আজও সকাল থেকে ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি। আর আমার মনে সেই পাষাণ ভার। কিছুতেই এই দিনটাকে ভুলতে পারি না। ক্যালেন্ডার না দেখলেও ঠিক জেনে যাই আজই সেই দিন। আর তারপর থেকেই কষ্ট আর লজ্জায় রাঙানো একটা গাঢ় খয়েরী ছোপ একটু একটু করে মনের ভেতরটা দখল নিতে থাকে। কত বছর হয়ে গেল তবু — বৃষ্টি উপেক্ষা করেই বাচ্চারা রথ নিয়ে বেরিয়েছে। যেমন বেরোতো আমাদের সময়েও। যেমন সেদিন বেরিয়েছিলাম আমিও। মা নিষেধ করেনি। শুধু বলেছিল — বেশিদূর যাস না। — সবে বারো তখন। মার সব কথা শোনার ধৈর্য ছিল না। দলবল মিলে রথ টানতে টানতে একেবারে জি. টি . রোডে পৌঁছে গেলাম। ওখানে অনেক লোক। সবারই খুব উৎসাহ। চলতে চলতে হঠাৎই একটা কিরকম অজানা অস্বস্তি শরীরের মধ্যে অনুভব করলাম। পেটের কাছে একটা হালকা ব্যাথা আর একটা অন্যরকম অনুভূতি! একবার ভাবলাম বাড়ি চলে যাই। কিন্তু ওদের সঙ্গে যাবার লোভও ছাড়তে পারছিলাম না। শরীরের অস্বস্তি চেপেই চললাম। কিন্তু অস্বস্তিটাও বাড়তে বাড়তে এবার অন্য মাত্রা নিয়েছে।ব্যথার সঙ্গে স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমার দুই উরুর ফাঁক দিয়ে নেমে আসছে এক তরল ধারা। কি হল? সকলের অলক্ষ্যে একবার দু পায়ের ফাঁকে তাকিয়ে দেখলাম আর পরক্ষনেই ভয়ে, আতঙ্কে শিউরে উঠলাম। গাঢ় লাল সেই ধারা একটু একটু করে নেমে আসছে হাঁটু বেয়ে। ক্রমশ নিচের দিকে। নিজের অজান্তেই হাত চলে গেল পেছনে। অনুভব করলাম স্কার্ট ভিজে উঠেছে। মনে পড়ে গেল মা কদিন আগেই এই কথাই বলছিলেন। বোঝাচ্ছিলেন যে এরকম হলে ভয় পাবার কিছু নেই। কিন্তু সে তো বাড়িতে থাকলে। মায়ের কাছে থাকলে ! এখন কি করব ? কি করে বাড়ি যাব? আমার রথের সঙ্গীরা অনেকদূর এগিয়ে গেছে। আরো যেতে চাইছে। কিন্তু আমি দু পা ক্রস করে দাঁড়িয়ে পড়েছি রাস্তায়। চলতে গেলেই ভয়। লোক দেখার ভয়। লজ্জা। প্রাণপণে জগন্নাথকে ডাকছি। কি করে এই অবস্থাতে এতটা যাব ভেবে মাথার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কানের কাছে কে যেন বলে উঠল “ কি হোল রে ? এখানে দাঁড়িয়ে আছিস এভাবে? তোর বন্ধুরা তো এগিয়ে গেছে।” চোখ ফিরিয়ে দেখি বিল্টুদা। আমাদের পাড়ার উঠতি মাস্তান। আরো ভয় পেয়ে গেলাম। ওর সাথে কথা বলেছি জানলে মা আস্ত রাখবে না। পাড়ায় ওর খুব বদনাম। কেউ পছন্দ করে না ওকে । প্রাণপণে কান্না চেপে ঠোঁট টিপে দাঁড়িয়ে আছি। “ কি রে? চুপ কেন? শরীর খারাপ লাগছে নাকি তোর?” এবার আর পারলাম না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। আমার বিবর্ণ মুখ, ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকা , পিছনে হাত দিয়ে কিছু গোপন করার চেষ্টা আর তার ওপর কান্না বোধহয় সব কিছু বুঝিয়ে দিল ওকে।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে একবার তাকিয়েই নিমেষের মধ্যে নিজের জামা খুলে আমার কোমরের দু পাশ দিয়ে জড়িয়ে বেঁধে দিল ও। আর একহাতে টেনে সাইকেলে বসিয়ে নিল। সেদিন বিল্টুদা আমায় যত্ন করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। কেউ কিছু বোঝার আগেই আমার লজ্জা ঢেকে দিয়েছিল। বিল্টু দা। যাকে পাড়ার মাস্তান, খারাপ ছেলে বলে জানতাম। সেই বিল্টুদা। এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর একদিন খবর আসে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে বিল্টুদা মারা গেছে। কেউ মন খারাপ করেনি ওর জন্য। খারাপ ছেলে ছিল তো। শুধু একলা ঘরে বসে মা আর আমি চোখের জল ফেলেছিলাম। আজও রথের দিন এলে সেই দিনটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। একা একটা অসহায় বারো বছরের কিশোরী। আর তাকে ভরসা দেওয়া সেই দুটো বলিষ্ঠ হাত। বিল্টুদা নেই। কিন্তু গাঢ় খয়েরী ছোপটা থেকে গেছে।