এই গল্পের নায়িকা ঊর্মি। মাধবপুরের বড় কালীতলার মেয়ে। খুব ছোট্ট বেলায় ও মাকে হারিয়ে ঠাগমার কাছে মানুষ। ঠাগমা বিনোদিনী খুব কৈএ বৈএ। আর নাতনিটি ও তেমনি। এদিকে বাপ নিতাই আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে। এই বৌ এর নাম দয়াময়ী। তা বলে ভাবার দরকার নেই যে তার খুব দয়ামায়া। বরং উল্টোটা।
যতদিন বিনোদিনী ডাঁটোখাটো ছিল ততদিন দয়াময়ীর সাধ্য ছিল না ঊর্মির ব্যাপারে কথা বলবার। বরং ভালোমানুষীর একটা মুখোশ পরে থাকত। বিনোদিনী মাঝে মাঝেই বলত “শোনো বৌ! আমার ঊর্মির জন্য তোমার আর নিতাই এর ভাবনা চিন্তার কারণ নেই। আমার যেটুকু আছে তাতেই ও মেয়েটার একটা গতি হয়ে যাবে”। কিন্তু এই কথাটাই ভাবিয়ে তুলল দয়াময়ীকে। তার মানে নিশ্চয়ই গোফা গোফা ধন সম্পত্তির মালিক এই বুড়ি। আর সব কিনা সতীন মেয়েটা পাবে। আমার যে একটা মেয়ে আছে সেটাও একবার ভাবে না। ওই উর্মিটা যদি না থাকত তবে শাশুড়ির কাছ থেকে দয়াময়ী সব পেত। অতএব তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল দয়াময়ী। আর সব রাগ গিয়ে পড়ল ওই ঊর্মির উপর। ওকে যেকোন ও ভাবে সরাতে হবে ওদের জীবন থেকে। কোথাকার কোন আবাগীর মেয়েটার কপাল এত ভাল হবে। আর ওর জীবন, ওর মেয়েটার জীবন নিয়ে কারও হুঁশ নেই।
উর্মির বারো বছর বয়স হল। এখনই যেন রূপ ঠিকরে পড়ছে। টানাটানা গোরুর মতো চোখ দুটো কত না অপূর্ব। গায়ের রঙ যেন আনারদানা। সেদিন চন্ডীর মা ডাকপাক বললে “ঊর্মিকে যে ছেলে দেখবে এক দেখাতে ই পছন্দ হবে। তার উপরে ওর চুল প্রতিদিন ওর ঠাগমা বেঁধে দেওয়ার জন্য কত বড় চুল “।
এসব কথা শুনে রাগে রী রী করে দয়াময়ী। কাউকে কিছুই বলতে পারে না। বিনোদিনী এসব শুনে আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলে “ওইজন্য তো নিতাই ঊর্মির নাম রেখেছিল আনারকলি”। নিতাই সেখানেই উপস্থিত ছিল। বললে “ওর মা অমন সুন্দরী ছিল যে”। এটুকু কথাতেই সেদিন সংসারে বিপর্যয় নেমে এল নিতাই এর। রাতের অন্ধকারে যখন সারা পাড়া নিথর নিথর তখন নিতাই পড়ল মহা ফ্যাঁসাদে। বৌ বললে “আগের বৌ সুন্দরী ছিল। তাহলে আমার মতো মেয়ের সাথে বে করতে কে তোমাকে সেধেছিল। সতীনের মেয়ের জন্য তো তোমার দরদ দেখলে বাঁচি না! আর আমার মেয়েটা বুঝি ফ্যালনা”? নিতাই দেখলে তার দ্বিতীয় পক্ষের মুখ নয় যেন ক্ষুর। তবু বললে “তা কেন!কথার পিঠে কথা দেওযা বই তো নয়। আমার কাছে ঊর্মি যা। শর্মি ও তাই। এ কীরকম কথা কৈছো বলো দিকিন!” না। আজ আর থামছে ই না দয়াময়ী। শীতের রাতে প্রতিটি কথা শুনতে পাচ্ছে এক অশীতিপর বৃদ্ধা। এতদিন যে বৌমার গুণগান করেছে তার প্রকৃত রূপ যেন চাক্ষুষ করছে। দয়াময়ী বলে চলে “তোমার মায়ের যাবতীয় সম্পত্তি ওই সতের গুষ্টি পাবে। আর তোমার মুরোদ আমার জানা আছে”।
রাতের অন্ধকারে নারী পুরুষের চিৎকার চলে। দয়াময়ী যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে বারো বছরের ঊর্মির সাথে। সে বোঝাতে চায় তার অধিকারবোধ। যেন নিতাই এর আগের স্ত্রীর প্রতিরূপ ওই ঊর্মি। দয়াময়ীর চিৎকার ঘর ছেড়ে বাইরে গিয়ে পড়ল। বললে “তোমার মায়ের কীরকম বিবেচনাবোধ। এত একচোখোমোর কারণ কী? কেন তার গচ্ছিত সম্পদ শুধুই ঊর্মির প্রাপ্য? তবে এক কাজ করবে ঊর্মির বিয়ের পর তোমার মা যেন ঊর্মির সাথেই তার শ্বশুর বাড়িতে আশ্রয় নেয় “।
দয়াময়ীর কথা যেন তীক্ষ্ণ ফলা। বৃদ্ধার বুকের বাঁ পাশটা ব্যথা করছে যেন।হয়ত সংসারের মেয়াদ আর বেশিদিন নেই। যা করার এখনই করতে হবে। আস্তে আস্তে ঊর্মিকে ডাকতে থাকে যাতে কাকপক্ষী টের না পায়। রাতের অন্ধকারে বৃদ্ধা ঠাগমা তার নাতনিকে স্ত্রীধন দিয়ে যান। একটা সুদৃশ্য বাক্সে কত গহনা। বুকে হাত চেপে বলতে থাকেন “আমি যখন থাকব না তখন জীবনের কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে এগুলো তোর সহায় হবে। এগুলো তোর কাছে লুকিয়ে রাখ”।
ছোট্ট মেয়ে। গহনাগুলো খেলনার বাক্সে রেখে দেয়। আর সেটা দেখার মতো কৌতুহল না থাকাই স্বাভাবিক। পরের দিন নিতাই এর মায়ের গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটে। হঠাৎই হার্ট অ্যাটাক।কিন্তু নিতাই দয়াময়ীকে ক্ষমা করতেই পারে না। পারলৌকিক কাজ মিটলে নিতাই অবহেলার চোখে দেখে দয়াময়ীকে। আর এই অবহেলার মাশুল গুনতে হয় ঊর্মিকে। কী নিদারুণ দুঃখ ভোগ চলে মেয়েটার। দয়াময়ী হৃদয়হীন। এখন রোজ স্কুলে যেতে ও পারে না। এদিকে নিতাই সংসার থেকে পালিয়ে বেড়ায়। বারবার দয়াময়ীর অনুসন্ধান চলে কোথায় রাখা আছে শাশুড়ির গুপ্তধন। আর ঊর্মির অক্ষরে অক্ষরে মনে আছে সেদিনের ঠাগমার কথা গুলো। অনেক লেখাপড়া করতে চায় ঊর্মি। সামনের বছরে সে কলেজ যাবে। ঠাগমা চলে গেছে ছবছর হয়ে গেল। এখনও কাঁদে সে। গভীর রাত হলেই মনে পড়ে ঠাগমার কথা। ঠাগমা তাকে লেখাপড়া শেখাতে চেয়েছিল। আর এই মা তাকে দিন রাত কাজ করার কথা বলে।
নিতাই এর জ্ঞাতি সম্পর্কের ভাই বাইরে চাকরি করে। আর তার মাধ্যমেই দয়াময়ীর কানে আসে তার অফিসের কোন বড় বাবু বিয়ে করতে চায়। বয়স দুই কুড়ি পেরিয়ে গেছে। এখনও অকৃতদার। কোনও ঘরোয়া মেয়ের সন্ধান থাকলে বিনে পয়সাতে বিয়ে করবে। তবে তার বিরাট অবস্থা ব্যবস্থা।
দয়াময়ীর মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি জাগে। দেওরকে বলে “আমাদের ঊর্মি আছে তো। দেখশোন করো। অত বড়লোক পাত্র যখন। মেয়েটা ভালো থাকবে। আঠার বছর হল। উপরি উপরি দুটো মেয়ে। বিনে পয়সার ব্যাপার যখন চারহাত এক করো”।
যৌবনের দ্বারপ্রান্তে এসেই জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা শুনল ঊর্মি। কী বলছে এরা! ওর যে অনেক অনেক স্বপ্ন আছে। ঠাগমাকে কথা দিয়েছিল প্রচুর পড়া শোনা করবে। জীবনে একটা পরিচিতি থাকবে।
দয়াময়ী ফাঁদ পাতছে। টাকা পয়সার উপর মোহ প্রচুর। একবার যদি মেয়েটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাজী করানো যায় তবে বেশ কিছু টাকাও হাতিয়ে নেওয়া যাবে।
ফুড অ্যান্ড সাপ্লাই এর গেজেটেড অফিসার রজতাভ সান্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেন এর কাছে দানেশ শেখ লেনে থাকেন। জায়গাটা থেকে কলকাতা যাতায়াত সুবিধা। দ্বিতীয় হুগলী সেতু হয়ে এই এক সুবিধাও। ধর্মতলা পার্কস্ট্রীট যেতে সাত মিনিট লাগে গাড়িতে।
রজতাভ সান্যাল এর বয়স তেতাল্লিশ। প্রেসিডেন্সির ব্রিলিযান্ট স্টুডেন্ট। ফিজিক্স নিয়েই পড়েছেন। বাড়ির মানুষ বলতে হরি দা। রজতাভ সংসারের সব দায়িত্ব কাজের লোক হরিদার হাতে তুলে দিয়ে দিব্যি আছেন।
আজ মিহির বাবুর আসার কথা। মাধবপুরে থাকেন। খাদ্য দফতরের বৈদ্যবাটী শাখার দপ্তরী। ওর মাধবপুরের ওখানে একটা ঘরোয়া মেয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। আজ আসবেন আর মাধবপুরের বিরাট দীঘিতে মাছ ধরার লোভ সামলাতে পারলেন না। ছেলেবেলার দিন গুলো ত্রিবেণীতে কেটেছে। ওখানেই রজতাভ বাবুর মামার বাড়ি। বেশ কিছু জমি জমা পেয়েছেন মায়ের সূত্রে। এছাড়াও পৈতৃক সম্পত্তির পরিমাণ কম নয়। বাবা ছিলেন বি ই কলেজের প্রফেসর। সেইসূত্রে ই এখানে বাস।অবসরের পর সব টাকা একমাত্র পুত্রের জন্য গচ্ছিত রেখে গেছেন। তবে পুত্র পুত্রবধূ নিয়ে গুষ্টিসুখ তাঁরা করে যেতে পারেন নি সেটা রজতাভের কারণে। কলেজে পড়বার সময় কোন এক মেয়ের প্রেমে পড়েছিল। তাকে শেষ পর্যন্ত জীবনে না পাওয়ার কারণেই অকৃতদার এর সিদ্ধান্ত।
কিছুদিন আগে মায়ের বাৎসরিক কাজ মিটেছে। মনটা মাঝে মাঝেই হু হু করে মায়ের জন্য। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। আবেগ বড় হয়েছিল তার কাছে। মা কতবার বলেছেন “খোকা!আমার কত স্বপ্ন ছিল ঘটা করে বিয়ে দেবো তোর। আমার বংশধর আসবে। আধো আধো বুলিতে মুখরিত হবে আমার ঘর”। রজতাভ সান্যাল এসবের গুরুত্ব দেন নি। তবে মৃত্যুশয্যাতে মাকে কথা দিয়েছিল সে বিবাহ করবে। আর সেটা হবে খুব সাদামাটা। বাহুল্য থাকবে না। ঘরোয়া কোনও গ্রামের একেবারেই ভোলাভালা কেউ। কেতাদুরস্ত হলে চলবে না।
ঊর্মি সরাসরি তার মাকে জানিয়েছে তারপক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়। বাবাকে বলে “আমি উচ্চশিক্ষা লাভ করতে চাই। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই “। নিতাই বলে “এ তো খুব ভাল কথা। সেটাই করো”। বাপবেটির এমন কথাতে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে দয়াময়ী। মনে মনে বলে “পড়া বার করছি। “ কথাতেই আছে। তোকে হাতে না মেরে ভাতে মারব। শুরু হল দয়াময়ীর অভিনয়। কত রকমের অসুখের বাহানা করতে লাগল। আর সংসারের সব কাজ ঊর্মির উপরে ন্যস্ত করতে লাগল। পড়তে বসলে ই ফরমাশ। ঊর্মির বুঝতে বাকি থাকল না তার মা আসলে কী চায়। কাকে বলবে সে এই অত্যাচার এর কথা! বাবাকে বললে বাবার উপরে অন্য রকম নির্যাতন নেমে আসবে। জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সব কাজ করে পড়ার সময়ই ক্লান্তি আসে। মনে হয় ঘুমায়। হাই ওঠে। রাতের অন্ধকারে মা বাবাকে বলতে থাকে “সবসময়ই ঘুম। ওর লেখাপড়াতে মন নেই। বিরাট অফিসার পাত্রের খোঁজ দিয়েছে মিহির ঠাকুর পো। তোমার মেয়েটাকে ভেবে খেতে হবে না। পায়ের উপর পা তুলে থাকবে। বিরাট অবস্থা ব্যবস্হা। বয়স টা একটু বেশি। তাতে কী! ওটুকু মানিয়ে নিতে হয়। “
নিতাই বলে “তাহলে তো খুব ভাল কথা। কিন্তু আমি কি পারব অত বড়লোক কুটুম করতে”? দয়াময়ীর আনন্দ জাগে। নিতাই কে বোঝাতে থাকে এক পয়সা লাগবে না। ঊর্মিকে দেখে পছন্দ হলে ই ব্যাস!” নিতাই বলে “মিহির যখন সম্বন্ধ এনেছে তখন নিশ্চিত ভালো হবে। ছোট্ট থেকেই চিনি। মানুষ বড় খাঁটি। আর হ্যাঁ!কত বয়স পাত্রের?! দয়াময়ী আমতা আমতা করে বলে “ওই একটু বেশি। তেমন কিছুই না!” মাধবপুরের “বড় সরকার “শুধুই পুকুর বলা যাবে না। বরং দীঘি বলা যায়। এই গ্রামের দুটো পুকুর। দুটোই সরকার দের। ওদের কোন পূর্বপুরুষ ভগবানের স্বপ্নাদেশ পেয়েছিল। তারপর অনেক সম্পদের মালিক হয়েছিল। ঠাগমার মুখে সরকার দের অনেক গল্প শুনেছে ঊর্মি। তখন সন্ধ্যার সময়ই গল্প হোতো ঠাগমা নাতনীতে। ঠাগমা বলত কার কপালে কী যে আছে কেউ বুঝতেই পারে না। সব নাকি ভগবানের ইচ্ছে।
সকাল তখন দশটা। জলখাবারের বাসনকোসন নিয়ে ঊর্মি বড় সরকারে গেল। কিন্তু আজ বেশ বিমর্ষ সে। নারকেল ছোব দিয়ে বাসন গুলো মেজে জলে ফেলতে ই একটা আওয়াজ পেল “আ! আস্তে!” অবাক হয়ে গেল ঊর্মি। এই লোকটা আবার কে? ঊর্মির অবাক ভাব দেখে লোকটা বলল “জলে ঢেউ উঠলে মাছ পালিয়ে যায়।”
লোকটার আবভাব দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল ঊর্মি। বলল “এত্ত বড় একটা লোক আবার ওরকম করে কথা বলে কেউ? “ লোকটা ঊর্মির দিকে চেয়ে রইল। মনে মনে ভাবতে লাগল মেয়েটার চোখের দৃষ্টি ভারী অদ্ভুত। খুব সাধারণ মেয়েটার মধ্যেই কোথাও যেন অসাধারণত্ব লুকিয়ে আছে”। লোকটা ই কথা বলল। “ইসসস! খুব হাসছ দেখি? কখনও মাছ ধরেছ তুমি”। চোখ বেঁকিয়ে তাকাল ঊর্মি। বলল “আপনার মতো ওরকম ছিপের দিকে তাকিয়েই থাকি না আমরা। “বলতে গিয়ে অসাবধানে পা পিছলে গেল উর্মির। বাসনকোসন নিয়ে পড়ে গেল জলে। ঘটনার আকস্মিকতাতে লোকটি ও হতভম্ব। সে ও সাথে সাথেই ঝাঁপ দিলে।
রজতাভ মেয়েটাকে তুলে আনলেন জল থেকে। সত্যিই মেয়েটার খুব লেগেছে। বেশ কিছুটা জল খেয়ে ফেলেছে। রজতাভ র বলিষ্ঠ হাতের মধ্যেই ও কাঁপছিল। ডাঙাতে তুলে যখন এক জায়গাতে বসালো তখন উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগল ঊর্মি। পরম মমতাতে মেয়েটার মাথাতে হাত দিয়ে রজতাভ বললে “এখন আর কান্না নয় একদম।” কিন্তু রজতাভ দেখল মেয়েটার ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে। অস্থির হয়ে উঠল রজতাভ। বলল”ইসসস!অনেক টা কেটে গেছে। কাটল কী করে”। ঊর্মি এতক্ষণ কথা বলে নি। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে রলল” আমার বাসন কোসন কোথায়? সব ভেসে গেল বুঝি!তাহলে তো মা মারবে আমাকে”।
রজতাভ সান্যাল যেন কার নির্দেশ মেনে এই মেয়েটার সব কথা শুনেই চলেছে। জলে নেমে বাসন গুলো খুঁজে দিল। একটা নিদারুণ মায়া তার হৃদয়ের গভীর স্পর্শ করল। ভিজে কাপড়ে মেয়েটার ফুলের মতো সৌন্দর্য আর ও দ্বিগুণ হয়ে গেছে। মেয়েটার মুখে শিশুর সারল্য। তবে কি রজতাভ এই মেয়েটার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ল। দুজনেই দুজনের দিকে চেয়ে রইল। এরপর সচকিত হল ঊর্মি। আশপাশের কেউ দেখলে আর রক্ষা নাই। নিস্তরঙ্গ গ্রাম্য জীবন। সামান্য কে অসামান্য করে দেয়।আর দয়াময়ী জানলে তো কথাই নেই। কাঁসার বাসনে ঠোঁট কেটেছে উর্মির। এমন তো ওর কতবার হয়। কাঠের উনানে রান্না করতে গিয়ে কতবার হাতে তাপ লাগে। কেউ তো উদ্বিগ্ন হয় না কখনও। তাহলে ওই লোকটা অমন করছিল কেন! আর আজ তার মা দয়াময়ীর আজ এত উদ্বেগ তার কাটা ঠোঁট দেখে। কেন এমন ভোলবদল হঠাৎ করে।
বাড়িতে মিহির কাকা এসেছে। চা খাচ্ছে। দয়াময়ী হেসে বললে “একেবারে চান করে এলি বুঝি” উর্মি এখন সব কথা সবাই কে বলেনা। শুধুই ঘাড় নাড়ে। মিহির কাকা বলে “ঊর্মির মুখখানা খুব সুন্দর “।
ঘরে ঢুকে উর্মির ভাবান্তর ঘটে। বারবার মনে পড়তে থাকে ওই পুকুরের ঘাটের লোকটাকে। কত ভালোবাসছিল ঊর্মিকে। কী সুন্দর দেখতে। তবে যখন জল থেকে তুলে আনছিল ঊর্মিকে তখন ঊর্মি দেখেছে কানের কাছে লোকটার চুলপাকা। তার মানে বেশ বড় লোকটা। আজ ঊর্মির কপাল খুব ভালো। দুপুরের খাওয়ার সময় ওকে অত খাতির কেউ করে না। আজ সবকিছুই অন্যরকম । মাছের বড় পিসটা ওকে দেওয়া হয়েছে। ঠোঁট কেটে গেছে বলে কষ্ট প্রকাশ করছে দয়াময়ী। খাওয়ার পর ওকে ঘুমাতে বলা হল। বললে “ঊর্মি একটু ঘুমিয়ে নে। বিকেলে তোকে দেখতে আসবে”।
দুপুরের ঘুমে ঊর্মি স্বপ্ন দেখে। ঠাগমা এসে ওর ঠোঁটে ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছে। আর একটা সুপুরুষ কোন দেশের রাজা এসেছে। ঠিক ওই ঘাটের লোকটার মতো দেখতে। ঠাগমার গয়না পরেছে ঊর্মি। আর রাজা বলছে “চলো ঊর্মি। চলো!এখানে থেকো চলো”।
মিহিরের বাড়িতে এসে বড় সরকার এ মাছ ধরতে গিয়ে কী কান্ড টাই না হল। কিছুতেই ভুলতে পারা যাচ্ছে না মেয়েটার মুখটা। কোনও নারী শরীরের স্পর্শ এতটা উতলা করতে পারে জানা ছিল না রজতাভের। সেই কম্পিত ঠোঁট, সেই অসহায় চাহনি। কান্না ভরা চোখের অদ্ভুত আবেদন। জানালার কাছে এসে একটা সিগারেট ধরাল রজতাভ।
আবার অন্য চিন্তা গ্রাস করল। ছি ছি। মেয়েটার জন্য এমন চিন্তা আসছে কেন! অনেক অনেক ছোট্ট যে। মিহির বাবুকে যে জিজ্ঞেস করবে কে ওই মেয়েটা তার উপায় নেই। কী এখন ভেবে বসবে। আচ্ছা! মেয়েটার ঠোঁট টা কেমন আছে! ওর মা ওকে মারবে বলছিল। কেন যে বলছিল! এই সব নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল রজতাভ সান্যাল এর মাথায়।
এদিকে বিকেল চারটে বাজল। দয়াময়ী স্নেহ পরিপূর্ণ স্বরে ডাকছে “ও উর্মি! ঘুমের ঘোরে কী বলছিস বল দিকি। ওঠ! তোকে দেখতে আসবে। বিরাট ঘর বর হবে তোর। নে এই শাড়িটা পর। সুন্দর করে চুল বাঁধ। ওঠ বলছি”।
মেয়েটার গায়ে হাত দিয়েই দয়াময়ী বুঝতেই পারল ধূম জ্বর । আর কোথায় যায়। লোকদেখানো মাতৃত্ব হটে গিয়ে বেরিয়ে এল কামটের মতো মুখ। আবার সেই ভাষা ‘,সাধে কি আর তোকে অলক্ষ্মী বলি! আজ পাত্র নিজে বলির পাঁঠা বাছতে আসবে , আর আজ ই জ্বর বাঁধানো। আর গেলি তো পুকুর ঘাটে বাসন ধুতে; তবে ঠোঁট কী করে কাটলো! তোমার মেয়ে সোয়াগী বাপ তো বলে তুমি নাকি শান্ত শিষ্ট লেজবিশিষ্ট। আমি নাকি শাঁখের করাত!তোমাকে যেতে ও কাটি, আসতে ও কাটি। তোর বাপ তো তাই বলে। বল!সত্যিটা বল!”
নিতাই অবাক হয়। ঊর্মির নীরবতা তাকে ও রাগান্বিত করে। কাছে গিয়ে বলে “মাকে উত্তর দিচ্ছিস না কেন?” ঊর্মি কিছুই বলে না। নিতাই বলে “তোমার মা বলে বটে তোমার অবাধ্যতার কথা। আজ দেখছি তোমার মা সঠিক “। দয়াময়ী আজ চরম উৎসাহ পেয়ে গেছে। উত্তেজিত করছে নিতাই কে। আর নিতাই প্রচন্ড রেগে মেয়েটার গালে একটা চড় মেরেছে। বলেছে “আমি মিষ্টির দোকানে যাচ্ছি। এখনই শাড়ি পরে চুল বেঁধে নে।
নিতাই বেরোতে যাবে তখনই দেখে একটা বড় গাড়ি এসে দাঁড়াল। পাত্র রজতাভ সান্যাল হাজির। সাথে মিহির। মিহির এগিয়ে আসতেই দয়াময়ীর হাসি ধরে না। নিতাই স্পষ্ট শুনতে পায় দয়াময়ীর সাথে মিহির এর কথোপকথন “আমাদের বখরা যেন ঠিক ঠাক থাকে”।
নিতাই পাত্রের দিকে তাকাল। বেশ সুন্দর। তবে অবাক কান্ড। এর সাথে তার দুধে বালক মেয়েটার বিয়ে কী করে হবে। বড়লোক হলেও বয়স টা দেখতেই হবে। ভীষন ভুল হয়েছে আজ। কান্নাটা দলা পাকিয়ে গলার কাছটা চেপে ধরেছে। মনে মনে মা মরা মেয়েটাকে বলছে “আজ বড় অন্যায়ের কাজ করে ফেললাম মাগো! বাপটাকে পারিস তো ক্ষমা করিস।”
আজ হঠাৎ করেই ছোট্ট ঊর্মির খোলস থেকে বেরিয়ে এল আর এক ঊর্মি। এই ঊর্মি অনেক পরিপক্ব হয়ে উঠেছে সংসারের নানা ঘাত প্রতিঘাতে। এতদিন বাবাকে তার পায়ের বেড়ি মনে হয়েছিল। মনে হোতো অন্তত বাবা তাকে ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু আজ অন্যরকম একটা অনুভূতিতে তার হৃদয়ের মধ্যেই কে যেন বলতে লাগল “কেন পড়ে আছিস এমন করে!তোর কত স্বপ্ন। সব এরা গলা টিপে মেরে দেবে। তার স্কুলের অনীতাদি কতবার বলেছেন “শোন ঊর্মি! প্রতিকূল অবস্থাতে ও মনের জোর হারালে চলবে না”।
আজ একটা সিদ্ধান্ত নেবে ঊর্মি। তার জীবন নিয়ে কাউকেই খেলতে দেবে না। অনেক হয়েছে। লাল শাড়িটা সুন্দর করে পরল আজ। না। চুল সে বাঁধবে না। বিরাট চুলের সম্ভার নিয়েই সে যাবে। তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য থাক। কাজল পরল ঊর্মি। ভীষন সুন্দরী সে। আয়নাতে দেখলো নিজেকে। তারপর দরজার দিকে এগোতে যাবে সেই মুহূর্তেই তার বাবা হাজির। বলল “একদম যাবি না। আমি বলছি। এসব তোর মায়ের চক্রান্ত। পয়সার লোভে এই বিয়ের প্রস্তাব এনেছে”।
মৃদু হাসল ঊর্মি। তারপর শুনতে পেল দয়াময়ীর ডাক। বললে “আয় ঊর্মি। বাবাজীবন তোকে দেখবে যে মা”। একটা চেয়ারে বসেছিল রজতাভ সান্যাল। উর্মি ধীর গতিতে প্রবেশ করল। বাবা নিতাই তাকে মায়ের চক্রান্তের কথা বলেছে। না বলে দিলেও ঊর্মির অজানা নয়। সামনের একটা চেয়ার ঊর্মির জন্য। ঊর্মিকে দেখে চমকে উঠল রজতাভ। আরে! সেই পুকুরে বাসন ধুতে যাওয়া মেয়েটা না!
রজতাভ এই মুহূর্তে কিছুই প্রকাশ করল না। বলল “আপনার নাম কী”? ঊর্মি এবার চমকে উঠল। চোখ মেলে দেখল সেই লোকটা। গলাটা শুনেই বুঝতে পেরেছিল। ঊর্মি ইশারা করল যেন। রজতাভ জানে গ্রামীণ সংস্কৃতিতে মেয়েটা ভীষণ অন্তর্মুখী। ঊর্মির জবাব এল “আমার নাম ঊর্মিলা “। রজতাভ সান্যাল কী যেন একটা বুঝে গেছে। তবুও আড়ষ্ট ভাব কাটাতে আবার প্রশ্ন করল “বলুন তো। ঊর্মিলা কে ছিলেন?” ঊর্মির স্পষ্ট জবাব “মহাকাব্যের চরিত্র। লক্ষ্মণের স্ত্রী। রাম সীতার সাথে চোদ্দ বছরের জন্য বনবাসের গেলে ঊর্মিলা ব্রহ্মচর্য পালণ করেন। স্বামীর অনুপস্থিতিতে খড়ের বিছানাতে ঘুমাতেন। আদর্শ ভারতীয় নারী এমন ই”।
ভীষণ খুশি হল রজতাভ সান্যাল। বেশ বুদ্ধিমত্তা আছে মেয়েটার। দয়াময়ীর আহ্লাদ আর ধরে না। ঝানু দয়াময়ীর বুঝতে বাকী নেই যে পাত্রের মন বসেছে ঊর্মির উপর । রজতাভ সান্যাল মিহির বাবুকে বলল “আমার পাত্রী দেখা হয়ে গেছে। পাত্রী অত্যন্ত গুণী মেয়ে। তবে বিয়ের মতো এতবড় একটা সিদ্ধান্ত আমি পরে জানাচ্ছি”।
পাত্র চলে যেতেই বাড়ির মধ্যে ঝড় উঠল। নিতাই চিৎকার করে। কিছুতেই সে এখানে মেয়েটার বিয়ে দেবে না। এদিকে মিহির বলে গেছে কুড়ি হাজার টাকা ঘটকালি বাবদ আদায় করবে সে। বিশাল এক যুদ্ধ চলে যেন নিতাই আর দয়াময়ীর। আর মনে মনে দৃঢ় হতে থাকে ঊর্মি।
সন্ধ্যার মুখে মিহির এলো। দেখলে নিতাই মুখ ভার করে বসে আছে। মিহির বুঝতেই পারল সে অন্যায় করে ফেলেছে। সত্যিই তো। মেয়েটার কথা একবার ভাবে নি। মিহির কে দেখে দয়াময়ী ছুটে এল। আগ্রহের সাথেই বলল “কী হল খবর!রাজি তো?”
মিহির আড়চোখে একবার নিতাই এর দিকে তাকাল। তারপর বলল “স্যার আমাদের ঊর্মির অনেক প্রশংসা করেছেন। আর বলেছেন ঊর্মির লেখাপড়ার দায়িত্ব উনি নেবেন। সবরকম দায়িত্ব নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন “। নিতাই এবার সচকিত হয়ে উঠল। দয়াময়ী উত্কণ্ঠার সাথে বললে “আর বিয়ের কী হবে?” মিহির মাথা নাড়ে। সেটা সম্ভব নয়। ঊর্মি বড় ছোটো।”
ওদের মধ্যে সব কথা শুনতে লাগল আর একজন। দয়াময়ীর আনন্দ ধরে না। বললে “তাহলে কত টাকা দেবে!” আর ঊর্মি এইসব শুনে আর অপেক্ষা করলে না। দরজা বন্ধ করলে।
রজতাভ সান্যাল মিহির এর বাড়িতে রাতটা কাটিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে। সারারাত ঊর্মির কথাগুলো ভাবছিল সে। কী যেন একটা বলল মেয়েটা। ভারতবর্ষের নারীদের কথা। ঊর্মিলা তার যৌবন কাটিয়েছে ব্রহ্মচর্যে। কেন বলল! ও কি কিছু বলতে চায়। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।
পরের দিন সকাল থেকেই ঊর্মির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। নিতাই চারদিক খুঁজছিল। দয়াময়ীর চিন্তা বাড়তে লাগল। কোথায় গেল মেয়েটা। ঘরের মধ্যেই একটা বাক্স নজরে এল দয়াময়ীর। জিনিস গুলো এলোমেলো। কিছু খেলার সামগ্রী। নিতাই বাক্স দেখে চিনতে পারল। এটা তার মায়ের গহনার বাক্স।
দয়াময়ীর আস্ফালন দেখে কে। শালীর বেটি ঠিক গয়না গুলো নিয়েই পালিয়ে গেছে। আজ ওর একদিন কী আমার একদিন। দয়াময়ীর একূল ওকূল দুকূল গেল। অক্ষমের শক্তি চিৎকার। আর ঊর্মি। সে শুনে নিয়েছে পৃথিবীর একজন মানুষ তাকে ভালোবাসছে। ভালোবাসা কারে কয় ঊর্মির জানা ছিল না। আজ তার মনে হয়েছে ওই যে চুল পাকা ওর থেকে অনেক অনেক বছরের বড় ওই পুকুরের ঘাটের লোকটা ওকে ভালোবাসবে। টাকা আনা পাই এর হিসাবে নয়। সত্যিকারের ভালোবাসা। ও তো ঊর্মিলা। ভারতীয় নারী। রামায়ণ এর ঊর্মিলার তো যৌবন ব্রহ্মচর্য তে গেছে। ও কেন পারবে না।
রজতাভ সান্যাল এর গাড়ি পাকা সড়ক এ উঠল। বারবার মনে হচ্ছিল ঊর্মির সাথে একবার দেখা করার। এদিক ওদিক তাকাল। একটা মেয়ে দূর মাঠ ভেঙে ছুটে আসছে। রজতাভ সান্যাল অবাক হল। ও কী ঊর্মি! দাঁড়িয়ে গেল গাড়িটা। মেয়েটা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসে হাঁপাচ্ছে তখন। রজতাভ সান্যাল এগিয়ে এসে বলল “কী ব্যাপার ঊর্মি। কিছু বলবে”!
ঊর্মির চোখের জল বাধা মানে না। গহনাগুলো এগিয়ে দেয় রজতাভ সান্যাল এর দিকে। রজতাভ বলে “কী এগুলো!কেন এনেছ এসব। এগুলো গহনা তো। আমার কী প্রয়োজন!”
কথা বলার শক্তি নেই মেয়ের। শুধুই বলল”এগুলো আমার ঠাগমা আমাকে দিয়ে গেছে। আমি আপনাকে দিতে চাই “। পিছন থেকে আওয়াজ এল “দিয়ে দ্যাখ একবার। ভেবেছিস কী!দে বলছি। গহনাগুলো দে”। প্রকাশ্যেই গালিগালাজ করতে থাকে দয়াময়ী। রজতাভ সান্যাল সমস্ত গহনা দয়াময়ীর হাতে তুলে দিয়ে বলে “আমি এই হীরেটাকে নিয়েই চললাম। “ সবাই চুপ। মাধবপুরের ঊর্মিকে রজতাভ সান্যাল তার গাড়িতে তুলে নেয়। আর একটা কোকিল কোথা থেকে যেন গান গায়। রজতাভ সান্যাল খুব খুশি। মাকে মৃত্যুশয্যাতে কথা দিয়েছিল যে। চায়ের দোকানে গান বাজছিল “ভালোবাসি ভালোবাসি”।