মানসিক দূষনের ইনকোয়েস্ট
মৃনাল কান্তি বাগচী
আজ সকাল থেকে দুর্গাপুর মহকুমা অফিসের ডেপুটি মেজিস্ট্রেট অলোকেন্দু মুখার্জী সাহেবের মেজাজ ভীষন ফুরফুরে। অনেকদিন পর আজ বাড়িতে বিশ্রামে থাকবেন। রোজই তাকে আফিস করতে হয়। রোজ রোজ অফিস করতে তার আর ভালো লাগছেনা। ডব্লিউ বি,সি,এস ( এক্সিকিউটিভ),ছাড়া অন্যান্য সকল কর্মচারীগন শনিবার, রবিবার বা অন্যান্য সরকারী ছুটির দিন ইচ্ছে মত উপভোগ করতে পারেন, কিন্তু এক্সিকিউটিভ অফিসারদের এই সুযোগ নাই বললেই চলে। গতকাল Subdivisional Magistrate সাহেবকে মৌখিক ভাবে মুখার্জী সাহেব জানিয়েছিলেন আজ রবিবার তিনি কোয়ার্টারেই ছুটি কাটাবেন,Subdivisional Magistrate সাহেব সন্মতিও দিয়েছেন, সেই অনুসারে মুখার্জী সাহেব আজ ভালো খাওয়া দাওয়ার প্ল্যান করেছেন।
ডব্লিউ বি, সি, এস ( এক্সিকিউটিভ ) অফিসারদের একটি বড় সমস্যা ,তারা অন্য সকল মানুষদের পরিষেবা দিতে গিয়ে নিজের পরিবার, আত্মীয় স্বজনদের প্রতি অনেক দায়িত্ব পালনই করতেই পারেন না। তাই ইচ্ছা থাকলেও অনেক কিছু তাদের বিসর্জন দিতে হয়। মুখার্জী সাহেবের স্ত্রীর হৃদরোগে অকস্মাৎ বিয়োগ হওয়াতে ছোট মেয়েকে নিয়েই সরকারী কোয়ার্টারে থাকেন।
কাজের চাপে অনেক কিছুই তাকে বিসর্জন দিতে হয়েছে, তদুপরি রক্তে সুগার ও কোলেস্টেরল আধিক্য দেখা দেওয়ায় খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রেও তার প্রচুর বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে।
তা সত্বেও গতকাল রাতে মুখার্জী সাহেব স্হির করেছেন আজ রবিবার নিজেই বাজার থেকে খাসীর মাংস ও বড় ইলিশ মাছ নিয়ে আসবেন। সেই অনুসারে ঘুম থেকে ওঠেই তিনি বাজারে চলে গেলেন। বাজার থেকে বড় সাইজের একটা ইলিশ ও এক কিলো খাসীর মাংস নিয়ে বাড়িতে আসলেন। তিনি রান্নার মাসী মীরাকে ভালো করে রান্না করতে বললেন।
আর নিজে স্নান করে খবরের কাগজ নিয়ে পড়তে বসলেন।
খবরের কাগজ পড়ার শেষে চোখ বুজে অতীত স্মৃতিতে তিনি ডুবে গেলেন। মুখার্জী সাহেবের মাছ ,মাংস ভীষন প্রিয়, বিশেষ করে খাসীর মাংস ও ইলিশ মাছ, স্ত্রী বেঁচে থাকা কালীন কত যত্ন করে রেঁধে খাওয়াতেন, আজ সে সব অতীত, মন চাইলেও অনেক কিছু আর সম্ভব হয়না। তবুও অনেকদিন পর দুপুর বেলা মেয়ের সঙ্গে বসে ভালো মন্দ খাওয়া যাবে এই ভেবে আনন্দে ফুর ফুরে মেজাজে রয়েছেন তিনি ।
ইচ্ছে করলেই সব ইচ্ছে পূরণ হয়না, কেননা তিনি দেখলেন হঠাৎ তার মোবাইল ফোন বাজছে, দেখেন ফোন করেছেন, Sub Diversional Magistrate সাহেব নিজেই, তিনি জানালেন একজন অস্বাভাবিক মৃত মহিলার জরুরী ও গুরত্বপূর্ন Executive Magistrate inquest আছে, বিকাল চারটার মধ্যেই Inquest করে রিপোর্ট আমার কাছে জমা দিতে হবে।অন্য কোন Executive Magistrate এই মূহুর্তে দুর্গাপুরে নাই, কাজেই এই কাজটি আপনাকে ঠিক সময়ে করতে হবে। ইচ্ছে না থাকলেও মুখার্জী সাহেব Subdivisional Magistrate লাহিড়ী সাহেবকে সন্মতি জানালেন।
মুখার্জী সাহেবের ফুরফুরে মেজাজটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল।
কি ভেবেছিলেন আর কি হলো। মুখার্জী সাহেব সাধারন মানুষের পরিষেবার কাজ খুব আগ্রহ ও আনন্দ সহকারে করে থাকেন, কিন্তু অস্বাভাবিক মৃত্যুর Inquest করার কাজটা তার ভীষন অপছন্দের অথচ মাঝে মধ্যে করতেই হয়। বি,ডি,ও থাকাকালীন বহু Inquest তিনি করেছেন, এই কাজ করতে গেলে তার মন ভীষন খারাপ হয়ে যায়, এখন অবশ্য তুলনামূলক কম Inquest করতে হয়, কেননা Dy Magistrate দের রোটেশন অনুসারে এই কাজ করতে হয়, আজ মুখার্জী সাহেবের রোটেশনের নির্ধারিত দিন ছিলনা, তবুও তার ভাগ্যেই এই duty আজই জুটলো।
অগত্যা সরকারী গাড়ি সহযোগে দুর্গাপুর Subdivisional Office মর্গে গিয়ে তিনি উপস্থিত হলেন।
সেখানে কর্তব্যরত ডোমকে তিনি মৃত দেহটিকে দেখাতে বললেন।
ডোম অনেকগুলি মৃত দেহের মধ্যে পিয়ালী দাসের মৃত দেহটিকে দেখালেন।
যে police officer inquiry করেছেন তিনিও কাছাকাছি ছিলেন। তার কাছে মৃত মহিলার সব তথ্য মুখার্জী সাহেব জেনে নিলেন। মৃতের আপনজন কেহ সেখানে এসেছন কিনা তাহা জেনে নিলেন।
মৃতার দাদা ও মা মর্গের কাছে ছিলেন, মুখার্জী সাহেব দাদার কাছে কি ভাবে তার বোনের মৃত্যু হয়েছে জিজ্ঞাসা করলেন,মৃতার দাদা বিমল দাস জানালেন, ” আমার একমাত্র বোন পিয়ালীর সঙ্গে পাশের গ্রামের প্রলয়ের গত বছর বিয়ে দিয়েছি, বোনের বয়স ২২ বছর, বি,এ,পাশ। আমরা ভীষন গরীব। কিন্তু প্রলয়রা বেশ ধনী, আমার বাবা অনেক আগেই মারা গিয়েছে ,মায়ের বয়স হয়েছে।
প্রলয়দের খুবই আগ্রহ দেখে আমরা গরীব হওয়া সত্ত্বেও প্রলয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছিলাম,ভালো থাকবে এই আশায়।বিয়ের পর ভালোই কাটছিলো আমার বোনের, কিন্তু কিছু দিন পরেই প্রলয়ের আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ে। ও আমার বোনকে দিয়ে অনেক অসমাজিক কাজ করতে বাধ্য করানো শুরু করে, বোন দেখতে সুন্দর, সে তার স্বামীর অভিপ্রায় বুঝতে পারে,প্রতিবাদ করা শুরু করে,শুরু হয় বোনের উপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, মাকে সব কথা বোন জানিয়েছিল,মা বলেছিলো, চেষ্টা কর মানিয়ে নিতে, বোনও সেই ভাবে চলছিলো, কিন্তু এই ভাবে তাকে যে ওরা ফেলবে আমরা ভাবতে পারিনি স্যার”। মৃতার মাও তেমনটা মুখার্জী সাহেবকে জানালেন।
মুখার্জী সাহেব এবার পুলিশ তদন্তকারী ইনসপেকটর শ্যামল বসুর কাছে ঘটনা জানতে চাইলেন, শ্যামল বাবু জানালেন পলাশডাঙা প্রলয়ের বাড়ির বেড রুম থেকে মৃতার ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করা হয়েছে, প্রলয়ের প্রতিবেশীরা থানায় খবর দিয়েছিলো, সই অনুসারে আমি ঘটনা স্হলে উপস্থিত হই। প্রলয় ও তার মা বাবা পালিয়ে গিয়েছে। থানায় একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর কেস রজ্জু হয়েছে। আমি মৃতার সুরতাল করেছি, দেহে অনেক আঘাতের চিহ্ন আছে, যদিও ঝুলন্ত দেহ পাওয়া গিয়েছে, কিন্তু ডাক্তারের দ্বারা দেহের ময়না তদন্ত না হলে প্রকৃত কি ভাবে মৃত্যু হয়েছে জানা যাবে না”।
এই সব জানার পরে মুখার্জী সাহেব ডোমের সহায়তায় মৃতা পিয়ালীর সারা শরীর পরীক্ষা করে দখলেন, কি ভাবে একটি বাইশ তেইশ বছরের তরুনীর অসময়ে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে গেলো, শুধু সেই কথাই মাথার মধ্যে ঘুর পাক করছিলো, তিনিও মৃতার সারা শরীরে অনেক আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেলেন, সরকারী নিয়মানুযায়ী তদন্ত করে রিপোর্ট পুলিশ ও Subdivisional Magistrate সাহেবকে পাঠিয়ে দিয়ে মুখার্জী সাহেব কোয়ার্টারে ফিরলেন।
কোয়ার্টারে এসে স্নান করে ফ্রেস হলেন, বিকেল সাড়ে চারটে বেজে গিয়েছে। মেয়ে আগেই খেয়ে নিয়েছে, মেয়ের সঙ্গে একসঙ্গে খাওয় হলোনা। যে ইলিশ মাছ ও খাশীর মাংস মুখার্জী সাহেবের প্রিয়, আজ আর ভালো লাগলোনা। খেতে হয় তাই কোন রকমে কিছু খেয়ে উঠে পড়লেন।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো, রাতের খাবার খাওয়ার পরে আরাম কেদারায় বসে পিয়ালীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর
কথা ভাবতে ভাবতে তার তন্দ্রার ঝিমুনী আসছে।
ঢুলু ঢুলু চোখে তিনি দেখলেন, তার সন্মুখে পিয়ালী এসে হাজির, পিয়ালী বলছেন, ” স্যার, আপনার সমাজ সচেতনতার অনেক বক্তব্য আমি শুনেছি,আপনারা মানুষের উন্নয়নের বহুবিধ পরিকল্পনার কথা বলেন, আপনাদের এমন কোন পরিকল্পনা নাই যেখানে নিজের স্বামী তার বিবাহিত স্ত্রীর ইজ্জত অপর পর পুরুষ কর্তৃক লাঞ্ছিত ও বিক্রিত করবেনা, পারেন না স্যার যাতে আমার মত মেয়েদের এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর রিপোর্ট তৈরী না করে মানুষের মানসিক নোংরা প্রবৃত্তির Inquest করতে, যাতে সমাজ থেকে অস্বাভাবিক মৃত্যু সংখ্যা শূন্যতে নিয়ে আসা যায়, করুন না স্যার এই ধরনের মানসিক দূষনের ইনকোয়েস্ট, এটা করলে আমার বা আমার মত মেয়েদের অস্বাভাবিক মৃত্যু হতোইনা।
মুখার্জী সাহেবের ঢুলু ঢুলু চোখ খুলে ,চোখ বিস্ফারিত হলো, তিনি পিয়ালীকে খুঁজছেন, কিন্তু সামনেতো পিয়ালী নেই, পিয়ালী কি বলে গেলো, মানসিক দূষনের ইনকোয়েস্ট। পিয়ালী জানিয়ে দিয়ে গেলো আমাদের সমাজের এক গভীর অন্ধকারের ছবি, আমরা কি এর কোন বিহিত করতে পারিনা???