কে আপন কে পর
সলিল চক্রবর্ত্তী
” কর্তাবাবু ঠান্ডা তো ভালই পড়েছে, কত্যামা’কে বলি এককাপ গরম গরম চা করে দিতে”
“কেন মিছিমিছি আমাকে চা খাওয়াতে গিয়ে নিজে বকা খাবি!”
“একটু বকবে তো শুধু,মারবে তো না।” এই বলে বটেশ্বর ওরফে বটা রান্না ঘরের দিকে চলে গেল।
কিংশুক বাবু সস্ত্রীক থাকেন বারাসাতের এই বাগান বাড়িতে। প্রায় বিঘা খানিক জমির ওপর বড় বড় ঘর যুক্ত দোতলা বাড়ি, আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেলের বাগান, ছোট একটা ডোবা, কি নেই এখানে। প্রৌঢ় বয়সে বাগান বাড়িটা করে কিংশুক বাবু ওপার বাংলার টানকে কিছুটা হালকা করেছিলেন। দুই ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছেন, বর্তমানে তারা আমেরিকায় থাকে। নাতি নাতনিদের নিয়ে আর এক সাথে থাকা হলনা। দুই ছেলেই পরিবারকে আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। সাদাসিধা মনের স্বল্প শিক্ষিতা স্ত্রী অনুরাধাকে নিয়ে বটা’র তত্ত্বাবধানে দিনগুজরান করছেন। নিজের সন্তানের থেকে বেশি, এই বটাই সম্বল। আশির দোরগোড়ায় যেতে পেরেছেন স্ত্রী আর বটার জন্যে। ছেলেরা দুই তিন বছর অন্তর এক-আধ সপ্তাহের জন্যে আসে, ওই টুকুই। বটা-ই বছর দশেক তাদের দেখভাল করছে।
কিংশুক বাবু ভেবে পাননা, এই পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ কি!! পিতৃহারা বটার মা-ই একমাত্র ভরসা। কিংশুক বাবুর ভয় হয়, কোনদিন না বটার মা এসে বলেন- ‘বটা আর কাজ করবে না।’
বৃদ্ধা অনুরাধাদেবী সকালের চা টিফিন পর্ব সেরে সবে মাত্র আপন মনে বকতে বকতে দুপুরের আহার পর্বে অনিচ্ছাকৃত মনোনিবেশ করেছেন—
— আর ভাল্লাগে না, যা ঠাণ্ডা পড়েছে,পেটটা যদি না থাকত তো তিন বেলা রান্নার ঝামেলা থাকতনা।
— একদম হক কথা কত্যামা, শীত জাকিয়ে পড়লেই আমার মা-ও ওই একই কথা বলে।
— মায়ের দোষ ধরা হচ্ছে, ঠাণ্ডায় তো আমাদের মতো জলের কাজ করতে হয়না বুঝবি কি করে!!
— আচ্ছা কত্যামা,শীতকালে যদি গরম পড়ত,আর গরমে শীত, তাহলে খুব ভাল হত না?
— জ্যাঠামো করিসনে, বাজারে যেতে হবে, সে খেয়াল আছে?
— যাব যাব, বলছি কি কত্যামা যা ঠান্ডা পড়েছে—।
—-ঠান্ডা পড়েছে না গরম পড়েছে আমি বুঝতে পারছি না, না?
— পারছেন বলেই তো বলছি যে—।
— তোর চালাকি আমি বুঝিনা, না? পারব না, উনি কম্বল মুড়ি দিয়ে চা এর ফরমাশ করবেন, আর আমাকে—। আমার মনে হয় বয়স হয়নি। যা একটা বিয়ে করে আন, তোর বউ সংসারের হাল ধরবে, আর তুই তোর কর্তা বাবুর যত পারিস সেবা করিস।
বটা হো হো করে হেঁসে বলল- “কত্যামা তুমি আমাকে বিয়ে করতে বলছ!! আমার মতো বেকার বাউন্ডুলে কে! কথায় আছেনা-‘খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে মলো এক এঁড়ে গরু কিনে।’
— কেন দেশে কি তোর মতো গরীব ছেলেরা বিয়ে করে না?
— করবে না কেন! কিন্তু আমি ওই দলে নেই।
— কেন তোর আপত্তি কিসের?
— আমার আপত্তি না, মায়ের জন্য চিন্তা।
— তার মানে??
— বিয়ের পর বর যদি পয়সাওয়ালা হয় তো বৌ বরকে নিয়ে ফুড়ুৎ, আর যদি বর গরীব হয় তো বর ছাড়াই ফুড়ুৎ। পাখি পালাবেই কেউ আটকাতে পারবে না।
বটার মুখে কথাগুলো শুনে বৃদ্ধা চা করতে করতে কেমন যেন আনমনা হয়ে যান। জানালার বাইরে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন–” ঠিকই বলেছিস বটা, মা পাখি কত কষ্ট করে প্রায় না খেয়ে ডিমে তা দিয়ে ডিম ফুটিয়ে ছানা বার করে। তারপর যতদিন পর্যন্ত সেই ছানা উড়তে না শেখে, ততদিন পর্যন্ত মা,পাখি শত্রুর হাত থেকে নিজের জীবন বিপন্ন করে ছানাগুলোকে বড়ো করে। নিজেরা না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ায়, কিন্তু যেই ছানাগুলো উড়তে শেখে অমনি মা বাবাকে ছেড়ে চলে যায়। এটাই ভবিতব্য, এই নে চা,ওনাকে দিয়ে একটু বাজারের দিকে যা।”
বটা বাজারে বেশ বড়বড় সাইজের ট্যাংরামাছ পায়। কর্তাবাবু ট্যাংরামাছ ফুলকপি দিয়ে খেতে ভাল বাসেন বলে একটু বেশি করেই কেনে, সঙ্গে একটা বড় ফুলকপি। অনুরাধাদেবী বেশ উপাদেয় করেই রান্না করেছেন। ভোজনরসিক কিংশুক বাবুও বয়সের কথা না ভেবে তৃপ্তি করে মধ্যাহ্ন ভোজ সারলেন। তারপর একটা দিবানিদ্রা দিয়ে উঠলেন। ঘুম থেকে উঠে চুপ করে বসে থাকতে দেখে অনুরাধাদেবীর কেমন খটকা লাগল। যে মানুষটা ঘুম থেকে উঠে চা,চা করে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন, তিনি একদম চুপ। বৃদ্ধ মানুষেরা রাতকে বড় ভয় পায়,পর দিন সূর্য দেখার প্রার্থনা করে শোয়। বটা ব্যাপারটা দেখে মজা করে বলল-” তুমি কি ভাবছ বলোতো, এখনো রাত হয়নি, শীতকালের ছোট বেলা তার উপর মশার যা উৎপাত দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়েছি। কত্যামা আপনি বসেন আমি আপনাদের দুজনের জন্যে চা করে আনি।” কিংশুকবাবু কিছুক্ষণ নির্বাক শ্রোতা হ’য়ে ছিলেন,এবার মুখোমন্ডলে একটা বিরক্তি এনে জানালেন, তিনি চা খাবেন না,কারন তাঁর শরীরে একটা কষ্ট হচ্ছে। অনুরাধাদেবী একটু ব্যাঙ্গের সুরেই বললেন-” নিশ্চই গ্যাস হয়েছে, অতো ফুলকপি খেলে হবেনা!! বটা এক জগ জল এনে কিংশুক বাবুর সামনে রেখে বলল-” জলটা আস্তে আস্তে খেয়ে শেষ করো দিকিনি, গ্যাস উড়ে পালাতে পথ পাবেনা।”
রাতে কিংশুক বাবু কিছুই খেলেন না। যদি বমি হয়ে যেত তা হলে একটু স্বস্তি পেতেন। অগত্যা রাতে অনিচ্ছাকৃত ভাবে বাধ্য হয়ে রুটিন মাফিক ওষুধ খেতে হবে বলে অল্প শুকনো মুড়ি খেলেন।
অনুরাধাদেবী চা তৈরী করে ঘরে ঢুকে দেখেন কিংশুক বাবু তখও লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। বিরক্ত হয়ে চা রেখে জানালার পর্দাগুলো সরাতে সরাতে বললেন-” রোজ রোজ মোরগ ডাকার আগে উঠে আমাকে ডাকতে থাকবেন-ওঠো চা করো,ওঠো চা করো। যেই জাঁকিয়ে শীত পড়েছে আর ঘুম ভাঙছে না, এবার আমাকে ঘ্যানঘ্যান করতে হবে- ওঠো চা হয়ে গেছে, ওঠো চা হয়ে গেছে।” কিংশুকবাবু নিরুত্তর, আনুরাধাদেবী ভাবলেন মনে হয় শরীরটা খুব খারাপ হয়েছে,গত রাতে যা গ্যাস হয়েছিল। তিনি গলার সুরটা একটু নরম করে বললেন-” কি গো তোমার শরীর কি খুব খারাপ?” এই বলে লেপ সরাতেই অনুরাধাদেবী চমকে উঠলেন। কিংশুক বাবুর সমস্ত শরীরটাই বরফের মতো ঠান্ডা। তিনি চিৎকার করে বটাকে ডাকেন। বটা সকাল বেলায় অনুরাধাদেবীর অমন আর্তনাদে ভয় পেয়ে ছুটে এসে কত্যাবাবুকে ওই অবস্থায় দেখে আরো ভয় পেয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। অনুরাধাদেবী আতঙ্কিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বটাকে বলেন-” পাশের বাড়ি থেকে প্রশান্তকে তাড়াতাড়ি ডেকে আন, এখনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।”
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে প্রতিবেশী প্রশান্ত এসে কিংশুক বাবুর বডিতে হাত দিয়ে বুঝতে পারলেন শরীরে আর প্রাণ নেই। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে কল করলেন।
ডাক্তার এসে জানিয়ে দিয়ে গেলেন ঘণ্টা চার পাঁচেক আগে ঘুমের মধ্যে কিংশুক বাবুর সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছে। হঠাৎ করে এমন একটা মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ায় অনুরাধাদেবী এবং বটা উভয়েই যেন পাথর হয়ে গেছে। আমেরিকায় ছেলেদের খবর দেওয়া, আপাতত ডেড বডি কোলকাতার পিসহ্যাভেনে পাঠানো, প্রয়োজনীয় যাবতীয় কাজগুলো প্রশান্ত বাবুই করলেন।
শ্রাদ্ধ শান্তি মিটতে সপ্তা দুই কেটে গেল। আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশীদের একটাই প্রশ্ন এবার অনুরাধাদেবীর কি হবে!! আমেরিকা বাসী দুই পুত্রেরও ওই একই চিন্তায় ঘুম ছুটে যাওয়ার মতো অবস্থা। মানষিক ভাবে ভেঙে পড়া বটাকে অনুরাধাদেবীর বড়ছেলে বললেন-” বটা তুই যদি এতো ভেঙে পড়িস তো মার কি হবে বল, এখন থেকে মার বল ভরসা তো তুই-ই।” অনুরাধাদেবীর ছোট ছেলে কতর স্বরে বলল-” এত বড় সম্পত্তি চটকরে কিছু করা যাবেনা, তারপর মনে করলেই মাকে নিয়ে যেতে পারব না, পাসপোর্ট, ভিসা কত ঝামেলা। তার থেকে বরং মাকে আপাতত তুই দেখাশোনা কর, টাকাপয়সা নিয়ে ভাবিসনে তার ব্যবস্থা আমরা করে যাব।” এইসব আলোচনার মাঝখানে দু’বৌ এক পাঁজা উপহার পাওয়া জামাকাপড় এনে বড়ো ছেলের বৌ বলল-” বটা এখান থেকে তোর যা যা পছন্দ হয় নিয়ে বাকিগুলো ভিখারিদের দিয়ে দিস। এসব বিলো স্ট্যান্ডার্ড গার্মেন্টস আমাদের ঝি চাকরেও পরেনা।” ছোট ছেলের বৌ-ও কম যায় না,সেও ইনিয়েবিনিয়ে বলল-” বটা মাছ মাংস তো উঠেই গেল, হালকা খাওয়াদাওয়া করবি। উনি যেন আবার এই বয়সে অসুস্থ হয়ে না পড়েন। বুঝতেই তো পারছিস, কত বড় একটা ইকোনমিক্যাল প্রেসার গেল,—-“। অনুরাধাদেবী চুপ করে বসে সব শুনছেন, কোনো কথা বলছেন না। কিংশুক বাবু মারা যাওয়ার পর তিনি কেমন যেন যবথব হয়ে থমকে গেছেন। বড় ছেলে মাকে আস্বস্ত করে বলল-” তুমি ভেবনা মা, এ ঘটনা তো একদিন না একদিন ঘটতই। আমাদের ছুটি শেষ, আগামী কাল আমেরিকা ফিরে যেতে হচ্ছে। তবে বছর খানেকের মধ্যে আবার আসার চেষ্টা করব। দেখি তখন তেমার কি ব্যবস্থা করা যায়।
বেশ কয়েক মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। বটা অনেকদিন গ্রামের বাড়িতে মাকে দেখতে যায়নি। অনুরাধাদেবীর কাছে দু’দিনের ছুটি চায়। তিনি তো বটা ছাড়া চোখে অন্ধকার দেখেন। কিন্তু বটারও তো মাকে দেখতে ইচ্ছে করে। সাতপাঁচ ভেবে তিনি বটাকে বলেন- ” আচ্ছা বটা, তুই তোর মাকে তো এখানে নিয়ে আসতে পারিস। এতো বড় বাড়িটা খালি পড়ে আছে!” বটা অনুরাধাদেবীর কথা শুনে নেতি বাচক মাথা নাড়িয়ে বলল-” না কত্যামা, মা গ্রামের বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেনা। ছোট মাসি মাকে তার বাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, মা যায়নি, বলেছিল- শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে মা কোথাও গিয়ে থাকতে পারবে না। এমনিতে মাকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, এখনো বেশ শক্তপোক্ত আছে। চিন্তা সামনে বর্ষাকাল, অনেকদিন হলো ঘরের চালের খড় পাল্টনো হয়নি, খড় গেছে পচে, তারউপর চড়ুই পাখির বাসা বাঁধার গুতোয় সে চাল আর ভাল নেই। বর্ষাকালে ঘরে জল থৈথৈ করে।”
— তা মা’র এতো কষ্ট, ঘরের চালটা তো নতুন বিচালি দিয়ে ছেয়ে দিতে পারিস।
—সে তো অনেক টাকার দরকার, খড় হলেই তো হবে না,সঙ্গে সঙ্গে বাখারিও পাল্টাতে হবে, বাঁশ,খড়,পেরেক, মজুরি, একসাথে তো অনেক টাকার দরকার। অত টাকা কই!!
—- আমি টাকা দিচ্ছি, তুই বাড়ি গিয়ে মায়ের ঘরটা ঠিক করে দে।
— কিন্তু কত্যামা!!!
— তোকে আর কিন্তু বলতে হবে না। আমার ছেলেদের কথা ভাবছিস, ওরা জানতেই পারবেনা,এতো আমার টাকা। তাছাড়া এ-টাকা আমার আর কি হবে। তোর বড়দা দু’দিন আগে ফোন করে বলল, ওরা পুজোর সময় এসে মাস খানেক থাকবে। তারপর ওদের সাথে আমাকে আমেরিকা নিয়ে যাবে।
— আর এই বাড়ি ঘরের কি হবে??
— তা জানিনে বাপু!
— দাঁড়াও, দাঁড়াও এতোদিনে ব্যাপারটা দুয়ে দুয়ে চার হয়ে গেল।
— কি পাগলের মতো বকছিস, কি দুয়ে দুয়ে চার হয়ে গেল!!
— দাদারা সেবার এসে অমিত দালালের সাথে খুব গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করছিল। আমার একদম পছন্দ হচ্ছিলনা। আরে লোকটা এক নম্বরের চিটিংবাজ। কত লোকের টাকা পয়সা মেরে দিয়ে জেলও খেটেছে, তাতেও লজ্জা হয় না। ছোট মুখে বড় কথা বলতে নেই বলে আমি কাউকে কিছু বলিনি।
— আরে না না, তোর দাদারা পৈতৃক ভিটে বেচবে না। ঠাকুরের আশীর্বাদে ওদের সম্পত্তি বেচে খেতে হবে না। তবে দেশের টান, একদিন দেখবি বাপের ভিটেয় ফিরে আসবে।
— সেটাই যেন হয় কত্যামা, হাজার হোক কর্তাবাবুর সখের বাগান বাড়ি তো !!
দুই ছেলে বছর খানিক পর বাড়ি ফেরায় অনুরাধাদেবী যেন নুতন করে প্রাণ ফিরে পেলেন। বাতের ব্যাথা আর তেমন মালুম হচ্ছেনা। ঝিমিয়ে পড়া শরীরে নুতন করে কাজের গতি এসেছে। বটা ব্যাগ ভরে বাজার করে আনছে। আর অনুরাধাদেবী নানা রকম উপাদেয় রান্না করে দুই ছেলেকে যত্ন করে খাওয়াচ্ছেন। মোচা, থোড়, চুনোমাছের ঝাল, ভেড়ির টাটকা মাছ, রেওয়াজি খাসির টাটকা মাংস, এসব তো আর আমেরিকায় পাওয়া যায় না।
দুপুরে অনুরাধাদেবীর দুই ছেলে খেতে বসেছে, টেবিলের নিচে মেঝেতে বসে বটা ভাত খাচ্ছে। পাঁচ ছয় পদের খাবার খেতে খেতে অনুরাধাদেবীর ছোট ছেলে বটাকে উদ্দেশ্য করে বলল-” ভালই তো খাওয়া দাওয়া করিস, তাই ভাবি সংসার খরচ এত হয় কি করে।” কথাটা কানে যেতেই, বটা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। গালের ভিতরে আধ চিবানো ভাতের দলাটা নিয়ে বটা থমকে গেল। ভাবল সে ভুল শোনেনি তো! কথাটা অনুরাধাদেবীর কান এড়ালো না। তিনি ছোট ছেলেকে থামিয়ে বললেন-” ও কি বলছিস বাবা, এত বাজার করে আনছে তো তোরা এসেছিস বলে। আমি মাছ খাইনা বলে বটা কখনো মাছও কিনে আনে না। আমার সাথে ভাজা, সিদ্ধ খেয়েই দিন কাটায়।” অনুরাধাদেবীর উত্তর শুনে বটা বুঝল সে ভুল শোনেনি। মুখের গ্রাসটা আর গিলতে পারল না। থালাটা নিয়ে উঠে কলতলার দিকে চলে গেল। বড় ছেলে একটা ব্যঙ্গোক্তি ভাব নিয়ে বলল-” গরীব মানুষের এত দেমাক ভাল না।”
বটা বাগানে ছোট পুকুরটার পাড়ে গিয়ে দঁড়ায়। ঘরে তার মন বসল না। একটা অস্বস্তি তাকে কুরেকুরে খাচ্ছে। সে ভেবে পাচ্ছেনা দাদারা কেন তার সাথে এমন ব্যবহার করল। তবে কি তাকে পরিচারকের কাজ থেকে সরিয়ে দেবে। কত্যামাকে নিয়ে বিদেশে চলে গেলে এমনিতেই তো কাজ চলে যাবে। অনেক ভেবেও দুর্ব্যবহারের অঙ্কটা বটা মেলাতেই পারছে না। দু’চোখ জলে ভরে উঠল। দাদাদের দেশে ফেরায় যে আনন্দটা হচ্ছিল এক লহমায় সেটা কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল সবজি ওয়ালা ফটিকদার কথাটা “ওরে বটা এতো আনন্দের কি আছে, কত্যামা বিদেশে চলে গেলে তোর কাজটাও চলে যাবে।” কত্যামাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে এটা দুঃখের, কষ্ট হচ্ছে বদনাম ঘাড়ে নিয়ে ফিরতে হবে!! মাথায় কর্তাবাবু, কত্যামাকে নিয়ে নানা রকম মিষ্টি মধুর স্মৃতি আনাগোনা করতে থাকল। এরি মধ্যে হঠাৎ বটার নজরে পড়ল বড়দা আর ছোড়দা রাস্তায় দাড়িয়ে অমিত দালালের সাথে হাত মুখ নেড়ে কি সব কথা বলছে, সাথে সাথে কিছু কাগজ পত্র হাত বদল করল। বটার অল্প বুদ্ধি বিবেচনাতেও কেমন যেন খটকা লাগে। সে ওখান থেকে সরে আসে।
রাতে খাওয়ার আগে অনুরাধাদেবীর বড়ছেলে বলল-” মা এই পেপার্স গুলোতে সই করে দাও।” রাতের বেলায় কগজ পত্র সই করতে বলায় অনুরাধাদেবী একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন-” কিসের কাগজ পত্র??” একটু ইতস্তত করে ছোট ছেলে বলল-” পাসপোর্ট ভিসা করতে হবেনা?” অনুরাধাদেবী কথা না বাড়িয়ে কাগজ পত্রে সই করতে থাকলেন। মন থেকে তিনি আমেরিকা যেতে চাইছেন না। এত বড় বাড়ি তালা দিয়ে ফেলে রেখে যাওয়া কি ঠিক হবে! তারপর বটার জন্যেও মনটা খচখচ করতে লাগল। এরি মধ্যে বিনা ভূমিকায় বড় ছেলে বটাকে বলল-” বটা তোকে সমস্ত হিসাব মিটিয়ে অতিরিক্ত পাঁচ হাজার টাকা দিচ্ছি, তুই কালই বাড়ি চলে যা,তোকে আর আসতে হবে না। হঠাৎ করে এমন একটা কথা শুনে অনুরাধাদেবী অবাক হয়ে বড় ছেলেকে বললেন-” কালই ওকে ছাড়িয়ে দিবি। আমরা যেদিন চলে যাব সেই দিন-ই না হয় ও বাড়ি চলে যাবে!” ছোট ছেলে বলল-” আজ সোমবার শুক্রবারে দুটোর ফ্লাইটে আমরা চলে যাব। এই দিন পাঁচেক আমরা সামলে নেব। বটা এতক্ষণ চুপকরে ছিল এবার দাদাদের বলল-” তোমরা আমার পাওনা টাকাটা হিসাব করে দাও, পাঁচ হাজার টাকাটা দিতে হবেনা।” অনুরাধাদেবী বটার অভিমানটা অনুভব করে বললেন-” দাদারা নিজে থেকে যখন দিচ্ছে, নিবিনা কেন!” বটা মাথা নিচু করে বলল-” দশবারো বছরে আপনারা আমাকে অনেক দিয়েছেন কত্যামা।” ছোট ছেলে বটার কথা শুনে বলল-” সে-তো অবশ্যই,না হলে এক মাইনেতে কেউ এতদিন এক জায়গায় পড়ে থাকে??” কথাটা শুনে বটা কোন উত্তর না দিয়ে পাশের ঘরে চলে যায়। অনুরাধাদেবী ছেলেদের ব্যবহারে মনে ভীষণভাবে কষ্ট পেলেন, তিনিও যে অসহায়। চশমাটা খুলে শাড়ির আঁচল দিয়ে শুধু চোখের জলটা মুছলেন।
সকালে বটাই আগে উঠে প্রাত্যহিক কাজ কর্ম সেরে ফেলে। অনুরাধাদেবী ঘুম থেকে উঠে দেখেন বটা তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি, যেহেতু ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয় নিশ্চই কোনো অসুবিধা হয়েছে। তিনি চলে গেলেন চা করতে। চা হয়ে যাওয়ার পরও যখন বটা ঘরের দরজা খুলল না তখন অনুরাধাদেবী বটার ঘরে ঢুকে দেখেন, বটা ঘরে নেই। বটা বটা বলে তাঁর স্বরে ডাকতে থাকেন। বটার দেখা পাওয়া গেল না বটে,তবে অনুরাধাদেবীর শ্রীমান পুত্রদ্বয় চোখ কচলাতে কচলাতে হাই তুলতে তুলতে বিছানা ছেড়ে উঠে এল। পরিস্থিতিটা তাদের অনুকুলে আছে বুঝে ভিতরে ভিতরে যারপরনাই পুলকিত হয়ে ছোট ছেলে বলল-” পাখি উড়ে গেছে, এখন দেখে নাও ঘরের সব কিছু ঠিকঠাকমতো আছে কিনা!!” অনুরাধাদেবী বাচাল ছেলেদের কথায় কর্ণপাত না করে জলভরা ঝাাপসা চোখে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলেন।
করুণা মণ্ডল, বটেশ্বর ওরফে বটার মা,দুদিন ধরে দেখছেন বটা বাড়িতে এসে ফিরে যাওয়ার কথা একবারও বলছে না, কত্যামা সম্পর্কেও কোনো কথা বলছেনা, নিজের মায়ের সাথে দু’দণ্ড বসে কথাও বলছে না, এমন কি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে প্রতিবেশীদের বাড়িতেও যাচ্ছে না। সব সময় বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। করুনা মন্ডলের মনে একটা খটকা লাগায় তিনি বটার কাছে কারণ জানতে চাইলেন। আজ দুই-তিন দিন ধরে চেপে রাখা কষ্ট বটা মায়ের কাছে আর লুকাতে পারল না। সে শিশুর মতো কেঁদে ফেলল। করুণা মণ্ডল বটাকে জড়িয়ে ধরতেই বটা সমস্ত ঘটনা মা’কে বলল। করুণা মণ্ডল বুঝলেন দাদাদের বদনাম দেওয়া অভিমানের থেকে কত্যামাকে না জানিয়ে ফিরে আসা, আর দেখতে না পাওয়ার কষ্ট টা-ই বটাকে কুরে কুরে শেষ করে দিচ্ছে। করুণা মণ্ডল সন্তানের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বললেন-” আমি বুঝতে পারছি তোর কষ্টটা কোথায়। কিন্তু তোর কষ্ট পাওয়া ছাড়া কি-ই বা করার আছে বল। তিনিও তো অসহায়, ছেলেদের হাতে বন্দী। বুঝেছি, কত্যামাকে না জানিয়ে চলে আসায় তোর কষ্ট আরো বেড়ে গেছে। তুই এক কাজ কর, শুক্রবারে ইয়ারপোট চলে যা। কত্যামা পেলেনে ওঠার আগে একবার দেখা করে আয়, তাতে তোর কষ্টটা কমবে। এখন যা তো বাবা স্নান করে দুটো ভাত মুখে দে।”
জীবনে এই প্রথম বটা শহরে এলো, তা-ও আবার এয়ারপোর্ট চত্ত্বর!! বড়বড় বাড়ি, ঝাঁ চকচকে শর্পিল রাস্তা,পিঁপড়ের সারির মতো গাড়ি, কোনটা যে কোথায় গেছে বটা বুঝতেই পারছে না। ঝাঁঝালো রোদে একে ওকে জিজ্ঞেস করে বটা দ্রুত পায়ে এয়ারপোর্টের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। প্রায় দুটো বাজে, ঈশ্বরকে ডাকে একবার যেন কত্যামার সাথে দেখা হয়।
কোনোমতে ডোমেস্টিক গেটের কাছে এসে বটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। প্রশস্ত স্থান, এতো মানুষ,কতো গেট, কোথায় খুঁজবে তার কত্যামাকে। হাল না ছেড়ে একটু এগিয়ে গিয়ে এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করল-” দাদা আমেরিকা যাওয়ার প্লেন কোথা থেকে ছাড়ে?” ভদ্রলোক একটু তাচ্ছিল্য সুরে জানালেন-” একটু এগিয়ে গিয়ে উপরে উঠে যান।” একে ওকে জিজ্ঞাসা করে করে বটা এক সময় পৌঁছুল ইন্টারন্যাশনাল গেটের সামনে। মহা জনসমুদ্র বটা কত্যামাকে খুঁজতে থাকে। দুটো বেজে গেছে, কত্যামাকে এ জীবনে আর হয়ত দেখতে পাবে না। মনে মনে নিজের উপর খুব রাগ হল। মা-ই ঠিক বলেছে, দাদাদের উপর আভিমান করে কত্যামার সাথে দেখা না করে সূর্য ওঠার আগে তার বাড়ি ছেড়ে চলে আসা ঠিক হয়নি। বটা সাত-পাঁচ ভাবছে, আর এ গেটে ও গেটে খুঁজেখুঁজে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ বটার নজরে পড়ল ভিড়ের মধ্যে একটা চেয়ারে কত্যামা বসে। ‘কত্যামা’ বলে চিৎকার করে বটা ছুটে সেখানে গিয়ে দেখে, কত্যামার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট, উদ্ভ্রান্তের মতো চোখ দুটো যেন কিছু খুঁজে চলেছে। বটাকে দেখে যেন মনে বল পেয়ে বললেন-” বটা তুই এসেছিস!!” পাশে দাদাদের কাউকে না দেখতে পেয়ে বটা অবাক হয়ে বলল-” তুমি একা কেন,দাদারা কোথায়? ” অনুরাধাদেবী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন- “ওরা আমাকে বসতে বলে টিকিট কাটতে ওই গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল, এখনো তো এলনা!” দাদাদের আচরন প্রথম দিন থেকেই বটার ভাল লাগছিল না। একটু সন্দেহ প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করল-” কখন গেছে?” অনুরাধাদেবী একটু ভেবে বললেন-” তা ঘন্টা তিনেক হবে।” বটা দৃঢ় প্রত্যয়ে বলল-” তাই আবার হয় নাকি।”
দুজনের মধ্যে যখন বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথাবার্তা চলছে, তখন একজন সিকিউরিটি এগিয়ে এসে উপযাচক হয়ে প্রশ্ন করলেন- ” কি ব্যাপার বলুনতো, উনি তিন চার ঘন্টা এখানে বসে রয়েছেন দেখছি।” বটা সিকিউরিটিকে ঘটনাটা জানালো। সিকিউরিটির কাছে ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। তিনি বললেন- ” এখান থেকে সরাসরি আমেরিকা তে কোন ফ্লাইট নেই, দুবাই হয়ে আমেরিকা যেতে হয়। তাছাড়া দুবাইয়ের ফ্লাইট এক দেড় ঘন্টা আগে কোলকাতা ছেড়ে গেছে। আপনারা এক কাজ করুন, এয়ারপোর্ট থানায় গিয়ে দুই ছেলের নামে কমপ্লেন লঞ্চ করুন।” অনুরাধাদেবী কাঁদতে কাঁদতে বললেন-” কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করব বাবা সব থুতুটা তো নিজের গায়ে এসে পড়বে।” —– তাহলে বাড়ি ফিরে যান।
—- আ-র বা-ড়ি!! সে কি আর আছে বাবা!! এখন বুঝতে পারছি, পাসপোর্টের নাম করে গাদা গাদা সই কি এমনি করিয়েছে!! এ আমার পাপের শাস্তি বাবা পেটের সন্তানকে শিক্ষিত করেছি মানুষ করতে পারিনি। এখন ফল-তো ভোগ করতেই হবে। ভগবান যতদিন উপরে তুলে না নিচ্ছেন ততদিন ফুটপাতেই কাটিয়ে দেব।”
বটা এতোক্ষণ চুপ করে অনুরাধাদেবীর কথা স্বজল নেত্রে শুনছিল, তারও চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। আবেগকে আর সংযত করতে না পেরে ঘৃণাভরে রাগান্বিত স্বরে বলল-” তোমার ছেলেরা যে অকৃতজ্ঞ সেটা আমি আগেই বুঝেছিলাম, কিন্তু এতোটা যে অমানুষ তা কল্পনাও করতে পারিনি!! কুকুর, বিড়ালকেও মানুষ এইভাবে রাস্তায় ফেলে চলে যায় না, আর জন্মদায়িনী মাকে!! ছি,ছি আমার ভাবতেও ঘেন্না করছে। বুকের রক্ত দিয়ে তিল তিল করে যে মা এদের মানুষ করেছে, তাকে——। এরা নাকি আবার বাবা মায়ের শিক্ষিত সন্তান!! একবার ভেবে দেখলি না তোরাও একদিন বুড়ো হবি, তোদেরও সন্তান আছে। হায় ভগবান, এ তোমার কেমন বিচার? তুমি কেঁদোনা কত্যামা, ওরা তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে তো কি হয়েছে। আমি কি তোমার ছেলে নই? চল আমাদের গ্রামের বাড়ি, আজ থেকে দুই মাকে নিয়ে শুরু হবে আমার নুতন জীবন।”