কিনু গাঁয়ের বাজারে সব্জী বিক্রি করে ফিরছিল। বাড়ির সংলগ্ন দশকাঠা জমিতে সে বারো মাস কাটা ফসলের চাষ করে। আর জমি বলতে তো ওটাই।বাপ বেঁচে থাকতে লোকের জমি ঠিকে নিতো। বাপ বেটা খাটতো খুব। আর ওই করে খেয়ে পরে দু কুঠুরি পাকা ঘর তুলেছিল। গাঁয়ের সবার চোখ টাটিয়েছিল খুব। নয় শতক ভিটে। ওটা অবশ্য পূর্বপুরুষের আমলের। আর ভিটের ঈশান কোণে বটগাছ। বোশেখ মাসে গাঁয়ের কত লোক বটগাছে জল ঢালে। পুণ্যি হয়। ও গাছের বয়স কম করে দুশো বছর। কিনু মাঝে মাঝেই শিহরিত হয়। মনে ভাবে কত পূর্বপুরুষ এই গাছের ছায়া তে বসেছে। কত জীবনের স্বপ্ন দেখেছে। এমনি করেই কেটেছে যুগ। আজ ওদের উত্তরসূরী কিনু। বাজারে সব্জী বেচে। ওর বৌ কত কাজ করে। জমির আগাছা পরিস্কার করে। আজ শীতটা জাঁকিয়ে পড়েছে। যত শীত তত কপি। কী বাঁধুনি। একটা কপি বিক্রি করলে পনের টাকা। বাঁধাকপি চল্লিশ টাকা কেজি। এর সাথেই আবার পালঙ মূলোর চাষ। ভোর থেকেই এই পর্ব চলছে। শুধুই কী তাই। ওই শীতে ঠান্ডার মধ্যেও পালঙ মূলো ধুতে পুকুর ঘাটে যেতে হয়। বাবুরা কেউ কাদামাখা জিনিস কিনবে না। বাজারের ব্যাগ ভর্তি করছিল কিনু। আলো ফুটছে বটে। তবে এখনও ঝুমকো ঝুমকো অন্ধকার। ও পাড়ার সতুর মা সাতসকালে হাজির। হাঁক দিলে “অ কিনু। অনেক দিন থেকেই লাউ পালঙের চচ্চরি খেতে মন হচ্ছে। দে না বাবা”।কিনু হাঁ করে তাকিয়েছিল সতুর মায়ের দিকে। বললে “বাজারের মাল গুছিয়ে নিচ্ছি। তুমি পরে এসো। এখন বৌ গেছে শাক ধুতে। “ এর মধ্যেই চলে এল বৌ। সতুর মাকে দেখে একগাল হেসে বললে “কিছু বলছেন না কি কাকীমা”? কাকীমা সোৎসাহে বললে “আর বলিস না বৌ। কদিন থেকেই লাউ পালঙের চচ্চরি খেতে মন যাচ্ছে। এদিকে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। দেখলাম তোদের জমিতে কত আনাজপাতি। ওইজন্য বলছি”!
বৌ সতুর মাকে খুব ভালো চেনে। সেই গত ভাদ্দর মাসে যখন খুব টানাটানি তখন একবার গিয়েছিল সে। কিনু নিজে ই বলেছিল “যা না কমলি। সতুর মাকে গিয়ে বল । অভিনন্দন অসময়ে ওরা কি আর দুকেজি চাল দেবে না!” না। দেয় নি সতুর মা। উপরন্তু পাঁচকথা শুনিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল “আমার চাল কী সস্তা?চাল না থাকে আগালী খেগে যা”। আজ সতুর মা ওর কাছে এসেছে। কমলা বললে “টাকা এনেছেন তো। এখনও বউনি হয় নি কিনা”। আকাশ থেকে পড়ে সতুর মা। “একটু লাউ পালঙ দিবি তার জন্য আবার পয়সা। সত্যিই তোরা খুব চামার। “ কমলি রেগে ঝনঝন করে ওঠে। বলে গতর টা মাগনা নয় কাকীমা। অনেক পরিশ্রম লাগে ফসল ফলাতে”।
স্বভাবতই নীচের এত স্পর্ধা সতুর মায়ের সহ্য হল না। ওরা হল এই চত্বরের সব থেকে অবস্থাপন্ন। কোনও দিন এরকম হয় নি। আর আজ কালকের যুগী ওই কিনুর বৌ ভাত কে বলছে অন্ন। কিছুটা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে ই বললে “থাক বৌ থাক। বাজার থেকে কিনে নেবো। “বলেই সে বটগাছের দিকে তাকিয়ে বললে “এই গাছটা ভিটেতে রেখে দিয়েছিস কী মরতে। তোদের এটুকু জ্ঞান নেই যে ওই গাছে প্রেতাত্মা আছে। গলায় দড়ি দিয়েছে তোর শ্বশুর। ওই গাছে আবার পুজো! আহা!কত যন্ত্রণা পেলে তবে অমন ভালো মানুষ অমন করে”। এই কথাগুলো কমলির বুকে গিয়ে লাগল। গলার কাছে একটা দলা পাকানো কষ্টের ধারা তার চোখ দিয়ে বইতে লাগল। সতুর মা খুব আনন্দ পেল। বললে “তোর শ্বশুর থাকলে কি আমাকে ফেরাত রে। ভালো মানুষ এর এমন মৃত্যু হল”। কিনু দিনের শুরুতেই এমন বাক্যবাণ শুনে অবাক। তার উপরে কমলির চোখে জল ওকে উতলা করে তুলল। বললে “সাত সকালে শাক চাইতে এসেছ নাকি মেজাজ গরম করতে এসেছ শুনি। আর আমার বাপের মস্ত রোগ হয়েছিল। গোটা গা হু হু করে জ্বলতো। সেই জ্বলুনি সহ্য করতে না পেরে বাপ গলাতে ফাঁস লাগালে। তুমি এখন যাও দিকি। আমাকে আমার কাজ করতে দাও। বাজারে যেতে দেরি হলে মাল বিকোবে না।” সতুর মা পাড়া মাতাতে মাতাতে বাড়ির দিকে চলে গেল। কিছুক্ষণ এর মধ্যেই কিনু বেরিয়ে গেল। আর কমলি। বিছানার উপর শুয়ে অঝোরে কেঁদে চলল। ওর কতদিন মনে হয়েছে ওই যে বটগাছ। কত আয়ু ওই গাছের। ওকে দেখে ও কী শিক্ষা পেল না শ্বশুর। কষ্ট করে লড়াই করে কী বাঁচা যায় না। আজ সতুর মা সকালবেলা বাবার কথা কৈলে। আর কমলির মনে পড়ল কত কথা। সেই যেবার ওদের গাঁয়ের কৈলাস ঘোষ অন্নপুন্নের পুজো দিলে নিজের বাড়িতে সেখানেই তো লুচির নেমন্তন্ন ছিল কমলীদের। কমলীরা ছিল সামন্ত। জাতে চাষা। কৈলাস জেঠু বলেছিল “পুজোর দিন মানুষ জনকে দেখশোন করিস “। তারপর ওখানেই বলাই ঘোষ প্রথম দেখে কমলিকে। কমলির চাঁদের মতো মুখ। ভিজে চুল থেকে স্নিগ্ধতা যেন ঝরে ঝরে পড়ছে। বলাই ঘোষ লক্ষ করছিল । বললে “এমন লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে তোমার। আমাকে দাও। যদি আমার বাঁদরটাকে মানুষ করতে পারে। এমন মেয়ে যার ঘরে যাবে তারা বাড়বাড়ন্ত হবে গো।
বলাই ঘোষের ছেলের সাথেই চার হাত এক হল। বলাই ঘোষ বললে কমলা মানে লক্ষ্মীদেবী। আমার কিনুর লক্ষ্মীলাভ হল। চারিদিকে উলুধ্বনি শঙ্খধ্বনি। লাল চেলী । টানা নথ। কনকাঞ্জলি দেবার সময় মা কেঁদে ভাসালে। বললে “স্বামীর ঘর আজ থেকে তোর ঘর। ওদের কী করে ভালো হবে সেটাই ভাববি। আষ্টেপৃষ্ঠে ভালোবাসবি।”তারপর গাড়ি চেপে কিনুর পাশে বসে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিল কমলি। কিনু বলেছিল “গঞ্জের মোড়ে স্টুডিও আছে। ফটোক তুলবো আমরা। অত কেঁদো না। ফটোক ভালো উঠবে না”। বেশ কিছুটা এগিয়ে আসার পর চালতা তলায় মিনুকে দেখেছিল। মিনু গাড়ি থামিয়ে কমলিকে জড়িয়ে বলেছিল “আমাকে ভুলে যাবি না তো সই। তোর মতো করে কেউ কখনও বোঝেনি আমাকে!” সেদিন দুই সখী খুব কেঁদেছিল। আর আজ। একলা ঘরে সবাই যেন ভিড় করে আসছে মনে। ওই মিনুকে সবাই বলতো স্বৈরিণী। ওর নাকি পুরুষ মানুষের উপর খুব লোভ। সবাই বলতো। সেই কোন কালে একটা চাকরি ওলা বাবু এসেছিল। ওরা বলতে ইলেটিরি বাবু। গাঁয়ের ভটচাজ বাড়ির সদরঘরে ভাড়া এসেছিল। মিনু একপাল ছাগল নিয়েই ব্যস্ত থাকত। ওর উদ্ধত যৌবন উঁকি দিত। আর ওর বর ছিল বাসের টিকিট বাবু। বরের খাবার তৈরি করে ওর মন চলে যেতে চাইত ইলেটিরি বাবুর কাছে। বরের সন্দেহ হত। একদিন হাতেনাতে ধরলে দুজনকে। ইলেটিরি বাবু ওকে গান শুনিয়ে ছিল। ও গাইত “আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে চাও কি? হায় বুঝি তার নাগাল পেলে না”। কেউ কখনও পায় নি। ওর বর ইলেটিরি বাবুর সাথে ওকে গান করতে দেখে ঠ্যাঙানি দিলে। হাতে দিলে আগুনের ছ্যাঁকা। গোটা গাঁ ঢি ঢি পড়ে গেল “মিনু স্বৈরিণী। মিনু দ্বিচারিণী।” শুধুই কমলীকে মিনু বলেছিল “আমার বর নপুঙসক। আমি কখনও মা হতে পারব না”। কমলি বলেছিল “এমন বর তুই ছেড়ে দে মিনু। “মিনু মৃদু হেসেছিল। বলেছিল “আমি তবু ভালোবাসি”। কমলির মনে হয় এই নারীজীবন ওই বটগাছ টার মতোই। শুধুই ভালোবাসার জন্য জন্মায়। আশ্রয় দেয়। ছায়া দেয়।” কমলি হঠাৎই চমকে উঠল। কত বেলা গড়িয়ে গেল কে জানে। ওর পাঁচ বছরের ছেলের গায়ে ওর চোখের জল পড়েছে। এই নোনাজল বড় বিস্বাদের। এখনই কিনু চলে আসবে। বাসি ঘরে ঝাঁটপালা পড়ে নি। ছেলেটা ঘুম থেকে উঠেই খাবার চাইবে। কী সব ভাবনা যে গ্রাস করে।
বাসি কাজ করে স্নান করল কমলী। পুকুরে তিন ডুব দিয়ে ঘটি করে জল আনল সে। বটগাছের গোড়াতে ঢেলে দিলে জল।এই বটগাছের তলায় বসলে গরমের দিনে কত আরাম। শ্বশুর যখন বেঁচেছিল তখন শ্রাবণের মৌনি অমাবস্যাতে শাউরি বৌ গাছ পুজো করেছিল।
তখন তো শ্বশুর কে মারণরোগে ধরেছে। শাউরি কত কেঁদেছিল। শ্বশুর তখনও বলেছিল “কাঁদিস নে কিনুর মা। আমি সহজে মরব না। ” আবার সেই মানুষ মরে গেল। পাড়া প্রতিবেশীদের কত জিজ্ঞেস। কেন মরল! কত লজ্জার মধ্যেই দিন কাটাতে হয়েছে ওদের। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে। যতদিন বাবা বেঁচেছিল কমলীর কোনও চিন্তাই ছিল না। কত কী জানত । আর অন্য মানুষ মান্যি করতো। সেই যেবার খোকার জন্মের সময ডাক্তার যখন বললে”রক্ত কমে গেছে তখন কোথা থেকে বাবা ঠিক কুলেখাড়া শাক আনলে। থেঁতো করে রস বার করে বলত “নে কমলি খেয়ে নে। এ একেবারে অব্যর্থ ওষুধ “।
এসব আজকাল খুব মনে পড়ে। বাবা ছিল আর এক বটগাছ। প্রখর রোদে প্রচন্ড কষ্টে যে শুধুই সংসারের মানুষ গুলোর কথা ভেবে গেছে। আজকাল যখন বটগাছের পুজো করে কমলী তখন গাছের গোড়ায় মাথা ঠেকিয়ে অঝোরে কাঁদে।
মনে মনে বিশ্বাস করে বাবা হল ভগমান। সতুর মা বলেছিল প্রেত আছে গাছে। “কাঁদিস না বৌ” বলে একটা শীর্ণ হাত মাথায় ঠেকে। কমলী তখন আরও ডাক ছেড়ে কাঁদে। শাউরি বলে “বাপ নেই। আমি তো আছি। তোদের মুখ চেয়ে বেঁচে আছি”। বলেই শাউরি কমলির হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যায়। বকুনি দেয়। ভিজে কাপড়ে থাকলে তোর জ্বর আসবে দেখিস “।
কমলী তাড়াতাড়ি কাপড় ছাড়ে। ভাঙা চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়াতে থাকে। তারপর ফিক করে হেসে ওঠে। শাউরি বলে “এই তো কেঁদে ভাসাচ্ছিলি। এখন আবার হাসি।
কমলির আসলে মনে পড়ে গেছে সেই ইলেটিরি বাবুকে। ওকে চুলের মুঠি ধরে মিনুর নপুঙসক বর গদাধর মারতে গিয়েছিল। কে জানত লোকটার ফরস চুল। মিনুর বরের হাতে উঠে এল চুলের গোছা। কমলী আরও জোরে হাসতে লাগল। অনেক দিন পর কমলী হাসছে। মায়ের হাসি দেখে ছেলেটা ও হেসে কুটি কুটি। শাউরি হাসে আর বলতে থাকে “সকালে হাসি সব্বোনাশী”।
কিনু ফিরল। সবাই হাসে দেখে ওর আনন্দ হল। সকালে সতুর মা যা কাণ্ড করলে। ও ভেবেছিল কপালে হরিমটর আছে। শাউরি বললে “ভাঙা চিরুণ দিয়ে বৌ মাথা আঁচড়াচ্ছে। তুই দেখতে পাস না কিনু”! আজ বাড়ির মধ্যে যেন উৎসবের আনন্দ। কমলির হাসিমুখ যেন নতুন রূপে মাতিয়েছিল বাড়িটাকে। শাউরি বটগাছের পাতা দিয়ে ওষুধ করে। দুটো লোকের মেহ রোগ হয়েছে। এই ওষুধ নাকি একেবারেই অব্যর্থ। তারা আবার জাতে মুসলমান। তিন ক্রোশ দূরে দুর্গাপুর যাবার রাস্তার ধারে তাদের হোটেল। শাউরির উপরে তারা খুব খুশি। কিনু বাজার থেকে গরম সিঙারা এনেছে। শাউরি তা থেকেই ওদের দিলে। ওরা একটা মোরগ এনেছে। বললে “বটের পাতার ওষুধ একেবারেই অব্যর্থ। আমরা ভালো আছি”। শাউরি বলে “সংসারের হাল খারাপ। ওই কাটা ফসলের উপরে এতগুলো পেট। বড় কষ্ট আমাদের “। লোকগুলো কী সব কথা বলে অনেক ক্ষণ। রান্নার জোগাড় করে কমলি। বটগাছের পাতা ঝাঁট দিয়ে বস্তার মধ্যে রেখেছে শাউরি। তাই জ্বেলে চা বানানোর সময়ই হাঁচি আসে। চোখ মুখ লাল হয়ে যায়। কিনু চা সিঙারা খেয়ে মোরগ ছাড়াতে বসে। একটা আঙট কলাপাতা কেটে নেয়। কতদিন পর বাড়িতে মাংস হচ্ছে। চাল জোটে না তো মাংস!শাউরির জন্য এটা সম্ভব হল। লোকদুটো চলে গেলে উনান শালে এল শাউরি। কমলির কপালে হাত দিলে। বলে উঠলে”যা ভেবেছি ঠিক তাই। এ তো জ্বর এয়েচে। আমি রান্না করছি। ও কিনু। বৌমার জ্বর। শিগগির করে ওষুধ আন বাপ”।
ওষুধ খেয়ে কাঁথা চাপা দেয় কমলী। জ্বর এর ঘোরে কী সব বলতে থাকে। আর বটগাছের কথা বলে। মানুষ যদি গাছের মোতো হোতো। যেমন করে শ্বশুর হয়েছিল। কত ছায়া। কত মায়া। শাউরির ডাকে স্বপ্ন ভাঙে। জ্বর ছেড়েছে। সবাই কে খেতে দিয়েছে শাউরি। মাংসের গরম ঝোল কী অপূর্ব। সবার মুখ আজ তৃপ্তিতে ভরা। শাউরি বললে “কাল থেকে নতুন কাজ পেয়েছি। রুটি আর মাংস তৈরির কাজ। দুর্গাপুর যাবার রাস্তার ধারে হোটেলে। মাসে সাত হাজার দেবে”। এত বড় একটা খবরে কিনু উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। আর কমলি শাউরির দিকে তাকিয়ে ভাবে “মা আবার বটগাছ হয়ে গেল কী করে!”