“আম জাম কলা শসা /রাত্রিবেলা মুন্ডু খসা -এই ছড়াটির সঙ্গে কেউ পরিচিত আছেন কিনা জানিনা , তবে খুব সম্ভবত , এই প্রবাদটির মাধ্যমে ‘অতিদানে বালি বধ্য ,অতি মানে চ কৌরবা ‘জাতীয় বার্তা পৌঁছনোর চেষ্টা হয়েছিল, অর্থাৎ , অতিরিক্ত কোনকিছুই ভাল না, ফল বেশি হলে তার ফলও বিষময় , ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে অল্পবিস্তর ভাবে ফল সকলের জীবনেই জড়িত , ফল কেউ পছন্দ করুক না করুক। বলতে গেলে , শিশুশিক্ষার প্রথম ধাপ শুরু হয় এ ফর অ্যাপেল দিয়ে ! এবং কী আশ্চর্য সমাপতন , মানুষের আবির্ভাব ও বিস্তারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক আপেল খন্ড । মানব সভ্যতার যে অত্যাশ্চর্য্য অগ্রগতি , তার সঙ্গেও অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত নিউটনের সেই বিখ্যাত আপেল পতনের কাহিনি। তেমনি আরেক বহুচর্চিত ফল হল আঙ্গুর। শেয়াল আর আঙ্গুর ফলের গল্প কে না জানে ! তবে আপেল আর আঙুর ঠিক বাঙালীর ঘরের ছেলে নয় ,বরং মহার্ঘ্য বলে এক সময়ে শুধু রোগীর পথ্য হিসেবে এরা ধার্য ছিল।
বাঙালীর অনেক বেশি প্রিয় আম এবং কলা। প্রথমটি মরসুমি ফল হিসেবে বাঙালীর রসনা তৃপ্ত করে শীতকালের কমলালেবুর মতোই ,আর ‘রণে বনে জঙ্গলে ‘ বাঙালীকে পরিত্রানের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এই ফল, কিছুকাল আগেও বাঙালী মধ্যবিত্তের টিফিন ও পিকনিকের সঙ্গী ছিল । তবে বাঙালী সেন্টিমেন্টের সঙ্গে যেমন জড়িয়ে আছে আম, মারাঠি, বিশেষত নাগপুরের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল কমলালেবু।
দুটি ঘটনা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। সময়টা ছিল ডিসেম্বর , ক্রিস্টমাসের আগে I কমলালেবুর শহর থেকে কিছু লেবু সওদা করে কলকাতায় নিয়ে আসবো, এরকম ইচ্ছে প্রকাশ করতেই আমার সারথি আমায় নিয়ে গেলো ‘হোলসেল মার্কেটে ‘I সেখানে বিক্রেতা ছোকরা পেল্লায় এক ঝুড়ি কমলা আমায় গছিয়ে দেবে বলে নাছোড়বান্দা I বহু কষ্টে তাকে নিবৃত্ত করে বললাম, অত ওজন আমি বইতে পারবো না হাওয়াই জাহাজে I আমার উৎসাহের অভাব দেখে সে বেশী পীড়াপীড়ি করলো না, ছোট একটা বাক্স বেঁধে দিলো ভালো করে I কিন্তু আবার বলে দিলো , ” আপনি নিতেই পারতেন I ইয়ে অরেঞ্জ সিটি হ্যায় , অরেঞ্জকে লিয়ে কোই কুছ নেহি বলেগা !”
যাই হোক, এয়ারপোর্ট চত্ত্বরে ঢোকার আগেই বন্দুকধারী সান্ত্রী মশাই আমার পেটিখানি দেখে বললেন, ‘এটিকে স্ক্যান করাতে হবে ‘I স্ক্যান পরীক্ষায় বাক্সটি সসম্মানে উত্তীর্ন হওয়ার পরে সান্ত্রী মশাই বললেন , ‘ইসমে অরেঞ্জ হ্যায় – চেক ইন মে মত দেনা – খুদ ক্যারি করনা ! ‘ পরামর্শমত চলে গেলাম হ্যান্ড লাগেজ ওজন করাতে – দেখা গেলো – হ্যান্ড লাগেজের ওজন সামান্য একটু বেশী -কাউন্টার যুবতী কিন্তু এনকাউন্টার করলেন না I উল্টে, সহাস্যে বললেন , “ইস দেয়ার অরেঞ্জ ইনসাইড ? ” আমি সম্মতি প্রকাশ করতেই তার সবুজ সংকেত , ” ইউ কান ক্যারি ইট !” সুতরাং বোঝা গেলো – সেই দোকানিটি ঠিকই বলেছিলো , অরেঞ্জ হচ্চ্ছে নাগপুরের ওই যে আজকাল বলে না , অস্মিতা কী স্বাভিমান বা ভাবাবেগ -ওই জাতীয় কিছু একটা I অনেকটা বাঙালীর রসগোল্লার মত – তবে কমলালেবুর পেটেন্ট নেয়া যায় কিনা জানি না ! কমলালেবু নিয়ে একটু লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা বলি , আমার আফ্রিকা প্রবাসের সময়ে। আমি তখন আফ্রিকার দক্ষিণে , বতসোয়ানা নামক দেশে থাকি। তার রাজধানী হ্যাবরনিতে এমনিতে হাট বাজার বলে বিশেষ কিছু নেই – আছে শুধু শপিং মল। তবে মলের সামনে অনেকসময় ভ্রাম্যমান বিক্রেতারা এটা সেটা বিক্রি করে। কোনো এক সপ্তাহান্তের বাজারে, এমনি এক অরেঞ্জ অরেঞ্জ হাঁক পাড়া এক বিক্রেতার কাছ থেকে গোল গোল কমলালেবু ‘দেখতে পেয়ে কিনে নিলাম এক ডজন। বাড়িতে গিয়ে দেখি- কমলালেবু কোথায় -এ তো মুসম্বি !ঠেকে শিখলাম , কমলালেবু কে ওরা বলেন narjaris আর আর অরেঞ্জ হল মুসম্বি!
এমনিতেও ফল চিনে কিনতে পারা খুব সহজ নয়। সঠিক ধরনের ফল চেনার জন্য বাড়ির গৃহিনীর নানাবিধ সদুপদেশ , যেগুলো কর্ণকুহরে প্রবেশ করেও বেরিয়ে যায় , সেগুলো আত্মস্থ করতে পারলে কী হত জানি না, তবে একবার এক তরমুজওয়ালা আমাকে খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিল, “কাকা বেশি লাল তরমুজ কিনবেন না ওতে ইনজেকশন দেওয়া থাকে !”
তরমুজের কথাই যখন উঠল, গল্পের ঝাঁপি খুলি আবার। এক সরকারি বিভাগে একটি আদ্যোপান্ত একাডেমিক ছেলেকে প্রায়ই তার ব্যাচমেটরা প্রায়ই উপহাস করত, কারণ দশ বছর চাকরি করেও সুপথে কুপথে সম্পদশালী হতে পারে নি। কিন্তু ছেলেটি কিছুদিন বাদেই একটি আন্তর্জাতিক শিক্ষাক্রমে জাপান গেল গোটা তিন বছরের জন্য। ফিরে এসে তার বিস্ময় আর থামে না , “আমার হয়ত ওদের মত পয়সা নেই, কিন্তু টোকিওতে আমি চৌকো তরমুজ দেখেছি-ওরা কি দেখেছে ?” গুগলপূর্ব দুনিয়ার গল্প এটি , জানি না, এখনো এত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ছেলেটি এই উদাহরণ দিতে পারত কিনা !
তবে বিশ্বায়ন পরবর্তী ভারতে, শহুরে মধ্যবিত্তের চোখের সামনে হরেক কিসিমের ফল হাজির হয় শপিং মলগুলোতে। নিউ মার্কেটের মধু ডোবানো লাল লাল চেরি ফলকে পেছনে ফেলে হাজির হয়েছে কিউই , এপ্রিকট , ড্রাগন ফ্রুট, আরো কত নাম না জানা ফল। একবার এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোককে দেখছিলাম তাঁর বাবাকে কোন এক শপিং মলে ঘুরে ঘুরে ফল গুলো দেখাচ্ছেন – এই দেখ ফুজি আপেল, দারুন স্বাদ এগুলোর ! পুত্রগর্বে গর্বিত , নিতান্তই মধ্যবিত্ত বাবার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, ” বাবলু , চাইনিজ আপেল নাই রে?”
সেই বাবার কথা বোধহয় চাইনিজ ওয়াল ভেদ করে চলে গেছে সদরদপ্তরে, তাই এক সাদা আর হলদে রঙের চীনে তরমুজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভারতের বিভিন্ন বিপনীতে।
কলা এবং পেয়ারা এই দুটি ফল কিঞ্চিৎ আদিরসের ছোঁয়া জড়ানো কয়েকটি উপকথার বিষয়বস্তু , আপেলের আদিম পাপের গল্পকে তারা তফাৎ রাখতে পারে। তবে সেসব গল্প এইখানে কহতব্য নয় , রসিক জনের স্মরণে আনার মহান কর্তব্যটি করলাম , এই যা।
শেষ করি কমলাকান্তের দপ্তরের ‘মনুষ্যফল ‘ দিয়ে। দেশের বড়মানুষদের কাঁটাল , সিবিল সার্ভিসের সাহেবদের আম , ও নারীজাতিকে নারকেলের সঙ্গে তুলনা করার থেকেও আমার পরম প্রিয় শিমুলফলের প্রসঙ্গটি। কমলাকান্তের জবানিতেই সেটি উল্লেখ করা যাক- -“এ দেশে এক জাতি লোক সম্প্রতি দেখা দিয়াছেন, তাঁহারা দেশহিতৈষী বলিয়া খ্যাত। তাঁহাদের আমি শিমুল ফুল ভাবি। যখন ফুল ফুটে, তখন দেখিতে শুনিতে বড় শোভা—বড় বড়, রাঙ্গা রাঙ্গা, গাছ আলো করিয়া থাকে। কিন্তু আমার চক্ষে নেড়া গাছে অত রাঙ্গা ভাল দেখায় না। একটু একটু পাতা ঢাকা থাকিলে ভাল দেখাইত; পাতার মধ্য হইতে যে অল্প অল্প রাঙ্গা দেখা যায়, সেই সুন্দর। ফুলে গন্ধ মাত্র নাই—কোমলতা মাত্র নাই, কিন্তু তবু ফুল বড় বড়, রাঙ্গ রাঙ্গা। যদি ফুল ঘুচিয়া, ফল ধরিল, তখন মনে করিলাম, এই বার কিছু লাভ হইবে। কিন্তু তাহা বড় ঘটে না। কালক্রমে চৈত্র মাস আসিলে রৌদ্রের তাপে, অন্তর্লঘু ফল, ফট করিয়া ফাটিয়া উঠে; তাহার ভিতর হইতে খানিক তূলা বাহির হইয়া বঙ্গদেশময় ছড়িয়া পড়ে!” এ লেখাটি বোধহয় আজকের দিনে আরও অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক – বঙ্গদেশের জায়গায় ভারতবর্ষ পড়লেও অনুচ্ছেদটি সমান সত্যি !