করেন।বলেন “ছেলেটার তেমন মাথা নেই লেখাপড়ায়”। আত্মপ্রসাদের প্রসন্নতা নিয়ে নিজের ছেলেদের কত বুদ্ধি তা বলে চলে জিতেন।
আজ সেই দিন হাজির। বাবার হৃদয়ে স্নেহের ফল্গুধারা। সকালে যখন সুজয় জেলে এসেছিল তখনই তিলক সেবা করতে করতে চিৎকার করছেন বাবা ” শোন রে সুজয়। আজ একটা দুকেজি সাইজের রুইমাছ দিয়ে যা। বিকেলে সদরে পয়সা নিবি। ছেলেটা ঘি আলুসিদ্ধ আর মাছভাজা খেতে বড়োই ভালোবাসে”। অজয়ের গর্ব হয় বাবাকে নিয়ে। অতুলবাবুকে এক ডাকে সবাই চেনে। বুদ্ধিমান শুধুই নয়,সহৃদয় মানুষ তার বাবা। যে বছর গাঁয়ে বান হয়েছিল সে বছর কত গরীব মানুষ ঘর হারিয়ে দিশেহারা। বাবা নিজের বাড়িতে তাদের ঠাঁই দিয়েছিল। খাইয়েছিল নিজের টাকায়। আর অজয় একটু যদি ভালোভাবে পাশ করে তবে বাবা কত খুশি হয়। অজয় খুব ভাল ফুটবল খেলে। প্রচন্ড দৌড়াতে পারে। হেড মাস্টার মশাই বাবাকে বলেছেন “সবাই সব দিকে পারদর্শী হয় না। আমাদের স্কুলের হয়ে খেলায় মেডেল এনেছে আপনার ছেলে। খুব ভাল ছেলে অজয়।” বাবা বলেছিলেন “সবাই তো ভাল বলে। কিন্তু লেখাপড়া তো করে না। মনে রাখতে পারে না। ওটাই চিন্তার “। মা সকালেই ভাত বসিয়েছে। কলতলায় মাছ ধুচ্ছে মা। আলুভাতে জিরে আর লঙ্কা ভেজে মাখবে। ঘরের তৈরি ঘি এর শিশি রোদে বসানো। অন্য দিন হলে ভাত ফোটার গন্ধেই আকুল হোতো অজয় । কিন্তু আজ তার কিছুই খাবার ইচ্ছা নেই। সবই বিস্বাদ লাগে ।
ভাত খেলো না অজয়। বাবা বাড়িতে নেই। আর মা কত করে বললে “অল্প হলেও খেয়ে যা বাপ আমার। দেখবি ঠিক তুই পাশ করবি। তোর বাবা কিছুই বলবে না। রাগ করে কাল বলেছিল ঠিক ই। আবার ঠিক হয়ে গেছে। এমন করে ভাতের অবহেলা করিস নে। তোর জন্য এই শীতের মধ্যেই রান্না করলাম। “
অজয় তো পরীক্ষা দিয়েছে। আর ও তো জানে কত ধানে কত চাল। অঙ্ক আর ইংরেজিতে কী হবে। আন্দাজে কিছু টিক দিয়েছিল ঠিক ই। কিন্তু তাতে পাশ করা দুষ্কর। ফার্স্ট বয় প্রণব বলেছিল প্যারাগ্রাফটা আমার খাতা দেখে টুকে দে। অজয়ের তাতেও আপত্তি। অন্যের দেখে লেখার চেয়ে ফেল করা অনেক সম্মানের। আজ সবার আগে প্রায় সাড়ে নটায় স্কুলে এসেছে অজয়। খোকন তখন সবে স্কুলের গেট খুলছে। অজয়কে দেখে বললে “অজয়বাবু আমাদের সক্কাল বেলা স্কুলে হাজির। তা মিষ্টির প্যাকেট চাই পাশ করলে”। অজয়ের সব কিছুই হেঁয়ালী মনে হয়। ওর আবার পাশ আর তার আবার মিষ্টি। বাবা বলে দিয়েছে ঠিক করে পাশ না করলে নিজের পথ দেখে নিতে। নিজেকেই নিজে ধিক্কার দেয়। মাথায় গোবর পোরা। তাও আবার ষাঁড়ের গোবর। অন্য গোবর হলে পুজোতেও লাগত।
আস্তে আস্তে সবাই আসছে এবার। অনেক অভিভাবক এসেছেন। স্কুলের পরিচালন সমিতির সবাই এসেছেন। এবার অ্যানুয়েল বলে কথা। অজয়ের যদি ভালো রেজাল্ট হোতো তাহলে ওর বাবাও আসত। ফেলু ছেলের কদর নেই।স্কুলের প্রার্থনা হল। জাতীয় সঙ্গীত হারমোনিয়ামে ডালিয়াদি গেয়ে যান। আজ আর ছাত্র ছাত্রীদের গলার আওয়াজ শোনাই গেল না।
এবার যে যার ক্লাসে গিয়ে বসল। কেউ আজ অজয়কে ফেলুদা বলে নি এখনও। রেজাল্ট বের হবার পর নিশ্চয়ই বলবে। অজয়ের মনে হল বলুক গে। ঠিক ই তো বলে। সত্যিই তো সে ফেলু। আজ ভীষণ চুপচাপ ফেলুদা। অবশেষে সপ্তম শ্রেণির উত্তীর্ণ দের তালিকা প্রকাশ করে অষ্টম শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করলেন প্রধান শিক্ষক। শ্রেণি শিক্ষক নাম ঘোষণা হয়ে গেলে হাতে মার্কশিট দেবেন। প্রধান শিক্ষক বললেন: সব ছেলেই প্রথম হবে না। তবে সার্বিক ফল এই ক্লাসের ভালো। কোনও ছাত্র হয়ত খেলাধূলা ভালো করে। কেউ ভালো গায় ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর শুরু হল নামঘোষণা। অজয়ের পেটের দিকটা গুরগুর করছে। সবার শেষে যখন স্যার বললেন “অজয় চক্রবর্তী” তখন ক্লাসসুদ্ধ সবাই আনন্দে আত্মহারা। ওদের ফেলুদা পাশ করেছে। তবে অঙ্ক আর ইংরেজিতে ফেল। মার্কশিট নিয়ে সবাই বাড়ি ফিরে গেল। কিন্তু অজয়ের মা রাস্তার দিকে মুখ করে বসেই আছে। সত্যেনকে বললে “আমাদের অজয় কোথায়! ওকে দেখছি নে কেন। ও পাশ করেছে তো।” সবাই বললে “হ্যাঁ গো কাকীমা। অজয় পাশ করেছে”।
বিকেল হয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু অজয়ের কোনও পাত্তা নেই। মা কাঁদতে শুরু করলে। বাপ বললে “নিশ্চয়ই কোনও বন্ধুর বাড়িতে আছে”।
সন্ধ্যার সময় পূজারী এল রাধা দামোদর এর বৈকালী দিতে। অতুল বাবুর ধারণা ছিল ওই পূজারির ছেলে শঙ্কর এর কাছেই তো যায় অজয়। তাহলে ওখানেই আছে। কিন্তু এ কী শুনছে! শঙ্কর এখন কলকাতায়। ও নাকি নতুন সরকারি চাকরি পেয়ে দিন দশেক কলকাতায় আছে। আকাশ ভেঙে পড়ল অতুল বাবুর মাথায়। নানারকম কু চিন্তা মাথার মধ্যে আসতে লাগল। অজয়ের মা স্বামীকে দোষারোপ করতে লাগল। বললে “আমার ছেলে লেখাপড়াটা করতে পারে না। কিন্তু অমন ছেলে পাঁচটা গাঁ খুঁজে পাবে না। তুমি তো ওর সাথে গরু ছাগলের ব্যবহার করতে।”
অতুল চক্রবর্তীর মতো রাশভারী মানুষ ও চুপ করে গেল। ভেবেছিল কিছুতেই তো কিছুই হল না যদি ভয় দেখিয়ে কিছু করা যায়। এখন ভীষণ দুশ্চিন্তা গ্রাস করল তাকে। জীতেন খবর শুনে হাজির। কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটে দিতে ওর জুড়ি নেই। বললে “রেললাইন এ মাথা টাথা দেয় নি তো। ?স্টেশন মাস্টার এর কাছে খবর নাও হে অতুল “। চমকে ওঠে অতুল। এইসব যেন না হয় । রাধাদামোদর বলে উঠলেন তিনি। এদিকে অজয় মার্কশিট নিয়ে সোজা হাওড়া গামী ট্রেনে চেপেছে। ও শঙ্করের মুখে শুনেছিল কলকাতা শহরে কাজের ছড়াছড়ি। যে যেমন করে পারছে টাকা উপার্জন করছে।একবার যদি শঙ্করের সাথে দেখা হয়ে যায় তবে ওর আস্তানাতে থেকে কাজ করবে অজয়।
এর আগে একবার চিড়িয়াখানায় বেড়াতে এসেছিল অজয়। এছাড়া কোনও দিন কলকাতাতে আসে নি। হাওড়া স্টেশনে নেমে ওর চক্ষু চড়কগাছ। ওর পকেটে তিনশ টাকা আছে। কয়েক দিন ওটা দিয়ে চালিয়ে দেবে। আর তার মধ্যেই শঙ্করকে খুঁজে নিতে হবে। আর একটা জিনিস আছে ওর। গলায় রাধাদামোদরের পুস্প।ওটা সোনার মাদুলি।
হাওড়া স্টেশন থেকে বেড়িয়ে বাসস্ট্যান্ড এ এল অজয়। এখানে বেশ কয়েক টা দোকান আছে। গরম গরম পরোটা ঘুগনি আলুর দম বিক্রি হচ্ছে। সারাদিন অজয়ের পেটে খাদ্য যায় নি। ভাবলে আগে কিছু খাই। খালিপেটে বুদ্ধি কাজ করে না। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আজ এই বাসস্ট্যান্ড এ থেকে যাবে। কোনও বাসের কন্ডাক্টর কে হাত করে বাসে শুয়ে পড়বে। বাড়ির কথা মনে হল। সবাই খুব চিন্তা করবে। ভাববে ছেলেটা কোথায় গেল। অজয় ঠিক কিছু করে কদিন পরে ওদের তাক লাগিয়ে দেবে। তখন সবাই বলবে “আরে আমাদের ফেলুদার কত বুদ্ধি। যে ছেলেটা ফেল করত বছরের পর বছর আজ দেখো সে কত বড় হয়েছে। বাপ মাকে কত সুখে রেখেছে।” ভাবতে ভাবতেই তার চোখ দিয়ে জলের ধারা বইতে থাকে। গরম পরোটা আর ঘুগনি খেয়ে এক কাপ চা খেলে অজয়। এইসময় রাধাদামোদরের বৈকালী হয়ে গেলে অজয় মায়ের সাথে চা খায়। মা তাকে কত করে বলেছিল “ভাত খা অজয়। মায়ের কথা শুনতে হয়। “অজয়ের মনে হল ভাতের কত দাম।দিব্যি বিনিপয়সায় বাপের হোটেলে চলছিল তার। এখানে কটা পরোটা আর চা খেয়েই তো পঞ্চাশ টাকা বেরিয়ে গেল। সাবধানে চলতে হবে। যতদিন না শঙ্করের দেখা পায়।
অনন্ত ইঁদুর কখনও অনন্ত পৃথিবীকে অধিকার করতে পারে না। এই অনন্ত পৃথিবীতে কত মানুষ। কত তাদের শ্রেণিভেদ। কেউ কারখানার মজুর। কালিঝুলি মুখে শিশুর মুখে অন্ন তুলে দাঁত বার করে হাসছে। আবার কোনও শিশু কারো ভোগের লালসায় উৎপন্ন হয়ে অনাথ। তবুও সবাই বেঁচে আছে। কলকাতা শহরে এসে অজয়ের তেমন ই বোধ হল। কী আজব শহরের মধ্যে সে এসে পড়েছে। বাসের একটা ছেলের সাথে তার আলাপ হল। তার বাড়ি রানীহাটি। তার বাবা তার মাকে ছেড়ে নতুন ঘর বেঁধেছে। মা লোকের বাড়ি কাজ করে ছেলেকে বড় করেছে। ছেলেটার নাম নিতাই। গাঁয়ের ছেলে বটে তবে খুব চৌকস। অজয়ের রাত টা কাটাতে নিতাই এর সহযোগিতার দরকার। নিতাই বললে “আজ আমাদের বাস রানে যাবে না। তুমি আমার সাথেই শুয়ে পড়বে। তবে এই শীতের রাত। তোমার তো গায়ে দেবার মতো কিছুই নেই। আমার একটা কাঁথা অবশ্য আছে।”
রাতে সিঙারা আর মুড়ি খেলে অজয়। নিতাই কেও খাওয়ালে। পয়সাটা বুঝে চলতে হবে। এমনিতেই অজয়ের গায়ে অনেক শক্তি। খেলোয়াড় মানুষ। কত রাজ্যস্তরের খেলার সার্টিফিকেট আছে ওর।
নিতাই বললে “তোমার দাদা শঙ্কর কোথায় থাকে? তুমি ঠিকানা বলো”? অজয়ের অত জানা নেই। বললে “কলকাতার ধর্মতলা এটুকুই জানি। এর বেশি তো কথা হয় নি”। নিতাই এর চোখ কপালে ওঠে। বলে “তুমিও যেমন। বলি ধর্মতলা বললেই তো হবে না। আমার বাস ধর্মতলার উপর দিয়েই তো যাবে। তোমাকে ওখানে নামিয়ে দেবো। কিন্তু সেখানে কোথায় খুঁজবে তাকে বলো দিকিন । তার থেকে তুমি বাড়ি ফিরে যাও। তোমার বাবা মা কেঁদে আকুল হবেন।” অজয়ের সেটা ইচ্ছা নয়। বললে “কাজ করব।নিজের পায়ে দাঁড়াব। তারপর বাড়ি যাবো। শুধুই দু তিন দিন লাগবে শঙ্কর দা কে খুঁজতে।”
এদিকে অজয়ের বাড়িতে হুলুস্থুল। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের ভিড়। সবাই এক কথা বলে “ছেলেটা বেঁচে আছে তো”! অতুল চক্রবর্তীর আর থেমে থাকার সময় নেই। বললে “চলো জিতেন। থানায় যাই”। থানার বড়বাবু কানে ফুরফুরি দিচ্ছিল। অতুল বাবুর সব কথা শুনে গম্ভীর মেজাজে বললে “আপনাদের বাবা হওয়া উচিত হয় নি। দেখছেন এঁড়ে গরু। তা না টেনে দো। ঠিক আছে। দেখা যাক কী করতে পারি। আমি যে কেসে হাত দেবো সেটাই সফল। তবে,,,,” জিতেন এসব ভাল বোঝে। অতুল এর কানে কানে বললে “কিছু টাকা ছাড়ো। বুঝছো না অফিসার এর ইঙ্গিত “! অতুল চক্রবর্তী দশ হাজার টাকা পুলিশ অফিসার কে দিলে। বললে “ছেলেটাকে এনে দিন স্যার!” টাকা পেয়ে অফিসার পুরো চাঙ্গা। ভাবটা যেন এই ‘এখনই আনছি “!
ধর্মতলাতে অজয়কে নামিয়ে দিলে নিতাই। বললে “আবার কখনও দেখা হবে। ভালো থেকো বন্ধু।” অজয় ধর্মতলা বলতে এমনটি ভাবেনি। ভেবেছিল হয়ত ঠাকুর স্থান। কিন্তু এবার গভীর সঙ্কটে পড়ল। কী করে শঙ্কর কে পাবে সে! সারাদিন ঘুরছে ওই চত্বরে। আবার বিকাল ঘনিয়ে এল। এখানে হোটেলে ভাত খেয়েছে আজ। ডিম ভাত। ষাট টাকা। শীতের দিন। ভাবলে এই ফুটপাথ এ এতো দোকান। এখানেই কোথাও শুয়ে পড়বে।
চারিদিকে অজয়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ।সব দেখে চলেছে। হঠাৎই ওর নজরে পড়ল এক সুন্দরী গৃহবধূ। যেন লক্ষ্মীঠাকুর। হেঁটে আসছে। হয়ত বাসেই চাপবেন। কিছুক্ষণ এর মধ্যেই অজয়ের লক্ষগোচর হল একটা ওর বয়সী ছেলে বৌটির মানিব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে ছুটছে। বৌটি চিৎকার করে উঠল “আমার মানিব্যাগ। ওই পকেট মার নিয়ে পালাচ্ছে। কে আছো!”
অজয়ের আশ্চর্য হতে বাকি নেই। কেউ সাড়া দিল না। কিন্তু অজয়। সে বসে থাকতে পারল না। ধাওয়া করল ছেলেটার পিছনে। ছেলেটা ভাবতেই পারেনি এই শহর বাজারে কেউ তার পিছু নেবে। তীরের ফেলার মতো ছুটে গিয়ে ছেলেটার কলার ধরে নিয়ে এল অজয়। মানিব্যাগ ওর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বৌটাকে দিলে।বললে “দেখে নিন সব ঠিক আছে কি না”। ততক্ষণে কর্তব্য রত পুলিশ এসে গেছে। তারা তখন হম্বিতম্বি করছে। বৌটি অজয়ের দিকে তাকিয়ে বলল “তোমার নাম কী? তুমি বড় উপকার করলে। নৈলে পঞ্চাশ হাজার টাকা চোট যেত ভাই”।
অজয় বললে “আমার সাথে দৌড়ে কেউ পারে না। আমি স্কুলের হয়ে অনেক খেলেছি।” অজয়ের সরলতা মুগ্ধ করল স্ত্রীলোক টিকে। বললে “কাছেই নিউমার্কেট এ আমার ফ্ল্যাট। চলো। ওখানেই তোমার কথা শুনবো।” ভাগ্যবানের বোঝা ভগবানে বয়। অজয়ের ঠাঁই হল নিউমার্কেট এর এক বিলাসবহুল ফ্লাটে। ভদ্রমহিলা সচরাচর বাসে চেপে যান না। কিন্তু সেদিন ড্রাইভার অনুপস্থিত থাকার কারণে বের হতে হয়েছিল। অজয়ের সব বৃত্তান্ত শুনে অবাক মহিলা। বললে “তাহলে আমার বাড়িতেই কাজ করো তুমি। আমি তোমাকে বেতন দেবো। সাথে আমার ছোট্ট একটা গেস্টরুম আছে। সেখানে থাকবে। আমার বাড়িতেই খাবে। তারপর তোমার শঙ্কর দাদাকে খুঁজে পেলে চলে যেও।” আজ সাতদিন হয়ে গেল অজয়ের কোনও খোঁজ পাওয়া যায় নি। পুলিশ অফিসার মাঝে মাঝেই আসছে আর সেলামি নিচ্ছে। অসহায় বাবা মা ঠিক মতো খাচ্ছে না। অজয় ছাড়া ওদের জীবনের কী দাম আছে? পার্শ্ববর্তী নদীতে জাল ফেলা হয়েছে যদি নদীতে ঝাঁপ দেয় অজয়। না। সেখানেও নেই। শোকে পাথর অতুল চক্রবর্তী । গুম হয়ে থাকেন। কাজকর্ম বিশেষ করেন না। নিউমার্কেট এর ফ্লাটে বহাল তবিয়তে আছে অজয়। বাড়ির সব কাজ ফাই ফরমাশ খাটে। আর এই বৌটার একটা বাচ্চা আছে। তাকে নিয়ে বেড়াতে যায়।কিছুদিন পরে এক ভদ্রলোক এই বাড়িতে হাজির। অজয়ের প্রশ্ন “কী চাই? কাকে চাই?” পুলিশ এর বড়কর্তা শ্যামল মুখার্জি নিজের বাড়িতে এরকম প্রশ্ন শুনে স্তম্ভিত। কে এই ছেলে? বললে “তুমি কে? আমি তো আমার নিজের বাড়িতেই আসছি”। অজয়ের বুঝতে বাকি থাকে না ইনি গৃহকর্তা। বললে “দুঃখিত স্যার। আমি আপনাকে দেখিনি। নিজের কর্তব্য করছিলাম “। চকচক করে উঠল শ্যামল মুখার্জির চোখ। বললে “এত কর্তব্য সচেতন তুমি। জীবনে উন্নতি করতে পারবে তুমি”। ততক্ষণে বৌটা এসে গেছে। বললে “এই ছেলেটির কথাই তোমাকে জানিয়েছিলাম। খুব ভালো ছেলে। ওর নাম অজয়। “ অজয় ছুটে এসে দুজনকেই প্রণাম করলে।
অজয়ের ব্যবহার মুগ্ধ করলো পুলিশের বড়কর্তাকে। দুপুরে অজয়ের সাথেই খেতে বসলেন তিনি। বললেন “তোমার শিক্ষাগত যোগ্যতার অভাব।কী চাকরি তুমি পেতে পারো তুমি জানো?” অজয় বললে :”ছোটোখাটো একটা কিছু কাজ করতে চাই। “ শ্যামলবাবু বললেন “রবীন্দ্র মুক্ত বিদ্যালয়ে ভর্তি হও। মাধ্যমিক পাশ করো। তারপর দেখছি কী করা যায়। তোমার বৌদি তোমার লেখাপড়ার ভার নেবেন। আর প্রতিদিন তোমাকে ছুটতে হবে। দৌড় চাই। স্পিড চাই “।
শুনশান ভোরের কলকাতাকে দেখে অজয়। গাড়ি নেই লোকজন নেই। অপূর্ব কলকাতা। দৌড় প্র্যাকটিস করে সে। প্রাতঃভ্রমণরত কলকাতাবাসী ওকে দেখে পুলকিত হয়। অতুল বাবুর নিয়মিত থানায় যান। কিন্তু এখনও অজয়ের হদিশ নেই। জিতেন এর মাঝে পুলিশের সাথে যোগসাজশ করে দুদিন অন্তর অতুল চক্রবর্তীর সাথে টাকা নেয় ভাগা পায়। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে যায়। শ্যামলবাবু দেখেন লেখাপড়ার উন্নতি হয়েছে অজয়ের। একদিন ডেকে বললেন “তোমার কান্ডজ্ঞান নেই। তোমার বাবা মা কেমন আছেন তা কী তুমি জানো?” অজয়ের বুকে বাজে। বলে “আমি কিছু একটা করে তবেই গ্রামের পথে রওনা হবো”।
শ্যামলবাবু বললেন “থানাটা তোমাদের কোথায়?” অজয় সোৎসাহে বললে “ফরিদপুর থানা আমাদের। গাঁয়ের নামও তাই”।কিছুক্ষণ পর রবীন্দ্র মুক্ত বিদ্যালয়ে রেজাল্ট বের হবে। খবরটা শ্যামলবাবু জানলেন। দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছে অজয় চক্রবর্তী। এই খবরটা অজয়ের বাবা মাকে জানাতে চান তিনি। আরও একটা কাজ তিনি গোপনে সেরে রেখেছেন। শুধুই পুলিশ ভেরিফিকেশন টা বাকী।
জিতেন আর পুলিশ অফিসার পকোরা আর কফি খাচ্ছিল। হঠাৎই থানার ফোনটা বেজে উঠল ।অফিসার বললেন “ক্যা”। ওপার থেকে গলা ভেসে এল “নিউমার্কেট অ্যাডিশনাল পুলিশ সুপার বলছি”। অফিসার এর তখন আত্মারাম খাঁচা। বললে “হ্যাঁ স্যার। বলুন স্যার “। আহ্লাদে যেন গদগদ। শ্যামলবাবু বললেন “অজয় চক্রবর্তী পিতা অতুল চক্রবর্তীর তথ্য জানান”। অফিসার যেন আকাশ থেকে পড়ল। বলল “অজয় চক্রবর্তী নিরুদ্দেশ স্যার। আমি অনেক চেষ্টা করেছি। তবে তার কোনও খোঁজ পাই নি”। শ্যামলবাবু বললেন “তাই না কি। আপনি কেমন চেষ্টা করেছেন কী ব্যবস্থা নিয়েছেন একটু রিপোর্ট পাঠান”।
পুলিশ অফিসার ঘামতে শুরু করেছেন। কী যে হল , ওখানে কী করে খবর গেল সেটা ভাবিয়ে তুলল। অবস্থা বেগতিক বুঝে পালাল জিতেন।
অজয়ের মা রাধাদামোদরের মন্দিরে ঠাকুর এর কাছে কাঁদছে। তার হারানিধি যেন ফিরে আসে। অতুল বাবুর চোখের পাওয়ার বেড়েছে। চশমাটাও বদলানো হয় নি। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস তাকে স্থবির করে দিয়েছে যেন।
হঠাৎই এই ফরিদপুর গ্রামে একটা পুলিশের গাড়ি। নিস্তরঙ্গ গ্রাম্য জীবনে যেন কী একটা ঘটেছে। গাড়িটা অজয়ের বাড়ির সামনে দাঁড়াল। অতুল বাবু ঝাপসা চশমা নিয়ে দেখলেন এক অফিসার ভদ্রলোক নামলেন। সঙ্গে একজন স্ত্রীলোক। কিন্তু আর একজনকে খুব চেনা মনে হচ্ছে। সুন্দর সুঠাম যুবক। হাঁ করে থাকেন অতুল চক্রবর্তী।
অজয় চোখের জল বাগ মানে না। বাবার পা দুটো জড়িয়ে শিশুর মতো কাঁদতে থাকে “আমি পাশ করেছি বাবা”। বাপও কাঁদে,ছেলেও কাঁদে। মা ছুটে আসে মন্দির থেকে। ঘরটা আজ আলোয় ভরে গেছে। কী স্মার্ট ছেলে অজয়। সেই ফেলুদা সব অপবাদের জবাব দিয়েছে বটে। শ্যামলবাবু বললেন “পুলিশ ভেরিফিকেশন এর প্রয়োজনে ফরিদপুর থানায় যাচ্ছি। তাছাড়া থানার অফিসার এর সাথে আমার বোঝাপড়া আছে। অতুল চক্রবর্তীর আনন্দ আর ধরে না। ছেলে শুধুই পাশ করে নি। চাকরি পাচ্ছে। সরকারি চাকরি। পুলিশ এর কনস্টেবল। মা আজ হাসছে। তার ফেলুরাম ছেলে কী অসাধ্যসাধন করেছে। এখন রান্না করতে হবে সকলের জন্য। সবাই আজ দেখছে তাদের প্রিয় ফেলুদা কে।