বিগত অন্ধকার রাত্রিটির পরিযানে এসেছে নবদিগন্তব্যাপী এক আলোকময় উন্মেষ। আজকের এই মহাসূচনাটি যে দুটি ভিন্ন মানব-মানবীর হৃদয়কেও যে এক অভিন্ন ঐশ্বর্যের দানে আলোড়িত করে তুলবে যা একমাত্র আগামীদিনের ইতিহাস সেটি জানলেও তখন কেবল স্তব্ধবাক গাম্ভীর্যে শুধু দেখে যাচ্ছিল। হয়তো ধ্বনিত হচ্ছিল বিশ্বনিখিলের নিয়মরীতির এই ধারাপতনটি।আজ সেই কাহিনীটিই আবার নতুন করে বলতে বসেছি। …..
নৈরঞ্জনা নদীর তীরস্থ এই বনরাজি শ্বাপদসঙ্কুল হলেও বড় মনোরম। সে বনের এক প্রান্তে অবস্থিত সেনানী নামে একটি ছোট গ্রাম । এই গ্রামস্থ বেশীর ভাগ মানুষ গোপ সম্প্রদায়ের। এদের জীবিকা হল অমৃততূল্য সেই সব দুগ্ধজাত মনোময় আহার্য্য বিক্রয় করে এই গোপ জনগোষ্ঠীর বণিকেরা সেইসব জনপদ থেকে পরিবর্তে সংগ্রহ করে আনে প্রয়োজনীয় জীবননির্বাহী বস্তুসকল।
এই গ্রামে ‘নন্দীক’ নামে এক সদাহাস্যময় ধনী বণিক ছিলেন। একমাত্র তাঁর ছিল দুটি আধুনিক বাণিজ্যপোত। স্বধর্মের সাথে তিনি বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্যেও সাগরে নিষ্ক্রান্ত হয়ে সংগ্রহ করে আনতেন রত্নরাজি, তৈজসদ্রব্য, সুগন্ধী মশলা, চীনাংশুক, মুক্তা ও মৃগনাভী।
দীর্ঘ বিগত চারটি সৌরক্রান্তি বৎসর তাঁকে বাণিজ্যসাফল্যে বলীয়ান্ করলেও গৃহে তাঁর মনস্তাপের কারণটিও যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। ব্রজবালা সুজাতা ছিলেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী ।
দূর্ভাগ্য এই যে প্রজাপতির নির্বন্ধটি সুখময় হলেও বিগত চারটি অয়নান্তের পরেও একটিও অপত্যধনের মহাসফলতায় ধনী করেনি বলে তাঁরা দুজনেই শোকে সমভাবাপন্ন ও কাতর ছিলেন। …..
ভ্রাম্যমাণ এক বনশ্চারী বৈদিক সন্ন্যাসী পল্লীতে ভিক্ষা করতে এলে তিনি দম্পতিটির এই দুঃখের কথায় আকুল হন ও অরণ্যের ভিতরে অবস্থিত এক বৃক্ষদেবতার আরাধনায় ব্রতী হতে তাঁদের নির্দেশ করেন। সন্ন্যাসীর আদেশে ওই দম্পতি গত সৌরবৎসরে একদিন বনের মধ্যে অবস্থিত এক প্রাচীন শাল বনস্পতির কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করেছিলেন যেন এই দম্পতিটির কোলে একটি সন্তানের শুভাগমন ঘটে। ……
বিগত ফাল্গুনী পূর্ণিমার রাতে তাদের গৃহপ্রাঙ্গণ আলোকমালায় বিধৌত করে একটি পুত্রসন্তান জন্মানোয় যেন সেই সর্বসাধনার মহাস্বীকৃতিটি উদযাপিত হয়েছে।
আনন্দাশ্রুপূর্ণ মাতা সুজাতা সদ্যজাত শিশুটিকে কোলে তুলে নেন “অর্চিষ্মান” নামকরণে। কিছুদিন পরে খবর আসে যে তার বণিকশ্রেষ্ঠ পিতাটিও এই সৌরবৎসরে সিংহল সমুদ্রে বিপুল বাণিজ্যজয় করে স্বদেশে প্রত্যাঘমনরত।
এই দুটি যুগপৎ আনন্দসংবাদে বণিকপত্নী সুজাতা আজ সুপূর্ণা নামে এক দাসীকে সঙ্গে নিয়ে নিকটেয অরণ্যাভিমুখে অতিপ্রত্যূষকালে বনদেবতার পুজো দিতে গিয়েছিলেন । এই বন্দনা সামগ্রীর মধ্যে ছিল মধুপর্ক, ঘৃত ও তন্ডুলের নৈবেদ্য এবং স্বর্গামৃত তূল্য পরমান্নের একটি মৃৎপাত্র। …….
সুজাতা টের পেলেন যে সামনের ঘন অরণ্যটি আদতে শ্বাপদসঙ্কুল হলেও আজ যেন তা দৃশ্যতই বড় নয়নাভিরাম দেখাছে।
নিকটে প্রবাহিত স্বচ্ছ নৈরঞ্জনা নদীটিও যেন মৃদুগমনা ও অমৃতধারায় বহতা। উদ্দিষ্ট বনস্পতি দেবতাটির নামাঙ্কিত সুবিশাল প্রাচীন শাল বৃক্ষটিকে চিহ্নিত করবার পর সেখানে গিয়ে সুজাতা দেখলেন যে পূর্বে তাঁরা বৃক্ষটির যেখানে বনদেবতাটির উদ্দেশ্যে একদা মঙ্গলদীপ জ্বালিয়ে এসেছিলেন সেখানে আজ এক দূর্বলদেহী তরুণ সন্ন্যাসী উপবিষ্ট ও গভীর সমাধিচারণে মগ্ন ।
সুজাতা ভাবলেন এই ব্যক্তিটি আসলে সেই দয়াময় বনদেবতা যিনি আজ একজন সন্ন্যাসীর রূপ ধরে ওদের সামনে পূজা স্বীকার করতে আজ বসে আছেন । কৃতজ্ঞচিত্তে সুজাতা হস্তধৃত উপাচার সমূহ সভক্তিতে সন্ন্যাসীকে নিবেদন করলেন । অর্ঘ্য সমর্পণের মুহূর্তটি যেন থেকে থেকেই এক অকপট আনন্দাশ্রুতে আজ উদ্বেল হয়ে যাচ্ছে। বারংবার করজোড়ে প্রণতি করতে থাকেন সদ্যমাতৃময়ী ব্রজবালা সুজাতা।
….
বিস্ময়ের ঘোর কাটলে অত্যন্ত দূর্বলদেহী সেই তরুণ সন্ন্যাসীটি এবার স্মিতহাস্যে ও পরম তৃপ্তিতে গ্রহণ করলেন মধুভান্ড ও পরমান্নের পাত্রটি। ঠিক তখনই যেন এক অলৌকিক আনন্দের সংরাগ বাহিত হল দয়িতা ও আরাধ্যের দুটি অন্তরে। বনের শুকপক্ষীগণও যেন সেই ঘটনার আনন্দআলোড়নে যেন মথিত করে তুলল তাদের অরণ্যবিহারের প্রতিটি শাখা। …..
সুজাতা অবগত ছিলেন না যে এই ঘটনার কিছুদিন পূর্বেই সেই কৃশকায় তরুণ সন্ন্যাসীটি সত্যজ্ঞান লাভের জন্য কঠোর তপস্যায় বহু দিবস অভুক্ত থাকায় প্রবজ্যাপথের অতিক্রমণে বড় দূর্বল হয়ে পড়েছিলেন। দীর্ঘকালব্যাপী এই ঘোরতর অনিদ্রা ও অনাহারের কারণে তাঁর শরীরটি এখন বড় শীর্ণ ও শুষ্কপ্রায়। বিগত তিনটি অয়নান্ত পূর্বে তিনি শেষবার নৈরঞ্জনা নদীটিতে দ্বিপ্রহরে স্নান করে ফিরে আসার সময় তিনি শারীরিক দুর্বলতা হেতু নদীতটে কিছুক্ষণের জন্য জন্য মুর্ছিত হয়েও পড়েছিলেন। ……… সেই অচেতনতা থেকে ক্রমচেতনায় ফেরার সময় তিনি দেখতে পেলেন এক প্রজ্ঞাময় দেবপুরুষ মগ্নসাধনায় এক অলৌকিক বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছেন । তাঁর সেই অকল্পিত যন্ত্রটির তিনটি তারের , প্রথম দুটি তার খুব শক্ত আর টান করে বাঁধা । আর তৃতীয় তারটি খুব আলতো করে কোনো মতে দুপ্রান্তজুড়ে বাঁধা আছে আর মধ্যের তারটি খুব টান করে বাঁধা ও আলতো হাতে ওই সুন্দর দেবোপম পুরুষটি মগ্নচেতনায় সেই তারটি ঝঙ্কৃত করে একটি মধুর সুরারোহণে ভরিয়ে দিচ্ছেন সেই অরণ্যের পটভূমি ।
……..
কৃশদেহী তাপসটি এবার সে খাদ্য ও পানীয়ের পাত্রটি স্পর্শ করে যেন চমকে উঠলেন। তারপর বললেন – ” হে আদিদেব! আপনি এই ভিক্ষুর প্রণাম গ্রহণ করুন। আমি আজ বুঝেছ জীবনের এক অন্যতম সত্য! আমাদের জীবনটিও আসলে আপনার হাতের ওই সেতারটির তারগুলির মতো । শুধু কঠোর তপস্যা করেও নয় আবার চরম ভোগ বিলাসে জীবন এলিয়ে দিয়েও নয় , সকলকে আসলে বেছে নিতে হবে সেই পরম মাঝের পথটি বা মধ্যপথ ( মঝঝিম পন্থা )! সমর্পণের সাধনায় এই তো হল আসল পথ ও একমাত্র সত্য লাভের উপায়। “
আত্মসমাহিত এই তখন তরুণ সাধকটি স্থির করলেন যে আর চরম কৃচ্ছসাধন নয় , পরিমিত আহার করেই তপস্যা করতে হবে । এই অথর্বপ্রায় কঙ্কালসার দেহপিঞ্জরটি নিয়ে আর কিছু কাজ হবে না ।
……
আজ যেন ধ্যানে বসে সেইকথাটি ভাবতে ভাবতে তাপসটি দেখেছিলেন এক মন্দগমনা নারী আজ এসেছেন সম্ভবতঃ বনদেবতার পূজা দেওয়ার জন্য, তাঁর সঙ্গে একজন সহায়িকা । নারীটির হস্তধৃত সেই পরমান্ন ও মধুপর্কটি সন্ন্যাসীটিকে যেন চিহ্নিত হল সেই সাধন পথের পরিবর্তনের সূচক হিসাবে। কঠোর ও কৃচ্ছসাধনের পরিবর্তে তা যেন হয়ে উঠল প্রকৃত মধ্যপথ গ্রহণের ইঙ্গিত । এরপরে খাদ্যটির স্বাদু আস্বাদন যেন তাপসের অভ্যন্তর থেকে মুছে দিল তার দীর্ঘ ছয় বছরের নিস্ফল কঠোর তপস্যার গ্লানি। ……. অপরদিকে সুজাতা এই দেবোপম অথচ কৃশাঙ্গ সাধক ও তরুণ পুরুষটির অর্ধনিমীলিত অক্ষরাজিতে যেন পেলেন কৃতজ্ঞতাস্বীকার ও সংকল্পের প্রবজ্যাবোধ। তাপসটির পরিচয় জানতে চাইলে সস্নেহে তার হাতদুটি একবার স্পর্শ করে স্মিত হাস্যে তিনি বলে উঠলেন,
” হে দেবী! আজ বুঝলাম, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্তের সমন্বয়ই জীবন। কেবল একটি সঠিক মুহূর্ত পাল্টে দেয় একটি দিন। একটি সঠিক দিন পাল্টে দেয় একটি জীবন। আর একটি জীবন পাল্টে দেয় গোটা বিশ্ব। আজ আপনার এই প্রদেয় আহার্যটি শুধু জীবাত্মাকে তুষ্ট করেনি বরং চরম ত্যাগ ও তিতিক্ষার সংবেদটিকেই আসীন করে দিল সমারোহের পরমজ্ঞানের পথে…..” ….. এইভাবেই অশ্রুস্নানে সিক্তা এই দুটি রমণীদ্বয় নৈরঞ্জনাতীরস্থ এই অরণ্যবনানীটিকে দান করে এলেন সঙ্ঘ প্রচারের মূলকল্পের বীজটিকে। যা অচিরেই জম্বুদ্বীপ সহ বহির্বিশ্বকে একদিন জারিত করে তুলবে পঞ্চশীলের চিরপ্রবজ্যার মন্ত্রে। …..
তাপসটি এরপর সেখান থেকে উঠে ধীরপদে নৈরঞ্জনা নদীর তীর ধরে খানিকদূর নগ্নপদে এগিয়ে চললেন । তাঁর অন্তরের ভিতরে যেন আজ থেকে জেগে উঠেছে এক প্রবুদ্ধ জ্যোতি।
পদব্রজে পথ চলতে চলতে এবারে সন্ধ্যা নেমে এলে বৈশাখী পূর্ণিমার শুভ্র আলোকে তিনি এবারে এক অশ্বত্থ গাছের তলায় গিয়ে বসলেন । একদা এই চন্দ্রাতপেই আবহে শাক্যসিংহ দেখতে শিখেছিলেন ব্যপী ভূমন্ডল। আবার আজ তিনি এই মাঙ্গলিক তিথিতে রাতের তৃতীয় প্রহরে প্রকৃত বুদ্ধত্ব লাভ করে আবার জন্মগ্রহণ করবেন প্রকৃত দিজত্বে । যে শাক্যবংশীয় কূলতিলক থেকে ত্যাগীয়ান নির্বেদ হওয়ার ঐশী আলোকপ্রাপ্ত হয়ে তিনি এবারে প্রকট হলেন “বুদ্ধ তথাগত” রূপে। ……..
করুণাঘন সন্ন্যাসীটি এতক্ষণে তাঁর আসন ত্যাগ করে নিকটবর্তী পর্বতপ্রান্তের সুউচ্চ অসমতল ক্ষেত্রটিতে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর দুটি চক্ষু ক্রমে সজল হয়ে উঠছে। এ অশ্রু দূর্বলের শোকগাথা নয়, নীচে শায়িত সমগ্র ভারতভূমিটিকে দেখে এক সাধকটি বর্ষণ করলেন আত্মত্যাগের প্রেমাশ্রু! নিজের মানস্চারণে স্বগতোক্তির ভাষায় বলে উঠলেন – “আত্মদীপো ভব, আত্মশরণ্যে ভব, অনন্যে শরণ্যে ভব”- নিজেকে নিজের প্রদীপ করে তোল। তার আলোয় নিজের পথ খুঁজে নাও। …….
এবারে তাঁর পরবর্তী গন্তব্যস্বরূপ নিকটবর্তী ঋষিপত্তমের মৃগদাব। তিনি আজ নিশ্চিত যে সেখানেই অত্যাশ্চর্যভাবে তাঁর জন্য প্রত্যাশায় থাকবেন আরো দশজন সংবেদী ও ভবিষ্যতের নিষ্ঠপ্রাণ অর্হৎের দল।