হাওয়াই জালটা নিয়ে সদানন্দ বেরিয়ে যেতে যেতে বললে “এমন বিষটি বাদলার দিনে ঘরে বসি থাকতি বলিস।সেই সেবারে মনে আছে তোর কত্ত বড়ো একটা মাছ ধরে ছিলুম।। মালা বাপের কথার সূত্র ধরেই বলে “মনে থাকবে না কেন?” মালা আর সদানন্দ দুই বাপবেটির সংসার। বাড়ির অনতিদূরে বঙ্গোপসাগরে র আহ্বান। এই বাদাগুলোতে জোয়ারের জল ঢোকে।নোনাজল।মাটিতে ফসল ফলে না। মালা এই নোনাজলে গেড়িগুগলী তোলে। শুধু ও নয়।এই ধামাখালির সবাই তাই করে। রাতের অন্ধকারে মাটির দাওয়ায় শুয়ে থাকতে থাকতে সদানন্দ মদের ঘোরে কত কথা বলে। ভালোবাসার মানুষ হারিয়ে গেলে তার কদর বোঝা যায়। কুপির আলোয় মালা তাকিয়ে থাকে বাপের দিকে। মানুষ টা কত বদলে গেল। দক্ষিণ রায়ের পুজো দিয়ে কত কেঁদেছে মালা।মাকে আর ফিরে পাবে না কখনো।
বিকেলে কোঁচলে যখন গুগলী নিয়ে আসছিল তখন পুবপাড়ায় বাঘুৎ দেবতার পুজোর আয়োজন দেখছিল। ছেলেগুলো তারস্বরে বলে চলছিল “আয় বৃষ্টি ঝেঁপে”।মালা অবাক হয়।এই জলের কত তফাৎ। সমুদ্রের জলে মিললেই নোনা।বিস্বাদময়। সেদিন মায়ের কথা যখন ভাবছিল তখনও জল মুখে আসছিল। সমুদ্রের জল মনিষ্যির চোখে।নয়নসাগর যেন। আজ অনেক গুলো মাছ পেয়েছিল সদা।ঘরে আনে নি।সোজা চলে গিয়েছিল শতপথীর কাছে।উড়ে বামুন বলে সবাই।এই ধামাখালি,সন্দেশখালিতে যজমানি, ছেরাদ্দ শান্তি করে কম কামায় না।তার উপরে মাছ কমদামে কিনে ক্যানিঙে বেচে দেয় চড়াদামে।
সারারাত বৃষ্টি হচ্ছে।মালার চোখে ঘুম নেই। বৃষ্টি মানে কী?সতীশ বলছিল “বিষটি মানে ভালোবাসা।ফসল ফলায় রে।ধরণীর কানে কানে কথা কয়।মাটিকে উর্বর করে”। সতীশ টা পাগল। আবার কাব্যি করে বলে “তোর বুকে অনেক বিষটি মালা”। পঞ্চদশী মালা বলে “মোটেই না।বিষটি সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়।যেমন করে ঝড় জল বন্যার রাতে মা ভেসে গেল”।
সতীশের মা অনেক কষ্ট করে সতীশ কে বড় করছে।এই শ্রাবনে সতীশ এর বয়স হবে একুশ।খুব মুখচোরা।তবে মালার সাথে কথা বলতে চায় ।সেদিন মালা বাড়ির সামনেতে বসেছিল।হঠাৎই দেখতে পেল একটা জাহাজ।আঁতকে উঠলো মালা।তড়িঘড়ি সব তৈজস পত্র সরাচ্ছে দেখে ছুট্টে এল সতীশ। বললে “এই তো আমি এসে গেছি।তোর ভয় কি”?
জাহাজ ঢুকেছে মাতলা নদীতে।এমনিতেই এই নদী মাতাল।এর উপরে জাহাজের ঢেউ উপচানো জল ভাসিয়ে দেয় জেলেপাড়া।মালা নদীর ধারে ওদের মুরগী খাঁচার সামনে বসে চিংড়ি বাছছিল।সতীশ এসে ওর পাশটিতে বসে জিজ্ঞেস করলো “আজ এত তাড়াতাড়ি রান্না করছিস কেনে?”
মালা বলল “বাপ আজ ট্রলার নে বেরোবে।কটা দানাপানি পেটে থাকলে চিন্তা থাকে না”। সতীশের মনটা উদাসীন হয়ে যায় ।মনে পড়ে যায় সাত বছর আগের কথা।জঙ্গলে কাঁকড়া ধরতো বাপ। সকালে বলেছিল “সতের মা। আজ ভোলামাছের ঝাল রেঁদে দে।জঙ্গলে এব্বড়ো ক্যাংড়া।একটা বিকোলে দশ টেকা”।সতেরা আর পাঁচটা জেলের মতোই গরীব।সতের বাপের নাম ধনা।ভালো নাম ধনঞ্জয় পাত্র।সদানন্দ ধনাদা বলে ডাকতো।ভোরে উঠে ভোলা মাছের ঝাল আর আলুছানা নিয়ে গামছায় থালা বেঁধে একটা বড় বাঁশ আর একটা শিক নিয়ে বের হয়েছিল ধনা।সন্ধ্যার সময় এক ব্যাগ কাঁকড়া আনলে কত আনন্দ। সংসারে পইসা আসবে।একটু সুখের মুহুর্ত আসবে।এমন তো প্রায়ই যেত ধনা। সেদিন একেবারেই সীমান্ত এলাকায় চলে গিয়েছিল ধনা।রায়মঙ্গল নদীতে ভরা জোয়ার। নৌকা টলমল করে।এই বুঝি উল্টায়।
সদানন্দ ওইদিকেই মাছ ধরতে যায়।ওদের ট্রলার থেকেই ধনাকে দেখতে পেয়েছিল সদা।চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল “ধনাহেএএএ।কি যাও। নদী ফোঁসায়।নায়ে ভরসা কিডা।এদিক পান থেকে যাও কেনে।পরানটা দিবা নাকি?” খাঁড়ির কাছে এসে সদানন্দ কে ডাকল ধনা।বললে “সতের মা ভাত দেছে ।গরম ভাত।সাথে লঙ্কাপোড়া দে আলুছানা।ভোলামাছের ঝাল।” একসাথেই খেয়েছিল দুজন। সদা বললে “খুউউউব সাবধান। দক্ষিণ রায়ের পুজো দেছো।এই গভীর জঙ্গল। রয়েল বেঙ্গল টাইগার। নামটা মনে রেখো”।
সদানন্দ ট্রলারে চলে গেলে খালের পথ ধরে চলতে থাকে ধনা।হাঁটু পর্যন্ত পা গেড়ে যাচ্ছে চ্যাটচ্যাটে কাদায়।দূরে আরও কয়েক জন কে দেখতে পেল।মনে মনে বললে ‘এই ক্যাংড়ার কত দাম।আড়তদাররা বলছিল এই ক্যাংড়ার রফতানি চলে বিদেশে।তিনশ কোটি টাকার ব্যাওসা”।গভীর জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল ধনা।পায়ে গাছের শিকড় জড়ায়।এর মধ্যেই গর্ত।পাশাপাশি গর্ত।লাঠি টা গর্তে ঢোকায়।তারপর ঠিক টের পায় কাঁকড়া আছে।শিক ঢুকিয়ে টেনে নিয়ে আসে কাঁকড়া। লোকালয় ছাড়িয়ে এলে অনেক কাঁকড়া।গাছের গোড়ায় মাগুর মাছ আর কাঁকড়ার লাট লেগেছে যেন।আজ খুব আনন্দ ধনার।খেতে বসে সদাকে বলেছিল “আমার এই চেক লুঙ্গিখান তুই দিছিলি।আমুও তোরে একটা কিনে দেবো।” সদা বলেছিল “সে হবে খনে।এই কাঁকড়া ধরি কাম নাই।ট্রলার এ কাজ করো দিকিন।মহাজন দাদন দিবে।মাসমাইনা দিবে।আরে শতপথি ভালোই। তারে বলে কয়ে ট্রলার এ আইস ভাই”। “সদানন্দ কতটা বোকা ।বলে কিনা মহাজনের হাতে পড়তে।এক ব্যাগ কাঁকড়া।পোলাপান ওই শিবরাত্রির সলতে সতে।বাপ আমার। তুরে ফুট খাওয়াবো।বাবুদের পোলাপান ফুট খায়।” এইসব বিজবিজ করে বলছিল ধনা।ওইপথ ধরে চলে যাচ্ছে আরশাদ আর মজনু।ওরা মৌয়াল।বললে “ধনা চাচা।সাঁজ নামে।গভীর জঙ্গল। ফিরে এসো”। সম্বিত ফিরে পায় ধনা।ওদের পিছনে আসে।কিন্তু কে জানতো অতর্কিতে ওর উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়বে বাঘ।আরশাদ আর মজনু হায় হায় করে ওঠে।ওর দেহটা ততক্ষণে শতচ্ছিন্ন।লুঙ্গি পরা নিম্নাঙ্গটা পড়ে আছে।হৃদয়টা কোথায় যেন নিয়ে গেছে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। যে হৃদয় পোলাপান কে ফুট খাওয়াবে ভেবেছিল। ততক্ষণ সদানন্দ এসে পড়েছে।চেক লুঙ্গিটা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল সদা। ধনঞ্জয় এর আংশিক দেহ বাড়িতে এল।শতপথি বললে “অপঘেতে মরণ।তিনদিন তেরাত অশৌচ।” ঘাট শ্রাদ্ধ মিটে গেল।সতেটা তখন কত ছোটো ।সবাই বললে “বাঘ বেধবার ছা।” মালা দেখলে সতীশ কেমন যেন গুম হয়ে আছে।তবুও বললে “কী এত ভাবো?বাপের কথা?আমাদের তো এমনই মরণ হবে।এখন দ্যাকো ক্যামন ঝ্যামন আঁচড় মারতেসে প্যাটে।কী করিয়া রান্দিব।জলে সব ভাসি যায়।
শতপথি দূর থেকেই লক্ষ্য রেখেছিল মালার ঘরে।ওর সাথে ছিল ছোটোভাই।এই ছোটোভাই আসলে শতপথির বয়সী।তবে এই এলাকায় ওর ওই নাম।সে ক্রুর হাসি হাসলে।শতপথিকে উদ্দেশ্য করে বললে “উদিকে চোখ গেছে কত্তা।সোমত্ত মেয়ে।সদানন্দের ঝি উটা।বেশ ডাগর।” হিংস্র কামটের মতো মুখ করে শতপথি বলে “এই সোন্দরবনে সোন্দর যা কিছু সবেতে আমার অধিকার। ওই বাঘ বেধবার পোলা উখানে কি করে?”
গোপন কী সব কথা হয় শতপথি আর ছোটভাই এর।সতে মালাকে সাহায্য করে।বাসনগুলো এনে দেয়।তারস্বরে বলে “আজ রান্দিবাড়ির কাজ নাই।আমার ঘরে খাবি তুরা”।মালা সতীশের ঘরে যায়।সতীশের মা মানকচু দিয়ে মাছের ঝোল রান্না করবে। মালা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।কী বড় কচু।সতীশের মা হাসে। বলে “এ হল গিয়ে অমেত্ত মান।এতে হাত চুলকানি নেই।অ্যাই দ্যাখ। ক্যামন দুধ বের হয়।সাদা সাদা জলের মতো।” খেতে বসে রেডিও চালায় সতীশ। ভেবেছিল গান শোনাবে মালাকে।কিছুক্ষণ যেতেই রেডিও তে স্থানীয় সংবাদ শুরু হল।কী শুনছে ওরা।সাঁজের বেলা ঝড় আসছে।উত্তাল হবে সাগর।মৎস্যজীবীদের গভীর সমুদ্রে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা।মালার মুখটা বদলে যায় ।কী হবে এখন। তার বাপ যে গভীর সমুদ্রে ট্রলার নিয়ে গেছে। সদানন্দ যখন মালার মাকে বিয়ে করেছিল তখন সে ছিল মৌয়াল। জঙ্গলের মধু সংগ্রহ করে জীবন চলতো।শরীরটা চটে মুড়িয়ে কেমন অদ্ভুত ভাবে মধু সংগ্রহ করতো।চুপ করে দেখতো কীভাবে মৌমাছিরা ফুল থেকে মধু নিয়ে ছুটছে যেখানে চাকবাঁধা আছে।
মালা যখন পেটে তখনই মালার মা বাদ সাধলে।বললে “মধু সারাবছর মেলে না।তুমি মাছ ধরো।ট্রলার কেনো।আয় উপার্জন বাড়ানো পেয়োজন। “ সদানন্দ গরীব মানুষ। আকাশ থেকে পড়লে।বললে “মাথা খারাপ নাকি?সেতো অনেক টেকার খেপ।” গায়ের গয়নাগুলো খুলে দিয়েছিল মালার মা।বিক্রি করে ট্রলার কিনলে বাপ।মালার কত চিন্তা ভিড় করে আসছে আজ।সতীশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।বড় নিস্তব্ধতা বিরাজ করে এখানে। নিস্তব্ধতার একটা ভাষা আছে।মালা অনুভবে বুঝতে পারে।
বাড়ি ফেরার পথে মালা দেখলে একটা টুপি পরা লোক। কেমন অদ্ভুত সাজ লোকটার।একটা চোখ কানা বোধ হয়।কাপড় বাঁধা।সকালে শতপথির সাথে দেখেছিল মালা।লোকটা ওর দিকেই এগিয়ে এল।বললে “কোথায় গেসলি? বাপ ফেরে নি বুঝি? অত চিন্তার কারণ দেখি না।” গায়ে পড়ে কথা বলছে লোকটা।কে ও। তবে কি বাবার বন্ধুদের কেউ। জোয়ারের জল নেমেছে।এখন ঘরদোর গুছাবার পালা।কিন্তু আকাশে কালো মেঘ।এই সুন্দরবন কত ভয়ঙ্কর। সবাই বলে জল মানে জীবন।এখানে জল নোনা ।বিস্বাদময়।তবুও এই বন ছেড়ে কোথাও যেতে মন চায় না।যখন বাপ ঘরে থাকে তখন এই ঘর যেন স্বর্গ। কত পুরানো দিনের কথা,সেই যখন মালার মাকে বে করেছিল ওর বাপ সেইসব দিনের কথা একমনে শুনতে থাকে।বাপ বলে “জীবনের আর এক নাম লড়াই।এই সোন্দর বনে শুধুই জলে কুমীর ডাঙায় বাঘ নয়।কত বিষধর নাগ।তাদের ছোবল।আর আছে জলদস্যু।পশুর থেকে ভয়ঙ্কর এরা। মালা অস্থির হয়ে উঠলো।এই বিপদ থেকে তো বনবিবি একমাত্র বাঁচাতে পারবে।এখনই বনবিবির থানে যেতে হবে।এই সংসার সমুদ্রে বাবা ছাড়া ওর কে আছে।সতীশের মা বলছিল “কবেকার কোন অসহায় বিধবার ছেলে দুখে তার কাকার সাথে পাড়ি দিয়েছিল মধুখালির চরে।যখন সবাই কাঠকাটার নাম করে ওকে ফেলে চলে এসেছিল তখন বনবিবিকে স্মরণ করেছিল দুখে ।তারপর বনবিবি মায়ের রূপ ধরে দুখেকে রক্ষে করে।মালা ভাবে তার বাপ যেখানে গেছে সেতো দক্ষিণ রায়ের এলাকা।ওখানে মানুষের বসতি নেই।দক্ষিণ রায় দৈত্য দের রাজা।তাকে হারাতে পারবে একজন। বনবিবি।গুলালবিবির মেয়ে।সতীশের মা বলেছিল “ইব্রাহিম নামে এক ফকির ছিল।তার ছিল দুই বৌ।ফুলবিবি আর গুলালবিবি।সৎমা ফুল বিবির জন্য বনবিবিকে বনে রেখেছিল ফকির সাহেব।সেকি আজকের কতা গো”। আকাশ ঘোর করে এসেছে।মালা এসব উপেক্ষা করেই বাড়ি থেকে পা বাড়ালো।বনবিবির তলায় গিয়ে মানত করবে।বুকের রক্ত দিয়ে পুজো দেবে।গাজি বাবার থানে সিরনি দেবে পাঁচপো করে।
সতীশ মালার খোঁজে এসে অবাক হল।কোথায় গেল সে।এই ঝড় জলের দিন ওর এমনিতেই আতঙ্কের। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক খুঁজছিল সে।হঠাৎই একটা হাত সতের পিঠে ঠেকলো।বললে “কি হে ছোকরা।কী খুঁজছ?বেশ তো শরীল খানা।বলি কামকাজ করতি চাও তো বলো ।ভালো কামানি আছে।” সতীশের অবাক লাগল। এরকম টুপি পরে আছে।একটা চোখ বাঁধা।তবে বেশ চেনা মনে হচ্ছে।
মালা চলেছে। আর পিছন পিছন কারা যেন ফিসফিস করছে। অনেক দূরে চলে এসেছে আজ। ঝড়ের আগাম সঙ্কেত। কী ভয়ঙ্কর!মালা আজ দিশেহারা। একাকী কোন পথে সে এসে পড়ল। সতীশকে কেন বলল না। এখানে জঙ্গল গভীর। এমন ঠাসবিনুনি জঙ্গল মালা আগে দেখেনি। বিরাট বিরাট গাছ। দিনের বেলাতেই ঠাউর হয় না।এখন তো আবার সাঁঝবেলা। বাড়ির জন্য মনটা কেঁদে উঠল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই নজর এল একটা আলো জ্বলছে। ঘন্টার আওয়াজ। মালা এগিয়ে গেল দেউলের দিকে।
বনের মাঝে এমন দেউল আছে তা মালা জানত না। এটা তো বনবিবির থান নয়। আর এমন মন্দির, চাতাল, ধুনি জ্বলছে। আর মাঝে মাঝে ভিতর থেকে আওয়াজ আসছে “জয় মহাকাল”।আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে মন্দিরের পিছন দিকে গেল মালা। ব্যাপার টা বুঝতে হবে। এখানেই গা ঢাকা দিয়ে রাতটা কাটাতে হবে। এই সুন্দরবন বড় রহস্যময়। দেউলের পিছনের দিকে এগিয়ে গেল মালা। এখানে জায়গাটা নির্জন। পুজোর আওয়াজ নেই। তবে এদিকে একটা ঘর দেখতে পেল। ঘরের মধ্যে থেকে একটানা কান্নার আওয়াজ পেল মালা। ওদিকে ঢাক আর ঢোল ঘন্টার আওয়াজ আর পিছনে কান্নার আওয়াজ। সতীশের মা বলেছিল সুন্দর বনে যারা মরে তাদের আত্মা কেঁদে কেঁদে ঘোরে। ওদের আত্মা অতৃপ্ত। মালা ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু কিছুক্ষণ এর মধ্যেই ভাবলে এখন ভয় পাবার সময়ই নয়। আরও এগিয়ে গেল মালা। এবার সে অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে গেল। এদিকটা ভীষণ পরিস্কার। গাছপালা কাটা। ঝোপ নেই। এতক্ষণ একটা গুমোট ভাব লাগছিল। আর এখানে বেশ বাতাস। নদীর কুলুকুলু ধ্বনি কানে এল। ছুটল মালা। এই তো মাতলা মাতালের মতো বইছে। বেশ কয়েকটা ট্রলার দেখতে পেল। তার মানে মালার বিপদ হলে ও ট্রলারে চলে যেতেই পারে। আর এখানে সব ট্রলার তো শতপথির। আর ওর মতো ভালোমানুষ এ তল্লাটে কটা আছে! অসীম সাহস এখন মালার বুকে। আবার এল দেউলের পিছনে। একটা ছোট্ট জানালা আছে ঘরটার। কিন্তু বেশ উঁচুতে। মালার বুদ্ধি এখন ভীষণ তীক্ষ্ণ। একটা গুঁড়ি অদূরে ই পড়ে আছে। গড়িয়ে নিয়ে এল। ওটাই এখন লম্বা করবে ওকে। গুঁড়ি তে উঠে একই দেখছে সে। একটা ওর বয়সী মেয়ে। হালকা আলো জ্বলছে ঘরে। আর খাটিয়ার উপরে দুই হাঁটুতে মাথা গুঁজে কেঁদে চলেছে মেয়েটা। দরজা ওদিক থেকেই বন্ধ। কোনও হিসেব মিলছে না মালার।কে এই মেয়েটা!ফিসফিস করে জানালা দিয়ে ডাকে মালা ‘অ্যাই মেয়ে? শুনছ!কে তুমি? এখানেই বা কী করে এলে?” মেয়েটা সচকিত হল। কে কোথা থেকে কথা বলছে বুঝতে না পেরে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। ডুবে যাবার আগে মানুষ যেমন খডকুটো অবলম্বন করতে চায় তেমন অস্থির হল মেয়েটা। মালা বলল “জানালার দিকে তাকা ও”। মেয়েটা উপর দিকে তাকাল। মালা দেখল মেয়েটার মাথা সিঁদুরে রাঙা। খুব ক্লান্ত মুখ। কেঁদে চোখ ফুলে গেছে। হাত নেড়ে কাছে আসতে বলল। মেয়েটা খাটিয়া টেনে তার উপরে উঠে মালার সোজাসুজি হল। বলল “তুমি আমাকে বাঁচা ও। এরা আমাকে মেরে ফেলবে”। মালার বুঝতে বাকি রইল না যে একটা গন্ডগোল আছে এখানে। বললে “কী নাম তোমার “? মেয়েটার গলা দিয়ে যেন আওয়াজ বেরোচ্ছে না। বললে “মাধবী”। মাধবী যেন হাতে স্বর্গ পেল। কাতর কণ্ঠে বলল “তোমার নাম কী? তুমি আমাকে এদের হাত থেকে রক্ষা করো”।মালা নিজের নাম বলল। আর সাথে একটা আশ্চর্য অনুভূতি গ্রাস করল। বললে “কাদের কথা কইছ বলো দিকিন? আমাকে সব বলো। তোমার বাড়ি কোথায়? এখানেই বা কী করে এলে? তোমার বিয়ে হয়েছে।” মাধবী এবার বলতে শুরু করল। ওর যেন বিগত জীবনের কথা। বললে “আমার বাড়ি সেই পুরুলিয়া। ওখানেই একটা হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে আমি। আমাদের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরাতো। আমরা অনেক গুলো ভাইবোন ছিলাম। সবসময়ই মনে হোতো ভালো করে বাঁচব।আমার সেই চাহিদা কাল হল আমার। আমার গ্রামতুতো এক দাদার বাড়িতে তার বন্ধু এল। আমি কখনও অত সুন্দর কোনও মানুষ দেখিনি।
মালা বলল “আকাশের অবস্থা ভাল না। এই অন্ধকার এর মধ্যে আমিও পথ খুঁজে পাবো না। তুমি তাড়াতাড়ি বলো। “ মাধবী বলে চলে “ওর নাম পলাশ। আমাকে ও যেদিন বলেছিল আমাকে ও ভালোবাসে আমি যেন মুক্তির স্বাদ পেলাম। পলাশ চাকরি করে। ও প্রায়ই আমাদের গ্রামে আসতে লাগল। আমার জন্য কত উপহার আনতো। আমার হৃদয়ের রাজকুমার ও।” মালা চোখ মার্বেল করে শুনে যাচ্ছিল মাধবীর কথা। বলল “তোমার পলাশ এর মতো আমার সতীশ জানো। আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। আমার জন্য ও জীবন দিতে পারে। “ মাধবী মৃদু হাসল। বলল “আমার বাড়ির লোকজনের পলাশ কে পছন্দ হল। আর পছন্দ না হবার কী বা আছে। পলাশ খুব সুন্দর দেখতে। তার উপর আমাদের অভাবের সংসার। ও অনেক টাকা খরচ করত। “
মালার মনটা খুশিতে ভরে উঠল। রলল “তোমার বিয়ে তার মানে পলাশ এর সাথেই হল। ভালোবাসার মানুষকে পেলে?” মাধবীর চোখ অশ্রুসিক্ত। বলল “হ্যাঁ মালা। আমাদের বিয়ে হল। বিয়ের পর ওর সাথেই আসছিলাম। বলল শহরে ঘর বাঁধব। কিন্তু তারপর একটা লোককে দেখিয়ে বলল “মাধু। ইনি আমার দাদা। এর কাছে বসো। আমার একটু কাজ সেরে আমি আসছি”।
মালার চোখ দুটো যেন বেরিয়ে এল। বলল “মানে!তোমার বর এখন তোমার কাছে নেই। কার সাথে এসেছো?শিগগির বলো। তোমার তো ঘোর সর্বনাশ দেখছি!” মাধবী হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। বলল “তুমি আমাকে বাঁচা ও বোন। আমার গ্রামের বাড়িতে ঝি গিরি করে খাবো আমি”। কথা শেষ হতে না হতে ই কারা যেন দরজা খুলছে মনে হল। মালা ইশারা করতেই মাধবী খাটিয়ার মধ্যে শুয়ে পড়ল। কিন্তু মালা এ কাকে দেখছে! এ তো শতপথি। জানালার পাশে সরে গিয়েছে ততক্ষণ। শুনতে চেষ্টা করল ওদের কথোপকথন। শতপথি বললে “চল মেয়ে। তোমার সোয়ামীর কাছে গিয়ে আর কাজ নেই। আমি তোমাকে বিদেশ নিয়ে যাবো। সেখানে তোমার অনেক সোয়ামীর দেখা পাবে”। ক্রুদ্ধ বাহিনীর মতোই গর্জে উঠল মাধবী। বললে “আমার স্বামী পলাশ কোথায়? আমি তার কাছে যেতে চাই “। শতপথির সাথে ছোটোভাই হাসতে লাগল। বললে “তোকে বিক্রি করেছে তোর সোয়ামী। মোটা টেকা নিয়েছে। এবার আমার কাজ বিদেশের বাজারে তোকে বিক্রি করা। ওই পিছনে নদী। ওইপথে ই সোজা চালান হবি তুই”! মাধবীর চিৎকার। বলতে থাকে আমার স্বামীকে কোথায় রেখেছ? শিগগির বলো”। শতপথি নির্বিকার থেকেই বলল “তোমার সোয়ামীর এর আগেও কুড়িটা বিয়ের খবর আছে। তার তো এটাই কাজ “। যা বোঝার মালার বোঝা হয়ে গেছে। যেমন করে হোক মাধবীকে রক্ষা করতেই হবে। ছুটল মালা । এখনই কিছু একটা করতেই হবে।কী করবে সে! রাগে ঘৃণা তে তার গোটা শরীর রীতিমত রী রী করছে। এই শতপথি এত অন্ধকার জগতের মানুষ!আর গ্রামের গরিব মানুষের কাছে ভগবান হয়ে পুজো নিচ্ছে! থানার দিকেই ছুটছে মালা। বনের পথ নয়। পিছনের নদীর পাড় ঘেঁষে। কিছুক্ষণ যেতেই সে দেখল তার বাবা। সদানন্দ বললে “তুই এখানে এত রাতে কী করছিস!” মালা বললে “এখনই থানায় যেতেই হবে। নৈলে সর্বনাশ হয়ে যাবে”।সদানন্দ থানার কথা শুনেই ঘাবড়ে গেল। বলল “কী হয়েছে বল আমাকে”। সব শোনার পর সদানন্দ অবাক হল। বলল “এবার বুঝলাম কেন ট্রলার এ ঘাটে আনতে বলেছে। তুই থানার দিকে যা। তুই না আসা পর্যন্ত আমার নৌকা কোনও দিকেই যাবে না।” থানার নতুন অফিসার ভীষণ জাঁদরেল। মালার কথা শুনেই বললেন “এখনই ওই জায়গাতে যেতে হবে। কয়েকটি পাচারচক্র এখানে সক্রিয়। নদীপথে বাঙলাদেশ দিয়ে মধ্য প্রাচ্যের দেশে পাচার করছে। আমাদের দেশের সীমান্ত পেরোলে আর কিছুই করার থাকবে না।” সুন্দর বনের অশিক্ষিত মেয়েটা আজ একটা মেয়েকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। শতপথির পাচার চক্রের হদিশ পেল পুলিশ। মাধবী এখন পুলিশ এর হেফাজতে সুরক্ষিত। আর সতীশ যখন এ খবর পেল তখন অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। আর মালা চিৎকার করছে আর বলছে “আয় বৃষ্টি ঝেঁপে”। সতীশ মালার মুখখানা দুই হাতে ধরে বলল “বৃষ্টি মানে ভালোবাসা”।