সার্ভ সেভিংস কার্ড
সলিল চক্রবর্ত্তী
আজও বাবু বোস অনিরুদ্ধ চক্রবর্ত্তীকে পাকড়াও করে এক নুতন সংবাদের অবতারণা করলেন—-
কিছুদিন আগে ইউ টিউব, ফেসবুকে সুইজ সরকারের একটা অভুতপূর্ব সিস্টেমের খবর খুব ঘোরাঘুরি করছিল।
—- একটি বাঙালি ছেলে, রজত শুভ্র হালদার, পড়াশোনার জন্যে সুইজারল্যান্ডে থকে। ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি একটা বাড়িতে ভাড়া সিস্টেমে থাকে। পাহাড়ী সমতলে সাজানো গোছানো সুন্দর একতলা বাড়ি। এক দিকে টু বি এইচ কে, অন্যদিকে ওয়ান বি এইচ কে সেপারেশন ফ্লাট সিস্টেম। ওয়ান বি এইচ কে তে রজতশুভ্র হালদার থাকে। অন্যদিকে আনম্যারেড সুইজ ল্যাণ্ডলেডি একাই থাকেন। পেনশন ভোগী এক্স স্কুল টিচার। ভীষণ মিষ্টি স্বভাবের, অভিভাবক সুলভ আচরণ। শক্তপোক্ত গড়ন,ষাটোর্ধ মহিলা যে সেটা বোঝার উপায় নেই। তবে অকারনে একটি বাক্যও খরচ করেন না। কিন্তু পড়ুয়া রজতের উপর তাঁর সতর্ক নজর থাকে। তাঁর বক্তব্য মা বাবা অনেক আশা নিয়ে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে পড়তে পাঠিয়েছেন, উদ্দেশ্যটা যেন বিফলে না যায়। পাশাপাশি রজতও সিঙ্গেল আন্টির খেয়াল রাখে, উভয় দিক থেকে যেন এক অলিখিত চুক্তি।
রজত খেয়াল করে আন্টি প্রত্যেক দিন নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ি থেকে বার হন, আবার একটা নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ি ফেরেন। রজতের মনে প্রশ্ন জাগে- উনি কি নুতন কোনো কাজে জয়েন করেছেন! কেনই বা করবেন? পেনশন আর ঘর ভাড়া যা পান সেটাই ওনার প্রয়োজন হয় বলে মনে হয় না। বার্ধক্য চিকিৎসার ব্যয়ভার তো সুইজ সরকারের হাতে! তাহলে কোথায় যান?? রজত সাত পাঁচ ভাবে, তবে অনধিকার চর্চা করা উচিত নয় ভেবে কিউরিওসিটিটা মনের মধ্যে চেপে রাখে।
এক রবিবার সকালের দিকে রজত নিজের ঘরে পড়াশোনা করছে। হঠাৎ আন্টির ঘরের দিক থেকে কিছু পড়ার শব্দ শুনে রজত ছুটে আন্টির ঘরের দিকে গিয়ে দেখল, আন্টি মেঝেতে পড়ে আছেন। এ্যালুমিনিয়ামের দুই পা ওয়ালা মইতে উঠে আন্টি কোনো কাজ করছিলেন। ঠিক তখনি আকস্মিক ভাবেই অ্যাক্সিডেন্টেটা ঘটে যায়। রজত এক মিনিট সময় নষ্ট না করে অতি তৎপরতায় এবং সাবধানতা অবলম্বন করে আন্টিকে ধরে তুলে একটা চেয়ারে বসাল। আন্টি একটু ধাতস্থ হয়ে যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে রজতকে একটা ফোন নাম্বার দিয়ে ফোন করতে বললেন। নাম্বারটা ছিল নিকটবর্তী হসপিটালের। ফলে আসতে যা সময়, মিনিট কুড়ির মধ্যে বাড়ির লনে এম্বুলেন্স হাজির।
এম্বুলেন্সে ড্রাইভার সহ দু’জন স্বাস্থ্য কর্মি ছিল। তাঁরা অতি যত্ন সহকারে আন্টিকে স্ট্রেচারে শুইয়ে এম্বুলেন্সে করে হসপিটালে নিয়ে গেলেন। রজত হল অপ্রয়োজনীয় পেশেন্ট পার্টি , সে শুধু দেখে যাচ্ছে। ভাবখানা এমন “তুমি পেশেন্ট পার্টি, দেখে যাও আমরা কি করি।” এম্বুলেন্স হসপিটালে পৌঁছুল।
হসপিটালের চেহারা আর পরিসেবা রজত দেখে অবাক না হয়ে পারল না, কোলকাতার বড়সড় নার্সিং হোমগুলো লজ্জায় মুখ লুকবে। যা-ই হোক ঘন্টা খানিকের মধ্যে ট্রিটমেন্ট কমপ্লিট করে হসপিটালের তরফ থেকে পুনরায় বাড়িতে পৌঁছে দিল।
পরদিন সকালে রজত ইউনিভার্সিটি যাওয়ার আগে ভাবল, আন্টির সাথে একটু দেখা করে আসবে, অসুস্হ মানুষ যদি কোনো প্রয়োজন হয়!!
আন্টি প্লাসটার পা নিয়ে বিছানায় বসে আছেন। রজতকে দেখে গুড মর্নিং জানিয়ে বসতে বললেন। রজতের হাতে সময় কম জানিয়ে নিজের কর্তব্যের কথাটা জানাতেই, আন্টি ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন-” তার কোনো প্রয়োজন হবেনা, আমি সুস্থ না হয়ে ওঠা পর্যন্ত আমার সমস্ত দায়িত্ব সুইজ সরকারের উপর। আমার ‘সার্ভ সেভিংস কার্ড’ আছে যে।” কথাটা শুনে রজত কিছু না বুঝতে পেরে অবাক হয়ে আন্টির মুখের দিকে চেয়ে থাকল। আন্টি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একটা এ টি এম কার্ডের মতো কার্ড দেখিয়ে বললেন-” বুঝলে না তো? এটাই সার্ভ সেভিংস কার্ড। রিটিয়ার লাইফে প্রতিটি মানুষ যতদিন সক্ষম থাকে আমাদের দেশে তাঁরা অসহায় দুঃস্থ মানুষদের সেবা শুশ্রূষা করে। সেই সেবা কর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব থাকে এই কার্ডে। তুমি আমাকে প্রায়শই নিয়ম করে বাড়ি থেকে বার হতে দেখেছ, তখন আমি মোবাইলে পাঠানো ম্যাসেজ এবং লোকেশন অনুযায়ী অসুস্থ রুগীর কাছে যেতাম সেবা শুশ্রূষা করতে। এই কার্ডে আমার সাত হাজার পাঁচশ চুয়াত্তর ঘন্টা সেবা সঞ্চিত আছে। এখন আমি সেবা প্রার্থী। যিনি এসে আমার সেবা শুশ্রূষা করবেন, তাঁর কার্ডে সেবা সময় যতটা বাড়বে, ঠিক ততটাই সেবা সময় আমার কার্ড থেকে কমে যাবে। অর্থাৎ সঞ্চিত সেবা ব্যায় হবে।” একটা সুন্দর সিস্টেম শুনে রজত অভিভুত। এরি মধ্যে ষাটোর্ধ এক মহিলা এসে দরজায় নক করে ঘরে ঢুকল। আন্টি রজতকে বললেন-” উনিই আমার প্রয়োজনীয় কাজ গুলো করে দেবেন। রজত আমার অসুস্থতার খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।”
বাবু বোস সংবাদ পরিবেশনটা শেষ করেই বলল-” সিস্টেমটা কত সুন্দর কার্যকর একবার ভাবুন, আমাদের এই পোড়া দেশে কিচ্ছু হবে না। যাদের দেখার কেউ নেই তারা পচে গলে মারা যায়। রাস্তা ঘাটে মানুষ অসুস্থ হলে পুলিশের ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনা। সবাই নিজের নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তাছাড়া এ দেশের সরকার করবে সার্ভ সেভিংস কার্ড?? গদি বাঁচানোর প্লান করতে করতেই যাদের পাঁচ বছর কেটে যায়!!”
অনিরূদ্ধ চক্রবর্ত্তী এতক্ষন চুপচাপ ঘটনাটা শুনছিলেন এবং মধু মন্ডলের তৈরি তিতো চা সেবন করছিলেন। চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে বাবু বোসকে বললেন-” কে বলেছে তোমাকে সার্ভ সেভিংস কার্ড আমাদের নেই??”
বাবু বোস চোখদুটো গোল্লা পাকিয়ে চরম বিশ্বয়ে বলল-” আছে???”
—- অফকোর্স আছে। সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে আছে। বেদে উল্লেখ আছে, গীতায় এর ব্যাখ্যা আছে, রামায়ণ মহাভারতে এর প্রয়োগ আছে।
—- কীরকম, কীরকম??
—- তবে এখানে একটা কথা আছে, কার্ডটা থাকে সৃষ্টি কর্তার হাতে, দেশের সরকারের নয়।তিনিই হিসেব নিকেশ করেন। তাঁর কাছে একদম সুপার কম্পিউটার বসানো আছে। এক সেকেন্ডের এক লক্ষ ভাগের এক ভাগও এদিক ওদিক হওয়ার উপায় নেই। বরং ওই কার্ডে বোনাস সিস্টেম আছে।
— বলেন কি!! আমারতো সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।
— যাবেই তো, ব্যাখ্যাটা জানলে সব আবার জল ভাত হয়ে যাবে।
— যেমন,যেমন!!!
— শ্রেফ দুই ধরনের কর্ম। এক স্বার্থ যুক্ত কর্ম, দুই নিঃস্বার্থ কর্ম।
— ব্যাপারটা দয়া করে যদি একটু ব্যাখ্যা করেন—–।
—- যেমন ধর, তুমি বিবাহিত সংসারি মানুষ। তোমার কষ্টার্জিত রোজগারে তোমার সংসার প্রতিপালিত হচ্ছে। তুমি তোমার সাধ্য মতো স্ত্রী, সন্তান,বৃদ্ধ বাবা মার প্রতি কর্তব্য পালন করছ। এটা তোমার স্বার্থযুক্ত কর্ম। এর মধ্যেও একটা ব্যাপার আছে, তুমি শুধু খাইয়ে পরিয়ে গেলেই কর্তব্য পালন হয় না। সংসার এবং সমাজের প্রতি সুতীক্ষ্ণ নজর দেওয়াও তোমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। — সেটা কেমন?
তৃতীয়তঃ স্ত্রীর প্রতি নিরপেক্ষ সুচিন্তিত আচরন করা।
যদিও এগুলো নিজ স্বার্থের কর্ম, তবুও সৃষ্টি কর্তার সার্ভ সেভিংস কার্ডে রেকর্ড হয়। বৃদ্ধ বয়সে তুমিও এর রিটার্ন পাবে। আবার অনেকে এমনও আছে, যা আয় করে সংসারে সামান্য দিয়ে মদ জুয়া খেলে নষ্ট করছে। স্ত্রী, সন্তানের দিকে নজর নেই, বৃদ্ধ বাবা,মাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাঁদের তৈরি বাড়ি থেকেই বার করে দিচ্ছ। ফলে সার্ভ সেভিংস কার্ডে সেভিংস জিরো। অর্থাৎ তৈরি থাকতে হবে ওই দিনটা তারও আসবে।”
এবার আসা যাক নিঃস্বার্থ কর্মে—
ধর তুমি স্বার্থকর্ম সাধ্যমতো করে চলেছ এবং সৎ ভাবে স্বচ্ছতার সাথে কিছু বাড়তি রোজগার করো়। তুমি এই অর্থ দুই ভাবে ব্যয় করতে পারো। এক, প্রয়োজনাতিরিক্ত সুখ ভোগ করে। দুই, প্রকৃত দানের মাধ্যমে। যেমন, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার হাতে কিছু অর্থ দেওয়া, অনাথ আশ্রমে অর্থ দান, গরীব মেধাবি ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার খরচ বহন, গরীব দুস্থ মানুষকে খাদ্য বস্ত্র প্রদান, মোদ্দা কথা অসহায় মানুষের পাশে সাধ্যমতো দাঁড়ানো। এগুলো জীবনের নিঃস্বার্থ কর্ম। এই কর্মের মধ্যে নিজেকে নিযুক্ত রাখলে সৃষ্টি কর্তা অতিশয় সন্তুষ্ট হয়ে তোমার সার্ভ সেভিংস কার্ডে বোনাস দিয়ে দেবেন। তার ফল তোমার কল্পনাতীত। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলি —প্রথম যেদিন তুমি এসেছিলে ভবে-
তুমি মাত্র কেঁদেছিলে হেসেছিল সবে,
এমন জীবন হবে করিতে গঠন-
মরনে হাসিবে তুমি, কাঁদিবে ভুবন।
আর্থাৎ কোনো মানুষ যদি তার জীবনকে সুন্দর করে গড়তে পারে তাহলে না চাইলেও সুগঠিত জীবনের সুফল সে পাবেই পাবে। আবার ঠিক বিপরিত দিকে পরিকল্পনা বিহীন, উশৃংখল জীবন যাপন করলে তার কুফল থেকে সে বঞ্চিত হবেনা।
এটাই হল সৃষ্টি কর্তার কাছে থাকা সার্ভ সেভিংস কার্ডের ফল। এবার তোমার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কতো মানুষ তো এইভাবে জীবন জাপন করেও দুক্ষ কষ্টে রোগভোগ করে মারা যায়, তাদের বেলা এই রকম হয় কেন?? সেগুলো স্রেফ পুর্ব জন্মের কর্মফল। আমরা পাপ পুণ্য নিয়েই তো ধরাধামে আসি, না হলে কেউ ফুটপাতে আবার কেউ প্রাসাদে জন্মাই কেন!! বাদ দাও, ওটা আবার অন্য বিষয়।
কথাটা শেষ হতে না হতেই অনিরুদ্ধ চক্রবর্ত্তীর মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। তিনি পকেট থেকে ফোন বার করে চেচিয়ে ওঠেন-” সর্বনাশ করেছে, হোম মিনিস্টারের ফোন, বেলা এগারোটা বেজে গেছে, কর্মফল এবার বাড়ি গিয়ে টের পাব।” এই বলে অনিরুদ্ধ চক্রবর্ত্তী বাজারের ব্যাগ দু’টো নিয়ে বাড়ির দিকে ছোটেন। বাবু বোস চেঁচিয়ে বলে -” দাদা ভারি ব্যাগটা বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসব?” অনিরুদ্ধ চক্রবর্ত্তী ত্বরিত গতিতে হাঁটতে হাঁটতে বললেন-” না তোমার সার্ভ সেভিংস কার্ডে সঞ্চয় বাড়িয়ে আমার কোন লাভ নেই। আমার কপালে যা আছে সেটা এখন ঘটবেই।”
বেশ তথ্যমূলক রচনা, সমৃদ্ধ হলাম।