পীরিতি গরল ভেল
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
————————
ইহা যে কি তাহা ইতিপূর্বে জানিবার অবকাশ হয় নাই। যেদিন ইহা জানিলাম,সে দিন হইতে লক্ষ্মীছাড়া হইলাম।
আষাঢ়মাসের প্রথম দিবস। কালেজে অধ্যাপক মহোদয় বৈষ্ণব পদাবলি পড়াইতেছিলেন। তখন বয়ঃসন্ধিক্ষণ তায় মদনবাণ বিরহিত নিতান্ত সাধারণ আমি, তৎকালে অকস্মাৎ কানের ভিতর মরমে পশিল –
” কে বা বাঁশী বজায় কালিন্দীকূলে / আকূল শরীর মোর বেআকূল মন/ বাঁশীর শবদেঁ মোর আওলাইলো রন্ধন ” – নায়িকার রন্ধনে বাধা পড়িল কিনা জানা নাই, আমার পড়াশুনা মাথায় উঠিল।
ইতিপূর্বে অনেক ফুল ফুটিতে দেখিয়াছি। এখন তাহাদের দেখিলে মন উন্মনা হইয়া যায়। জ্যোৎস্নাপুলকিত নিশীথ রাত্রি এতদিন নিরুপদ্রবে নিদ্রাদেবীর চরণে আহুতি দিয়া নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাইতাম, এখন তাহাও বন্ধ হইল। কিসের আকূতি সমগ্র সত্ত্বাকে আচ্ছন্ন করিল তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। গৃহে আমার সামান্য কৃশকায় দেহলক্ষণ সকলের চিন্তার কারণ হইয়া উঠিল।
…..
এতদিন স্ত্রী জাতি সম্পর্কে একধরণের দূরত্ব মনে বহন করিতাম। ভাবিতাম বিধাতা তাহাদের দূর্বল দেহ দিয়াছেন যেমন, তেমন দিয়াছেন ভ্রূ কটাক্ষ আর অকারণ দেহবল্লরীর আভূষণ যাহা পুরুষদিগের পতনে একমাত্র সহায়। কিন্তু বৈষ্ণবকবির আকূতি যখন হৃদয়ে গুঞ্জরিত হইল সেই ক্ষণ হইতে বর্ষার কালিমালিপ্ত মেঘবর্ষণে দয়িতের প্রতি নিবিড় সমর্পণের ভাব ছন্দিত হইল। ফলতঃ সোৎসাহে কাব্য সুকুমারী আপনার নামে একখানি তালুক খরিদ করিয়া লইলেন বোধকরি, তাহাতেই খাতায় কবিতার বন্যা নামিল !
এমনাবস্হায় তাহাকে খুব মনে পড়িতে লাগিল। তাহারা বেশীদিন এ পল্লীতে বেশীদিন বাস করে নাই। আলাপও পাকা হয় নাই, তথাপি এই সংকটময় মুহূর্তযাপনে কেবলই তার আঁখিদ্বয় আর ওষ্ঠের ভঙ্গিমা স্মরণে উদিত হইতে লাগিল। রাত্রিকালে স্বপ্নেও তার অবাধ যাতায়াত শুরু হইলে আমি মরিলাম অবশেষে।
…
ইহার পর নানা ঘটনায় কিছুকাল কাটিয়াছে। একজামিনের বন্দীদশা ঘুচিয়া সবেমাত্র স্বাধীন হইয়াছি এমতাবস্থায় একদিন দেখিলাম পশ্চিম হইতে ছোটপিসিমা পিত্রালয়ে আসিয়াছেন তাঁহার একমাত্র পুত্রের বিবাহোপলক্ষে আপন পিতৃকূলকে আমণ্ত্রণ জানাইতে।
শুনিয়াছি তাঁহারা নাকি মস্ত ধনী। তাই গড়মন্দারপুরস্থিত রায়বাহাদুরের একমাত্র পুত্রের বিবাহে আয়োজন আড়ম্বরের ফাঁকি নাই। দুপুরে ছাতে বসিয়া সুপারি কুটিতে কুটিতে তিনি অঞ্চলবাস হইতে একখানি সাদাকালো ফোটোগ্রাফ বার করিয়া আমাকে দয়া করিয়া দেখিতে দিলেন।
হায়! সেই ছবি দেখিয়া পুলকিত হইবার ভান করিয়া নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিলাম।
যাহাকে দিবারাত্র তিলোত্তমার ন্যায় স্বহস্তে গড়িয়া তুলিয়াছি কল্পনায় আজ তাহারই ফোটোগ্রাফ হাতে আসিয়া বক্ষে শেল নিক্ষেপ করিয়া গেল।
যাহা অবচেতনে একবার দূমূর্ল্য হইয়া যায় তাহা হাতের নিকট আসিলে কেমন ভাবের ঘরে চুরি হইয়া যায়। বুঝিলাম আজভাবী বউঠাকুরানীর মধ্যে স্বপনচারিণী খুঁজিতে যাওয়া বিড়ম্বনাই বটে।
….
যথাকালে ভ্রাতাটির শুভবিবাহ সুসম্পন্ন হইয়া গেল। নববধূর পদার্পণে সে ঘরে সহস্র মঙ্গলদীপের আলোকচ্ছটায় সকল অন্ধকারের অবসান হইল তো বটেই, এমনকি শ্বশুড়কূলে আসিয়া পড়িবামাত্র তাহার একমাত্র দেবরটির সহিত সখ্যতায়ও কম পড়িল না।
চুপ করিয়া দেখিতে লাগিলাম যে আমার কাব্যলক্ষ্মী ক্রমে চিরঅন্তর্হিতা হইবার পথে চলিতেছেন।
….
—ooXXoo—
পিরীতি গরল ভেল ভালো লাগলো।