পোড়া গন্ধ
◆◇◆◇◆◇◆
তিমিরণ দত্তগুপ্ত
(১)
শিখার অনেকক্ষণ থেকেই জলতেষ্টা পেয়েছিল।দু’বার ‘কেয়া,কেয়া’ করে ডেকেও যখন সাড়া পাওয়া গেল না,তখন দু’হাতে ভর রেখে কোনরকমে আধশোয়া হয়ে বিছানায় বসে দরজার দিকে তাকাল।গ্রীষ্মের পড়ন্ত বেলা,বন্ধ জানালায় মোটা পর্দা ঝুলছে।প্রায়ান্ধকার ঘরে কিছুই বোঝা যায় না।চোখ সইয়ে আধ ভেজান দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল বসার ঘরের দেওয়ালের ধারে আবছা দু’টি ছায়া মূর্তি।তার স্বামী অলোক কেয়াকে চুমু খাচ্ছে।কেয়ার ঘাড়ের পিছনে চুলের মধ্যে অলোকের একটা হাত।মুখের খুব কাছে মুখ মনে হল।শাড়ির আঁচল বুকের থেকে খসে পায়ের কাছে লুটোচ্ছে।কেয়ার মুখ চোখে আপত্তি কী না,শিখা বুঝল না।অনেকক্ষণ ধরে দৃশ্যটা দেখার চেষ্টা করল।জলতেষ্টা পেয়েছিল,গলা বুক শুকিয়ে কাঠ।তবুও মুখ দিয়ে এতটুকু আওয়াজ বেরোল না।
প্রথমে শরীরের মধ্যে একটা অস্বস্তি।প্রবল রাগ হল,জ্বালা হল,গা গুলিয়ে উঠল।মনে হল চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে বিশ্বসংসার লেপে মুছে গিয়েছে।তারপরই হঠাৎ শরীরের মধ্যে এক অবসাদ বোধ করল সে।চোখ বন্ধ করে পিঠ নামিয়ে বালিশে মাথা রাখতে গিয়ে হাত পড়ল পাশের টেবিলে রাখা জল ভর্তি গ্লাসে।ঝনঝন করে স্টীলের গ্লাস পড়ার শব্দে কেয়া এসে দেখল মেঝে জল থৈথৈ।শিখা আড়ষ্ট পুতুলের মত বিছানায় শুয়ে।মাথাটাও ঠিকমত বালিশে পড়েনি।মাথা সোজা করে দিয়ে কেয়া বলল,আমাকে ডাকনি কেন?
শিখা ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ বোবা চোখে কেয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল।তারপর খুব ধীর গলায় বলল,দাদা,কখন এল?
কেয়া চোখ কপালে তুলে বলল,দাদা,কী এই সময় ফেরে?তুমি জান না?
শিখা বলল,তবে বাইরে কার গলা পেলাম,কেউ এসেছিল?
‘সে’ও তো প্রায় ঘন্টাখানেক আগে।দত্ত মেডিসিনের ছেলেটা ওষুধ দিয়ে গেছে’,কেয়া ঘরের জল মুছতে মুছতে বলল।
শিখার বিশ্বাস হল না।ঘরের মধ্যে আবছা অন্ধকার,তবুও সে স্পষ্ট দেখেছে।ঘাড় কাত করে আবার বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখল।সোফা,টিভি সেট,দেওয়ালে ঝোলান পেইন্টিং সব পরিষ্কার দেখা যায়।ঠিক ওই ছবিটার তলায় কিছুক্ষণ আগেও দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে অলোক আর কেয়াকে অন্তরঙ্গ দেখেছে।এত ভুল তার হয় না।কেয়া ঘর মুছে ন্যাতা হাতে বেরিয়ে যাচ্ছিল।একটা অস্ফুট শব্দ শুনে পিছন ফিরে দেখল,শিখা প্রাণপণে ওঠার চেষ্টা করছে।কেয়া এসে ধরে ফেলল,কী হয়েছে বৌদি,টয়লেট যাবে?
শিখা কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে কেয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,একটা পোড়া গন্ধ বেরোচ্ছে না?গ্যাসে কিছু বসিয়েছিস?
কেয়া বলল,না তো।এখন কী বসাব?
শিখার তবুও বিশ্বাস হল না।বাতাসে নাক টেনে বলল,ভাল করে দেখ।কিছু পুড়ছে মনে হচ্ছে,আমি স্পষ্ট গন্ধ পাচ্ছি।
মাথার উপর সিলিং ফ্যান ঘুরছে।ঘামে ভিজে যাচ্ছে গায়ের জামা,বিছানার চাদর।মন থেকে যতই খানিকক্ষণ আগের দেখাটাকে তাড়াতে চাইছে ততই আবছা একটা দৃশ্য ঘুরে ফিরে আসছে।চোখ বন্ধ করলেও সাদা দেওয়ালের গায়ে দু’টো অস্পষ্ট ছায়া।এমন কি কটু পোড়া গন্ধের আগে পরিচিত ডিওডেরান্টের মৃদু ঘ্রাণও পেয়েছে।চাপা অব্যক্ত বেদনায় ক্লান্ত হল সে।নিজেকে এই মুহূর্তে সবথেকে নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে।বাইরে রোদ মরে এসে ঘরের ভিতরটা আরও অন্ধকার।এই অবেলায় অবসন্ন শিখা আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
অফিস থেকে ফিরে বসার ঘরে শিখাকে দেখতে না পেয়ে অলোক
বলল,বৌদি ওঠেনি?
কেয়া চা করে এনেছিল।টেবিলে দিয়ে বলল,সন্ধের মুখে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।শরীর ভাল নেই বোধহয়।দোকান থেকে ওষুধ দিয়ে গেছে,মিলিয়ে দেখে নিও দাদা।
অলোক চায়ে চুমুক দিল না পর্যন্ত।শোওয়ার ঘরে গিয়ে দেখল শিখা ঘুমোচ্ছে।এক মুহূর্ত ভাবল ডাকবে কী না।।কি ভেবে একবার দু’বার ডাকতেই ধরমর করে উঠতে গিয়ে আবার শুয়ে পড়ল শিখা।অলোক অপ্রস্তুত হল,এইভাবে ডাকা উচিত হয়নি।ডক্টর সেন বারবার বলেছেন,এমন অবস্থায় উত্তেজনা একেবারে ঠিক নয়।
অলোক মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বলল,শরীর খারাপ?
শিখা ঘাড় নাড়ল,সামান্যক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,কখন ফিরলে?
অলোক ঘরের আলো জ্বেলে দিল,এই তো সামান্য আগে।চল,চা খাবে।
শিখা শুয়েই রইল।কোন কথা কানে গেল না।অলোক দেখল শিখার ঠোঁট কাঁপছে।চোখে রাগ,ক্ষোভ,কষ্ট।একটু ভয় পেল অলোক।ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া?পিঠে হাত রেখে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল,ব্যথাটা কী বেড়েছে?
শিখা অলকের চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,দুপুরে ফিরে এসেছিলে কেন?কিছু নিতে ভুলে গিয়েছিলে?
অলোক হো-হো করে হেসে উঠল,অবেলায় ঘুমোলে এমনটাই হয়।
মুহূর্তে শিখার মুখ ম্লান হল।বলল,কী জানি,তোমার ডিওডেরান্টের গন্ধ পেলাম যে।
অলোক বলল,দেখ গিয়ে তোমার কেয়া লুকিয়ে মাখে কী না।
চেয়ারে গা এলিয়ে চা খাচ্ছিল অলক।একটু যেন অন্যমনস্ক।শিখা খেয়াল করল।বলল,কী ভাবছ?
অলক বলল,পরশু তোমার কেমোথেরাপির ডেট।অফিসেও একটা জরুরী কাজ পড়েছে।ডক্টর সেনকে বলেছি,দশটা নাগাদ অ্যাডমিট করিয়ে আমি একবার অফিসে ঘুরে আসব।তোমার কেমোথেরাপি শুরু হওয়ার আগে আবার পৌঁছে যাব।
শিখা সাময়িক ভুলে ছিল।গত কয়েক মাস ধরে তিলে তিলে এই যন্ত্রণার কথা সে ভুলতেই চায়।কিন্তু পারে কই।কেউ না কেউ,কোন না কোনভাবে মনে করাবেই।যন্ত্রণা তো শুধু শরীরের নয়,মনেরও অনেকখানি।
প্রথমে ব্রেস্ট টিউমার,তারপর ব্রেস্ট ক্যানসার।স্তন বাদ দেওয়ার মানসিক যন্ত্রণা বাদ দিলেও শরীরে বিষের প্রতিক্রিয়া যথেষ্ট।
অলক পোষাক পাল্টাতে ঘরে যাচ্ছিল।শিখার মুখ দেখে মনে হল কিছু বলতে চায়।বলল,কিছু বলবে?
শিখা বলল,কেমোথেরাপি নেওয়ার জন্য দু’দিন ভর্তি থাকার দরকার কী?ডে-কেয়ারে নিলেই হয়।ফালতু একগাদা টাকা খরচ।তুমি ডক্টরকে বল।আমি রাতে নার্সিং হোমে থাকব না।
অলক বিরক্ত হল।বলল,ডক্টর যেমন ভাল বুঝবেন,তেমন করবেন।
শিখা তবুও মুখ গোঁজ করে বসে রইল।কেয়া যে কিছু বলার জন্য অনেকক্ষণ পাশে এসে দাঁড়িয়েছে,তাও প্রথমে টের পেল না।মুখ তুলে খানিক বাদে জিজ্ঞেস করল,কী হয়েছে?
কেয়া বলল,আজ একটু বাড়ি যাওয়ার দরকার ছিল বৌদি।ছেলেটার জ্বর এসেছে।কাল সকালেই চলে আসব।
শিখা এতক্ষণ মুখ কালো করে বসেছিল।এই প্রথম কেন জানি তার মুখ সামান্য উজ্জ্বল হল।বলল,যা না।
অলক ঘর থেকে বেরিয়ে দু’জনের কথা শুনতে পেয়ে চটে গেল,বৌদিকে দেখবে কে?রাতে কোন অসুবিধে হলে?
শিখা অলককে বাধা দিয়ে বলল,যাক না।এক রাতের তো ব্যাপার।কিচ্ছু হবে না।
অলক কিছুতেই রাজি নয়।তার এক কথা,এতগুলো টাকা দিয়ে রাখা হয়েছে।সে তো শুধু শিখার জন্যই।এখন বাড়ির অসুবিধের কথা বলে লাভ কী?
কেয়া মুখ ভার করে রান্নাঘরে চলে গেল।শিখার মুখে ফুঠে ওঠা সামান্য আলোও নিভে গেল।অলকের উপর অভিমান হল।অলক কী কিছুই বোঝে না।
রাতে খাওয়া দাওয়ার শেষে ঘরের আলো নিভিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় শিখা ডাকল,মশারিটা ঝুলছে।একটু গুঁজে দাও তো।
অলোক দরজা ভেজিয়ে বেরোতে গিয়েও আবার ফিরে এল।বসার ঘরের আলো আবছা হয়ে এই ঘরে এসে পড়েছে।নিচু হয়ে মশারি গোঁজার মুহূর্তে শিখা হাতটা ধরে ফেলল,আজ এখানেই শুয়ে পড় না।আমার কেমন যেন ভয় করছে।
‘ভয়?কীসের ভয়’?অলক শিখার হাতের পাতাটা ধরে দেখল কেমন ঠান্ডা।সামান্য সময়,অলকের মন অস্থির হল।পরক্ষণেই হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,অকারণে ভয় হবে কেন?আমি তো পাশের ঘরেই আছি।কেয়াও অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে।ডাকলেই শুনতে পাবে।
‘আমার সাথে শুতে তোমার অসুবিধে কোথায়’,শিখা ফুঁসে উঠল।
অলক নরম গলায় বলল,তুমি তো সবই জান।ডক্টর বলেছেন,কোনভাবেই তোমার কোনরকম উত্তেজনা চলবে না।
শিখা বিকৃত স্বরে বলল,শুধুই তাই?না কী আমি অসুস্থ বলে?আমার বুক নেই,তাই তোমার ঘেন্না করে।বললেই হয়।আর ভয়ের কথা বলছ,সে তো তোমরা থাকলেও হয়।
অলক কিছুই বলল না।দরজা খোলা রেখেই নিজের ঘরে চলে গেল।বইয়ের পাতা উল্টে গেল,ঘুম এল না।আলাদা ঘরে শোওয়ার ব্যবস্থা শিখারই।অলোককে সকালে উঠতে হয় অফিসের জন্য।শিখা বিছানায় ছটফট করলে অলোকের ঘুম হবে না।অথচ,এখন এমন কথা।
পাশের ঘরে শিখারও ঘুম এল না।বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে লাগল।কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না।কি যেন বিঁধে রয়েছে মনে।সারাক্ষণ নাকের গোড়ায় পোড়া গন্ধ।অলোকের ব্যবহারেও কষ্ট হচ্ছে না।শুধু মনে হচ্ছে হঠাৎ কোন অসুখ বোঝা হয়ে চেপে বসেছে।অস্থির লাগে,পাগল পাগল মনে হয়।বাইরের ঘরের আলো নিভে নীল রাতবাতিতে অপার্থিব লাগে।হাওয়ায় পর্দা উড়ে বিপরীত দেওয়ালে কাটাকুটি খেলে আর দৃশ্যের পরে দৃশ্য জন্ম নেয়।শিখার চোখ ঝাপসা হয়ে এল।আর,দেখা যায় না।অনেক বড় নিথর কোন পাথর নড়ে উঠে আচমকা যেন ধস নামিয়েছে।ঝুলন্ত কোন সেতুর মত কেঁপে কেঁপে উঠছে শিখা।শুরু এমনই হয়,শেষ পর্যন্ত সুনামীর মত সব ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়।
শেষ রাতে বোধহয় চোখ লেগে এসেছিল শিখার।বাইরে বসার ঘরের মেঝেতে বিছানা পেতে কেয়া শোয়।
মৃদু গোঙানির শব্দে ঘুম থেকে উঠে কেয়া বুঝল বৌদিকে বোবায় পেয়েছে।পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দিতে গিয়ে শুনল,শিখা ঘরঘর গলায় বলছে,পুড়ছে,পুড়ছে।সব পুড়ে যাচ্ছে।
(২)
ভিজিটিং আওয়ার শেষ হতে আধ ঘন্টা বাকি।আরও কয়েকজনের সাথে বাইরের চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছিল অলক।সামান্য অস্থির হয়ে ঘড়ি দেখল একবার।সময় শেষ হয়ে আসছে,অথচ শিখার দাদা-বৌদির বেরোনোর নাম নেই।নার্সিং হোমের ভিতরটা আধুনিক,সুন্দর করে সাজানো।ঢুকলে মন ভাল হয়ে যায়।তবুও অলকের ভাল লাগছিল না।চেয়ার ছেড়ে কেবিনের দরজার দিকে এগোতে দেখল শিখার দাদা-বৌদি বেরিয়ে আসছেন।
ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে অলক টের পেল হাতের তালু ঘামে ভিজে উঠেছে।পর্দা সরিয়ে দেখল শিখা চিৎ হয়ে শুয়ে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে।কেউ যে ঢুকল,সেটা টের পেয়েও একবার পাশ ফিরে তাকাল না।অলক হাতের ব্যাগ একপাশে রেখে নিঃশব্দে চেয়ারে বসল।শিখার ঠোঁট শুকনো,ফ্যাকাশে মুখ।চোখের নিচে কালি।মাথাটা ঝুনো নারকেলের মত দেখাচ্ছে।
কাঁপা হাতে শিখার হাতটা মুঠোয় নিল অলক।ঠান্ডা খসখসে হাত।এই প্রথম তাকাল শিখা।অসহায়,করুণ দৃষ্টি।
‘এতক্ষণে আসার সময় হল’?হিম শীতল গলায় বলল।
অলক বলল,এসেছি তো অনেকক্ষণ।তোমার দাদা,বৌদি না বেরোলে কী করব?
‘ডাক্তারের সাথে কথা বলেছ’?
অলক মৃদু ঘাড় নাড়ল,দুপুরে একবার কথা হয়েছে।এখন ওটিতে আছেন।বেরোলে কথা বলব।
‘দুপুরে কি বললেন’?
‘ঠিকই আছে সব।কাল বিকেলের দিকে ডিসচার্জ করে দেবেন’।
‘তারপর’?
‘তারপর আবার কী?পরের কেমোথেরাপির ডেট নিতে হবে’।
শিখা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।তারপর বলল,আর কতদিন?
অলক একটু ঝুঁকে এল শিখার দিকে,রিল্যাপস্ করলে কেমোথেরাপি তো করতেই হবে।যে রোগের যা নিয়ম।তোমার আমার হাতে কতটুকুই বা আছে।
শিখা হাসল,আমার হাতে তো কিছুই নেই।
আকাশের আলো দিনের এই সময় খুব তাড়াতাড়ি ম্লান হয়ে যায়।আচমকা সন্ধে নেমে আসে।এই শেষবেলায় শিখাকে শীর্ণ,অসহায় দেখাচ্ছে।অলক ওর পাংশু মুখের দিকে তাকাতে না পেরে দেওয়ালে ঝোলান ঘড়ির দিকে তাকাল।শিখা অলকের দৃষ্টি অনুসরণ করে বলল,ছটফট করছ কেন?এখনও পনেরো মিনিট সময় বাকি আছে।
অলক চোখ সরিয়ে শিখার দিকে তাকাল,কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো এখানে?হলে বলো,ডক্টর সেনকে বলতে হবে।
শিখা ধীরকণ্ঠে বলল,কোন অসুবিধে নেই।শুধু………..।
‘শুধু কী’?
‘একটা গন্ধ পাচ্ছি।এতবার তো এখানে অ্যাডমিট হয়েছি।কখনও কিন্তু পাইনি’।
‘কীসের গন্ধ’?
‘সে তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না।সিস্টারকে বললাম।সে চারদিক শুঁকেও কিছু বুঝতে পারল না।আচ্ছা,এমন হয় না কি’?
অলক একটু চিন্তিত হল।কিছুটা সতর্ক গলায় বলল,বুঝতে পারছি না।কেমন গন্ধ বললে না হয় ডক্টরকে একবার বলতাম।তাছাড়া,হসপিটাল বা নার্সিং হোমের তো একটা নিজস্ব গন্ধ আছেই।
শিখা বলল,ঠিক সেরকম নয়।ও তুমি বুঝবে না।কাল কখন ডিসচার্জ করবে বললে?
অলক বলল,সন্ধে ছ’টা নাগাদ।
‘আচ্ছা,তার আগেই যদি ডিসচার্জড হয়ে যাই’?
এমন আচমকা প্রশ্নে অলক অবাক হয়ে গেল।বলল,তার মানে?
সোজা তাকিয়ে থেকে শিখা বলল,মানে তুমিও জান।নার্সিং হোমে কেউ মরে যায় না?না কি,প্রতিবারই নতুন আর একখানা মৃত্যুর পরোয়ানা হাতে নিয়ে বাড়ি ফেরে?
‘তুমি থামবে’?অলক বিরক্ত হল,‘তোমার এই অযৌক্তিক কথাবার্তা আমার এতটুকু ভাল লাগছে না’।
‘অযৌক্তিক?সত্যি কথা বল তো,কখনও কোন মুহূর্তে তোমার এমন মনে হয় নি’?
‘সে হয়ত কোন চূড়ান্ত হতাশার মুহূর্তে।তার মানে এই নয় যে সেটা নিয়েই বসে থাকতে হবে।তাহলে এত এত মানুষ চিকিৎসা করাচ্ছে কেন?রোজ রোজ বাঁচার জন্য লড়ছে কেন’?
শিখা বলল,তারা ঠিকমত বেঁচে নেই বলেই হয়ত বাঁচার জন্য লড়াই করছে।
গলার স্বর দ্রুত নামিয়ে অলক সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,এত ভাবছ কেন?আমি তো রয়েছি।
শিখা বলল,তোমাকে নিয়েই তো চিন্তা।
কী যেন বলতে গিয়েও অলক থেমে গেল।দ্রুত কিছু চিন্তা করে বলল,আমি চলি,ডক্টরের সাথে কথা বলতে হবে।
অলক বেরিয়ে যাচ্ছিল।শিখার ক্ষীণ গলার ডাক শুনে ফিরল,কিছু বলবে?
‘কেয়া কী বাড়ি ফিরে গেছে’?
অলক হেসে ফেলল,তোমার কী হয়েছে বল তো?আজ তো আমাদের সাথে একসাথেই বেরোল।চাবি দিয়ে রেখেছি,কাল হসপিটাল থেকে আমরা ফেরার আগেই চলে আসবে।
শিখার শুকনো মুখে সামান্য হাসির রেখা ফুটে মিলিয়ে গেল আবার,রাতে খাবে কী?
‘সে দেখা যাবে।কিছু ব্যবস্থা করে নেব’,বলতে বলতে অলক বেরিয়ে গেল।
ডাক্তারের ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে আসতেই দেখল শিখার দাদা,বৌদি দাঁড়িয়ে।অলক একটু অবাক হল।কাছে এসে বলল,এখনো দাঁড়িয়ে?আমি ভাবলাম বুঝি…….।
শিখার দাদা ধীর-স্থির মানুষ।শালার হাত ধরে বলল,চলো একটু চা খাই।একটু কথাও ছিল তোমার সাথে।
চায়ের দোকানের ভিড় থেকে সরে অলক বলল,দাদা,বলুন।
শিখার দাদা আড়চোখে স্ত্রীর দিকে চেয়ে বলল,শিখার অবস্থা কেমন বুঝছ?
অলক বলল,ঠিকই আছে।ডক্টর তো বললেন সমস্যার কিছু নেই।তবে রোগটা তো আর জ্বর,পেটখারাপ নয়।তাছাড়া রিল্যাপস্ করেছে।দীর্ঘ দিন চিকিৎসা চলবে।
‘শিখা বলছিল……….’,কথা শেষ না করে উত্তরের অপেক্ষায় থাকল শিখার দাদা।
‘কী বলছিল’?
‘কেমন একটা গন্ধ পায়’।
অলক বলল,আমাকেও বলেছে।নার্সিং হোম,হাসপাতালে ওষুধের গন্ধ থাকে।এছাড়া তো আমি কিছু পাইনি।আপনারা কিছু পেলেন?
শিখার দাদা ঘাড় নেড়ে বলল,না,না।আমিও কিছু পাইনি।
অলক হাতঘড়ি দেখল।সন্ধে পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ।তাকে ফিরতে হবে অনেকটা।শরীরও আজ তেমন বশে নেই।প্রেসার বেড়েছে অফিস আর শিখার অসুস্থতার কারণে।বলল,দাদা,চলুন এবার ফেরা যাক।
‘ভাই,আর একটা কথা’?
‘বলুন’,অলক নিস্তেজ গলায় বলল।
‘তোমাদের বাড়ির কাজের মেয়েটি।কী যেন নাম……,কেয়া।ওর স্বভাব-চরিত্র ভাল নয় শুনলাম’।
অজান্তেই অলকের হাসি পেল।বলল,শিখা বলেছে বুঝি?
‘হ্যাঁ,তেমনটাই বলছিল।আমি যদিও পাত্তা দেইনি।তবুও একটু সাবধানে থেক’।
‘আচ্ছা দাদা,মনে রাখব’,শিখার দাদাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অলক চলন্ত একটা বাসকে হাত দেখিয়ে দাঁড় করিয়ে উঠে পড়ল।
বাস থেকে নেমে গলির মধ্যে ঢুকেই বুঝতে পারল লোড শেডিং।একে গরমকাল,তায় কারেন্ট নেই।অলকের মেজাজ খিঁচড়ে গেল।অন্ধকারে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ফ্ল্যাটের দরজার সামনে কাউকে দেখল।অলক চমকে একটু সরে এসে বলল,কে?
কেয়া বলল,দাদা আমি।
অলক ভয় পেয়েছিল।অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে বলল,তুই এখানে কী করছিস?
কেয়া বলল,ভাবলাম বৌদিকে যদি আজ ছেড়ে দেয়।
অলক এই অদ্ভুত যুক্তি আর কেয়ার মতলব,এই দুই গোলমাল থেকে বেরোনোর জন্য বলল,তুই এখন যা।আর তোর কাছে তো চাবি দেওয়াই আছে।কাল সন্ধের আগে এসে ঘর পরিষ্কার করে রাখিস।
কেয়া মন্থর পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে অলক দরজা খুলে একটা ভ্যাপসা গন্ধ পেল।আর ঠিক তখনই মনে হল,কেয়া কী কিছু বলতে এসেছিল?
(৩)
শিখা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হচ্ছিল।নার্সিং হোম থেকে ছাড়া পাওয়ার মুহূর্তে মনে হয়েছিল কতক্ষণে বাড়ি ফিরবে।নিজের ঘর,নিজের বিছানা,চেনা পরিবেশে ফেরার জন্য ছটফট করছিল।ডক্টর সেন সকালে দেখে যাওয়ার সময় বলেছিলেন,আর একটা দিন থেকে যান।আমি একটু অবসার্ভ করতে চাই।প্রায় জোর করেই সে ছুটি করিয়েছে।অথচ এখন ফেরার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হচ্ছে না।প্রতিবারের মত বাড়ি ফেরার কোন টান নেই।গভীর অবসাদে আচ্ছন্ন যেন।এটা ওর রোগ,না মানসিক অস্থিরতা,তাও বুঝতে পারে না।অলক তাকে দাঁড় করিয়ে ট্যাক্সি ডাকতে গেছে।শিখা আকাশের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে করতেই সে গাড়ি নিয়ে হাজির।বিকেল ফুরিয়ে আসার কিছু আগেই আকাশে মেঘ জমেছিল। এই সময়টা প্রায়ই কালবৈশাখীর ঝড় আসে।ঘন কালো মেঘ দেখে টের পাওয়া যায়নি তার পিছনেই একপাল ঝোড়ো হাওয়া হা-হা করে ছুটে আসছেl দেখতে দেখতেই আকাশ আড়াল হল, ঘুটঘুটে অন্ধকার মতন,তারপর কালবৈশাখীর ঝড় নামল l ঝড়ের শেষে বৃষ্টি আর বৃষ্টির তলায় তলায় ঝড়ের ঝাপটা থেকেই গেল।
গাড়ি ছেড়ে দিতে হয় গলির মুখে।ভাড়া মিটিয়ে অলক বলল,যাবে কীভাবে?ভিজে যাবে তো।আমারই ভুল,একটা ছাতা নিয়ে বেরোন উচিত ছিল।
শিখা ততক্ষণে মাথায় আঁচল দিয়ে নেমে পড়েছে।বলল,কিছু হবে না।জোরে পা চালিয়ে চলে যাব।এইটুকু তো পথ।
শিখার চোখেমুখে বৃষ্টির জল।মাথার কদমছাট চুলের জল চোখের পাতা বেয়ে ঠোঁটে নামছে।অলক একবার তাকিয়ে দেখল।তারপর রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে দিতে শিখা সামান্য আরক্ত হল যেন।চকিতে একবার অলকের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল।ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছে দিয়ে অলক বলল,তুমি উঠে যাও।আমি চট করে বাজার করে নিয়ে আসি।ঘরে কিছুই নেই।
বেশ কিছুক্ষণ কলিং বেল টেপার পরে দরজা খুলে দিল কেয়া।শিখা দরজার কাছে দাঁড়িয়েই বলল,এতক্ষণ সময় লাগে দরজা খুলতে?কেয়া মুখে কিছু বলল না।শিখার হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে একধারে রেখে দিল।নার্সিং হোম থেকে বাড়ি ফিরে সোজা বাথরুমে যাওয়ার কথা।শিখা ওই কাপড়েই সোজা অলকের ঘর ঘুরে এল।নিজের ঘরে ঢুকেও খুচখাচ কিছু করতে লাগল।কেয়া অবাক হয়ে দেখছিল।থাকতে না পেরে বলল,বৌদি জামা-কাপড় ছেড়ে নাও।
শিখার কোন ভাবান্তর হল না।যেন শুনতেই পায়নি।ঠোঁটে বাঁকা হাসি নিয়ে বলল,কাল সন্ধেবেলা এসেছিলি কেন?
কেয়া অপ্রতিভ হয়ে ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল।দেখল শিখার সন্দেহের চোখ,কপালের শুকনো ত্বকে কুটিল দু’টি রেখা।সে ঘাবড়ে গিয়ে বলল, তোমাকে কে বলল ,দাদা?
শিখা আরও একটু জটিল হাসল,সে বলবে কেন।বললে তো হয়েই গেছিল।ফ্ল্যাটবাড়িতে দেখার লোকের অভাব আছে?তোরা দু’টিতে না কি অন্ধকারে কীসব গুজগুজ করছিলি।
কেয়া মুখ নামিয়ে শাড়ির আঁচল আঙুলে পাকাতে পাকাতে বলল,দরকার ছিল বৌদি,না’হলে আসব কেন?
‘কালকেই দরকার পড়ে গেল?তুই জানতিস তো আমি থাকব না’?
‘জানতাম তো’।
‘তবে’?
কেয়া বলল,ছেলেটার দু’দিন ধরে জ্বর, তোমাকে তো বলেইছিলাম।তার মধ্যে ছেলের বাবা মাথা ফাটিয়ে ফিরেছে।ঘরে একটা টাকাও ছিল না।তাই ভেবেছিলাম দাদা ফিরলে কিছু ধার চাইব।
শিখার বিশ্বাস হল না,শুধুই তাই?তাহলে চাইলি না কেন?
কেয়া বলল,দাদার গম্ভীর মুখ দেখে চাইতে সাহস পাই নি।
শিখা বলল,বাজে কথা বলিস না।
কেয়া হতাশ ভঙ্গিতে বলল,তুমি আজকাল বড় খিটখিটে হয়ে গেছ বৌদি।এত সন্দেহ কেন বুঝিনা।
গরম হয়ে উঠল শিখার কানদুটো।রক্ত ছুটে গেল মাথায়।কপালের দু’দিকে দপদপ করতে লাগল।পরিষ্কার বুঝল প্রেসার বেড়েছে ।এই সময় মাথা ঠান্ডা রাখা উচিত।সে সোফায় বসে স্থির চোখে কেয়ার রান্নাঘরে চলে যাওয়া দেখতে পেল।যা ভাবছে,তা কি সত্যি?নিশ্চয়ই সত্যি নয়।
শিখা নিশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলল,তুই বুঝবি কী করে।আমি নিজেও কী ছাই বুঝি।
চমক ভাঙল কলিংবেলের শব্দে।শিখা অনেকক্ষণ জামা-কাপড় পাল্টে নিজের বিছানায় এসে শুয়ে পড়েছে।বড় ক্লান্ত লাগছিল।কখন যে চোখ লেগে এসেছে টের পায়নি।কলিংবেলের শব্দে উঠে পড়েছে।ভাবল,এই বুঝি অলক ঘরে এসে ঢুকবে।কিন্তু কোথায় কি।বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বাইরের ঘরে এসে দেখল অলক সোফায় বসে চা খাচ্ছে।কেয়া মেঝেতে বসে।দু’জনের চোখ টিভির পর্দার দিকে।কেয়ার বসার ভঙ্গি শিখার ভাল লাগল না।বুকের কাপড় সরে গিয়েছে খেয়াল নেই।বড় বেহায়া মেয়েছেলে।শিখা একটু রুক্ষ গলায় বলল,কেয়া ঠিক হয়ে বোস।
শিখার স্বরের এই রুক্ষতা অলক বা কেয়ার,কারোরই নজর এড়াল না।কেয়া উঠে রান্নাঘরে যেতে অলক বলল,কী হয়েছে বল তো তোমার?
শিখা তেমন রুক্ষস্বরেই উত্তর দিল,কিছুই তো হয়নি।
অলক বুঝল কোন কারণে শিখার মেজাজ ঠিক নেই।সন্ধেবেলা বৃষ্টিতে বাড়ি ফেরা শিখার সাথে এই শিখার অনেক পার্থক্য।অলক সামান্য সময় চুপ করে থেকে প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে একবার ঠোঁটে নিল।তারপর কিছু ভেবে না ধরিয়েই হাতে ঝুলিয়ে রাখল।আড়চোখে শিখার দিকে তাকিয়ে দেখল শিখার মুখটা কেমন অস্বাভাবিক লাগছে।চোখ কুঁচকে ফেলেছে,নাক টানছে।এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু খুঁজছে যেন।অলক চট করে এসে ধরে ফেলল।না হলে হয়ত পড়েই যেত।বিছানায় শুইয়ে অলক জিজ্ঞেস করল,শরীর খারাপ লাগছে?
শিখা ততক্ষণে একটু স্বাভাবিক।অলকের দিকে তাকিয়ে বলল,বলেছি না ঘরে সিগারেট খেও না।সিগারেট পোড়ার গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে।
অলক অবাক হল না।হাতের না-ধরানো সিগারেট পাঞ্জাবির পকেটেই রেখে দিল।
অলকের রাতের খাওয়া শেষ।শিখা খেতে পারেনি,গা গুলোচ্ছে।বেসিনে গিয়ে বমি করে এল একবার।ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ছে।অলক ওষুধ দিতে ঘরে এসে দেখল শিখা কী একটা জিনিস হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে।অলকের হাতে দিয়ে বলল,এটা তোমার বিছানায় পেলাম।
অলক হাতে নিয়ে দেখল,চুলের একটা ক্লিপ।বলল,এটা তো তোমার।
শিখা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,আমার কী চুল আছে যে ক্লিপ ব্যবহার করব?
অলক কিছুদিন ধরেই শিখার এমন পাগলামি সহ্য করছিল।একটু কড়া মেজাজে বলল,এখন নেই তো কী হয়েছে?আগে তো ছিল।তখন ব্যবহার করতে না?
শিখা অলকের আচমকা এমন ব্যবহারে সামান্য ধাক্কা খায়।মুখ মলিন করে বলল,তোমারও অনেক কিছু ছিল না।এখন তো দেখছি।
অলক তীক্ষ্ণ চোখে শিখার দিকে তাকিয়ে বলল,আরও অনেক কিছু দেখার বাকি আছে তোমার।দেখতে পাওনা আমার ও শরীর ভাঙছে?তোমার এই সন্দেহ করা,গন্ধ পাওয়া…..সব আমি বুঝি।একদিন সব মিটে যাবে।স্বাভাবিক গন্ধও আর টের পাবেনা।
শিখার থমথমে মুখের উপর আলো নিভিয়ে অলক বেরিয়ে গেল।দেখতেও পেল না অন্ধকার আর নৈঃশব্দের মধ্যে পাথরের মূর্তির মত শিখা বসেই আছে।
বাইরে কখন যেন বৃষ্টি থেমে গেছে।জানালার কাচে জলের আলতো ছোঁয়া তখনও লেগে আছে।শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল শিখা।অবসাদ আর ক্লান্তির ঘুমে মাঝরাত কেটে গেছে।ঘুম ভেঙে প্রথমে মনে হল কোন খোলা জায়গায় সে শুয়ে আছে।আশেপাশে টুপটাপ করে আঁধার গড়িয়ে পড়ছে।জল তেষ্টা পেয়েছিল।কাউকে ডাকল না।উঠে বসে হাত বাড়িয়ে নিজেই জল খেল।বাইরের ঘরের দিকে তাকিয়ে সাদা দেওয়ালের গায়ে আবার সেই দৃশ্য দেখতে পেল।দু’টো মানুষের অন্তরঙ্গ ছবি।
হঠাৎ ভারী হয়ে ওঠা শরীরটাকে টানতে টানতে পা চেপে চেপে বাইরে এসে দাঁড়াল।মেঝেতে কেয়া মাদুর পেতে শুয়ে।পাশের ঘরের রাতবাতিতে ঘুমন্ত অলক।জানালা দিয়ে আসা বাইরের ঝোড়ো হাওয়ায় পর্দা উড়ে বিপরীত দেওয়ালে ছায়া মূর্তির অবয়ব গড়ে তুলছে।ফ্রিজের উপর রাখা টেবিল ঘড়ি টিকটিক করে বেজেই চলেছে।বেজেই চলবে।কোথাও কোন অস্বাভাবিকতা নেই,কোন এলোপাথাড়ি ধাক্কা নেই,জলতরঙ্গের মত নিরবিচ্ছিন্ন বেজে যাওয়া শুধু।
ভয়ে শিখা দু’চোখ বন্ধ করল।ঘরের নরম অন্ধকার থেকে আরও গভীর অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে একবার সে ভেসে উঠতে চাইল।
(৪)
শিখার ঘুম থেকে ওঠার নির্দিষ্ট কোন সময় থাকে না।কখনও খুব সকালে ঘুম ভেঙে যায়।বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।হাবিজাবি চিন্তা করে।নিজে নিজেই রান্নাঘরে গিয়ে চা বানিয়ে ব্যালকনিতে বসে।আকাশ দেখে,পাখির ডাক শোনে।আবার কোন কোনদিন অনেক দেরিতে ঘুম থেকে উঠে দেখে অলক অফিসে বেরিয়ে গেছে।কেয়াকে মৃদু ধমক দেয় না ডেকে দেওয়ার জন্য।ফোন করে অলক পৌঁছলো কি না খবর নেয়।
আজ সকালে সবার আগে ঘুম ভেঙে চোখ খুলে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকল।কাল রাতে বৃষ্টির জন্য অলক জানালা বন্ধ করে দিয়ে গিয়েছিল।বাইরের নরম আলো কাচ ভেদ করে সদ্য ঘরে উঁকি দিয়েছে।শিখা ঘুম ঘুম চোখে বাইরের ঘরে এসে দেখল কেয়া তখনও মাদুর পেতে মেঝেতে ঘুমিয়ে।কেয়ার শোয়া বাজে।ঘুমের মধ্যে পায়ের দিকের কাপড় উঠে যায়। অনেক বলেও শোধরানো যায়নি।অলক শিখার অসুস্থতার কারণেই দরজা বন্ধ করে শোয় না।শিখা কেয়াকে ডাকল না।সন্তর্পণে পায়ের দিকের কাপড় নামিয়ে দিতেই কেয়া ধড়মড় করে উঠে বসে প্রথমে শিখাকে দেখল।তারপর ফ্রিজের উপর রাখা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,এ বাবা,কত বেলা হয়ে গেছে।তুমি মুখ ধুয়ে এস,আমি চা বসাচ্ছি।
শিখা আড়চোখে অলকের ঘরের দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল,কতদিন তোকে ঠিকভাবে শুতে বলেছি?
কেয়া পায়ের দিকের কাপড় আরও নামিয়ে বোকার মত হাসল,ঘুমের মধ্যে কী খেয়াল থাকে বৌদি?
শিখা হিসহিস করে উঠল,তুই তো আর বাচ্চা খুকি নোস।এক ছেলের মা হয়েছিস।একটু বোধবাধ্যি থাকবে না?আজ থেকে আমার ঘরে শুবি।
কেয়া একবার আড়চোখে অলকের ঘরের দিকে তাকাল।তারপর আলতো করে ঘাড় নেড়ে বালিশ,মাদুর নিয়ে চলে গেল।
অলক এখনও ঘুমিয়ে।বাথরুমে যাওয়ার আগে শিখা একবার তাকে ডেকে দিয়ে গিয়েছিল।ঘুম থেকে উঠে স্নান করা শিখার বরাবরের অভ্যেস।শুধু শীতকালটাই সেই অভ্যেসে ছেদ পড়ে।বাসি জামা-কাপড় ছেড়ে ভিজে চুলে সামান্য চিরুনি বোলাল।কপালের সিঁদুরের টিপ আঁকল।সিঁথি আন্দাজে সিঁদুর ছুঁইয়ে দেখল অলক তখনও ওঠেনি।অথচ আজ তাড়াতাড়ি অফিস যাওয়ার কথা।কি সব মিটিংয়ের কথা শুনেছিল।অলক সত্যি সত্যিই ঘুমোচ্ছিল কি না কে জানে।এবারে একবার ডাকতেই উঠে বসল।হাত দুটো ছড়িয়ে আলিস্যি ভাঙল।তারপরে বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়ে হঠাৎ বুকে হাত চাপা দিয়ে আবার বসে পড়ল।মুখে স্পষ্ট যন্ত্রণার ছাপ,বুকের বাম দিক খিমচে ধরে আছে।শিখা তাকিয়ে দেখল অলক ঘামছে।উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল,কী হল?শরীর খারাপ লাগছে?
অলক ইশারায় জল চাইল।জল খেয়ে বলল,প্রেসারটা বেড়েছে মনে হয়।
অলককে তেমন ভাবে কখনও অসুস্থ হতে দেখেনি শিখা।সামান্য জ্বর,সর্দি-কাশি ছাড়া।তবুও সামান্য ভয় পেল।বলল,আজকের দিনটা না হয় ছুটি নিয়ে নাও।একবার ডাক্তার দেখিয়ে এস।
অলক ততক্ষণে অনেকটাই স্বাভাবিক।হাতঘড়ি দেখে কাঁধের উপর তোয়ালে ফেলে বাথরুম যেতে যেতে বলল,পাগল?ব্যাঙ্কের চাপ জান না?ব্রাঞ্চ ম্যানেজার না গেলে কী হতে পারে,সেই ধারণা তোমার আছে?
শিখা পুজো দিতে দিতেই খেয়াল করল অলকের অস্বস্তি।জামা-প্যান্ট পড়ল,চুল আঁচড়াল,কাগজপত্র গুছিয়ে নিল।সবই নিয়ম মাফিক,তবুও কোথাও সামান্য তাল কাটছে।কেয়া পছন্দের ব্রেকফাস্ট করে দিয়েছে।তবুও ছড়িয়ে ছিটিয়ে খেয়ে উঠে পড়ল।
অলক বেরিয়ে যাচ্ছিল।শিখা দরজার সামনে এসে বলল,তোমাকে একটা কথা বলব ভাবছিলাম।
জুতোয় পা গলাতে গলাতে অলক বলল,তাড়াতাড়ি বল।অনেক দেরি হয়ে গেছে।
শিখা একটু ইতস্তত করে বলল,ভাবছি কেয়াকে বলব এখন থেকে ওর আর রাতে থাকার দরকার নেই।সন্ধেবেলা চলে যাক।রাতের খাবারটা আমি গরম করে নিতে পারব।
অলক একপলক শিখার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করে বলল,হঠাৎ?
শিখা বলল,হঠাৎ হবে কেন?তোমাকে তো আগেও বলেছি।ওর ছেলেটা ছোট,প্রায়ই অসুস্থ হয়।রাতটুকু না হয় ছেলের কাছেই থাক।তাছাড়া….।
অলক মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,তাছাড়া কী?
শিখা বলল,আমার চিকিৎসার পিছনে অনেক খরচ হচ্ছে।কিছুটা তো সাশ্রয় হবে।
অলক শিখার দিকে তাকিয়ে অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বলল,তুমিও নিশ্চিন্ত হবে বল?
শিখা অলকের কথার মানে বুঝতে না পেরে মাথা নাড়ল।
অলকের আর শোনার সময় নেই।দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নামতে নামতে বলল,আচ্ছা,আমি ফিরে এসে ভাবব।এখনই ওকে কিছু বলার দরকার নেই।
শিখা এখনই কিছু বলবে না বলে অজান্তেই সায় দিয়েছে।তবুও বলার জন্য ছটফট করতে লাগল।যেন এক্ষুনি কেয়াকে বলতে হবে আর একটু নিশ্চিন্ত হতে হবে।মন এমন একটা জিনিস যা ছড়াতে ছড়াতে বহুদূর পর্যন্ত চলে যায়।তখন গোটালেও পুরোটা আর হাতের মুঠোয় আসেনা।মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল শিখার।কেয়া নিজের মনে কাজে ব্যস্ত। ফ্রিজ খুলে সবজি নিয়ে কিচেনে গেল।কিচেন থেকে মশলার গন্ধ আসছে,বাসনপত্রের শব্দ হচ্ছে।শিখাকে টুকিটাকি কিছু জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে।শিখা সোফায় বসে বসে সব দেখতে পেল।অথচ কিছু বলতে পারছে না।এই বলতে না পারা তার দ্বিধা,না ভয়, সে জানেনা।
সাড়ে দশটা নাগাদ কেয়া এসে চা দিল।শিখা এইসময় একটু চা খায়।খবরের কাগজে চোখ বোলায়।কখনও সখনও টিভি চালিয়ে বসে থাকে।শিখা কেয়াকে ডাক দিল।কেয়া আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বাইরে এসে বলল,বল বৌদি?
‘তোর ছেলে ভাল এখন?জ্বর কমল’?
‘কী আর ভাল,’নিস্পৃহ গলায় কেয়া বলল, ‘ওষুধ খাওয়ালে জ্বর কমে।ফের আবার ফিরে আসে’।
শিখা বলল,এ তো ভাল লক্ষণ নয়।ওকে ভাল ডাক্তার দেখান দরকার।
কেয়া বলল,উপায় কী,ছেলের বাবাকে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হয়।ঠিক সময়ে না গেলে কাজ পায় না।আর,আমিও এখানে।ঘরে তো বুড়ি শাশুড়ি একা।
শিখা বলল,তবে তো খুবই মুশকিল।তোর ছেলের বয়েসও তো এমন কিছু বেশি নয়।বলতে গেলে মার কোলে পিঠেই থাকার কথা।
বৌদি হঠাৎ তার ছেলের কথা তোলায় কেয়া একটু অবাক হল।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,কালকে তো ছাড়তেই চায় না।এদিকে নার্সিং হোম থেকে তোমার আসার সময় হয়ে যাচ্ছে।দাদা পইপই করে বলে দিয়েছিল,বৌদি ফেরার আগে ঘরে ঢুকে সাফসুরোত করে রাখবি।শেষে লুকিয়ে চলে এসেছি।
শিখা বোধহয় এমন কথাই আশা করেছিল।বলল,এক কাজ কর।আজ থেকে তোকে আর রাতে থাকতে হবে না।কাজ সেরে সন্ধেবেলা ফিরে যাস।বাকিটুকু আমি সামলে নেব।
কেয়া এতটা অবাক হল যে প্রথমে মুখ দিয়ে কিছুক্ষণ কথা বেরোল না।বার কয়েক বৌদির দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে বলল,দাদাকে বলেছ?
শিখা হঠাৎ ফোঁস করে উঠল,দাদাকে বলার কী আছে শুনি?
কেয়া তবুও বলল,তুমি একা একা পারবে সামলাতে?
শিখা মুখে একটা মৃদু হাসি টেনে বলল,কোন অসুবিধে হবে না।কিছু দরকার হলে তো তোকে ফোন করেই ডেকে নেওয়া যাবে।এমন কিছু দূর তো নয়।এখন যা,তাড়াতাড়ি কাজ সেরে নে।
চলেই যাচ্ছিল কেয়া।কিন্তু রান্নাঘরের দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াল।আসল কথাটা জিজ্ঞেস করতেই সে ভুলে গেছে।এতক্ষণ বৌদির কোন কথাতেই আপত্তি করেনি।বলল,কই,টাকার কথা তো তুমি একবারও বললে না?
‘কী বলব’?
‘টাকা কমাবে না তো’?
শিখা হেসে ফেলল,আমাকে দেখে কী তোর সেইরকম মনে হয়েছে।নিজেই ঠকি,অন্যকে ঠকাব কী করে?
কেয়া রান্নাঘরে চলে গেলে শিখা ভাবল,কাজটা কী ঠিক হল।অলক বাড়ি ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেই হত।একবার ভাবল ফোন করে খবরটা দেই।কী মনে করে আর ফোন করল না।
দুপুরের খাওয়া শেষ করে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে শুয়েছিল শিখা।বেশিক্ষণ চোখ খুলে রাখতে পারেনি।ঘুমিয়ে পড়েছিল।হঠাৎ প্রবল এক অস্বস্তিতে ঘুম ভাঙল।কী যেন কাঁটার মত বিধছে পিঠে।সমস্ত শরীরে পোকার কামড় অনুভব করতে লাগল।একবার মনে হল কোথা থেকে বিচ্ছিরি দুর্গন্ধ আসছে।কি রকম পচা,বাসি একটা দুর্গন্ধ।গা গুলিয়ে উঠল।গলায় জোর এনে ডাকল,কেয়া,কেয়া?
কেয়া বাড়ি ফেরার জন্য তৈরী হচ্ছিল।তাড়াতাড়ি এসে বলল,কী হয়েছে বৌদি?
‘কেমন একটা পচা গন্ধ বেরোচ্ছে না?ইঁদুর মরেছে না কি?দেখ তো খুঁজে’।
কেয়া নাক টেনে গন্ধ নিল,কই পাচ্ছি না তো।
শিখা অধৈর্য হল,পাচ্ছি না বললেই হবে।ভাল করে খুঁজে দেখ।
কেয়া দরজার কোণ,খাটের নিচ,আনাচে-কানাচে খুঁজে দেখল।কিছুই পাওয়া গেল না।তবুও শিখার মন থেকে খচখচানি গেল না।সমস্ত ঘর থেকে বাসি পচা গন্ধ আরও ছড়িয়ে পড়ছে।নাকে হাত চাপা দিয়ে কেয়াকে বলল,রুম ফ্রেশনারটা নিয়ে একটু স্প্রে করে দে তো।
সন্ধের মুখে কেয়া বেরিয়ে যাওয়ার আগে শিখা ওর হাতে টাকা দিয়ে বলল,বাচ্চাটাকে ডাক্তার দেখিয়ে নিস।আর,এক ডজন রজনীগন্ধার স্টিক এনে দে আমায়।
কেয়া চলে যাওয়ার পরে শিখা একা বসে ভাবতে লাগল অলক এসে কী বলবে।খুব রেগে যাবে কি?আজ শিখা সবটুকু বলবে।তার দুশ্চিন্তার কথা,পোড়া গন্ধের কথা,তার অসহায়তার কথা।রাতের বেলা দেখা অলৌকিক দৃশ্যের কথা।অলক না বুঝলেও সে বোঝাবে,কেয়া থাকলে কত দ্রুত সে ক্ষয়ে যাচ্ছে।
সন্ধে গড়িয়ে রাত নামল।অলক ফিরল না।শিখা দু’বার ফোন করে দেখেছে মোবাইল সুইচ অফ।অন্য কারুর ফোন নম্বরও সে জানেনা যে খবর নেবে।তবে কী ডক্টর সেনের ওখানে গেল?না কী অন্য কোথাও?শিখার চিন্তা হল।মন ভার হল।একা একা ঘরে বসে ছটফট করতে লাগল।টিভি চালিয়ে ঘরের নিস্তবদ্ধতা কাটিয়েও লাভ হল না।বাইরে লোকজনের গলার শব্দ শুনতে পেয়ে ছুটে ব্যালকনিতে গিয়ে উঁকি দিয়েছে।কোথাও কিছু নেই।
ঘরের চাপা গুমোট আর তার মধ্যে অসহ্য এক দমবন্ধ করা গন্ধ।টেবিলের উপর পড়ে থাকা রজনীগন্ধা,ধূপের পোড়া গন্ধের সাথে মিশে যাওয়া বাসি পচা মাংসের গন্ধ।অস্থির হয়ে উঠল শিখা।মাথার উপর ঘুরতে থাকা ফ্যানের হাওয়াতেও কপালে,গলায় মৃদু ঘাম।
এমন সময়ে ফোনটা এল।মোবাইলের স্ক্রিনে নম্বর দেখে চিনতে পারল না।কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন ধরে বলল,হ্যালো?
‘বৌদি,আমি অলকের অফিস কলিগ বলছি’,ও প্রান্তে অচেনা পুরুষ কন্ঠ।
শিখা কিছুই শুনতে পায় না যেন।ক্রমাগত শূন্য থেকে শূন্যে মিলিয়ে যেতে যেতে বলল,অলক…..?কী হয়েছে ওর?
‘অলকের একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে বৌদি।বাড়ি ফেরার পথে রাস্তা পেরোতে গিয়ে গাড়ির ধাক্কা খেয়েছে।মাথায় আর বুকে চোট।পিজিতে ভর্তি করিয়েছি আমরা।ডাক্তার বললেন,বাহাত্তর ঘন্টা না কাটলে কিছুই বলা যাবে না।আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন।এখানে এসে এই মোবাইলে যোগাযোগ করবেন’।
শিখার সমস্ত শরীর যেন অসাড় হয়ে গেল।বোবা দৃষ্টি মেলে সামনে রাখা মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ।তারপর দ্রুত দাদাকে ফোন করে সব জানিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
সারা রাত চুপ করে বসে কেটে গেল।ভোরের আলো ফোটার খানিক আগে খবর এল,অলক আর নেই।
হঠাৎ কিসের আকুল করা ভোরের ঠান্ডা হাওয়ার একটা দমকা এসে বুকে ঝাপটা দিল।ঝাপটা তো নয়,ছোবল যেন।বুক থেকে পলকে এক শীতল অনুভূতি মাথার স্নায়ুতে উঠে এল।মাথা,বুক,হাত,পা অসাড়।সম্ভবত জীবনের ধ্বনিটুকু ঠিকসময়ে বাজতে ভুলে গেছে।শিখার আর পা বাড়াবার মতন কোন সিঁড়ি নেই।জীবনের সাড় নেই,আগ্রহ নেই।বোবা শূন্য চোখে প্রশ্ন নেই।এক অদ্ভুত স্থবিরতায় সে অপেক্ষা করতে লাগল অলকের জন্য।
(৫)
ছোট ফ্ল্যাট বাড়ি।গোনা গুণতি দু’টো শোওয়ার ঘর,আর একটা বসবার ঘর।খুবই ছোট।তবুও কত ফাঁকা ফাঁকা লাগে।চোখ মেললেই যেন উল্টো দিকের দেওয়াল পর্যন্ত দৃষ্টি চলে যায়।হঠাৎ জোয়ার এলে প্রথম প্রথম সব তছনছ হওয়ার সম্ভবনা থাকে।সময় গেলে জল সরে গিয়ে আবার স্থির হয়।গত কয়েকঘন্টা লোকজনের কমতি ছিল না।অলকের অফিস,ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী সবাই এসেছে,সান্ত্বনা দিয়ে ফিরে গেছে।শিখার দাদা শান্ত স্বভাবের বৈষয়িক মানুষ।এমন বিপদের দিনে সারাক্ষণ বোনের পাশে পাশে রয়েছে।হাসপাতাল,
থানা,মর্গ সব একার হাতে সামলেছে।শিখার গায়ে আঁচ লাগেনি।শ্মশানে যেতে পর্যন্ত মানা করেছিল।কিন্তু শিখা শুনলে তো।
গতকালের রাত ঘুমের মত কিছু একটা অনুভবে কেটে গেছে।ভয় এতটুকু করেনি।বরঞ্চ আচ্ছন্নের মত পড়েছিল।
সকালে উঠে বসার ঘরে গিয়ে দেখল ডাইনিং টেবিলে হাতে পেপার নিয়ে বসে দাদা চা খাচ্ছে।শিখাকে দেখে কেয়াকে ডাক দিয়ে বলল,আর এক কাপ চা দিয়ে যাও।
মুখে-চোখে জল দিয়ে এসে শিখা দেখল দাদা তার দিকে তাকিয়ে।শিখা বসতেই বলল,শরীর ঠিক আছে তো।
শিখা আঁচল দিয়ে মুখ মুছল।ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল।
শিখা ঘুম থেকে উঠে স্নান সারে,ঠাকুর পুজো দেয়,তারপর চা খায়।কেয়া চা দিতে ইতস্তত করছিল দেখে বলল,এখানেই চা দিয়ে যা।চা দিতে এসে কেয়া দেখল বৌদির মুখটা অন্যরকম।ঝড়ঝাপ্টা সামলে ক্ষত হওয়া মানুষের মতন নয়।বরং খুব উদাসীন এক মানুষের মুখ যেন।
শিখার দাদার চা খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল।বোনকে লক্ষ্য করে বলল,পরের কেমোথেরাপির ডেট কবে যেন?
শিখা সামান্য অন্যমনস্কভাবে কথাটা শুনল।ধীরে সুস্থে চায়ে চুমুক দিয়ে শান্ত গলায় বলল,থাক না এখন।কাজকর্ম মিটে যাক আগে।
শিখার দাদা বিরক্ত হল,থাকবে কেন?অসুখ কী বিপদের কথা বুঝবে?না,সে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে?কবে যেতে বলেছে কোথাও লিখে রাখিস নি?
শিখা দায়সারা ভাবে বলল,পাশের ঘরে অলকের ডাইরিতে লেখা আছে বোধহয়।ওই এইসব মনে রাখত।
অলকের ঘর ঘুরে এসে শিখার দাদা বলল,দেরি আছে।আমি ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে নেব।চিন্তা করিস না।
শিখার এইসব শুনতে ভাল লাগছিল না।বিশেষ করে আজকের দিনে।বিরক্ত গলায় ঝাঁঝ নিয়ে বলল,তোকে এত ভাবতে কে বলেছে?কোথায় ছিলিস এতদিন?বিয়ের পর থেকে তো যোগাযোগই রাখিস নি।অলকের বাড়ির লোকদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম।নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করেছি বলে দু’টো বাড়ি থেকেই সম্পর্ক রাখবে না?
দাদা বলল,আঃ,আজকে থাক না এইসব।
শিখা আরও ঝাঁঝিয়ে বলল,থাকবে কেন?একবারও কাউকে বলেছি,আমরা বাচ্চা নেইনি কেন?কী যন্ত্রণা নিয়ে আমরা দু’জন কাটিয়েছি?তাও ভাগ্য ভাল,অসুস্থ হওয়ার পরে তুই যোগাযোগ করলি।এবার,আমাকে আমার মত ভাবতে দে না।
একটা গুমোট আবহাওয়া তৈরী হল।হয়ত শিখার বলা উচিত হয়নি।জিভকে রাশ বেধে সবসময় রাখা যায় কি!কখনো সখনো আলগা হয়ে যায়।ক’টা মুহূর্ত নিঃশব্দে দু’জন মানুষ মনের ফেনা মাখলো নিজেদের মতন নিঃস্পন্দ,বিব্রত হয়ে।শেষ পর্যন্ত শিখার চোখের কোণে কেমন করে জল এল কে জানে।আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে বলল,পুরোহিতকে খবর দেওয়া হয়েছে?
শিখার দাদা বলল,ফোন করে বলেছি বিকেলের দিকে আসতে।
‘আমি কিন্তু ঘাটে যেতে পারব না।যা কাজ করার এখানে বসেই হবে’।
‘অলকের অফিসের লোকজন,তোর প্রতিবেশী কাউকে বলতে হবে না’?
শিখা দৃঢ় গলায় বলল,দরকার নেই।যার ইচ্ছে সে এমনিই আসবে।
আগে সবসময় মনে হয়েছে মুক্তির চেয়ে বন্ধনের জোর অনেক বেশি।এই অসুস্থ রোগে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া শরীরটা নিয়েও বেঁচে থাকার নেশায় বাঁচতে চেয়েছিল শিখা।অথচ আজ মনে হচ্ছে মৃত্যুর চেয়ে সহজ মুক্তি আর কোথায়?অলক সেই মুক্তির পথে তাকে ফেলে রেখে চলে গেছে।না কি,তাকেই মুক্তি দিয়ে গেল?
অলক কখনই অন্যমনস্ক থাকত না।নার্সিং হোম থেকে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় একবার গাড়ির মুখোমুখি।শিখা ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল।অলক হ্যাঁচকা টানে তাকে টেনে নিয়ে ড্রাইভারের উদ্দশ্যে গাল পাড়ল।তারপর রাগত চোখে শিখার দিকে তাকিয়ে বলেছিল,কী সারাক্ষণ এত অন্যমনস্ক থাক?কী ভাব বল তো?সেই সাবধানী অলক রাস্তা ভুল করে ফেলল।
অপঘাতে মৃত্যুর শ্রাদ্ধ আগেই হয়।এই দু’তিনদিন ব্যস্ততার শেষ ছিল না।দাদার বারণ সত্বেও পুরোহিতের ফর্দ মিলিয়ে সব গুছিয়ে রেখেছে।কোথাও এতটুকু কম যেন না হয়।শরীর ভাঙছে বুঝতে পেরেছে,তবুও মুখ বুঁজে সব করেছে।কেয়া হাতে হাতে এগিয়ে দিয়েছে।মুখের সামনে খাবার,ওষুধটুকু তুলে দিয়েছে।তবুও শিখার খুঁতখুঁত কমেনি।
বটিতে সামান্য ফল কেটে দিচ্ছিল।পিছন থেকে কেউ ‘শিখা’ বলে ডাকতেই অন্যমনস্ক হতে আঙুল কাটল সামান্য।শিখার মুখে ‘উঃ’ শুনে কেয়া দৌড়ে এল,হাত কাটলে বৌদি?এমন একটা দিনে?
এমন একটা দিনে মানে?আজ কী শুভ দিন,না অশুভ?রক্ত যতটা না,যন্ত্রণা তার থেকে অনেকখানি বেশি।
এই কয়েকদিন শরীর নিয়ে ভাবেনি,ভাবার অবকাশ পায়নি।এখন মনে হল,মন দেহেই থাকে।দেহবোধ এত সহজে যায়না।সাময়িক ভুলে থাকা যায়।কিন্তু সময় পেলেই মনে করিয়ে দেয়।
পুরোহিত বৃদ্ধ মানুষ।কুশের আংটি পড়াতে গিয়ে দেখলেন শিখা ক্লান্ত,বিধ্বস্ত।বললেন,তুমি এই কোষা-কুষি ধরে বসে থাক।
শিখা কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।পুরোহিত কোষা-কুষি হাতে ধরিয়ে ফের বললেন,শক্ত করে ধরে রাখ মা।ছেড়ে দিও না।
শিখা বুঝতে পারল না কী ধরবে আর কী ছাড়বে।শক্ত করে ধরে রাখার মত শক্তিই বা কোথায়।চাদর পাতার সময়ে যত্নে টানটান করে মেলে ধরি।আর যখন গোটাই?এক ঝটকায় তুলে ফেলি বাসি,ময়লা চাদর।
জীবন এমনটাই।
খাওয়ার ব্যাপারে অলক বরাবরের খুঁতখুঁতে।খাওয়ার জায়গা পরিষ্কার হতে হবে।অল্প খেত,কিন্তু পছন্দের খাবার ছাড়া মুখেই তুলত না।প্রথম প্রথম এই নিয়ে কেয়ার সাথে অশান্তি কম হয়নি।
পুরোহিত বললেন,দই,মধু,তিল আর কলা দিয়ে ভাল করে চটকে নাও।তারপর গোল করে ভাল করে পিন্ড কর।দেখো,হাতে যেন কিছু যেন না লেগে থাকে।
শিখা তাকিয়ে দেখল অলকের খাবার।অলক কী এমন খাবার খেত?
পুরোহিত বললেন,মোট দশটা পিন্ড করবে।চারটে আর তিনটে তিনটে করে।এই হল প্রেতের খাবার।
প্রেতের খাবার।কী সহজে জলজ্যান্ত মানুষ প্রেত হয়ে যায়।
অলক কখনও হাতে মাখা সিন্নি খায়নি।শিখা মুখ নিচু করে যত্ন নিয়ে পিন্ড বানাতে লাগল।পাত্রের গায়ে লেগে থাকা তিল,দই,মধু সব একসাথে করে পরম মমতায় গোল বলের মত পিন্ড বানিয়ে বলল,হয়েছে?
এবার কুশ,তুলসি পাতা সহ বেদীর উপর রাখা কুশাসনে হাতের চেটোয় পিন্ড রেখে বিশেষ কায়দায় ফেলতে হবে।শিখা ঠিকমতো ফেলতে পারছে না।বারবার চেষ্টা করেও একটাও ঠিক হল না।অজান্তেই চোখের কোণায় জল জমল।
সকালে যেমন তেমন খেয়ে চলে যেত।রাতের বেলায় খুব চাইত শিখা এসে খাবার বেড়ে দিক।শিখা কখনও ঘুমিয়ে পড়ত,কখনও ইচ্ছেও করত না।অলক কখনও জোর করেনি।মাঝেমাঝে শিখার কাছে এসে বলত,পেটটা ঠিকমত ভরল না।
শিখা মনে মনে বলেছে,খাও না বাপু।কেয়া তো যত্ন করে বেড়ে দিচ্ছে।
দুঃখ আর অহংকার খুব দামী।সহজেই ছেড়ে দিতে মন চায়না।লুকিয়ে রাখা অলংকারের মত।খুব গোপনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে হয়।অথচ শেষমেষ কিছুই পড়ে থাকেনা।
যজ্ঞ শুরু হলে পুরোহিত বললেন,মা তুমি একটু বিশ্রাম নিতে পার।যাও,ওখানে গিয়ে বোসো।
শিখা তবুও জেদ ধরে বসে রইল।পিঠ টনটন করছে।শরীর দুর্বল লাগছে।আগুনের তাপ,ধূপ-ধুনো-পোড়া কাঠের গন্ধ নিয়েও শক্ত হয়ে বসে রইল।দূর থেকে কেয়া রোজকারের দেখা বৌদিকে অন্যরকম দেখল।
বাড়ির পিছনে ছোট মত পুকুর।শ্যাওলা পড়া বাধানো ঘাট।অলকের উদ্দেশ্যে খাবার রেখে ঘাট থেকে ওঠার সময় পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিল শিখা।কেয়া এগিয়ে এসে ধরে বলল,পিছন ফিরে তাকাবে না।
সবাই এগিয়ে গিয়েছিল।পাশে শুধু কেয়া।পুকুর থেকে রাস্তায় ওঠার মুহূর্তে শিখা পিছন ফিরে দেখল,মাটির থালার আশেপাশে কাক এসে বসেছে।
কখন যে আলো মরে যায়।গুটিশুটি মেরে বিকেল ফুরিয়ে সন্ধে নামে।আজ বাইরে জ্যোৎস্না রয়েছে।কাল বাদে পরশু পূর্নিমা।চাঁদের আলো পরিস্কার।টিউবলাইট কেটে গেছে।ঘরের মধ্যে ছোট মতন আলো।জানালা খোলা।চাঁদের আলো এসেছে সামান্য।
ঘরের একধারে ছোট মতন টেবিলের উপর অলকের ছবি।বাসি রজনীগন্ধার মালা ঝুলছে।পোড়া ধূপের গন্ধ ছড়িয়ে আছে আশেপাশে।মাঝে দু’দিন বৃষ্টি-বাদলা ছিল।ঘরের ভিতর ভ্যাপশা মত গন্ধ।ঘরের দেওয়ালের আনাচে কানাচে ঝুল জমে।চারদিকেই নোংরা।ছেড়া কাগজ,মাথার চুল,ওষুধের বাতিল স্ট্রিপ,ধুলো।কিসের যেন গন্ধ উঠছিল।বিশ্রী নোংরা গন্ধ।এই ঘর পরিষ্কার হয়নি কয়েকদিন।পরিষ্কার করতে দেওয়া হয়নি কেয়াকে।
শিখা বিছানায় পড়ে আছে।আড়াআড়ি,মাথার তলায় বালিশ নেই।হাত-পা এলানো।চোখ বন্ধ।কেয়া একবার দরজার সামনে থেকে উঁকি দিল।বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা মুশকিল।
কেয়ার কাজকর্ম ভাল।ঘরের রান্নাবান্না,বাইরের বাজারঘাট সবই তাকে করতে হয়।নেহাত লেখাপড়া তেমন জানেনা।সবজি ফুরিয়েছে।ভাত চাপিয়ে শিখাকে ডেকে বাইরের সোফায় বসিয়ে কেয়া বলল,বৌদি একটু খেয়াল রেখ।আমি চট করে দোকান থেকে ঘুরে আসছি।
শিখা তেমনই বসেছিল।কিছুই টের পায়নি।কেয়া দরজা খুলেই গন্ধটা পেল।তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ঢুকে দেখল হাড়ির জল শুকিয়ে নিচ থেকে লেগে গেছে।রান্নাঘর ছাড়িয়ে বাইরের বসার ঘরেও ভাত পোড়ার কটু গন্ধ।অথচ শিখা তেমনই বসে আছে।কেয়া কাছে গিয়ে বলল,ও বৌদি,তোমাকে যে বললাম ভাতটা একটু দেখতে।
শিখা যেন কোন ঘোরের মধ্যে ছিল।কাটিয়ে উঠে বলল,কেন?জল শুকিয়ে গেছে বুঝি?
শিখা কপালে হাত দিয়ে বলল,শুকোবে কি গো?পুড়ে গেছে।তুমি গন্ধ পাওনি?
শিখা অন্যমনস্কভাবে দু’বার নাক টেনে বলল,না রে।পুকুরে ডুব দিয়ে ঠান্ডা লেগেছে বোধহয়।নাক বন্ধ হয়ে রয়েছে।
রাতের খাবার টেবিলে ঢেকে চুল বাধছিল কেয়া।এইবার বাড়ি যাবে।শিখার ডাক শুনে ঘরে ঢুকে বলল,কিছু বলবে?
শিখা চোখ তুলে কেয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,চেয়ারটা টেনে আমার কাছে এসে বোস।একটা গল্প বলি।
কেয়া বলল,ছোট তো?অনেক রাত হয়েছে কিন্তু।ফিরতে হবে আমাকে।
শিখা হেসে ফেলল অনেকদিন বাদে।বলল,ছোট করেই বলব।আগে বোস তো এখানে।
কেয়া চেয়ার টেনে খাটের ধার ঘেসে বসতেই শিখা বলল,নলরাজার নাম শুনেছিস?
কেয়া একগাল হেসে মাথা নাড়ল,নল-দময়ন্তীর গল্প?
শিখা বলল,সেখান থেকেই কিছুটা শোনাই তোকে।বিয়ের পর নল আর দময়ন্তীর সুখের সংসার।দ্বাপর আর কলি ছিল দময়ন্তীর পানিপ্রার্থী।মানে,ওরাও দময়ন্তীকে বিয়ে করতে চেয়েছিল।কিন্তু না হওয়ায় ওদের রাগ হয়।আর দু’জনে মিলে জোট বাঁধে।কী করে নলের ক্ষতি করা যায়।নলের ছিল পাশা খেলার শখ।কলির পরামর্শে দ্বাপর পাশার মধ্যে লুকিয়ে থাকল।আর দ্বাপর নিজে নলের ভুলের সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।একদিন হয়েছে কি…………।
কেয়া তন্ময় হয়ে শুনছিল।শিখাকে থামতে দেখে বলল,কী হয়েছিল?
শিখা বলল,তোর দেরী হচ্ছে না তো?
কেয়া বলল,না,না।তুমি বল না।
শিখা আবার শুরু করল,একদিন নল মূত্রত্যাগের পর হাত পা না ধুয়েই উপাসনা করতে বসল।কাজটা তো আর ঠিক হয়নি।কলিও তক্কে তক্কে ছিল।এই সুযোগে সে নলের দেহে প্রবেশ করল।কলির কুমন্ত্রণায় নল একদিন পুষ্করকে পাশা খেলতে ডাকে।এদিকে পাশার ভিতরে আগে থেকেই তো দ্বাপর লুকিয়ে।পাশা খেলতে গিয়ে নল রাজ্যপাট,ধনসম্পদ সব খুইয়ে সর্বশান্ত হল।এদিকে দ্বাপর আর কলির নজর দময়ন্তীর দিকে।কিন্তু নল দময়ন্তীকে পণ রাখতে রাজি হল না।স্ত্রীকে নিয়ে এক পোষাকে রাজ্য ত্যাগ করল।
‘ওদের ছেলে,মেয়ে ছিল না’।
‘ছিল তো।দময়ন্তী ছিল বিচক্ষন।সে নলকে পাশা খেলা থেকে আটকানোর অনেক চেষ্টা করেছিল।কিন্তু নল শুনলে তো।সামনে যখন বুঝল সর্বনাশ এসেছে,তখন দময়ন্তী ছেলে,মেয়েকে নিজের বাবার কাছে পাঠিয়ে দেয়’।
‘এইটুকু গল্প’,কেয়া বলল।
শিখা দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে বলল,রাজ্য ত্যাগ করে নল আর দময়ন্তী বনে বনে ভিখিরির দশায় ঘুরতে থাকে।একদিন নল কতগুলো সোনারঙা পাখি দেখতে পেল।তার লোভ হল।লোভ না খিদে কে জানে।মনের মধ্যে অসুখ দানা বাধলে ঠেকায় কে?ভাবল নিজের কাপড় খুলে পাখিদের ধরে ফেলবে।যেমন ভাবা তেমন কাজ।কিন্তু পাখিগুলো তো আর সত্যি ছিল না।ওগুলো ছিল দ্বাপরের ছল।পাখিরা নলের পোষাক নিয়ে চলে গেল।পোষাক গেল,পাখিও পেল না।দময়ন্তী ছিল পতি অন্ত প্রাণ।স্বামীকে ছেড়ে কোথাও যাবে না।দু’জনে তখন একই কাপড় জড়িয়ে চলতে থাকল।একদিন রাতে দময়ন্তী যখন ঘুমে,তখন কলির পরামর্শে নল অর্ধেক কাপড় কেটে স্ত্রীকে ফেলে চলে গেল।ঘুমন্ত দময়ন্তী টেরও পেল না।
কেয়া বলল,তারপর?
দেওয়াল ঘড়িতে দশটা বাজার শব্দ হল।শিখা বলল,তারপর আবার কী?অনেক রাত হয়েছে।এখন বাড়ি যা।বাকিটা কাল শুনিস।
কেয়া বেরিয়ে যাচ্ছিল।শিখা দরজা দিতে এসে বলল,কাল থেকে রাতে বাড়ি ফেরার দরকার নেই।আগে যেমন ছিলি তেমনই থাকবি।ইচ্ছে হলে তোর ছেলেকে এনেও রাখতে পারিস।
○●○●○●○●সমাপ্ত●○●○●○●○