আজ সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছে। এই বৃষ্টি মুষলধারে পড়ে চলেছে। গ্রামের যেদিকে সড়ক গেছে সেদিকে আছে ছোট্ট একটা বাজার । সভ্যতার কৃপণ আলো পেয়েছে গ্রামটি। এখানে একটা চা এর দোকানে আজ বিক্রি বাটা ভালোই চলছে। এই বর্ষার অপেক্ষা করছিল সবাই। চাষীপ্রধান এই গ্রাম মামুদপুর। হিন্দু মুসলমান মিলিয়ে হাজার লোকের বাস। গ্রামস্থ দেবদেবীর মধ্যে দুর্গা, শেতলা মনসা আছে। এছাড়াও গাঁয়ের পশ্চিম দিকে আছে গাজীসাহেব। পেটের যোগান দেওয়ার কাজে লিপ্ত থাকে ওরা। ছোট্ট বাজারে অবরে সবরে বরফ দেওয়া মাছ আসে। এছাড়াও আছে মধু দোকানীর মুদির দোকান। একটা হাস্কিং মেশিন। গোদা বাংলায় যাকে চালকল বলে। এই এলাকার সম্পন্ন চাষী জগাই। ওরা দুভাই। যমজ। অপরজন মাধাই। একটা সময় ছিল দুজনে একসাথেই চাষ করত। এখন সংসার ভিন্ন হয়েছে। জমির ভাগ হয়েছে। দুভাই আজ চাএর দোকানের মধ্যেই বসে আছে। চা ওলা অজয় আজ খুব খুশি। এইসব দিনে বিক্রিবাটা ভালো হয়। উনানে আগুন দিয়ে কাপগুলো ধুতে ধুতে গান ধরে “মেরা পেয়ার কি উমর হো ইতনা সনম”। জগাই কটকট করে ওর দিকে তাকায়। বলে “হিন্দি সিনেমার গান করছিস ? মাঝে মাঝেই শওরে গিয়ে এসব ছাইপাঁশ দেখা হয় বুঝি”? অজয় উঁচুদাঁত নিয়ে হাসে। বলে “আর দাদু। দিনরাত শুধুই কলমা আর রত্না করে গেলে। জীবনে জোশ চাই দাদু।জোশ চাই”। “তোর মাথা! দে একতাড়া বিড়ি দে দেখি?”
মাধাই হাতটা বাড়ায় জগাই এর দিকে। বলে “এই বিড়িটা তেমন নেশা আনে না। নেপানি তামাক নেই বেশি।” মুখ বিকৃত করে জগাই অজয়কে বলে “কী সব ভাঁওতা মারা জিনিস এনে লোক ঠকানো ব্যাবসাটা ছাড়। তোর বাপ এমন চশমখোর ছিল না। তুই দেখছি হাড় বজ্জাত “। অজয় আবার উঁচুদাঁত বার করে হাসে। ওর ব্যবহার টা অমনই। লাখ ই হোক, আর লিক ই হোক সব হেসেই উড়িয়ে দেয়। আর মুখে চলে হিন্দি সিনেমার গান।
কদিন আগেও জগাই মনমরা ছিল। মনে মনে ঈশ্বর এর মুন্ডুপাত করছিল। আর এখন বাইরে বেরিয়েছে। সেই কবেকার একটা তালপাতার পাকাল মাথায় দিয়ে ছোট্ট একটা মালকোঁচা বেঁধে ফুড়ুক ফুড়ুক বিড়ি টানছে আর চাএর ধূম ওঠাচ্ছে।
ঠিক সেই সময় প্রফুল্ল এসে হাজির। কোমর দুলিয়ে চলে প্রফুল্ল। পিছন দিকটা দেখলে মনে হবে যেন মৃদুমন্দ গমনে কোনও সুন্দরী এল। যাত্রিপার্টিতে বেড়ে ফিমেলের পার্ট করে। অ্যামেচার পার্টিতে মেয়েমানুষের ভাড়া অনেক। প্রফুল্ল সেখানে মাত্র পাঁচশ টাকায় করে দেয় । মুখে কড়া দাড়ি নেই তাই রক্ষে। মাঝে মাঝেই বুকের কাছটা দুলিয়ে দেয় ও কথা বলার সময়।
এই প্রফুল্ল অজয় এর থেকে দুবছরের বড়। জগাই কে দেখে বললে “কি গো! আজ তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ডুমুরের ফুল দেখছি। এবার বর্ষা নেমেছে। আর চিন্তা নেই।কী বলো দাদু”? জগাই মাথা নাড়ে। বলে পুবুলে না করলে রোয়াগাড়া হবে কি করে। তোমাদের আর কী। ফূর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ। বীজধান কোথায় পাবো অত। “
সত্যিই এবার বীজধান পাওয়া আকাল। দশকাটা জমিতে জগাই এর মতো চাষি বীজ ছড়িয়েছিল। ভেবেছিল বর্ষা নামলেই বীজধানে গোছ আসবে। আর অমনি সবাই কে তাক লাগিয়ে সবার আগে জ্যাঠা ধানের আবাদ করবে।
হায় কপাল!রেডিও তে রোজই বলে বর্ষা আসে নি। তা গেল কোথায় বাপু । এরকম তো বাপের জন্মে দেখেনি। আবার মানুষ ও তেমনি। ছাগল পুষছিস পোষ। তাতে আবার সকাল হতে না হতে ছেড়ে দিস কেমনে। হতাভাগা সব। খাবি কি। বলি ডানহাত মুখে উঠবে কী করে। ধান মানেই ধন। কতদিন পুন্নিমের মা ঘ্যানর ঘ্যানর করছে। গঙ্গা চান করবে। এখন তার আবার শুধুই ভাড়া দিলে হবে না। খরচার কী ফিরিস্তি।
সব টাকা এখন ধানচাষে ঢুকবে। তারপর ঠিক যখন শিউলিফুল টোপা টোপা ফুটবে তখন ওই বোঁটার রঙ মুখে মেখে জগজ্জননী আসবেন। মেয়ে আসবে বাপের ঘরে। কত আনন্দ। কত মজা চারদিকে। শুধু জগাই এর ঘর আলো করতে পুন্নিমেটা আর আসবে না।ওর ঘরে নামবে অন্ধকার। বুড়ি গুনগুন করে কাঁদবে। জগাই এর মনে পড়বে সব কথা। আপন মনে ভেবে চলে জগাই। প্রফুল্ল বলে “অ দাদু। তোমার হল কী?কীসব বিড়বিড় করছ বলো দিকিন। আমার কথা শোনো। এবার ধান উঠলে হাজার টাকা দিও।”
চমকে সম্বিত ফেরে জগাই এর। প্রফুল্ল কে বলে “হ্যাঁ। একেবারে হাজার টাকা। বলি গাঁয়ের অন্য অনেক মানুষ আছে। তাদের কে কত বলবি। নরম মাটি পেয়ে আঁচড়াচ্ছো ।”
প্রফুল্ল গা গেঁষে বসে। ওর কথা বলার আর্ট আলাদা। বললে “দাদু গো। এবারে যে সে পালা নয়। একেবারে সন্ধিপূজা। দেবী দুগ্গা মর্তে আসার কাহিনী। আমি হব রাণী। সুরথ রাজার বৌ”। যাত্রাপালার গল্প শুনতে জগাই এর বেশ লাগে। একটা সময় কত অ্যাক্টো টাই না করেছে। একবার কালাপাহাড় সেজেছিল। কী ভয়ঙ্কর সেই হুঙ্কার। তারপর সেলুলার জেল পালাতে লোকে জুতো ছুঁড়েছিল ওর অভিনয় দেখে। সে কী আজকের কথা। তখন জগাই জোয়ান। পেশীবহুল টানটান শরীর। পুন্নিমের মা তখনও আসে নি। পাঁচটা গাঁয়ের লোক ধন্যি ধন্যি করেছিল। আর এই প্রফুল্ল টা দেখো। এমন করে মেয়েমানুষ সাজে। ধূস।কোনো কম্মের নয়।
জগাইকে কাছে ডাকল ওর ভাই মাধাই। কানে কানে বললে “বীজধান এর কী হবে? আবাদী জমি আছে আর বীজধান নেই। এখন তুমিই ভরসা। তুমি যদি রূপবাবুকে বলে ব্যবস্থা করতে পারো”। জগাই ভাই এর দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে এই হল সহোদর। এখন কাঁড়ে পড়ে ভাঁড়ে জল খাচ্ছে। কোনও দিন ভাবেনি ভাই পৃথক হবে। যেদিন বিয়ে করে এল সেদিন থেকেই আপনজন ভুলে গেল। কী অশান্তি। আর আজ!সত্যিই অবাক হয় জগাই। মৃদু হেসে শুধু বললে “সে দেখা যাবে এখন “।
জগাই বাড়ি ফিরে এল। বর্ষাটা জাঁকিয়ে পড়েছে এটাই যা সুখ। অন্ধকার ঘর দুয়ার ।ঘরে একটা কুপি জ্বলছে। হাত পা কুয়োতলায় ধুয়ে একটা গামছা নিয়ে মুছলো। তারপর আধো আলোয় বিছানাতে গা এলিয়ে দিল। স্তব্ধ ঘরে কেবলই তার কানে বাজতে লাগল “বাবা। সতে কাকা বিশুদের জমির জল নিয়ে নিয়েছে। বাবা দীনু দা লাঙলা হয়েছে। “ এইসব কথা রোজ সে শুনতে পায়। বুকে মোচড় অনুভব করে জগাই। এক অশান্ত পিতৃহৃদয় থেকে জল এসে ভিজিয়ে দেয় চোখ। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি। আবার ভিতরের ঘরে এক অশীতিপর বৃদ্ধের চোখেও নোনাজল এর ধারা। যা বিস্বাদময়। এত অন্ধকার চারিদিক এ। যদি পুন্নিমে থাকত এত আঁধার থাকত না জগাই এর জীবনে।
জগাই এর বিয়ে হয়েছিল দেখাশোনা করে। ওদের আমলে ছেলেরা মেয়ে দেখতে খুব একটা যেত না। বাপ মা দেখে শুনে কথা দিত। আর বাধ্য ছেলেরা বিয়ের পিঁড়িতে বসত। জগাই ও তাই করলে। বাপ যখন শান্তিপুরে রাস দেখতে গেল ওখানেই ওদের ব্যবহারে মুগ্ধ হলে। বললে আমার জগাই এর বে দিয়ে কুটুম করবে।পাল্টি ঘর যখন। পিসতুতো দাদা চন্ডী গেসল একবার মেয়ে দেখতে। তখন বিয়ের আর কটা দিন বাকি। তোড়জোড় চলছে। হ্যাচাক গুলো সারাচ্ছে সাতকড়ি নাপিত। সে আশ্চর্য খলিফা ছেলে এল বাড়া ভাতে ছাই দিতে। জগাই কে কান ভাঙালে। বললে “ছ্যা ছ্যা। তোর বে শেষ পর্যন্ত ওই বিচ্ছিরি মেয়েটার সাথে। মুখ খানা লম্বা। কেমন জানো দেখতে”। জগাই এর মেজাজ গেল বিগড়ে। বিয়ের আগের দিন বাপকে সরাসরি বললে “এ বিয়ে আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। আপনাদের উপর একটা ভরসা ছিল ।আপনাদের ওই মেয়ে কী করে পছন্দ হল। একদম কুশ্রী। “ জগাই এর বিধবা পিসি বললে “এসব তুক গুনের খেল। ওই যে মিষ্টির সাথে কী খাইয়েছে তখনই সব সোন্দর দেখিয়েছে”। জগাই এর বাপ রাশভারী মানুষ। বললে “আমি কথা দিলে মাথা দিই। আমার কথার নড়চড় হবে না। আমি নিজে মেয়ে দেখেছি। বেশ লক্ষীমন্ত। তারপর যখনই ওদের দরজার কাছে গেছি দেখি বিরাট এক প্রজাপতি। ওখানেই সিঁদুর মাখালাম প্রজাপতিকে। ওখানেই বিয়ে হবে”। জগাই বললে “বুঝলি চন্ড দা। শুভদৃষ্টির সময় যদি দেখি বৌ ভুলভাল তবে পালাবো ।
সত্যিই জগাই কে পালাতে হয় নি। বেশ সুন্দর লেগেছিল জগাই এর। চন্ডীর কথা শুনে কী ভুলটাই না করছিল। তারপর সেই সংসারের কত দায়িত্ব নিজের হাতে পালন করত বৌ। ভোর হতেই ভিতে কাটতে চলে যেত জগাই। গামছায় থালা বেঁধে খাবার পাঠাত বৌ। মাধাই তখন শহরে গেল। বললে “জমিতে কী আর আছে ছাই। গতরে খেটে মরা। আমি বাইরে কাজে যাবো।” তিল তিল করে জমি বাড়তেই চলল। এমন মানুষ জগাই। কেউ তাকে ঠকাতে চায় না। বাপের ডানহাত সে। আর মাধাই। বেশ কেতাদুরস্ত হাবেভাবে। অল্প টাকার বেতন তো কী হয়েছে। জমিতে গাধার খাটনি। যত এড়িয়ে চলা যায় ততই মঙ্গল। মায়ের ঝোঁক মাধাই এর দিকে। বেশ বাবু বাবু লাগে মাধাই কে। ওটাই ঠিক মানুষ হয়েছে। আর জগাই যেমন গাঁয়ের ভূত তেমন ই রয়ে গেল। ওকে বোকার হদ্দ মনে হয়। এখন জগাই পঞ্চাশ বিঘা জমি করে ফেলেছে। চাষের যত্ন কীভাবে নিতে হয় ও জানে। ট্রাক্টর কিনেছে। অন্য চাষীর জমি চষে দিচ্ছে। জগাই এর বাপ খুব খুশি। এমন ছেলে ভাগ্য করে পেতে হয়। এবার যখন ধান উঠল তখন গোলায় যেন ধরে না। গোরুর গাড়িতে ধান আসছে। মা লক্ষ্মীর পদচিহ্ন পড়েছে ।জগাই বললে “আরো একটা গোলা করা দরকার। “ দিন যায়। মাস যায়। জগাই এর বৌ এর শরীরে নতুন প্রাণ এসেছে। জগাই স্বপ্ন দেখে ভা লক্ষ্মী তার ঘরে আসছে। কী একটা আনন্দ গ্রাস করে জগাই কে। সেদিন ঘটল একটা ঘটনা। মাধবপুরে কথকতার আসর বসেছে। সারারাত রামায়ণ এর কাহিনী শোনাবেন প্রণব ঠাকুর। গল্প শুনতে খুব ভালোবাসে জগাই। অবাক হয়ে যায় এক একটা কাহিনী শুনে। মায়াসুরের কাহিনী ।কন্যাসন্তানের জন্য তপস্যা করলে মায়াসুর। তাও আবার মহাদেবের কাছে। কীভাবে আবার মেয়েও পেয়ে গেল।এই মেয়ে জাতটাকে বড় ভালোবাসে জগাই। ওরা সবার জন্য কত ভাবে। বড় কোমল বড়ই সুন্দর। কতদিন অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে মথুরার কথা। কী রূপ। যেন ঠিকরে পড়ছে লাবণ্য। মহাদেবকে ভালোবাসার জন্য তাকে কুয়োর ব্যাঙ হতে হল। বাপ্রে। কী কষ্ট। কী যন্ত্রণা!
সেদিন কথকতা শুনে এসে বৌকে বললে “আমাদের যেন মথুরার মতো একটা কন্যে হয়”। বৌ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।”সে কে গা। কোথায় বাড়ি?” বৌ এর সরলতা মুগ্ধ করে জগাই কে। বলে “মথুরা স্বর্গের অপ্সরা। মহাদেব কে পতি রূপে পেতে চেয়েছিল। কিন্তু মাতা পার্বতী অভিশাপ দিলে “কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাকো”। ব্যাস!সঙ্গে সঙ্গেই একেবারে ব্যাঙ।” বৌ বলে “তা ব্যাঙ নিয়ে কী করব?”
রাতের অন্ধকার এ দুটি প্রাণ বকবক করে চলে। বৌকে আদরে ভরিয়ে দেয় জগাই। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে “আমার বৌটা ভীষণ বোকা। ব্যাঙ কেন হবে? ওটা তো অপ্সরা। মহাদেব প্রসন হয়ে শাস্তি কিছুটা লাঘব করলে। বললে বারো বছর কুয়োর মধ্যেই থাকতে হবে। তারপর এক মহান মানুষ তাকে বিবাহ করবে। “
বৌ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আপনমনে বলে চলে জগাই “কুয়োর মধ্যে থেকে মায়াসুর ওই মথুরাকে উদ্ধার করে। তখন তো আবার মেয়ের রূপ ধরেছে। আর জানো। তারা এই মেয়েটার নাম দিলে মন্দোদরী”। বৌ বলে “সে তো রাবণরাজার বৌ”। হাসতে থাকে জগাই। ঠিক এই সময়ই একটা কিসের শব্দ তে স্ত্রী পুরুষ দুজনেই চমকে ওঠে। বৌ জাপটে ধরে জগাই কে। বলে “অয় গো!ভূতটা আবার এয়েচে। আমি কদিন ধরেই এই শব্দ পাচ্ছি। তুমি আর কখকতা শুনতে যাবে না। আমার এমনিতেই ভয় করে। রাতের অন্ধকারে কারা যেন ফিসফিস করে। আমি শুনি তো”।
একটু অবাক হয় জগাই। কান করে থাকে। আর কোনও শব্দ তো পাওয়া যাচ্ছে না। মনের ভুল। কিন্তু বৌ এত ভয় পাচ্ছে এটা খুবই খারাপ। অন্তত এই সময়টা। সত্যিই আর রাত করা যাবেই না। কথকতা একটু শুনেই চলে আসতে হবে।
পরেরদিন সকালেই ডাক পড়ল জগাই এর। জগাই জানে নিশ্চয়ই কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। নৈলে সকালেই ডাক পড়তেই পারে না। বিশেষ করে এইসময়ই জগাই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চাষের বলদের জন্য খড় কুঁচাতে হয়। গাই গুলোকে দুইতে হয়। এক একটা গাই দিনে পঁয়ত্রিশ কেজি দুধ দেয়। তাদের ফ্যানজল দেখাতে হয়।ভূষি খোল দিতে হয়। তবুও বাপ মাকে বড় শ্রদ্ধা করে জগাই। সবাই কে বলে “ওরা পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন। ওদের সম্মান আগে”।
কর্তা জগাই কে বললে “মিত্তির দের একটা জমি বিক্রি আছে। আমরা কিনব। তুমি কি বলো?: জগাই হাসিমুখে বললে “এটা তো খুবই ভাল কথা বাবা। আর গোলায় যা ধান আছে তাতে হয়ে যাবে। “ বাপ বললে “এই জমিটা আলুজমি। খুবই উর্বর তিন ফসলি। চারটে গোলার ধান বেচলেও হবে না। আরও কিছু লাগতে পারে”। জগাই বললে “সে চিন্তা আপনি করবেন না। আমি আপনার বৌমার গহনা বন্ধক দিয়ে বাকি টাকা জোগাড় করে দেবো। পড়ে ওই জমির ফসল উঠলে না হয় ছাড়ানো হবে”।
সংসার বড় বিচিত্র। মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। কখনও কখনও অতিরিক্ত ভক্তিপ্রেমকেও মানুষ সন্দেহের চোখে দেখে। ধানের ব্যাপারী রঞ্জন পালকে খবর দিল কর্তা। ধান মাপা হবে। মেরেকেটে চারশ বস্তা ধান হবেই। খাস ধানের দাম বেশি। ফসল বেচে জমি কেনা হবে। দাঁড়িপাল্লা নিয়ে হাজির ব্যাপারী। গোলার ছাউনি তুলে ঢুকলো দুজন শক্তিশালী মজুর। সাথে জগাই।
ধান দেখে সন্দেহ হল জগাই এর। এ সে কী দেখছে। চূড় করে ধান রেখেছিল সে। এত কম ধান কেন? ওজনে দেখা গেল এক একটা গোলায় মাত্র তিরিশ বস্তা ধান। কোথায় গেল এত ধান। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে জগাই। বাবার কাছে এসে কাঁদতে থাকে ।বলে “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না বাবা। প্রতিটা গোলায় একশ বস্তা ধান থাকার কথা। আমি যে নিজে রেখেছি”। কর্তা চুপ করে যায়। মাধাই বলে “ধানের হিসাব তো তোর কাছেই। অত জমির ধান তো পাখনা মেলে উড়ে যায় নি”! মা বললে “দ্যাখ। হয়ত বৌএর গহনা করবে বলে নাটক ফেঁদেছে”। মাধাই ব্যঙ্গ মিশ্রিত কন্ঠে বলে “আমি তো তোমাদের আগেই বলেছি অতি ভক্তি চোরের লক্ষন”।
এতদিনের সংসার কে দিনের পর দিন খেটে যে মানুষ টা এত জমি কিনেছে আজ তার গর্ভধারিণী পর্যন্ত তাকে এমন কথা বলল। কিন্তু ধান গুলোই বা গেল কোথায়? কী রহস্য আছে এর মধ্যে। কর্তার মাথায় একরাশ চিন্তা। মিত্তির দের কথা দিয়েছেন। রেজিস্ট্রি করার জন্য দলিল লেখকদের অগ্রিম দিয়েছেন। এখন কী হবে! জগাই শেষ পর্যন্ত এমন করবে! না না। তার জগাই ধান সরাতেই পারে না। কিছুতেই না।
ধান বিক্রি হল। কিন্তু এখনও দু লাখ টাকা দরকার। বাপ জগাই কে ডাকলে। বললে “টাকা কোথা থেকে জোগাড় হবে?” জগাই কেঁদে চলে। বাপের পা ধরে কাঁদতে থাকে। বাপও আজ যেন কী একটা সংকল্প করেছে মনে মনে। জগাই বলে “বৌ এর সামান্য গহনা বিক্রি করে দিচ্ছি। বন্ধকীতে অত টাকা আসবে না। আর গোয়ালে দুটো গাই বেচে দেওয়া হোক।” মা শুনিয়ে শুনিয়ে কর্তাকে বললে “বলেছিলাম না। মাধাই আমার প্রকৃত মানুষ হয়েছে। সে শহরে বাড়ি কিনেছে। আবার শহরের মেয়ে বে করবে। বড় বৌ এর।মতো ন্যাকাবোকা নয়। খুব ইসমার্ট”। কর্তা বললে “জমিটা কেনা হোক। তারপর দুভাই ভেন্ন হবে। সবই আধাআধি ভাগ। “ মা এর চোখ কপালে ওঠে। বলে “মানে! কীসব বলছ?” কর্তা বললে “তোমার কিছুই তো অজানা নয়। এমন নাটক কেন করছ? আর কত নীচে নামবে তোমরা? আমি জগাই এর কাছে খাবো। আর তুমি তোমার আদর্শ পুত্রের কাছেই খেও।
জগাই এর মা এবার নির্বাক। তবে কি সবকিছুই ফাঁস হয়ে গেল! কিন্তু তা কী করে সম্ভব। মাধাই ছাড়া কেউ তো জানে না। এখন চুপ থাকাটাই শ্রেয়। রাতে মাধাই এর সাথে অনেক কথা হল মায়ের। মাধাই বললে “আমি তোমাকে রাণী করে রাখব। শুধু বাবাকে বলো তোমার ও সম্পত্তি চাই। তাহলে সেটাও পরে আমার হবে”। মহাকালের গতি এগিয়ে চলল। সম্পত্তির তিনটে ভাগ হল। উর্বর জমিগুলো নিয়ে নিল মাধাই। পাশে মা তার অন্ধ অনুগত। নতুন বাড়ি পড়ল মাধাই এর ভাগে। জগাই বললে “মা মাটির ঘর দুয়ারে কেন থাকবে? মাধাই এর ভাগে নতুন বাড়ি হোক।” বৃদ্ধ পিতা আড়ালে চোখের জল ফেললে। সংসারে এল মাধাই এর নিজের পছন্দ করা শহরের মেয়ে। চাষের কাজে যে কিছুই জানে না। দিনরাত গান বাজনা হৈ হৈ শব্দ আসে নতুন বাড়ি থেকে।
দেখতে দেখতে পুজো কেটে গেল। কোজাগরী পূর্ণিমাতে জগাই এর ঘরে এল ফুটফুটে এক মেয়ে। কী অপূর্ব। জগাই এর বাপ বললে “ঘরে আবার লক্ষ্মীর পদচিহ্ন পড়ল।”
মাধাই নতুন বৌ এর যত্নে ব্যস্ত। মাঝে মধ্যেই দলে দলে লোক আসছে। সেসব সামলানোর দায় মায়ের উপর বর্তেছে। এরমধ্যেই একদিন মাকে বললে “তোমার জমিগুলোর ভাল দাম পাওয়া গেছে। বিক্রি করে দেবো”। প্রথমে মা রাজী হতে না চাইলেও পরে ঠিক বুঝিয়ে সুঝিয়ে সব টাকা নিজের কুক্ষিগত করল। মা বুঝল তার প্রচুর টাকা ব্যাঙ্কে রেখে দিয়েছে মাধাই। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র হয়ে মাধাই এর সংসারের সব কাজ করে যেতে লাগল। জগাই এর মেয়ের নাম পূর্ণিমা। বাবার নয়নে মণি যেন। তবে লক্ষ্মীর পদচিহ্ন জগাই এর মন্দভাগ্যকে রোহিত করতে পারল না। অনুর্বর জমিগুলো তে ভালো ফসল হল না। পরপর কয়েক বছর দেখা দিল অতিবৃষ্টি আর অনাবৃষ্টি। এরমধ্যেই পিতা বিছানা নিলেন। জগাই নদীর ধারে জমি বিক্রি করে বাপকে শহরের ডাক্তার দেখালে। কিছুতেই কিছু হল না। পিতা রওনা দিলেন মহাপ্রস্থান এর পথে। এখন জগাই আরও অসহায় হয়ে পড়ল। এখন শুধুই মেয়েটা তার ভরসা। কিশোরী পূর্ণিমার চোখ দুটোতে কত মায়া জড়ানো। বড় স্নিগ্ধ আর শান্ত এই মেয়েটার কোমল স্পর্শ জগাই কে সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয় । জগাই নতুন করে সংগ্রাম শুরু করে। সে বোকা সোকা পাড়াগেঁয়ে ভূত। অত দুরভিসন্ধি বোঝে না। নৈলে সেই যেবার কথকতা শুনে বাড়িতে এসে ভূতের আওয়াজ শুনেছিল তার সত্যটা তার অজানা ছিল না। শুধুই মাএর সম্মান রক্ষা করতে সেদিন আসল সত্য সে চেপে গিয়েছিল। শুধু বাবাকে বলেছিল “মা আর ভাই গোলা থেকে রাতের অন্ধকারে ধান বেড় করে বেচেছে বছরের পর বছর। ওদের শহরের বাড়ি কিনতে সব টাকা চাষ থেকেই গেছে।তবুও ওরা আমার রক্তের সম্পর্ক। ওদের ছোটো করতে চাই না”।
আজকাল মা বুঝতে পারে তার বড় ভুল হয়ে গেছে। আসল হীরে ফেলে কাচের কদর করেছেন মা। সাধ হয় বড়ছেলে বড়বৌ এর সংসারে যাবার। বড়বৌ তাকে কত সেবা করত। কিন্তু এদের মায়াদয়া কম। সংসার তো অনেক হল। এখন নিভৃতে ঈশ্বরের নাম করবেন তার সময় নেই। জমিগুলো বিক্রি করে টাকা পয়সা নয়ছয় করেছে মাধাই। বসে খেলে রাজার ভান্ডার ফুরিয়ে যায়। কিন্তু এই বিষ বৃক্ষ তো নিজেই রোপণ করেছেন। এখান থেকে কী আর পরিত্রাণ মিলবে। তার জগাই কি তার মাকে ক্ষমা করতে পারবে।তবুও একদিন মাধাই আর তার বৌকৈ ডেকে মনের কথা জানালো মা। ওরা যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। বৌ বললে “অবশ্যই যান। ও তো আপনার ছেলে। ওর কাছেও যাবেন। “ মা বুঝতে পারে তার আর কিছুই নেই। কাজ করার সামর্থ্য নেই। এরা দায় সারতে চাইছে। মনে মনে হাসলেন আর বললেন “কী ভাগ্যি গহনাগুলোর কথা বলি নি। নৈলে ওগুলো নিয়ে নিত। অনেক হয়েছে। এবার পাপের স্খলন দরকার। কাঠের সুদৃশ্য বাক্সে অনেক সোনার গহনা ।সব জগাই এর পরিশ্রমের ফল। আজ জগাই এর মেয়ের বিয়ের গহনা সব ওর ঠাকুমা দেবে।
এদিকে মাধাই এখন চাষের কাজ করতেই পারে না। শালীদের বিয়ে দিতেও তার বেশ কিছু জমি বিক্রি হয়ে গেছে। বৌ ভীষণ স্বার্থপর । সবকিছুই মুখের বলার সাথে সাথেই চাই। আর এই নিয়ে মাঝে মাঝেই স্বামী স্ত্রীর মধ্যে তুমুল ঝগড়া চলে। একদিন অসহনীয় হয়ে মা বলল “তোমাদের কতদিন বলেছি ঝগড়া অশান্তি করবে না বৌমা ওতে লক্ষী চঞ্চলা হন। হরিহোড়ের সেই ঘুঁটে কুড়ানির গল্প পড়ো নি। এই ঝগড়ার কারণেই তো ভবানন্দ মজুমদার এর বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন মা”। বৌ তেলে বেগুনে রেগে বললে “আপনার এই জ্ঞান দেওয়াটা একটা রোগ। বেশ তো বলছিলেন বড়ছেলের বাড়ি চলে যাবেন তার কী হল”? অবাক শুধুই নয়, এমন কথা শোনার পর মায়ের পা এর তলার মাটি যেন কেঁপে উঠল। আর ওই কুলাঙ্গার পুত্র যাকে বিশ্বাস করে এসেছিলেন তার নীরবতা আর ও ব্যথিত করল। আর সেই মুহূর্তেই একটা ব্যাগে জিনিস পত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন মা।
লক্ষীছাড়া হল মাধাই। এখন সে সুযোগ খুঁজে বেড়ায় কী করে অবস্থার উন্নতি করা যায়। মা চলে গেছে । মনে মনে নিশ্চিন্ত হল। আজন্ম অলস মাধাই এখন হিংস্র হয়ে গেছে আরও। তার বিলাসিতার ঠাট বাট বজায় রাখতে সে মরিয়া হয়ে উঠল। সে দেখেছে জগাই আবার বেশ ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়ে গেছে। ওর বিক্রি করা জমি আসলে জগাই নিজেই কিনেছে লোক মারফত। অতএব এখন অভিনয় করতে হবে। জগাই এর মন বড় উদার।
মা প্রবেশ করলেন জগাই এর বাড়ি। বৃহস্পতিবার। মড়াই এর কাছে আলপনা দিচ্ছে পুর্ণিমা। এক পিঠ ঘন কালো ভিজে চুল থেকে তখনও জল ঝরছে। কী সুন্দর সাজানো পরিপাটি চারদিক। সেই তুলসীর মন্ডপ। যেখানে বৌ হয়ে এসে সাঁঝের প্রদীপ জ্বালতেন মা। কী সুন্দর ছিল সেই দিন গুলো। সদরে কর্তা বসে হিসেব নিকেশ করত। তার সেই সোনার সংসার আজ নিজের ভুলে ত্যাগ করেছিল সে। এখন তো প্রায়শ্চিত্তের সময়।
অনেক ক্ষণ চারদিক দেখতে লাগল মা। একটা রান্নাচালা করেছে নতুন। এগিয়ে গেল সেদিকে। কী সুন্দর দু পাকের উনান। থালায় কাটা আছে লাউশাক। কচি নধর। জগাই টা লাউশাক খেতে খুব ভালোবাসত। ওদিকে বড় বড় করে বেগুন কাটা। বৌ শিলে মশলা বাটছে। অনেক টা পোস্ত বাটছে। লাউশাক এর পোস্ত কী ভালোই না লাগে। হঠাৎই একটা ডাকে সবার সম্বিত ফিরল। জগাই পিছন থেকে ডাকল “মা। তুমি!” মা ও কাঁদে,জগাই ও কাঁদে। কথাগুলো ওদের বোঝাই যায় না। তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে পূর্ণিমা ছুটে আসে ঠাকুমার কাছে। বলে “তুমি এখন থেকে এখানেই থাকো”। বড় বৌ গড় করে। একটা পিঁড়ি এগিয়ে দেয় শাশুড়িকে। আনন্দের বন্যা বয়ে যায় জগাই এর উঠানে। পুজোপাট করে পূর্ণিমা ঠাকুমার ঘর গুছিয়ে দিল। ঠাকুমা বললে “নাতনি আমার যেন লক্ষ্মীপ্রতিমা। কী সুন্দর মুখখানা। যেন তুলি দিয়ে আঁকা”। বড় বৌ বললে “আর বলবেন না মা। ওই বাপসোহাগী মেয়ের জন্য আমার চিন্তার শেষ নেই। দিনরাত টোটো কোম্পানি। একরাশ চুল বাঁধে না। জট পাকিয়ে যায়। তিন সন্ধ্যে এক করে বাড়ি ফেরে মাগো। “
শাশুড়ি পূর্ণিমার পিঠে কিল দেয় । বলে “কোথায় এত ঘুরিস? তোর ভয় ডর নেই?” খিল খিল করে হাসে পূর্ণিমা ।ফিসফিস করে ঠাকুমাকে বলে “তোমাকে বলছি। তবে কাউকে বোলো না। সেই যে মাধবপুর পেরিয়ে একটা জঙ্গল সেখানে একটা মন্দির আছে। কালী ঠাকুরের মন্দির। আর পাশেই আছে কাঠিয়াবাবার আশ্রম। তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট তিরতিরে নদী। ওখানেই চুপ করে বসে থাকি”। আঁতকে ওঠে ঠাকুমা। চোখ মার্বেল হয়ে যায়। ঢোক গিলে বলে “ও তো ডাকাতে কালী। ডাকাত থাকে । ওখানে তুই কেন যাস”? পূর্ণিমার কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। বললে “তোমার মাথা। ডাকাত না আরো কিছু। কোথাও কেউ নেই।শুধুই ফোঁস আছে” বলেই হাত তুলে ফণা দেখালে।
বেশ কিছুদিন মা নেই। মাধাই এর অবস্থা তলানিতে ঠেকেছে। তাই জগাই এর বাড়ির দিকেই ওর নজর। যেমন করে হোক মাকে কাজে লাগিয়ে আরও কিছু আত্মসাৎ করতেই হবে।সাঁঝের অন্ধকারে কান পেতে থাকে। সুযোগ বুঝেই দাঁও মারবে।
মাধবপুরের জঙ্গলে ভীম ডাকাতের বাস। ওর দলবল সব ওখানেই। যেমন দশাসই চেহারা তেমনি গায়ের শক্তি। অনেক বার জেল খেটেছে । সামান্য চুরি বা ছিঁচকেগিরি সে করে না। চোখগুলো তার রাতেও জ্বলে। এরকম একটা অঞ্চলের চারপাশে ঘুরে বেড়ায় পূর্ণিমা। ভয় ডর বলে কিছুই নেই। মাঝে মাঝেই চলে যায় কাঠিয়াবাবার আশ্রমে। ওখানেই বসে গোকুলদাস বাবাজীর গল্প শোনে। আগে নাকি এখানটা বৈষ্ণব দের আখরা ছিল। চৈতন্যের পার্ষদরা এসে থাকত। বাবাজী পূর্ণিমাকে বলে “এই গভীর জঙ্গলের মধ্যে অনেক রহস্য। তুমি এদিকে আসবে না। তার উপর ডাকাতের বাস। “ পূর্ণিমা চোখ বড় বড় করে বলে “ভূতপ্রেত নেই তো”?
কত কাজ করে মেয়েটা। বাবাকে জমিতে জলখাবার দিয়ে আসা,পুকুর ঘাটে বাসন মাজা,কাপড় কেচে আনা,দোকান বাজার করা আবার বাবার সাথে হিসেব নিকেশ করা। কিছুদিন পর ঠাকুমা পূর্ণিমাকে ডাকে। তখন সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। তক্তপোশে বসে গহনার বাক্স নিয়ে। পূর্ণিমা জ্বলজ্বল করে তাকায়। বলে “এই বাক্সটা কী সুন্দর। এতে কী আছে গো ঠাম্মা?”
ঠাম্মা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলে “চুপ একদম। এগুলো সোনার গহনা। তোকে সাজাব আয়”। পূর্ণিমার আনন্দ ধরে না। একটার পর একটা গহনা পরাতে থাকে ।ফিসফিস করে কথা বলে ঠাকুমা আর নাতনি। কী অপূর্ব দেখায় পূর্ণিমাকে। যেন লক্ষ্মীর প্রতিমা। আর একটা ছায়াশরীরও সরে সরে যায়। আড়াল থেকেই সব লক্ষ করে। ঠাকুমা বলে “এই গহনা সব তোর। আমি তোকে দিয়ে দিলাম। যখন তোর বে হবে লাল বেনারসী পরে সব গয়না পরে বরের ঘরে যাবি”।
আজকাল পূর্ণিমার শরীরে মনে একটা অন্য পুলক কাজ করে। আর মাধবপুরের নির্জন ঘন জঙ্গল ওর ভীষণ প্রিয়। ওখানেই সুযোগ পেলে চলে যায় ও। কত কথা কত কাহিনী জড়িয়ে আছে এই জায়গাটায়। কাঠিয়াবাবা কত গল্প বলে। সবাই বলে কাঠিয়াবাবা আসলে ভন্ড। আসলে ওটাই দলের পান্ডা। পূর্ণিমার কোনও দিন এমন মনে হয় নি। এখানকার মন্দির বেশ পুরানো। পাশেই নদী। একটা সময় অনেক লোকের সমাগম ঘটত। আর এখন নির্জন নিস্তব্ধ।
ওখানকার কালী ঠাকুর পুজো হয় অমাবস্যার তিথিতে। আজ যখন ওখানে ঘুরছিল পূর্ণিমা তখন আশ্চর্য হয়েছে মাধাই কে দেখে। কাকা আবার এখানে কেন। একটা বড় গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে পূর্ণিমা।যাতে মাধাই তাকে দেখতে না পায়। রাতের অন্ধকার গভীর হলে ঠাকুমাকে বলে “জানো ঠাকুমা। কাল অমাবস্যা। এই অমাবস্যায় কালীপুজো করলে খুব ফল দেয়।
ঠাকুমার মন সচকিত হয়। বলে চুপ করে ঘুমো। এই অন্ধকার রাতে ভয় করে। সবাই আজ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধুই পূর্ণিমার চোখে ঘুম নেই। সন্তর্পণে পা টিপে টিপে বেরিয়ে পড়ে। তারপর ছুটতে শুরু করে। হঠাৎই তার চোখে পড়ে বনের মধ্যে অনেক গুলো লোক। প্রত্যেকের পরনে লাল পোশাক। কী দশাসই চেহারা সব। হঠাৎই একটা তীব্র আওয়াজ যেন কান ফাটিয়ে দিল। কীসের আওয়াজ ওটা। তবে কী ওটাকেই কাঠিয়াবাবা বলছিল। কী আশ্চর্য! আওয়াজ এর সাথেই লোকগুলো হারেরেরে করে দৌড়ে তার দিকেই তো আসছে। তবে কী এরাই ডাকাতদল। কোথায় ডাকাতি করবে ওরা! পূর্ণিমার এবার একটা সন্দেহ মনে দানা বাঁধল। নিশ্চয়ই এরা ঠাকুমার সোনার গহনাগুলোর খবর পেয়েছে। কারণ কাকাকে সে দেখেছিল বনের মধ্যেই। এটা ওর কারসাজি নয় তো। এখনই গহনাগুলোকে সুরক্ষিত করতে হবে। আর এক বিন্দু দেরী নয়।
ভীম ডাকাতের আস্ফালন সবথেকে বেশি। বললে “কোথায় সোনার গয়না আছে এখনই বের কর তোরা।” জগাই তো গহনাগুলোর ব্যাপার এ কিছুই জানতো না। বললে ‘গহনা তো আমার নেই। “ ভীষন চিৎকার করে উঠে মোটা বাঁশ দিয়ে আঘাত করে জগাই কে। বলে “ধান বিক্রির টাকাটা আগে দিবি। কাল ধান বেচে চল্লিশ হাজার কোথায় রাখলি। যদি না দিস তোর মেয়েকে খুন করব”। জগাই চমকে ওঠে। বলে “না না। আমার মেয়েটার কোনও ক্ষতি কোরো না। আমি এখনই দিচ্ছি”।
গহনাগুলোর হদিশ পেলে না ডাকাতদল। ফিসফিস করে ঠাকুমার কানেকানে পূর্ণিমা বলেছে কোথায় আছে গহনা। কিন্তু এত কষ্টের ধানের টাকা ডাকাতরা নেবে। মানতেই পারে না পূর্ণিমা। রান্নাচালার সামনে দেখতে পায় লঙ্কা বাটা। জলে গুলে ভীম ডাকাতের চোখে ছুঁড়ে দেয় পূর্ণিমা। টাকা নিয়ে পালাতেই পারে না ভীম। এদিকে গাঁয়ের লোক বুঝে গেছে জগাই এর বাড়িতে ডাকাতি হচ্ছে। ওরা দলবেঁধে ছুটে আসে। ছত্রভঙ্গ হয় ডাকাতেরা। ভীমের হাত থেকে টাকা কেড়ে নেয় পূর্ণিমা। কিন্তু এক লহমায় পূর্ণিমার মাথার উপর লাঠির বারি পড়ে।
লুটিয়ে পড়ে পূর্ণিমা।অমাবস্যার আঁধার পূর্ণিমাকে খেয়ে নেয়। জগাই এর সর্বশ্রেষ্ঠ ধন ডাকাতের হাতে চলে গেল। ঠাকুমার কথাই সত্য হল। লাল শাড়িতে পূর্ণিমা মরনের ওপারে শ্বশুর ঘরে যাচ্ছে। সব গহনা আজ ঠাকুমা পরিয়ে দিয়েছে। তবে পূর্ণিমা তো আবার আসবে ।চারিদিক জোসনায় ঝকঝক করবে। শুধু জগাই এর উঠোনে চিরকালের অমাবস্যা। সারা পাড়া আজ জগাই এর উঠানে।