পাখসাট
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
” কালো জলে কুচলা তলে ডুবল সনাতন
আজ সারা না, কাল সারা না পাই যে দরশন৷
লদীধারে চাষে বঁধু মিছাই কর আস
ঝিরিহিরি বাঁকা লদি বইছে বারমাস৷
চিংরিমাছের ভিতর করা, তায় ঢালেছি ঘি
নিজের হাতে ভাগ ছাড়েছি, ভাবলে হবে কি?
চালর চুলা লম্বা কোঁচা খুলি খুলি যায়
দেখি শ্যামের বিবেচনা কার ঘরে সামায় ৷
মেদনিপুরের আয়না-চিরণ, বাঁকুড়ার ঐ ফিতা
(আর) যতন করে বাঁধলি মাথা তাও যে বাঁকা সিঁথা৷ পেছপারিয়া রাজকুমারি…..”
তারপর পুরো কথাগুলো না মনে থাকার জন্য বাকিটা হুঁ হুঁ করে গাইতে গাইতে সনাতন বারুই বরজ থেকে বেরিয়ে আসে। তাদের পানের কারবার। গঞ্জের আড়তদার সদানন্দ সাহা বরজকে বরজ পান কিনে কলকাতায় চালান দেয়। সিকি পয়সা দরে ওর মত চাষীদের থেকে কিনে একটাকায় বেচে দেয় সে। সেবারে মানভূমের ঝুমুর গাইতে এসেছিল বিদ্যাধরীদের দল। এই গানটা ওখানেই শেখা। গানটায় ‘সনাতন ‘ কথাটা আছে বলে ওর বেশ লেগেছিল। এইরকম একটা সাদামাটা গেঁয়ো লোকের নাম দিয়েও গান হতে পারে, এটা ওর ভাবনার বাইরে।
………
এবারে টানা জল হয়েছে বলে পানগুলোর ক্ষতি হয়ে গেল। মহাজনকে দিয়ে হাতে কিছুই থাকবে না। ন’পাড়ার দিগেন বাগদীরা ভূট্টা লাগিয়েছিল। বর্ষায় ধামা ভরে তাই তুলে বিক্রি করে বেশ দু’পয়সা তুলল ঘরে। সনাতনের বৌ এবার পোয়াতী হয়েছে। প্রথম সন্তান আসতে চলেছে তার মধ্যেই ভাঁড়ে মা ভবানী।
*****
সনাতন ঠিক করে কিছু একটা বাড়তি রোজগারের ব্যবস্থা করতেই হবে। চিন্তায় চিন্তায় মাথাটা সবসময় ঝিম মেরে থাকে। তাই সিধু কাহারের কাছে গিয়ে দু পাত্তর তাড়ি গেলে চুপচাপ। তারপর টলতে টলতে রসিকবিলের পাশ দিয়ে জঙ্গুলে পথটা ধরে। জঙ্গল বলতে কয়েকটা শ্যাওড়া, সেগুন আর বুনো আম জাম কাঁঠাল গাছের বাগান। মুখুজ্যেমশায়দের আমলে এই বিলকে ঘিরে একটা বাগানবাড়িও ছিল।এখন ক’পাঁজা ইঁটের স্তুপ সাপখোপের আড্ডা হয়ে পড়ে আছে।
……
কত গানবাজনা যাত্রাপালা হত পুজোর সময়। সে সব তার ছেলেবেলা আর প্রথম যৌবনের স্মৃতি। বিলটাও পানায় ঢেকে যেমন মজে গেছে তেমনই ওর জীবনটাও আজকাল নিস্তরঙ্গ হয়ে গেছে। গড়বাড়ি বলে পুরনো জমিদারবাড়িটার সাথে একটা দালানের অবশিষ্টাংশ এখনো রয়ে গেছে মুখুজ্যেমশায়দের। তাই সেখানেই বৎসরান্তের পুজোটা এখনো বন্ধ হয়নি।যদিও ওবাড়ির সকলে নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে আবার পুজোর সময় এলে সব জড়ো হয়। গাঁয়ের লোকেরা সপ্তমী থেকে নবমী প্রসাদ পায়। ভাসানের দিন পায় বোঁদে আর ফেনী বাতাসা। নয়ন ময়রার ভিয়েন বসে ওদের চালার পিছনে। বেশ কাটে ওই পাঁচটা দিন।
****
কেরোসিনের কূপি জ্বালিয়ে আশমানি নীলরঙের ঝলমলে শাড়ি পড়ে ঠমকে চমকে এগিয়ে আসে সুন্দরী। ঝুমুর দলে এই মেয়েটা এবার সবার নজর কেড়েছে। “ঝিরিহিরি বাঁকা লদি বইছে বারমাস..” এই জায়গাটা গাওয়ার সময় মেয়েটার গলায় তার উঠতি যৌবনটাও যেন বাড়তি চলকে পড়ে।
……
এই কদিনের মধ্যেই সনাতনের সাথে বেশ ভাব হয়ে গেছে তার। কোমরে রূপোর পৈঁছা আর পায়ের নুপুর বাজিয়ে সে চলে। সনাতন তখন সতেরো। তার ডিগডিগে বুকে তুফান ওঠে। নিজের হাতে কেয়াখয়ের আর ঠাকমার ডিবে থেকে চুরি করা লং সুপুরির পান সেজে সুন্দরীকে খাইয়ে দেওয়ার ছলে প্রজাপতির ডানার মত তিরতিরে ঠোঁট দুটোয় আঙুলের ছোঁয়া লাগে সনাতনের। দমকা হাওয়ায় কুপির আলো নিবে যায় দপ করে। ঘাম চিকচিক সুন্দরীর গলা আর গলা ছাপিয়ে আরো নীচে কচি ডাবের মত বুকদুটো ততোক্ষণে সনাতনের অনভ্যস্ত নবীন হাতের মুঠোয়। হঠাৎ একটা ধাক্কা মেরে সুন্দরী সনাতনকে ঠেলে ফেলে দেয় মাটিতে। বলে,” মরণ!” এইবারে দুমদুম করে রাগী পা ফেলে সুন্দরী চলে যায় তার চটুল রূপের দেমাক দেখিয়ে। রসিক বিলের ঝুপসি অন্ধকার আর ব্যর্থকাম সনাতনের সতেরোর ঋজুতা টাটিয়ে থাকে অনেকক্ষণ।
*****
মুখুজ্যেবাড়িতে দশমীর দিন নীলকন্ঠ পাখী ওড়ানোর রেওয়াজটা অনেকদিনের। এখন রসিকবিলে পাখী টাখী আসা কমে গিয়েছে। দীনু সেবার একজোড়া পাখি ধরে এনে দু হাজারে বিক্রী করেছিল। বংশের নিয়ম। মুখুজ্যে বাবুরা তাই না করতে পারেনি।
সনাতন জঙ্গুলে পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে জামগাছের ডালে হঠাৎ দুটো নীলকন্ঠ পাখিকে নাগালের মধ্যে বসে থাকতে দেখতে পেল।একটা মাদী আর একটা বোধহয় মদ্দা। খুশীতে মনটা নেচে উঠল। আগেভাগে এগুলোকে ধরে পুষতে পারলে মুখুজ্যেবাড়িতে ভাল দামে বেচে দেওয়া যাবে। একমাস পরই তো পুজো। ততোদিন ঘরে লুকিয়ে রেখে এদের পুষতে হবে। কোমরের গামছাটা খুলে পলুইএর মত করে বেঁধে নেয়। বেশ নীচুডালটায় বসেছে জোড়ায়। খপ্ করে ধরতে বেগ পেতে হবেনা।
জোড়ার একটা পাখি অন্য পাখির গায়ে ডানা ঘষছে। ওদের গায়ের রঙটা আশমানি নীল আর ধূসর মেশানো।একজন ঠোঁট দিয়ে অন্যজনের ঠোঁটটা ঠুকছে। গলার কাছে নরম পালক ফুলে উঠছে তিরতির কাঁপনে। সনাতনের পায়ের আওয়াজে একটা ঝপ্ করে উড়ে গেল। অন্যটাকে গামছার পলুইতে ততোক্ষণে সনাতন ধরে ফেলেছে। পাখীটা ছটপট করছে একটু একটু। অন্যটা আর একটু উঁচু ডালে উঠে বসেছে। তার কোনও হেলদোল নেই। একটু আগেই যাকে আদর করছিল তাকে ফেলে দিব্যি নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত সে। সনাতনের চোখে ঘোর লাগে। নিবে যাওয়া ঝুপসি অন্ধকারে পা ঝমঝমিয়ে আর একজনের চলে হঠাৎ যাওয়াটা এদ্দিন পর এসে বুকে এসে এদ্দিনে ধাক্কা মারে।
” যাঃ শালা! তুইও তাহলে যা…” গামছার ফাঁসটা আলগা করে অন্যটাকে উড়িয়ে দেয় সে। অন্য পাখিটা আবার নির্লজ্জের মত এসে ওই পাখির তার পাশে এসে আবার বসেছে। আবার সেই ঠোঁটে ঠোঁট ঠোকা আর ডানা পালকের গা ঘষাঘষি।
সনাতন চোখ তুলে এবার মিটিমিটি হাসে। বেলা বাড়ছে, সে বাড়ির পথ ধরল অবশেষে। এতক্ষণে ওর সেই শোনা গানটার বাকি কথাগুলোও মনে পড়ে গেছে। মাথা দুলিয়ে গান গাইতে গাইতে সে হাঁটতে থাকে –
” পেছপারিয়া রাজকুমারি গলায় চন্দ্রহার
দিনেদিনে বাড়ছে তোমার চুলেরই বাহার৷
কলি কলি ফুল ফুটেছে নীলকালো আর সাদা
কোঁড় ফুলেতে কেষ্ট আছেন কোঁড় ফুলেতে রাধা।
কালো জলে কুচলা তলে ডুবল সনাতন,
আজ সারা না, কাল সারা না পাই যে দরশন৷
লদীধারে চাষে বঁধু মিছাই কর আশ
ঝিরিহিরি বাঁকা লদি বইছে বারো মাস….”
************