কাঞ্চন বেড়ি
সলিল চক্রবর্ত্তী
বাস্তুতন্ত্র বিশারদ দেবব্রত গুহর সাত বছরের নাতি তোজো। প্রতিদিন রাত নটা পর্যন্ত পড়াশোনা করে রাতের খাবার খেয়ে দাদুর কাছে আসে। দেবব্রত বাবু নাতিকে শিখিয়েছেন, রাতে খেয়েই শুতে নেই। তিনি নাতিকে মোবাইল ফোন দেখার অভ্যাস না হওয়ার জন্য প্রতিদিন শোয়ার আগে একটা করে গল্প শোনান।
“দাদু আজ কিসের গল্প বলবে?” দাদু নাতির আবদার পুরন করার জন্যে বললেন-” বল কিসের গল্প শুনবে?”
—সাপের।
—- সাপের? বেশ তবে শোন।
ছোট্ট সাপের ছানা, কোন ভাবে মায়ের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায়। জঙ্গলের এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে সে মাকে খুঁজতে থাকে। দুর থেকে একটা বাজপাখির নজর পড়ে সাপটির উপর।
জঙ্গলের ভিতর দিয়ে একটা পায়েচলা পথ আছে। সেই পথ ধরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ যজমানের বাড়িতে পূজা কর্ম সেরে ঘরে ফিরছিলেন।
এদিকে বাজপাখি শিকারের উদ্দেশ্যে সাপের ছানার কাছাকাছি এসে ডানা ঝাপটে নামল। ছোট্ট সাপের ছানাটি আত্মরক্ষার তাগিদে কাছাকাছি কোন গর্ত না পেয়ে পাতা লতার মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠল।
ব্রাহ্মণ কিছুটা দূর থেকে বাজ পাখিটাকে ছোঁ মেরে নামতে দেখে কিছু একটা অনুমান করে সত্তর বাজপাখির কাছে চলে এলেন। ভয় পেয়ে বাজপাখি উড়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী একটা গাছের ডালে বসে সাপের ছানাটির উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছিল। থরথর করে কাঁপতে থাকা সাপের ছানাটি ব্রাহ্মণের নজরে পড়ল। দয়ালু ব্রাহ্মণ সগতোক্তি করলেন, “আহারে! সদ্য ডিম ফোটা সাপের ছানাটি পৃথিবীটাকে দেখার আগেই বাজ পাখির উদরস্থ হবে! একে সরিয়ে দিয়ে বরং বাজ পাখির হাত থেকে বাচানোই শ্রেয়।” এই ভেবে ব্রাহ্মণ সাপের ছানাটাকে তুলে নিয়ে কিছুটা এসে মাটিতে নামাতে গিয়ে দেখেন পার্শ্ববর্তী গাছের ডালে উড়ে এসে বসল সেই বাজ পাখিটা। কথায় আছে বাজ পাখির দৃষ্টি। ব্রাহ্মণ সাপের ছানা টিকে পুনরায় মাটি থেকে তুলে নিলেন। দয়া পরবশত আর জঙ্গলে না ছেড়ে দিয়ে স্বগৃহে নিয়ে এলেন।
গ্রামের শেষে ব্রাহ্মণের ভিটা বাড়ি। গরীব পরিবার পূজা অর্চনা করেই কোন রকমে দিন গুজরান করেন। দুই ছেলে, তাদের স্ত্রী সন্তান নিয়ে ব্রাহ্মণ ও তাঁর স্ত্রী সুখ না থাকলেও শান্তিতে বসবাস করেন। বাড়িতে মা মনসার মূর্তি স্থাপন করা আছে। সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ পুজোপাট নিয়েই থাকেন।
বাড়ির সকলের অলক্ষ্যে সাপের ছানাটিকে মা মনসার কাছে ছেড়ে দিয়ে বললেন-” যা এখানে থাক। মায়ের কাছে অনেক মাটির সাপ আছে, তাদের মতো করে তুইও থাক।” ঘটনাটা সহধর্মিণীর চোখ এড়াল না।
রাতে বিছানায় নিদ্রা যাওয়ার আগে স্ত্রী ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞেস করলেন-” তুমি যে বিষধর সাপের ছানাটাকে ঘরে তুললে, বুঝতে পারছ বড় হলে কি পরিনতি হবে?” ব্রাহ্মণ ধরা পড়ে গেছে বুঝে স্ত্রীকে না লুকিয়ে সব ঘটনা বলে বললেন-” দেখ, ও জংলী জীব, সময় হলে ও জঙ্গলে চলে যবে।”
ব্রাহ্মণ কুলদেবতা মা মনসার পূজা প্রায় সমাপন করে এনেছেন, এমন সময় তাঁর নজরে পড়ল, মনসা মূর্তির সামনে পড়ে থাকা বাসি ফুলগুলোর মধ্যে নড়াচড়া করছে সাপের ছানাটি। ব্রাহ্মণকে দেখে সাপের ছানাটি এগিয়ে এসে ব্রাহ্মণের শরীরের সাথে নিজের শরীর লাগিয়ে চুপটি করে শুয়ে থাকল। ব্রাহ্মণ বুঝল এই অল্প সময়ে সাপের ছানাটি তাকে খুব চিনে গেছে। তাঁরও ছানাটির উপর কেমন যেন মায়া পড়ে গেল। মনে ভাবলেন, নিশ্চই বেচারার কিছুই খাওয়া হয়নি। এটা ভেবে একটা পাকা কলা থেকে ছোট্ট একটা টুকরো কেটে নিয়ে ছানাটির সামনে রাখলেন। সাপ যেমন ভাবে ব্যাঙ শিকার করে ঠিক তেমনি ভাবে ছানাটি পাকা কলার টুকরোটা গিলে ফেলল।
মাস খানিক কেটে গেল। সাপের ছানাটি কিছুটা বড় হওয়ায় এটি যে কেউটে সাপের ছানা সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল। কিন্তু আচরনে হেলেও লজ্জা পাবে। হবে না! ব্রাহ্মণ তো পাকা কলা খাইয়ে তাকে নিরামিষাশী করে রেখেছে। সাপের সাথে ব্রাহ্মণের সম্পর্ক কালক্রমে মধুর থেকে মধুরতর হয়ে উঠল। কেউটে সাপের ভাষা ব্রাহ্মণ বোঝে, ব্রাহ্মণের ভাষা কেউটে সাপ বোঝে। ব্রাহ্মণের অবসর সময়ে চলে দুই ভিন্ন চরিত্রের জীবের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান। ব্রাহ্মণ সাপটিকে বড় ভাল বাসে, আবার ভয়ও পায়, কারন প্রকৃতই সে তো একটা বিষধর প্রাণী। ফলে ব্রাহ্মণ সর্বদাই সচেষ্ট থাকে সাপটি যেন জঙ্গলে গিয়ে নিজের গোষ্ঠির সাথে না মিশতে পারে। সাপের মস্তিষ্কে একটা মন্ত্র প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন যে সে জঙ্গলে গেলে বাজপাখি তাকে মেরে ফেলবে।
এদিকে মনসা মূর্তির কছে বিষধর জ্যান্ত সাপের আনাগোনা,অথচ বিপজ্জনক নয়। বিষধর কেউটে পুরোহিতের গা ঘেঁষে ঘোরাঘুরি করছে, লোকজন দেখে ফনাও তুলছেনা, তেড়েও যাচ্ছেনা। মানুষ স্বচক্ষে দেখছে দুধ কলা খাচ্ছে। এ-তো মা মনসা স্বয়ং আবির্ভূত হয়েছেন। ঘটনাটি কানাকানি হতে জানাজানি তারপর পায় প্রচার। ফলে ব্রাহ্মণের কপাল খুলে যায়। প্রত্যুষ থেকে পূজা অর্ঘ্য নিয়ে ভক্তের লাইন। পালা করে পূজা চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। ব্রাহ্মণ পরিবার নাওয়াখাওয়ার সময় পর্যন্ত পায় না। মা মনসার কৃপা অথবা কেউটে সাপের কল্যানে, যেটাতেই হোক না কেন ব্রাহ্মণের দুরাবস্থা ঘুচে গেল। অর্থনৈতিক ভাবে স্বচ্ছল ব্রাহ্মণ পুত্র, কন্যা, নাতি,নাতনিদের নিয়ে সুখে দিন যাপন করতে থাকলেন। কথায় আছে সুখ ক্ষণস্থায়ী। ব্রাহ্মণের ভাগ্যেও সেটাই ঘটল।
সাপ, মন্দিরে আসা হাজার হাজার মানুষ দেখে ভাবল- “ব্রাহ্মণের মতো যদি এত মানুষ থাকে,তবে আমার মত নিশ্চই অনেক সাপ আছে! কিন্তু তারা কোথায়? আমার জন্ম তো নিশ্চই কোনো সাপ পরিবারে হয়েছে। তবে আমারও মা বাবা নিশ্চই আছে। ওই যে খাঁচায় বন্দী টিয়াপাখি, ওর মতো কত টিয়াপাখি তো স্বাধীন ভাবে আকাশে উড়ে বেড়ায়। কিন্তু আমি কেন আমার মতো অন্য সাপ দেখতে পাই না!! এই সব সাত পাঁচ প্রশ্ন সাপের মাথায় আসায় তার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল, সে বিষন্ন মনে গোল পাকিয়ে নিজস্ব ভঙ্গিমায় শুয়ে থাকল।
খাঁচায় বন্দী টিয়াপাখিকে দানা-পানি দেওয়ার সময় ব্রাহ্মণের নজরে পড়ল, সাপ নিজের শরীরের ভিতর মাথা গুজে চুপ করে শুয়ে আছে। তাকে এমন অবস্থায় দেখে বললেন-” কিহে সর্পরাজ তোমার আবার কি হল! মন মরা কেন?”
সাপ মনের কথা এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে বলল-” শরীরটা ভাল নেই, মাথাটা ভার, টনটন করছে।”
ব্রাহ্মণ ভাবল, প্রাপ্ত বয়স্ক সাপ, বিষে হয়ত পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, এটা হয়ত তারই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। কিন্তু ওর শরীরে যে মৃত্যুঘাতি বিষ আছে, সেটা ওকে জানতে দেওয়া যাবে না। এটা ভেবে ব্রাহ্মণ বললেন-” তুই এক কাজ কর, যখন দেখবি মাথাটা ভার হয়ে টনটন করছে তখনি গোয়াল ঘরের পিছনে কলা গাছের ঝাড়ের কাছে গিয়ে ছোট সরু একটা কলা গাছে ছোবল মারবি। এমন ভাবে ছোবল মারবি যেন তোর বড় দাঁত দুটো কলা গাছে বসে যায়। ব্যাস তারপর দেখবি তোর মাথা ভার কমে গেছে, টনটনও করছে না।”
জৈষ্ঠ্যমাসের তিব্র গরমে সাপটার মনে কেমন যেন হতে থাকল। মা মনসার হাতে ধরা মাটির সাপ গুলোকে শুধু দেখতে ইচ্ছে করছে। মনে মনে ভাবছে -” ইস্, সাপ গুলোর যদি আমার মতো প্রাণ থাকত!!” অকস্মাৎ তার মনে প্রশ্ন জাগল, ব্রাহ্মণ আমাকে জঙ্গলে যেতে নিষেধ করেছে কেন? সেতো এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। শুধু কি বাজপাখির জন্যে!! নাকি এর পিছনে ব্রাহ্মণের অন্য কোনো অভিসন্ধি আছে।
সপ্তাহে একদিন মনসা মন্দির বন্ধ থাকে। নিয়ম অনুযায়ী মন্দির বন্ধ, ব্রাহ্মণ নিকটবর্তী এক আত্মীয়ের বাড়িতে গেছেন। এই সুযোগে সাপটি ব্রাহ্মণের নিষেধ সত্ত্বেও জঙ্গলে চলে গেল। এই প্রথম সে নির্দেশিত গণ্ডীর বাইরে বার হল।
ছয় ফুটের নধর সাপটা হিলহিল করে জঙ্গলের মধ্যে খানিকটা ছুটল। তারপর একটু ছোটা থামিয়ে মাথা তুলে এদিক ওদিক চেয়ে দেখে নিল। এমন জোরে আগে সে কখনো ছোটেনি। মনটা বেশ ভাল লাগছে। কয়েকবার মাথা তুলে চেরা হিলহিলে জিভটা বার করে এলাকাটা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকল। হঠাৎ সাপটা একটা গন্ধ অনুভব করল, যে গন্ধটা তাকে ভীষণ ভাবে আকর্ষণ করছে। অথচ গন্ধটা তার অচেনা। যাইহোক, সে গন্ধের উৎসের দিকে ধীরেধীরে এগুতে থাকল। আরো কিছুটা যাওয়ার পর সে থমকে দাঁড়াল। দেখতে পেল তার মতোই বড়সড় একটা সাপিনী,ছয় সাতটা ছোটো বাচ্চা নিয়ে লালন পালন করেছ। যেটা মা মনসার হাতে ধরা সাপের থেকে আরো সুন্দর, জীবন্তও বটে। গৃহপালিত সাপটি অবাক হয়ে বন্য সাপিনীটিকে দেখতে থাকল। এইভাবে কিছুক্ষণ কাটতেই বন্য সাপিনীটি বলে উঠল আরেকটি সাপকে-” তুমি কি মানুষের গন্ধ পাচ্ছ?” সাপিনীর কথা শুনে পাশে থাকা সাপটি অতি শীঘ্র সতর্ক হয়ে, এদিক ওদিক চেয়ে বলল-” তা একটু পাচ্ছি, তবে মানুষ মনে হয় না। এরি মধ্যে সাপিনীর নজর পড়ল গৃহপালিত সাপের দিকে। সাপিনী সাপকে ডেকে দেখাল, বন্যসাপ দেখতে পেয়ে গৃহপালিত সাপকে ডাকল। গৃহপালিত সাপ এগিয়ে আসতেই মানুষের গায়ের গন্ধ তিব্র হল। বন্য সাপ নিশ্চিত হয়ে গৃহপালিত সাপের কাছে জানতে চাইল কেন তার গায়ে মানুষের গন্ধ! গৃহপালিত সাপ তার অতীত থেকে বর্তমান বর্ণনা করে বলল-” ওই ব্রাহ্মণ সেদিন যদি বাজপাখির হাত থেকে আমাকে না বাঁচাত তবে আমি তো সেইদিনই মারা যেতাম।” বন্য সাপ হেঁসে বলল-” তুমি যে বেঁচে আছ, এটা তেমাকে কে বলল?” গৃহপালিত সাপ অবাক হয়ে বলল-” তার মানে?”
— তুমি তো সেইদিনই মারা গেছ যে দিন তুমি ব্রাহ্মণের হাতে পড়েছিলে। গৃহপালিত সাপ কথাটা না বুঝতে পেরে ফ্যালফ্যাল করে বন্য সাপের দিকে চেয়ে থাকল। তখন বন্য সাপ বলল-” বুঝতে পারলে না তো? তোমার জন্ম সর্পকুলে, মনুষ্যকুলে নয়। তুমি বন্য প্রাণী, জন্মের সাথে সাথেই তোমার জীবন সংগ্রাম শুরু হবে চলবে আমৃত্যু। তোমাকে শিকার করে খাদ্য সংগ্রহ করতে হবে। ব্যাঙ, ইঁদুর, টিকটিকি,আরশোলা প্রভৃতি তোমার খাদ্য তালিকায় পড়ে, পাকা কলা নয়। স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়াবে জোড় বাঁধবে, ডিম পাড়বে, ডিম ফুটে ছানা বার হবে, তাদের নিয়ে সুখে ঘর সংসার করবে, এটাই তো তোমার স্বাধীন জীবন। ওই পুরহিত তোমার জীবনটাকে তোমার কাছে লুকিয়ে একটা মুর্তির কাছে রেখে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে বড়লোক হয়েছে। তুমি বন্য প্রাণী, বনেই তোমার জীবন কাটবে। জীবন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকাই তোমার জীবন। এই জঙ্গলে প্রতিটি প্রাণী স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়ায়। কেউ আমাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে না। তুমিতো ব্রাহ্মণের নির্দেশে বেঁচে মরে আছ।”
গৃহপালিত সাপ বিষন্ন মনে নিজেকে নানা রকম প্রশ্ন করতে করতে ব্রাহ্মণগৃহে ফিরল। তার মনে এই বিশ্বাস জন্মাল যে বন্য সাপ যে কথাগুলো বলেছে তা সর্বৈব সত্য। সাপ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীদেরও সে স্বাধীনভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখল। বুঝল ব্রাহ্মণ তাকে এতদিন চোখে ঠুলি পরিয়ে রেখেছে।
এদিকে ব্রাহ্মণ বাড়ি ফিরে সাপকে না দেখতে পেয়ে মন্দিরের চারপাশে খোঁজাখুঁজি করতে থাকলেন। সেখানেও না দেখতে পেয়ে একটা অঘটনের আভাস পেলেন। সুখের দিন কি তাহলে শেষ হয়ে গেল! জ্যান্ত সাপের কল্যানে আর মা মনসার কৃপায় অর্থ আসা এবার কি তবে বন্ধ হয়ে যাবে!! ব্রাহ্মণ দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন।
এরি মধ্যে সাপকে ফিরে আসতে দেখে রাগান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন-” কোথায় গিয়েছিলি? তোকে না বলেছিলাম বাড়ির বাইরে যাবিনা।” একে বিষধর কেউটে, তারউপর বন্য সাপের মগজ ধোলাইতে তারও মাথা ছিল বিগড়ে। সে-ও চার হাত ফনা তুলে ফোঁস করে বলে উঠল-” একদম চোটপাট করবে না। আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি, এবং নিজের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আমার নিজের স্বাধীনতা বলতে কিছু থাকতে নেই?” সাপের এ-হেন আচরণ দেখে ব্রাহ্মণের বুঝতে বাকি রইল না যে, তিনি যে ভয় পেয়ে কেউটে সাপকে জঙ্গলে যেতে বারন করেছিলেন, আজ জঙ্গলে গিয়ে নিশ্চই সেটাই ঘটেছে। এত ভেবেও বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ নিজেকে সংযত করতে পারলেন না। চিৎকার করে বলে উঠলেন-” বেইমান, দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছি। সে দিন যদি বাজপাখির হাত থেকে না বাঁচাতাম কোথায় থাকত তোর এত ফোঁসফোঁসানি? ” সাপ ফনা নামিয়ে বলল-” ঠিক বলেছ ঠাকুর মশায়, সেদিন আমাকে বাঁচানো তোমার উচিত হয়নি। বাজপাখির উদরস্থ হয়ে না হয় মরেই যেতাম। জীবন সংগ্রামে না হয় হেরেই যেতাম, মায়ের ছটা সাতটা সন্তানের সব তো বাঁচেনা, শেষ পর্যন্ত একটা বা দুটো থাকে। কিন্তু ঠাকুর মশায় আমি কি সত্যিই বেঁচে আছি, তুমি তোমার পরিবার যেমন ভাবে আছো!! কয়েকটা মাটির তৈরি সাপের সাথে ব্যাঙ, ইঁদুর না খেয়ে পাকা কলা খেয়ে জীবন কাটাচ্ছি, একটা সাপের জীবন চক্রের কোনো কিছুই ভোগ করতে না পারা, এটাকে তুমি বেঁচে থাকা বলবে? ওই যে খাঁচায় টিয়া পাখিটাকে তুমি বাঁচিয়ে রেখেছ, দুই বেলা দানা পানি দিয়ে। যাকে সৃষ্টিকর্তা দুটো ডানা দিয়েছে উন্মুক্ত গগনে স্বাধীন ভাবে উড়ে বেড়াবার জন্যে, অথচ সে কখনো ডানার ব্যবহারটাই জানল না। টিয়া পাখিটির একটা গোষ্ঠী আছে, আছে তার জীবন চক্র, কি পেয়েছে সে? একে তুমি বেঁচে থাকা বলবে?? ভেবে দেখত ঠাকুর মশাই, তোমার ওই অন্ধের যষ্টি নাতিটাকে কেউ যদি গৃহবন্দী করে সমস্ত মনুষ্য সমাজ থেকে আলাদা করে দেয়, সেটাকে কি বেঁচে থাকা বলে??”
সাপের যথার্থ বাক্যবাণে ব্রাহ্মণ ভেঙে পড়লেন। সাপকে চুপ করতে বলে ধীরে ধীরে টিয়ার খাঁচার কাছে গিয়ে খাঁচার দরজাটা খুলে দিলেন। টিয়াপাখি টা খাঁচার বাইরে বেরিয়ে ঘুরঘুর করতে থাকল। ব্রাহ্মণ আবার সাপের কাছে এসে হাত জোড় করে বললেন-” আমাকে ক্ষমা করে দে। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে তোদের জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছি। নুন আনতে পান্তা ফুরোনো পরিবারকে তুই অনেক দিয়েছিস। এবার তুই জঙ্গলে ফিরে যা।”
কেউটে সাপ মাথা নত করে বলল-” আমার এই ঔদ্ধত্যের জন্য তুমিও আমাকে ক্ষমা কোরো, এই শরীরে প্রাণ টা এখনো আছে তোমার জন্যে। আমি আমার গোষ্ঠীতে ফিরে যাচ্ছি, তুমি ভাল থেক।” এই বলে গৃহপালিত কেউটে ধীরে ধীরে জঙ্গলে চলে গেল।
দাদু নাতিকে গল্পটা শেষ করে বললেন-” দাদুভাই এই গল্প থেকে আমরা কি শিখলাম— এই পৃথিবীতে মানুষের যেমন স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে, ঠিক তেমনি প্রতিটি প্রাণীর-ই একই ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। আমরা জোর করে তা কেড়ে নিতে পারিনা। মানুষ প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বন্য প্রাণী বা মানুষের কাছাকাছি থাকা প্রাণীদের বন্দী করে রাখে। আমরা তাদের উপর সাধ্যমতো যত্নশীল হলে-ও অন্যায় করি। সেইজন্যে ঘরের মধ্যে কুকুর, বিড়াল,পাখি,মাছ পুষতে নেই। ওদের মতো করে ওদের স্বাধীন ভাবে বাঁচতে দেওয়া উচিত। আবার বেদুইনরা যে সাপ,বাঁদর,নেউল, ভল্লুক প্রভৃতি আটকে রেখে খেলা দেখিয়ে অর্থ উপার্জন করে ওটাও অন্যায়। সরকার এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে নানান পদক্ষেপ করছে, সর্বোপরি আমাদেরও সচেতন হতে হবে। “
ব্যস,এই পর্যন্ত থাক দাদুভাই, তোমার শুতে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। যাও মায়ের কাছে যাও।
++++++++++++